ঐতিহাসিককাল থেকেই এদেশের আদিবাসীরা বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছে। পাহাড়-সমতল সবখানেতেই এ বঞ্চনার শেকড় গেড়ে আছে।
বিশ্ব আদিবাসী দিবসের আগে নিয়মিতই এ ধরনের সরকারি পরিপত্র পাঠানো হয় গণমাধ্যমে
১৯৮২ সালে সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আদিবাসী দিবস’ নিয়ে কাজ শুরু করেছিল জাতিসংঘ। মূল উদ্দেশ্য ছিল আদিবাসীদের মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রসার, সংরক্ষণ ও মানবাধিকার সংক্রান্ত আদিবাসীদের আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণ করা।
১৯৯৪ সালে ৯ আগস্টকে “আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস” হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আনাচে কানাচে থাকা, দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত, সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও তাদের সমাজের বিভিন্ন সমস্যার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের জন্য সরকারসহ অন্যান্য প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক বিভিন্ন উদ্যোগ ও কার্যক্রম গ্রহণ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৪ সালে ৯ আগস্টকে “আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস” হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আনাচে কানাচে থাকা, দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত, সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও তাদের সমাজের বিভিন্ন সমস্যার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের জন্য সরকারসহ অন্যান্য প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক বিভিন্ন উদ্যোগ ও কার্যক্রম গ্রহণ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আদিবাসী দিবস পালন নিয়ে বাংলাদেশে শুরু থেকেই ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর মধ্যে দ্বিধা ও অস্পষ্টতা কাজ করেছিল। ১৯৯৩ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন বলা হয়েছিল, “এদেশে কোনো আদিবাসী নেই, এখানে যারা রয়েছে তারা বাইরে থেকে আসা কিছু যাযাবর মানুষ যাদেরকে উপজাতি বলা হয়”।
তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার ও প্রমোদ মানকিন এমপি’র নেতৃত্বে একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী বর্ষ উদযাপন করা হয়েছিল এবং সেখানে কিছু দাবিনামা তুলে ধরে বিএনপি সরকারের তীব্র সমালোচনা করা হয়। সেই দাবিনামার মধ্যে- ১৯৯৩ সালকে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’ ঘোষণার জন্য জাতিসংঘকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হয়। ‘বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই’- ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের এ বক্তব্যকে দুর্ভাগ্যজনক, হিংসাপ্রসূত ও সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত উল্লেখ করে এর তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, ২০০৮ সালে ‘দিন বদলের সনদ’ এর স্লোগান নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে ২০১০ সাল থেকে এদেশে আদিবাসী নয়, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’র বসবাস রয়েছে বলে বিএনপির ‘সেই’ দুর্ভাগ্যজনক, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার।
২০১১ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের কী হিসেবে অভিহিত করা হবে সে সম্পর্কে কূটনীতিক ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিদের ব্রিফ করতে গিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ তিন পার্বত্য জেলার অধিবাসী। ১৫ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশের ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশকে অবহেলা করে ক্ষুদ্র অংশটিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার তৎপরতা কোনোভাবেই দেশের স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে পারে না। তিনি আরও বলেছিলেন, স্বার্থান্বেষী কিছু মহল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম ও জাতিসংঘের বিভিন্ন আলোচনায় বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করার মাধ্যমে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অপপ্রয়াস চালায় যা, বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়, ভাবমূর্তি ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে (প্রথম আলো, ২৭ জুলাই ২০১১)।
দায়িত্বশীল মন্ত্রীর এমন বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, শাসকগোষ্ঠী বা যারা নিজেদের বৃহত্তর গোষ্ঠীর প্রতিনিধি ভাবেন, তারা আসলে কাদের স্বার্থ রক্ষার কথা ভাবেন। ডা. দীপু মনির বক্তব্য থেকে তখন এটাও দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ২ শতাংশের কম মানুষ যারা এদেশে সংখ্যালঘু, প্রান্তিক আদিবাসী রয়েছেন তারা রাষ্ট্র দ্বারা বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। অথচ ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরাই আবার কথায় কথায় সংবিধানিক বাধ্যবাধকতার আঙুল উঁচিয়ে ধরেন! সংবিধানের ২৮(১) এ বলা হয়েছে- “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।”
এমনকি পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ২৩(ক) ধারাতে পরোক্ষভাবে আদিবাসীদের উপস্থিতিকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে- “রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।” কিন্তু রাষ্ট্র যে প্রকৃত অর্থে আদিবাসীদের স্বার্থকে নিয়ে ভাবে না তা রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের বক্তব্য ও মন্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে।
এখানে একটি কথা না বললেই নয় যে, দীর্ঘ দিন ধরে সুবিধাবঞ্চিত ও বাদ পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এই অংশকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হলে তাদের কেবল একটি সাংবিধানিক ও আইনগত ভিত্তি পোক্ত হবে মাত্র। কেবলমাত্র এই আইনগত ভিত্তির জোরেই ২ শতাংশেরও কম সংখ্যক প্রান্তিক, আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি হবে বলে মনে করার কোন কারণ নেই। কিন্তু সেই রকম সমতার অধিকার তৈরি করলেও ক্ষতি কী? বিশ্বের বহু দেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে আদিবাসীদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মানুষজনেরা বঞ্চিত হননি। বরং তারা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতি তাদের পূর্বের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়ে উদারতার পরিচয় দিয়েছে এবং বর্হিবিশ্বেও প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
ত্রিশ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে পাওয়া বাংলার এই স্বাধীনতা কি এতটা ঠুনকো আর ভঙ্গুর নয় যে দেশের ২ শতাংশেরও কম সংখ্যক মানুষের মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে গিয়ে জাতীয় পরিচয় ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মধ্যে পড়বে! এ প্রান্তিক মানুষদের অধিকার ও মর্যাদা দেওয়ার অর্থ এই নয় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তার সমস্ত রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক মর্যাদা হারিয়ে ফেলবে!
ত্রিশ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে পাওয়া বাংলার এই স্বাধীনতা কি এতটা ঠুনকো আর ভঙ্গুর নয় যে দেশের ২ শতাংশেরও কম সংখ্যক মানুষের মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে গিয়ে জাতীয় পরিচয় ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মধ্যে পড়বে! এ প্রান্তিক মানুষদের অধিকার ও মর্যাদা দেওয়ার অর্থ এই নয় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তার সমস্ত রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক মর্যাদা হারিয়ে ফেলবে!এ ভ্রান্ত আর সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে বেরুতে না পারলে বর্তমান সরকারের যে উন্নয়নের বাহাস চলছে সেটার অন্ত:সারশূণ্যতা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
সাহেবগঞ্জ এ বাগদা ফার্মে এই সাঁওতালদের ঘর পুড়িয়ে উচ্ছেদের চেষ্টা হয়। ছবি: ডয়চে ভেল
সাম্প্রতিক গৃহগণনা ও জনশুমারি ২০২২ এর হিসাবে দেখা যায় যে, গত দশ বছরে এদেশে মুসলিম জনগোষ্ঠী ব্যতীত অন্যান্য ধর্মালম্বীদের জনসংখ্যার হার আরও কমে গেছে। এই সংখ্যাতত্ত্ব কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো নিরাপত্তার অভাব। এদেশের সংখ্যাগুরুরা আরেকটি কথা মনে রাখেন না যে, ‘সংখ্যালঘু’ মানেই ‘আদিবাসী’ নয়। কারণ বাংলাদেশের একজন সংখ্যাগুরু মুসলিম সদস্য যখন ইউরোপ, আমেরিকায় যান তখন তিনি সেখানে জাতিগত ও ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু হয়ে যান।
কাজেই বাঙালির ভুল শব্দ চয়ন, শব্দের ভুল ব্যবহার ও ভুল ব্যাখ্যার কারণে এদেশের সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলো নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকেই যাচ্ছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর বাঙালি জাত্যাভিমানের চাপে পড়ে তাই এদেশের সংখ্যালঘু প্রান্তিক মানুষদের অস্তিত্ব দিন দিন সংকট থেকে আরও গভীর সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
তার অর্থ এই নয় যে, একজন বাঙালি মুসলিম ইউরোপ, আমেরিকায় গিয়ে আদিবাসী বা সরকারের ভাষায় “ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী” হয়ে গেছেন! কাজেই বাঙালির ভুল শব্দ চয়ন, শব্দের ভুল ব্যবহার ও ভুল ব্যাখ্যার কারণে এদেশের সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলো নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকেই যাচ্ছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর বাঙালি জাত্যাভিমানের চাপে পড়ে তাই এদেশের সংখ্যালঘু প্রান্তিক মানুষদের অস্তিত্ব দিন দিন সংকট থেকে আরও গভীর সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
আমরা সবাই জানি যে, আদিবাসীদের প্রধানতম সমস্যা হলো, ভূমি সমস্যা। এ ভূমি সমস্যা বা তাদের ভূমি কেড়ে নেওয়ার প্রবণতা সে-ই বৃটিশ এবং পাকিস্তান আমল থেকে চলছে। গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মে সাঁওতাল ও প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভোগ দখলীয় জমিতে চিনিকল স্থাপন করে বর্তমানে সেখানে সেই জমি নিয়ে সাঁওতাল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর রাষ্ট্র স্টিম রোলার চালিয়ে সাঁওতালদের হত্যা করে, তাদের বসতিতে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আদিবাসীরা তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য, সংস্কৃতি, রীতিনীতিগুলো হারানোর পাশাপাশি বর্তমানে নিজের পরিচিতির জায়গাটুকুও হারাবার পথে। তাদের সর্বশেষ অস্তিত্বের জায়গা নিজেদের স্ব স্ব পরিচয়টুকুও আজ তাদের হাতে নেই। বর্তমান সরকার সেই আয়োজনও সম্পন্ন করে রেখেছে। এদেশ থেকে আদিবাসী পরিচিতি তুলে ফেলার জন্য সরকারিভাবে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তার কিছু নমুনা এই লেখার সাথে তুলে ধরছি।
১. অনেকে মনে করেন, শাসক শ্রেণির এটাও একটা কৌশল হতে পারে যে, আদিবাসী দিবস ঘনিয়ে এলে তারা এমন কিছু একটা বিতর্কের ফাঁদ পেতে বসে যাতে করে সেই বিতর্ক বা অপপ্রচারের জবাব নিয়ে আদিবাসী ও আদিবাসীবান্ধব সুশীল সমাজ সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের সমস্ত মনোযোগ এ বিতর্কের মধ্যে আবর্তিত হয়ে মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে যায়। যেমন, এ বছর আদিবাসী দিবসে মিডিয়ায় ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার না করে সংবিধান সম্মত শব্দ চয়ন ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান করে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে উপসচিব শেখ শামছুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি প্রেরণ করা হয় [স্মারক নং- ১৫.০০.০০০০.০২৪.১৮.১৮৩.১৪.৫৯৬, তারিখ ০৫ শ্রাবণ ১৪২৯/১৯ জুলাই ২০২২]। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এ চিঠি নিঃসন্দেহে সংবিধান পরিপন্থী একটি গর্হিত কাজ। কারণ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদেও ২(ক) ও ২(খ) ধারায় বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা স্পষ্টভাবে বলা আছে।
২. ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এনজিও বিষয়ক ব্যুরো [স্মারক নং ০৩.০৭.২৬৬৬.৬৬০.৬৬.৪৯২.১৯-১৯৭, তারিখ ০৬/১২/২০২০] থেকে আদিবাসী যুক্ত নিবন্ধনকৃত এনজিও সমূহের নাম পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে।
৩. ২০১৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে আরেক চিঠিতে [স্মারক নং-২৯.০০.০০০০.২২৩.০১৩.২০১৭-৩৫১, তারিখ- ০১/১১/২০১৮] এ মর্মে নির্দেশনা দেওয়া হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ বাঙালি জনগোষ্ঠী এবং বাঙালি আঞ্চলিক দলসমূহের প্রতি নিরাপত্তা বাহিনী ও অসামরিক প্রশাসন কর্তৃপক্ষ যেন তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল, মানবিক আচরণ এবং হেয় প্রতিপন্ন না করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল।
একটি রাষ্ট্র ও সরকার কতটা পক্ষপাতমূলক হলে এভাবে সরকারি আদেশ প্রদান করা যেতে পারে? একথা সকলেই জানে, আশির দশকে সরকারি উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলার বাঙালিদের পুনর্বাসন করা হয়েছিল যারা গত সাড়ে ৪ দশক ধরে এখনো সরকারি রেশন পেয়ে যাচ্ছেন। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুরা দশকের পর দশক বাস্তুহারা হয়ে যাযাবর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন, তাদের জন্য সরকার কোনোদিন সহায়তা প্রদান করেনি। নামকা ওয়াস্তে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘উপজাতীয় শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্স’ গঠন করে দেওয়া হয়েছে। কেবল কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভোগ করা ছাড়া যেটির কোনো কার্যক্রম নেই। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরে নিরুৎসাহিত করা, বিদেশীদের পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ও শর্তারোপ প্রয়োগের চিঠিই প্রমাণ করে যে, এ রাষ্ট্র ব্যবস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামকে সাধারণ মানুষ ও বিশ্ব ব্যাবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িরা যতই এ রাষ্ট্রের সাথে একীভূত হতে চায় তখন রাষ্ট্র ব্যবস্থা তাদের দূরে ঠেলে দিয়ে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’র তকমা দিয়ে সেখানে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি জিইয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী বর্ষ বা আদিবাসী দিবস চালুর আগে এদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোকেই ‘আদিবাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। কারণ তখন আদিবাসী শব্দটিকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোর ওপর ‘আদিম’ অর্থে প্রয়োগ করা হতো। অর্থাৎ যতদিন ‘আদিবাসী’ শব্দটি অবজ্ঞা অর্থে আদিবাসীদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছিল ততদিন শাসকশ্রেণীর মনে এই শব্দ নিয়ে কোনো খসখসানি ছিল না। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে আদিবাসী শব্দটি যখন থেকে ব্যাপকতা পেয়েছে তখন থেকেই সরকারের এলার্জির প্রবণতা বেড়ে যায় এবং সরকারের দায়িত্বশীলদের মুখ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দের হাস্যকর ভাবার্থ প্রকাশ পেতে শুরু করে।
জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী বর্ষ বা আদিবাসী দিবস চালুর আগে এদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোকেই ‘আদিবাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। কারণ তখন আদিবাসী শব্দটিকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোর ওপর ‘আদিম’ অর্থে প্রয়োগ করা হতো। অর্থাৎ যতদিন ‘আদিবাসী’ শব্দটি অবজ্ঞা অর্থে আদিবাসীদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছিল ততদিন শাসকশ্রেণীর মনে এই শব্দ নিয়ে কোনো খসখসানি ছিল না। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে আদিবাসী শব্দটি যখন থেকে ব্যাপকতা পেয়েছে তখন থেকেই সরকারের এলার্জির প্রবণতা বেড়ে যায় এবং সরকারের দায়িত্বশীলদের মুখ থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দের হাস্যকর ভাবার্থ প্রকাশ পেতে শুরু করে।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু আইএলও কনভেনশন ১০৭ অনুসমর্থন করেছিলেন। সেই ১০৭ এ কিন্তু আদিবাসী বলি আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যে নামেই অভিহিত করি না কেন, সুনির্দিষ্টভাবে তাদের অধিকার সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। বিশেষত ১০৭ এর ১, ২, ৩ ধারায় ভূমি, ভাষা, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন অধিকারের কথা বলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কিন্তু কে আগে এদেশে এসেছে আর কে পরভূমি থেকে এসেছে সেসব কথা চিন্তা করেননি। তিনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখেই আইএলও কনভেনশন ১০৭ অনুস্বাক্ষর করেছিলেন। তাই শাসকগোষ্ঠী যখন কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথা বলেন, তখন তার এই উদারতার দিকটি কেন স্বচ্ছন্দে অনুসরণ করতে এত কুণ্ঠাবোধ করেন সেটাই আমাদের মনে বড় প্রশ্ন জাগে।
দিন বদলের সনদের অঙ্গীকার নিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে একটি প্রাণবন্ত শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছিলেন। যেখানে তিনি বলেছিলেন, “বাংলাদেশে হাজং, কোচ, বানাই, ত্রিপুরা, মারমা, চাকমা, গারো, সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা, খাসিয়া, মণিপুরি, খুমি, খিয়াং, লুসাই, বম ও রাজবংশীসহ বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে। তারা তাদের স্বকীয়তা, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, সমৃদ্ধ মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য দিয়ে আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করেছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে এসব আদিবাসীদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অবদান। নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় বজায় রেখে আদিবাসী জনগণ যাতে সবার মতো সমান মর্যাদা ভোগ করতে পারে, সেটি নিশ্চিত করা আমাদের কর্তব্য।” এবং তিনি আদিবাসী জনগণের সার্বিক কল্যাণ কামনা করেছিলেন। একজন সরকার প্রধানের কাছ থেকে এমন নায়কোচিত উদার ও উদাত্ত বাণীই তো আমরা বারবার আশা করেছিলাম। কিন্তু ২০১০ সালে এসে ক্ষমতাসীন সরকারের মনে কী এমন মন্ত্র পুঁতে দেওয়া হলো যে, দেশের সকল আদিবাসীরা রাতারাতি ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ হয়ে গেল আর বৃহত্তর বাঙালি গোষ্ঠী ‘আদিবাসী’তে পরিণত হয়ে গেলেন!
২০১০ সালে প্রণীত “ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০” আইনটি আইনগতভাবে এদেশের আদিবাসীদের সংস্কৃতির দিককে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু এই আইনটি তো কেবল সংস্কৃতি সম্পর্কিত দিকগুলো তদারক করবে। এখানে ভূমি ও ভাষার অধিকারের কথা বলা হয়নি। এমনকি সংবিধানের ৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে রাষ্ট্রভাষা “বাংলা”। কাজেই আদিবাসীদের ভাষা ও ভূমির অধিকার রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি না পেলে আদিবাসীরা দিনে দিনে এদেশ থেকে হারিয়ে যাবে। যেমনটি পটুয়াখালী, বরগুনা থেকে কালে কালে সাগরের পাড় বিলীন হয়ে যাওয়ার মতোন রাখাইন আদিবাসীরাও বিলীন হয়ে যাচ্ছেন।
হ্যাঁ, ২০১০ সালে প্রণীত “ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০” আইনটি আইনগতভাবে এদেশের আদিবাসীদের সংস্কৃতির দিককে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু এই আইনটি তো কেবল সংস্কৃতি সম্পর্কিত দিকগুলো তদারক করবে।এখানে ভূমি ও ভাষার অধিকারের কথা বলা হয়নি। এমনকি সংবিধানের ৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে রাষ্ট্রভাষা “বাংলা”। কাজেই আদিবাসীদের ভাষা ও ভূমির অধিকার রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি না পেলে আদিবাসীরা দিনে দিনে এদেশ থেকে হারিয়ে যাবে। যেমনটি পটুয়াখালী, বরগুনা থেকে কালে কালে সাগরের পাড় বিলীন হয়ে যাওয়ার মতোন রাখাইন আদিবাসীরাও বিলীন হয়ে যাচ্ছেন।
একটি কথা দিয়ে লেখাটির ইতি টানতে চাই, ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি আদিবাসী সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর একজন প্রতিনিধি এবং তিনি একজন নারী। এটি নিঃসন্দেহে আদিবাসী, দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য গর্বের একটি বিষয়। ভারতকে আমরা হিন্দুত্ববাদী দেশ হিসেবে যতই তুলোধুনো করি না কেন, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় বসিয়ে এ ভারতই এক অনন্য নজির তৈরি করেছে। বাংলাদেশে হয়তো আমাদের সেই স্বপ্ন কখনো বাস্তবে রূপ পাবে না। কিন্তু এদেশের সংখ্যালঘু, প্রান্তিক ও আদিবাসী জনগণ নিজেদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি আর নিরাপদ আবাসটুকু তো অন্তত স্বপ্ন দেখতে পারে।
ইলিরা দেওয়ান
মানবাধিকার কর্মী ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক