বৃহঃস্পতিবার ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১ Thursday 21st November 2024

বৃহঃস্পতিবার ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

Thursday 21st November 2024

বহুস্বর মতামত

দেশের পুঁজিবাজার ও জুয়াড়ি চক্রের দৌরাত্ম্য

২০২৩-০৬-০১

সাঈদ সুমন
লেখক ও আলোকচিত্রী

পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক সমাজে পুঁজিবাজার সাধারণ মানুষ কে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি কোম্পানি গুলোতে মালিকানার সুযোগ দেয়। যদিও শেষ পর্যন্ত সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থ স্বল্পতার কারণে ওয়ারেন বাফেট’রা কিংবা জে পি মরগ্যানদের মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা পুঁজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে থাকেন।

 

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, কিংবা চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর বা ভারতের পুঁজিবাজার অনেক শক্তিশালী ও পরিণত। বাংলাদেশের ক্যাপিটাল মার্কেট এই দেশগুলোর মার্কেট থেকে অনেক পিছিয়ে, এখানে ব্যাংকিং শিল্পের যারা মালিক তারাই আবার পুঁজিবাজারের বড় বিনিয়োগকারী। একইসাথে এই শিল্প মালিকরা ব্যাংক থেকে যেভাবে ঋণ নিতে রাজি সেভাবে তারা পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে আগ্রহী নয়, এবং পুঁজিপতিরা তাদের সম্পদের মালিকানার হিস্যা জনগণের সাথে ভাগ করতে না চাওয়ায় পুঁজিবাজারকে এড়িয়ে চলেন। তাই বাংলাদেশের ক্যাপিটাল মার্কেটে হাতে গোনা কিছু মৌল-ভিত্তিক কোম্পানি ছাড়া বেশিরভাগ টেকসই কোম্পানি পুঁজিবাজারের বাইরে।

 

 

পুঁজিবাজার/ গ্রাফিক্স: দৃকনিউজ

 

 

বাংলাদেশের ক্যাপিটাল মার্কেট এর শেষ এক যুগের অবস্থা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ২০১০ এর মার্কেট ক্রাশ এর পর তিন থেকে চার বার ঊর্ধ্বগতির চেষ্টা করলেও প্রতিবারই আগের অবস্থানে বা তারে চেয়েও খারাপ অবস্থানে পৌঁছেছে। প্যাটার্নটা এমন ছিলো, দুই বছর মার্কেট নিম্নমুখী থাকার পরে, কিছুদিন ভালো থেকে আবার আগের অবস্থানে ফিরে গিয়েছে, এতে বার বার বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হয়েছে উচ্চমূল্যে বিনিয়োগ করে। ২০১৫ সালে বিএনপি-জামাতের আন্দোলনের সময় থেকে বাজার নিম্নমুখী হতে থাকে এবং কয়েকবার উত্থান এর ঝলকানি দেখালেও ব্যর্থ হয়ে ২০১৮-২০১৯ বছরগুলোতে নিম্নমুখিতা অব্যাহত থাকে। এরপর ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস এর সময় থেকে আকস্মিক বাজার ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে, এবং কাকতালীয়ভাবে সরকার করোনা প্যাকেজ ঘোষণার পর অনুমান করা যায়, সরকারের দেওয়া কম সুদের ঋণ পুঁজিবাজারে প্রবেশ করে। পৃথিবীর সমস্ত দেশের পুঁজিবাজার যখন দীর্ঘ সংশোধনে তখন বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে উত্থান শুরু হয় নাটকীয় ভাবে। 

 

২০২০-২০২২ সালে দেশের অন্যতম পুঁজিপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ‘বেক্সিমকো লিমিটেড’ ২০ টাকার নিচ থেকে একসময় ১৮৬ টাকায় দর ওঠে, এবং এরপর থেকে দর কমতে কমতে ১১৫ টাকায় ফ্লোর প্রাইসে প্রায় ৯ মাসের বেশি আটকে আছে। লক্ষ লক্ষ বিক্রেতা তাদের শেয়ার সেল করার জন্য অপেক্ষা করছে।  সালমান এফ রহমানের আর একটি স্টক ‘বেক্সিমকো ফার্মা’ ৫৫ টাকা থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত দর ওঠে, এবং এই স্টকটি ও এখন ক্রেতার অভাবে বিক্রি করা যাচ্ছে না। একই মালিকানার আরেকটি কোম্পানি ‘শাইনপুকুর সিরামিক্স’ ৬ টাকা থেকে ৬০ টাকা দর ওঠে।

 

এমন আরও অনেক ইকুইটি’র কথা বলা যায়, তাদের উত্থান দেখে মনে হয় কোনো আলাদীন এর চেরাগ তারা পেয়েছেন। সবচেয়ে আয়রনি ঘটনা বলা যেতে পারে, ‘অরিয়ন ইনফিউশনে’র ১০০ টাকার নিচ থেকে ৯০০ এর উপরে দর যাওয়া এবং এখন ৩০০ এর ঘরে ঘুরাফিরা করা। কিংবা ‘বিকন ফার্মা’ যে শেয়ার ১৮ টাকা থেকে একসময় ৩৫০ টাকা দর ওঠা এবং এখন ৩০০ এর নিচে ট্রেড হওয়া।

 

এই স্টক গুলোতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা একদম লাভ করেনি তা নয় তবে লাভ যত জন করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশিগুন মানুষ উঁচু দরে স্টক কিনে বিক্রি করার জন্য বসে আছেন। এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা তখন কোথায় ছিল? বাংলাদেশের পুঁজিবাজার কারসাজী চক্র ছাড়া ফাংশন করতে পারে না, এখানে বড় কিছু বিনিয়োগকারী ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী মিলে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করেন, সাধারণত কোনো শেয়ার এর ইন-সাইড ইনফোর মাধ্যমে কারসাজী হয়,  যারা শেয়ারটার বড় পাবলিক অংশ সংগ্রহ করে তারা আগে থেকেই জানেন কোম্পানির সামনে ভালো নিউজ আছে, এবং  যখন নিউজ প্রকাশ পায় তারা শেয়ার ছেড়ে দিয়ে বের হয়ে যায়। এবং একসময় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা উচ্চদরে সিকিউরিটিজ কিনে আটকে যায়। 

 

কিছুদিন আগে বাংলাদেশ স্টক এক্সচেঞ্জ- বিএসই চেয়ারম্যান বলেন, “শত অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি পুঁজিবাজার ভালো রেখেছেন।” যে বাজার থেকে ৭ থেকে ৮ মাস বেশির ভাগ শেয়ার বিক্রি করা যায় না, ক্রেতা নাই, সেই বাজারকে কিভাবে তিনি ভালো বলেন? গত ৩ বছরে বিদেশী বিনিয়োগ ঋণাত্মক, কারণ এমন বাজারে কেউ ব্যাবসা করতে চায় না যেখানে বিনিয়োগ করার পরে দীর্ঘদিন টাকা আটকে থাকে। পৃথিবীর কোনো দেশের পুঁজিবাজারেকে এভাবে ফ্লোর প্রাইস দিয়ে বেঁধে রাখা হয় না। 

 

দেশের পুঁজিবাজার অত্যন্ত অপরিপক্ব বাজার। যেখানে ‘স্কয়ার ফার্মা’ ও ‘বেক্সিমকো’র মতো মৌল ভিত্তিক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেও শেয়ারের ক্রেতা নাই। সেখানে চেয়ার টেবিল নাই এমন কোম্পানি যুগ যুগ ধরে ভাল রিটার্ন দিচ্ছে। অথচ, বাংলাদেশের  পুঁজিবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বলা হয় লোভী ও অবিবেচক। কিন্তু এটা কখনও বলা হয় না, এই পুঁজিবাজারে লোভী না হলে কারসাজী চক্রের সাথে তাল মিলিয়ে ব্যাবসা করা যায় না। এদিকে তাদের সাথে তাল মেলাতে না পারলে ব্যাবসা করার মতো কিছু আর বাকি থাকে না। তাই বাধ্য হয়ে বিনিয়োগকারীরা কারসাজী চক্রের শেয়ার গুলোতে এন্ট্রি নিতে বাধ্য হয়। 

 

মোটাদাগে শীর্ষ পদস্থদের দুর্নীতি, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কারসাজির পাশাপাশি পরিচালনাগত ত্রুটি, কাঠামোগত দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে চরম সংকটে রয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। আর এই সংকট দীর্ঘমেয়াদে তৈরি করেছে আস্থাহীনতার সংকট। যত দিন এই বাজারে সত্যিকারের ভালো কোম্পানি না যুক্ত হবে ততদিন এই বাজারে বিনিয়োগ করে জুয়াড়ি চক্রের কর্মকাণ্ড দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নাই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। 

 

 

সাঈদ সুমন

লেখক ও আলোকচিত্রী

 

Your Comment