ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ছাড়া গণমাধ্যম সংস্কারের প্রকৃত চিত্র বোঝা অসম্ভব: অধ্যাপক আ-আল মামুন
২০২৫-১২-১৫
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী শাসনামলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে শাসন ও নিপীড়নের চিত্রকে বিশ্লেষণ এবং এই গণমাধ্যম শিল্পকে সংস্কারের একটা রূপরেখা অন্তবর্তী সরকারে উদ্যোগে গঠিত গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে পাওয়া যায়। যে রাজনৈতিক প্রত্যয় নিয়ে সরকার কমিশনটি গ্রহণ করেন, একই রাজনৈতিক দৃঢ়তা ও মনোযোগ প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি কের্যত প্রতিবেদনটি আয়োজন করে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা ছাড়া সরকারের দিক থেকে এই বিষয়ে আর কোনও উদ্যোগ নেয়া হয় নাই। এই পরিপ্রেক্ষিতে দৃকনিউজের পক্ষ থেকে মীর হুযাইফা আল মামদূহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ-আল মামুন এর সাথে কথা বলেছেন যেখানে তিনি এই প্রতিবেদনের ঐতিহাসিক গুরুত্বসহ বাংলাদেশে গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতি, ক্লিকবেইট জার্নালিজম নিয়ে কথা বলেছেন।
মীর হুযাইফা আল মামদূহ: এই বছরের মার্চ মাসে অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। প্রতিবেদনটি নিয়ে প্রাথমিকভাবে কিছু আলোচনা হলেও, পরবর্তীতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় আর গণমাধ্যমের সংস্কার স্থান পায়নি। আমরা গণমাধ্যমের সংস্কারের প্রসঙ্গ এবং কমিশনের প্রতিবেদন ও পরামর্শ নিয়ে আলাপ-আলোচনাকে জারি রাখতে চাই। তারই অংশ হিসেবে এই আলাপ। আমাদের প্রথম প্রশ্ন, আপনি গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
অধ্যাপক আ-আল মামুন: গণমাধ্যম কমিশনের সাম্প্রতিক রিপোর্ট নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয় এবং সময়োপযোগী একটি উদ্যোগ। সার্বিকভাবে বলতে গেলে, এটি একটি যথেষ্ট ভালো রিপোর্ট। তবে দুঃখের বিষয়, অতীতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কমিশন রিপোর্ট, একটি মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে, অন্যটি ১৯৮৩ সালে, এর সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়নি। সেই তুলনা করলে রিপোর্টটি আরও গভীর হতো, কারণ ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ছাড়া গণমাধ্যম সংস্কারের প্রকৃত চিত্র বোঝা অসম্ভব।
কমিশনের এই রিপোর্ট বাস্তবায়ন কতখানি হবে, বা আদৌ নীতিতে রূপ পাবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়ে গেছে। তবুও আমি মনে করি, এই উদ্যোগটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ আমরা দেখেছি গত কয়েক দশকে মিডিয়া যেভাবে রূপান্তরিত হয়েছে, যেভাবে এর ব্যবসায়িক নেক্সাস, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ক্ষমতার বৃত্তগুলো জটিল হয়েছে, তার চূড়ান্ত রূপ। যদি গণমাধ্যম এই নেক্সাসের বাইরে বের হতে না পারে, তাহলে জনকল্যাণমূলক বা দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার যে আকাঙ্ক্ষা, তা বাস্তবে পরিণত হবে না।
তবে এটাও ভাবতে হয়, একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে থেকে আসলে কতখানি গণমাধ্যম সংস্কার সম্ভব? রিপোর্টে বারবার বলা হয়েছে, গণমাধ্যমকে ‘ব্যবসায়ে সফল’ হতে হবে। কিন্তু সেই সফলতার সংজ্ঞা কী, বা তার নৈতিক ও পেশাগত সীমা কোথায়, তা বলা হয়নি। গণমাধ্যমকে যেভাবে কেবল ‘ইন্ডাস্ট্রি’ হিসেবে দেখা হচ্ছে, সেটি পুরনো শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী ধারার চিন্তা। অথচ আজকের পৃথিবীতে প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক রূপান্তরের কারণে সেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল মডেল ভেঙে পড়েছে।
গণমাধ্যমকে কেবল একটি প্রতিষ্ঠান (ইনস্টিটিউশন) হিসেবে না দেখে, একটি জটিল সামাজিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বোঝার প্রয়োজন আছে। রিপোর্টটিতে সেই দার্শনিক ও ঐতিহাসিক ভিত্তি অনুপস্থিত। কেন আজকের গণমাধ্যম এমন হয়ে উঠেছে, তার পেছনে কী কী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন কাজ করছে, এই ব্যাখ্যা অনুপস্থিত। রিপোর্টে মনে হয়েছে, মিডিয়ার বর্তমান সংকটকে শুধু কোনো নির্দিষ্ট সরকারের নীতিগত ভুলের ফল হিসেবে দেখা হয়েছে, কিন্তু বিষয়টি এর চেয়ে অনেক জটিল ও বিস্তৃত, এবং কাঠামোগত।
তবুও এই রিপোর্টের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এখানে যে প্রস্তাবগুলো এসেছে, তার অর্ধেকও যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশে ‘সুস্থধারার সাংবাদিকতা’র জন্য একটি নতুন ভিত্তি তৈরি হতে পারে।
মীর হুযাইফা আল মামদূহ: পতিত সরকারের আমলে মূলধারার গণমাধ্যম প্রধানত আওয়ামী প্রোপাগান্ডা মেশিন পরিণত হয়েছিল, শুধু তাই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিডিয়া সরকার ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে জোট বেঁধে সরকারি বয়ান প্রতিষ্ঠা ও বিরুদ্ধ মত দমনে কাজ করেছে। মিডিয়া-সরকারের নেক্সাস/সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়ার জন্য কি কোনো দিক নির্দেশনা পেলেন কমিশনের প্রতিবেদনে?
অধ্যাপক আ-আল মামুন: কমিশনের প্রতিবেদনে আমি যেটুকু দেখেছি, সেখানে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা আছে। গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় স্বাধীনতা নিঃসন্দেহে অপরিহার্য, কিন্তু সেই স্বাধীনতা কি সত্যিই মুক্ত সাংবাদিকতার পথ তৈরি করে? আমাদের দেশে সাংবাদিকতাকে দীর্ঘদিন ধরে আইনি কাঠামো ও নানা সিস্টেমেটিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, প্রায়ই এমনভাবে যা বর্বর, ন্যাক্কারজনক এবং প্রকাশ্য। এ ধরনের প্রকাশ্য দমন ইউরোপ বা আমেরিকার পরিপক্ব গণতন্ত্রে দেখা যায় না। বাংলাদেশের মিডিয়ার পক্ষে স্বাধীন কণ্ঠ তোলা বা জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া প্রায়ই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাই শুধু রাজনৈতিক বা কর্পোরেট নেক্সাস ভেঙে ফেললেই যে আমরা একটি স্বাধীন ও দায়িত্বশীল গণমাধ্যম পেয়ে যাব, সে বিষয়ে আমি খুব আশাবাদী নই।
তবু কিছু প্রস্তাব আছে যেগুলো সত্যিই মৌলিক ও জরুরি। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি মালিকানার ধরন নিয়ে। ক্রস-মালিকানা থাকবে কি না, সেটাই এখন বড় বিতর্ক। একই মালিকের অধীনে অনেকগুলো মিডিয়া থাকা কি গণমাধ্যমের বহুমুখিতা ও স্বাধীনতাকে সংকুচিত করছে না?
উদাহরণ হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপকে ধরা যেতে পারে। তাদের অধীনে রয়েছে সাতটির মতো মিডিয়া প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে প্রিন্ট মিডিয়াও অন্তর্ভুক্ত। শুধু তাই নয়, বসুন্ধরার ছায়া বিনিয়োগ (শ্যাডো ইনভেস্টমেন্ট) আছে আরও অনেক মাধ্যমে। যখন বসুন্ধরার সাতটি মিডিয়া একই সুরে কথা বলে, তখন দেখা যায় আরও সাতটি সেই সুরে যোগ দিচ্ছে। এই একরৈখিকতার মধ্যেই হারিয়ে যায় গণমাধ্যমের প্রকৃত স্বাধীনতা, যে স্বাধীনতা আসলে জনগণের জানার অধিকারের রক্ষাকবচ ছিল।
মীর হুযাইফা আল মামদূহ: যেমন আমরা মোসারাত জাহান মুনিয়ার ঘটনা এবং ‘ধর্ষণ ও হত্যা’ মামলাটির রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে দেখেছি।
অধ্যাপক আ-আল মামুন: মুনিয়ার কেসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা দেখা গেছে। ঢাকার মিডিয়াগুলোকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, চাপে রাখা হয়েছে, বিজ্ঞাপন বাড়িয়ে বা নানা সুবিধা দিয়ে প্রভাবিত করা হয়েছে, সেটা মুনিয়া ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার সংবাদে স্পষ্ট হয়েছে। যখন দেখা গেল ঢাকার মিডিয়ায় এই বিষয়ে আর তেমন আলোচনা হচ্ছে না, বরং বিভাগীয় শহরগুলোতে মুনিয়ার কেস নিয়ে আলাপ বাড়ছে, তখন বসুন্ধরা বিভাগীয় ও জেলা শহরের পত্রিকাগুলোতেও বিজ্ঞাপন ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়া শুরু করল। ফলে সেখানকার সংবাদমাধ্যমগুলোকেও নীরব করে ফেলা সম্ভব হলো।
এই প্রক্রিয়াগুলো যে ঘটে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আর এই অবস্থার পরিবর্তনের একটি উপায় হতে পারে মালিকানার ধরন বদলানো, বিশেষ করে সাধারণ বা ক্রস-মালিকানার সীমা নির্ধারণ করা। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে এই বিষয়টি নিয়ে প্রস্তাব আছে।
মীর হুযাইফা আল মামদূহ: কিন্তু ক্রস-মালিকানার ধারণা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় কতটা সম্ভব? বসুন্ধরার উদাহরণই ধরা যাক, বসুন্ধরা যেখানে সাতটি মিডিয়া পরিচালনা করছে এবং রাজনৈতিক প্রভাবও বজায় রেখেছে, সেখানে যদি আপনি তাদের কাছ থেকে এই সাতটি মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে নিতে চান, বা বলেন, ‘তুমি হয়তো একটি মিডিয়ার অর্ধেক মালিকানা রাখতে পারো,’ তাহলে সে কি এতে রাজি হবে?
অধ্যাপক আ-আল মামুন: ক্রস মালিকানা বলতে কমিশন যেটা বোঝাচ্ছে, আমি সেটা বোঝাচ্ছি না। ক্রস মালিকানা বলতে যেটা আদর্শভাবে বোঝানো হয়, সেটা হলো, ধরুন, আমার হাতে পত্রিকা, টেলিভিশন ও রেডিও আছে; এই ক্রস মালিকানাটা বাতিল হতে হবে। কিন্তু আরেকটা প্রস্তাব সেখানে আছে, যেটা বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। সেটায় বলা হয়েছে যে, ইনভেস্টর একজন না হলেও ভালো, অর্থাৎ, একটা মিডিয়াতে যদি কয়েকজন ইনভেস্টর থাকে, তাহলে সম্পাদকীয় নিরপেক্ষতা রক্ষা করা যাবে। আমার ধারণা, এটা তাদের একটি অনুমান। কিন্তু সেটা হলেই যে সব ঠিক হয়ে যাবে, আমার কাছে মনে হয় না। আমার কাছে মনে হয়, কোনো করপোরেট হাউজ বা ব্যক্তির মালিকানায় একটি মিডিয়া থাকতেই পারে। সেখানে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার প্রশ্ন আছে।
সেই দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রস্তাব আছে। যেমন, প্রতি বছরে কত সার্কুলেশন হচ্ছে, কী পরিমাণ অডিয়েন্স রিচ হচ্ছে, সেটার একটি স্পষ্ট রেকর্ড মিডিয়াকে তুলে ধরতে হবে। তাদের আয় কোথা থেকে হচ্ছে, কী কী সোর্স থেকে আসছে, সেটাও প্রকাশ করতে হবে। এবং যদি ব্যবসায় সফল না থাকে, যদি এক-দুই বছরেও ব্যবসায় সফলতা না পায়, তাহলে সেই মিডিয়ার তো থাকার দরকার নেই। তাকে আমি ধরব: কেন তোমরা ব্যবসা সফল না? যেমন ঢাকায় এখন প্রায় এক হাজারের বেশি দৈনিক পত্রিকা আছে, এবং সারাদেশে তিন হাজারের বেশি দৈনিক পত্রিকা। এর মধ্যে এক-দুটি বাদে কোনোটি ব্যবসায় সফল না। তাহলে তারা চলে কীভাবে? এই প্রশ্ন তো উত্থাপন করা উচিত। আর সেই প্রশ্ন উত্থাপনের জন্য আমাদের যে প্রেস কাউন্সিল ছিল, সেটি একদমই অকেজো।
রিপোর্টে যেমন মিডিয়া ইনস্টিটিউটের একটি প্রস্তাব করা হয়েছে, মিডিয়া ইনস্টিটিউটে কী কী থাকবে, এবং তার আইনি ও পরামর্শ দেওয়ার জায়গাগুলো কী হবে, আমার ধারণা, সেগুলোও যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে মালিকানার সংকট, মালিকের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অন্যান্য ব্যবসা রক্ষার বাসনা, এই বিষয়গুলো কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। আমরা তো দেখতেই পাচ্ছি। একটি উদাহরণ দিই, ১৯৯৮ সালে সাবের হোসেন চৌধুরীর ‘ভোরের কাগজ’-এর সম্পাদক হন মতিউর রহমান। সাবের হোসেন চৌধুরী তখন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। পরে মতিউর রহমানের সঙ্গে তার ঝগড়া লাগে। মতিউর রহমান অনেকটা এইভাবে বলেন যে, ‘আপনার মিডিয়াতে আমি সম্পাদকীয় স্বাধীনতা পাচ্ছি না। ফলে আপনার পত্রিকায় আমি কাজ করব না, আমি অন্য পত্রিকা করব।’ এরপর তারা ট্রান্সকম গ্রুপের হয়ে ‘প্রথম আলো’র জন্য আবেদন করে। রেজিস্ট্রেশনও পায়। এবং তারা সরকারের সমালোচনা করেই যাত্রা শুরু করে। কিন্তু আপনি দেখবেন, পরে কিন্তু এরকম মালিকানা আর দেওয়া হয়নি। ২০০৯ সালের পর থেকে স্পষ্টভাবে আর কোনো মালিকানা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে দেওয়া হয়নি। মালিকানা দেওয়া হয়েছে সেই সব ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকেই, যারা সরকারকে সেবা দেবে।
রিপোর্টে (গণমাধ্যম কমিশন) এই প্রসঙ্গে কিছু উদ্ধৃতি আছে। আওয়ামী আমলে টিভির লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য আঙ্গিকারনামায় বলা হয়েছে, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের জন্য একটি টেলিভিশন দরকার।’ ‘আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন করতে চাই, আমার একটি টেলিভিশন দরকার।’ এসব তথ্য ‘গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে (২০২৫) উঠে এসেছে। এবং এসব টেলিভিশন মালিকানা পাওয়ার জন্য এরকম অদ্ভুত যুক্তি দেয়া হলেও তা নিয়ে কোনো ধরনের বিতর্ক হয়নি, কোনো আলোচনা হয়নি, তর্কবিতর্কও হয়নি। খুবই স্বেচ্ছাচারীভাবে নিজের লোকদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এই লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়াটা খুব drastically কমিয়ে আনা দরকার। যেমন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমি যদি ফিজিবিলিটি বিশ্লেষণ করি, ঢাকা শহরে ৩৫-৪০টি টেলিভিশন কি আদৌ চলতে পারে? আমি পৃথিবীর কোথাও এতগুলো মিডিয়া দেখি না। এমনকি ভারতেও না। কলকাতাতেও এতগুলো মিডিয়া পাবেন না। অন্য কোনো শহরেও না, এমনকি দিল্লিতেও না। তাহলে বাংলাদেশে এই মিডিয়ার প্রাদুর্ভাব কেন হলো, এটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। এবং রিপোর্টে কিছু পরামর্শ আছে, যেগুলো অন্তত মিডিয়াকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে নিয়ে আসতে পারে। এইটুকুই আশার কথা।
মীর হুযাইফা আল মামদূহ: মিডিয়ার মালিকানায় নির্দিষ্ট ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে যে নিয়ন্ত্রণ চলে যায়, সেটা প্রতিহত করার কোনো দিক-নির্দেশনা কমিশনের রিপোর্টে আছে বলে আপনি মনে করেন কি? এবং থাকলে সেগুলো বাস্তবায়নযোগ্য কি না?
অধ্যাপক আ-আল মামুন: আমরা দেখি যে, ইউরোপ বা আমেরিকাতেও এটা খুব একটা বাস্তবায়নযোগ্য ছিল না। যেটা বলা যায়, সেটা হল ‘চেইন ওনারশিপ’। আমরা বলি যে, মিডিয়া ব্যবসা অন্য ব্যবসার চেয়ে আলাদা। আমরা তো মালিকানার ক্ষেত্রে অনুসরণ করেছি আমেরিকান মডেল। আমেরিকাতেও দেখবেন একই ঘটনা ঘটেছে, এটা ঘটেছে পঞ্চাশের দশকের পর থেকে। তার আগে তেমন দৃষ্টান্ত নেই। তারপর থেকে দেখা যায়, একই মালিকানার অধীনে, একই করপোরেট হাউসের অধীনে টেলিভিশন, পত্রিকা, রেডিও, সিনেমা, এইচবিও; এমনকি অস্ত্র ব্যবসা থেকে শুরু করে নানা রকম ব্যবসা একসাথে চলছে। মানে, এটা তাদের জন্য একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং পাশাপাশি এর রাজনৈতিক ব্যবহারও ছিল।
বাংলাদেশে যে প্রস্তাবটা করা হচ্ছে, সেটা বাস্তবায়ন করা কঠিন। কিন্তু যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে আমাদের জনসংখ্যা, আমাদের শিক্ষা, সবকিছু বিচার করে আমাদের মিডিয়া রিয়েলিটি তৈরি করতে হবে। আমার কাছে মনে হয়, এটা বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু যদি করা যায়, তাহলে মালিকানার এই প্রশ্নটা সেটেল করা সম্ভব। সেটা এমন হতে পারে যে, একজন একটির বেশি মিডিয়ার মালিক হতে পারবে না। এবং তাকে এই শর্তগুলো পূরণ করতে হবে, ব্যবসায় সফল হতে হবে, নিয়মিত সাংবাদিকদের বেতন দিতে হবে, বেতনের একটি নির্দিষ্ট কাঠামো মেনে চলতে হবে। যদি এই শর্তগুলো পূরণ করে, তাহলে একজন মিডিয়ার মালিক হতে পারবে। তখন দেখা যাবে, যার কাছে শুধু ব্যবসার চিন্তা আছে, সে আর মিডিয়া করতে আসবে না। যদি এই সরকার বা কোনো রাজনৈতিক সরকার শক্তভাবে অবস্থান নিতে পারে, তাহলে একটা রূপান্তর ঘটবে। কিন্তু আমাদের যে আশঙ্কার জায়গা, সেটা হলো, বাংলাদেশের কোনো সরকারেরই তো কখনো সততা ছিল না, এবং ভবিষ্যতেও যে সেই সততা থাকবে, তা আমরা আশা করতে পারি না।
মীর হুযাইফা আল মামদূহ: আমাদের যে মিডিয়াগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়, সেগুলোর প্রতিষ্ঠা কি সত্যিই সাংবাদিকতা করার উদ্দেশ্যে হয়? এর পেছনে তো নানা রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক কারণ কাজ করে। মিডিয়ার এই রাজনৈতিক অর্থনীতি কি কমিশন বিবেচনা করেছে বলে আপনার মনে হয়?
অধ্যাপক আ-আল মামুন: সেটা হয়তো এখানে ধরার সুযোগও ছিল না। মিডিয়ার যে রাজনৈতিক অর্থনীতি, তার যে পরিবর্তন ঘটেছে, ৫০ বছর আগের মিডিয়ার রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং আজকের মিডিয়ার রাজনৈতিক অর্থনীতির মধ্যে আকাশ–পাতাল পার্থক্য। কিন্তু সেই পার্থক্যের সব দিক এখানে আলোচিত হয়েছে, তা আমি দেখি না। মিডিয়া কীভাবে চলে এবং কেন চলে, এই প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে অন্তত টেলিভিশনের ক্ষেত্রে বলা যায়, ব্যবসার উদ্দেশ্যে কেউ টেলিভিশন খুলে না। সবাই খোলে ভ্যাট–ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য, অথবা বিভিন্ন রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য। আমার ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর যে দ্বন্দ্ব, সেটাও মেটানোর একটি উপায় হয়ে দাঁড়ায় মিডিয়া।
যখন যমুনা গ্রুপের বিরুদ্ধে বসুন্ধরা রিপোর্ট করে, বা প্রথম আলো বসুন্ধরার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করে, তার ভেতরেও একটা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য কাজ করে। এই বিষয়গুলো সব বিস্তারিতভাবে বিবেচনা করা হয়েছে, তা নয়। তবুও রিপোর্টে কিছু প্রতিফলন আছে, আমাদের মিডিয়ার অর্থনীতি কীভাবে বদলেছে, তার কিছু ইঙ্গিত সেখানে এসেছে। তবে সেগুলো একটু ছড়ানো–ছিটানোভাবে এসেছে। আর নতুন মিডিয়ার (নিউ মিডিয়া) অর্থনীতি এখানে খুব বেশি উল্লেখ করা হয়নি, এবং সেটার ওপর বিশেষ কোনো ফোকাসও নেই।
মীর হুযাইফা আল মামদূহ: নিউ মিডিয়ার অর্থনীতির কথা আপনি বললেন। আমাদের মিডিয়ায় তো দেশের ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার পর একটি নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। প্রতিটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠানই সামাজিক গণমাধ্যমে প্রবেশ করেছে। ফেসবুকে তাদের বড় ধরনের কার্যক্রম আছে, ইউটিউবে নিজস্ব চ্যানেল আছে, কেউ কেউ টিকটকের মাধ্যমেও ব্যবসা করছে। এগুলো এখন তাদের আয়ের বড় একটি অংশ। যেমন, আমি যদি সময় টিভির কথা বলি, টিভি থেকে যে আয় হয়, ইউটিউব থেকে তার তিন-চার গুণ বেশি আয় হয় বলে শুনেছি। কিন্তু কমিশনের প্রতিবেদনে গণমাধ্যমের ঐতিহাসিক পরিক্রমায় দেখলাম, নিউ মিডিয়ার প্রসঙ্গ আনাই হয়নি।
অধ্যাপক আ-আল মামুন: এখানে কয়েকটা প্রসঙ্গ এসেছে। নিউ মিডিয়া আসার ফলে ট্র্যাডিশনাল মিডিয়া কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে সেই বিষয়টিকে ঘিরেই প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হয়েছে। প্রতিবেদনে একটা জায়গায় কেবল একটি উল্লেখ দেখা যায়, যেখানে বলা হয়েছে এখন নিউ মিডিয়া থেকে কী ধরনের আয় হচ্ছে। সেটা আমেরিকার কোনো একটি প্রতিবেদন, সম্ভবত ফ্রিডম হাউজ বা অন্য কারও। ২০২১ সালের একটি রিপোর্টে দেখানো হয়েছে কীভাবে বিজ্ঞাপনগুলো মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় না গিয়ে নিউ মিডিয়ার দিকে চলে যাচ্ছে।
শুধু এইটুকু বিশ্লেষণ করলেই যথেষ্ট হয় না। কারণ, ট্র্যাডিশনাল মিডিয়া এখন আর সেই জায়গায় নেই; সেই অডিয়েন্সও তার আর নেই। ট্র্যাডিশনাল মিডিয়ার যে পাঠক ছিল, সেই পাঠক এখন আর নেই। ট্র্যাডিশনাল টেলিভিশনের যে দর্শক ছিল, সেই দর্শকও আর নেই। ফলে, এখন নিউ মিডিয়ার জায়গা, এবং তার সঙ্গে ট্র্যাডিশনাল মিডিয়া কীভাবে সহাবস্থান করছে, প্রিন্ট মিডিয়া কীভাবে কো-অপ্ট করছে, তা কিভাবে তাদের নিউজের কাঠামো বদলে দিচ্ছে, যা আবার পপুলিজমকে উসকে দিচ্ছে- এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবনাচিন্তার অবকাশ আছে! যেমন ধরুন, ক্লিকবেইট। আপনি অনুমান করুন, আজ থেকে ৩০ বছর আগে আমরা যখন শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন গাবতলীতে বাসে উঠতে যাচ্ছি, হকার চিৎকার করছে, ‘খালেদা আবার মা হচ্ছেন’ কিংবা ‘হাসিনা পালিয়ে গেছেন’। তখনই মাথায় আসে, খালেদা জিয়া তো প্রধানমন্ত্রী, কী হলো! বা হাসিনার কী হলো! অর্থাৎ, এটাই ক্লিকবেইট।
আমি কোভিডের সময় ক্লিকবেইট নিয়ে একটি গবেষণা করাচ্ছিলাম। সেখানে দেখা গেছে, জাগো নিউজ সবচেয়ে বেশি ক্লিকবেইট ব্যবহার করে। তবে প্রথম আলো ব্যবহার করে না, তা নয়, তারাও পর্যাপ্ত ব্যবহার করে। ডেইলি স্টারও করে। সবাই করে, কারণ এটা তাদের ব্যবসায়িক প্রয়োজন। এমনকি একটি উদাহরণ দিতে পারি, যমুনা টিভির একটি কন্টেন্ট সর্বোচ্চ ভিউ পেয়েছিল। সেটাই ছিল তাদের সবচেয়ে বেশি দেখা কন্টেন্ট। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এক সপ্তাহের মধ্যে তারা জেনে যায় এটা ভুয়া। তবুও তারা সেই ভুয়া কন্টেন্ট সরায়নি। কেন সরায়নি, সেটা সহজেই বোঝা যায়, এই যে ক্লিকবেইট, এবং তার যে মুনাফা, সেটার সঙ্গেই তো তাদের টিআরপির হিসাব মেলে। ফলে তারা কন্টেন্টটি রেখে দিয়েছে।
এই যে নতুন মিডিয়ার বাস্তবতা, তার মধ্যে ক্লিকবেইট ও অন্যান্য সংবেদনশীল উপাদান (সেন্সেশনাল এলিমেন্ট) ক্রমশ প্রবল হচ্ছে। ধরুন, একাত্তর টিভি একটি টক শো করবে, তারপর দেখা যাবে তাদের ইউটিউব পেজে সেই টক শোর পাঁচটি আকর্ষণীয় শিরোনাম ও থাম্বনেইলসহ পাঁচটি সেগমেন্ট আলাদা করে প্রকাশ করছে। সেটাই এখন তাদের ব্যবসা, সেটাই তাদের টেলিভিশন প্র্যাকটিস। সেই কারণেই তারা টক শোতে এই ধরনের আলোচনা হাজির করে। ফলে, এই নতুন মিডিয়া ইকোলজি নিয়ে আলোচনা রিপোর্টে আসা দরকার ছিল। একটা মিডিয়া ইকোলজি ছিল নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত, চাইলে একে ২০০৭–০৮ পর্যন্ত ধরা যায়। কিন্তু যখন আমাদের ইন্টারনেটের গতি বেড়েছে, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো আসতে শুরু করেছে, আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজির হচ্ছি এবং নানা ধরনের লিংক ও সংযোগ তৈরি হচ্ছে, তখন এই মিডিয়া ইকোলজিটাই বদলে গেছে।
আমার ধারণা, এই নিউ মিডিয়ার উপস্থিতির কারণে গড়ে ওঠা নতুন মিডিয়া ইকোলজি, এই পুরো ধারণাটাই রিপোর্টের মধ্যে অনুপস্থিত।
মীর হুযাইফা আল মামদূহ: তবে প্রতিবেদনে মিস ইনফরমেশন, ডিস-ইনফরমেশন প্রতিরোধ এবং ফ্যাক্ট চেকিংয়ের বিষয়টির উল্লেখ আছে।
অধ্যাপক আ-আল মামুন: হ্যাঁ, ভুয়া তথ্য বা ভুল ইনফরমেশন প্রসঙ্গে এখানে কয়েকটি বিষয় এসেছে। সেখানে একটি রেফারেন্সও আছে। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে ২০১৬ সালে কীভাবে “ফেক নিউজ” শব্দটি যুক্ত হলো, সেটা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু, ফেক নিউজ ধারণাটাই দাঁড়িয়ে আছে যেন এক ফেক নিউজের উপরে! ফেক নিউজ কেবল ২০১৬ সালের ঘটনা না; ১৬ শতক থেকেই এর উপস্থিতি দেখা যায়। ষোল শতক থেকে কিভাবে আমরা ২০১৬ সালের ফেক নিউজ বাস্তবতায় এসে দাঁড়ালাম তার একটা নুয়ান্সড ক্রিটিক করা যায়। এসব প্রসঙ্গ আরও ক্রিটিক্যালি দেখা দরকার ছিল বলে আমার মনে হয়! কিন্তু এই যে ফ্যাক্ট চেকের প্রসঙ্গ, রিপোর্টে একটি প্রস্তাব আছে যে, সকল মিডিয়া হাউজকে ফ্যাক্ট চেক করতে হবে।
এখানে আমার একটা সমালোচনামূলক প্রশ্ন থাকে, মিডিয়াগুলো আসলে কেন ফ্যাক্ট চেক করে? মানে, লিবারেল মিডিয়া টিকিয়ে রাখা কেন প্রয়োজন? লিবারেল বা ট্র্যাডিশনাল মিডিয়াকে কেন টিকিয়ে রাখতে হবে? কারণ, আমাদের যে ঐতিহ্যগত ক্ষমতার কাঠামো (ট্র্যাডিশনাল পাওয়ার স্ট্রাকচার), সেটার সঙ্গে লিবারেল আদর্শ (আইডিওলজি) মিলে যায়। ফলে, ফ্যাক্ট চেক তাদের দরকার হয় এই উদ্দেশ্যে। এর মানে এই নয় যে, জনগণের বড় উপকারের জন্য ফ্যাক্ট চেক করা হচ্ছে।
রিপোর্টের অনুমানগুলো এমনভাবে এসেছে যেন, ফ্যাক্ট চেক করা দরকার কারণ মানুষ ভুল তথ্য পাচ্ছে, কিন্তু বিষয়টা তা না। আসল ব্যাপার হলো, পুরো ইন্ডাস্ট্রিটাই প্রো-পিপল নয়। মানে, মিডিয়া যতই আমাদের তথ্য দিক না কেন, আমরা যত বড় বড় কথা বলি না কেন, দেখা যায় যে একদম শুরু থেকেই, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশনের পর থেকে, যখন মিডিয়া আসতে শুরু করল, পেনি প্রেস থেকে যদি বলি, তার আগের সময়েও, মিডিয়া কখনোই ব্যবসার বাইরে যায়নি, কোনো রাজনৈতিক কৌশল বা প্রভাবের বাইরে যায়নি। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো অস্ট্রেলিয়ান রুপার্ট মারডকের সিএনএনসহ অন্যান্য টেলিভিশন নেটওয়ার্ক, যার বিশাল সাম্রাজ্যের পেছনে ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট। এই আলোচনাগুলো রিপোর্টে খুব বিস্তারিতভাবে নেই। এবং নতুন মিডিয়ার ইকোলজিও বিস্তারিতভাবে নেই, আমি বলব, একদমই নেই।
মীর হুযাইফা আল মামদূহ: মিডিয়া ফ্রিডম নিয়ে যে সকল ডোনার-ফান্ডেড প্রকল্প আছে সেখানে ফ্যাক্ট চেকিংকে বেশ প্রাধান্য দেয়া হয়। ভুয়া তথ্য বা সংবাদ উৎপাদন ও প্রবাহের যে রাজনীতি আছে সেটা এসব প্রকল্পে আমলে নেয় না। ফ্যাক্টচেকিং প্রসঙ্গে কমিশনের সুপারিশ এই এনজিওয়াইজড ডিসকোর্স প্রভাবিত মনে করেন কি?
অধ্যাপক আ-আল মামুন: হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, এনজিওবাদী চিন্তাভাবনার প্রভাব স্পষ্টই দেখা যায়। এও বলা দরকার, ভুয়া তথ্য বা সংবাদ উৎপাদন কেবল এসময়ের দক্ষিণপন্থী ও স্বৈরাচারী রাজনৈতিক তৎপরতার অংশ না, কেবল পপুলিস্ট আবেগীয় রাজনীতির হাতিয়ার না, বরং ক্রিস্টিন ফুক্সস বর্ণিত ‘ডিজিটাল ক্যাপিটালিজম’ (২০২২) পরিগঠনেরও এক বড় উপাদান বলে আমার মনে হয়। বুইং চুল-হান তাঁর সাইকোপলিটিক্স (২০১৪) গ্রন্থে দাবি করেছেন, আমরা ফুকো বর্ণিত ‘বায়োপলিটিক্যাল’ মডেল থেকে ‘সাইকোপলিটিক্যাল’ মডেলের সমাজে উন্নীত হয়েছি, সমাজ পরিগঠন এখন এই মডেলেই হচ্ছে। এই বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখা দরকার ছিল বলে আমার মনে হয়। আরেকটা বিষয় বলা দরকার- সাইবার বুলিং, ফেক নিউজ ছড়ানো- এগুলো যে গতিতে ছড়ায় ও মানুষকে আবেগমথিত, রাগান্বিত বা পারসেপশন গঠনে ভূমিকা রাখে কয়েক মুহুর্তের সুযোগেই, ফ্যাক্ট চেকিং কিন্তু তার শত ভাগের একভাগ গতিতেও মানুষের কাছে পৌঁছায় না! ফলে যে পদ্ধতিতে ফ্যাক্টচেক করা হচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
মীর হুযাইফা আল মামদূহ: আমাদের মিডিয়াতে কনটেন্টেরও বিবর্তন ঘটছে নানাভাবে। আগে টেলিভিশনের একটি নির্দিষ্ট সময়ের নিউজ বুলেটিন, ধরা যাক ১০ বা ১৫ মিনিটের পুরো অংশটিকেই আমরা একটি কনটেন্ট হিসেবে ভাবতাম। পুরো পত্রিকাকেও একসময় একটি কনটেন্ট হিসেবে দেখা হতো। অর্থাৎ, আগে সংবাদমাধ্যমের মূল পণ্য ছিল ‘পুরো নিউজ প্রোগ্রাম’ বা ‘পুরো পত্রিকা’। আলাদা কোনো সংবাদ বা ভিডিও তখন মূল্য রাখত না। এখন তো আর সেটা নেই। এখন একটি আলাদা নিউজও নিজেই একটি কনটেন্ট হয়ে উঠছে, এবং সেটি দিয়েই আয় করা হচ্ছে। ডিজিটাল মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এখন একটি ভিডিও ক্লিপ, একটি সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট বা এমনকি একটি ফেসবুক পোস্টও ‘কনটেন্ট’ হিসেবে গণ্য হয়। প্রতিটি কনটেন্ট আলাদাভাবে দর্শক টানে, ভিউ আনে, আয় করে। দেখা যাচ্ছে, বিনোদন বিভাগের একজন সাংবাদিক একটি নিউজ দিয়ে মিলিয়ন ভিউ এনে দিচ্ছেন, এবং তাকে সেইভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। মানে, সাংবাদিকের মর্যাদা এখন আর শুধু তাঁর লেখার গুণে নয়, বরং তার কনটেন্ট কতবার দেখা হয়েছে বা শেয়ার হয়েছে, সেটার ওপরেও নির্ভর করছে। এই কনটেন্টের বদল বা রূপান্তরটিও গণমাধ্যম কমিশনের মনোযোগের বাইরে থেকে গিয়েছে।
অধ্যাপক আ-আল মামুন: এখানেই বড় রকমের একটি ফাঁক থেকে গেছে। কনটেন্টের যে রূপান্তর (ট্রান্সফরমেশন) ঘটছে, এবং এর ফলে আমরা যে একটি ভালো ইন্ডাস্ট্রি পাব, এই আকাঙ্ক্ষাগুলো হয়তো বাস্তবায়িত হবে না। এই বাস্তবতা অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রেও সত্য।
আমি সম্প্রতি একটি বই পড়ছিলাম, নিক ডেভিসের ফ্ল্যাট আর্থ নিউজ, এটি ২০০৮ সালে প্রকাশিত। (নিক ডেভিস একজন ব্রিটিশ অনুসন্ধানী সাংবাদিক, যিনি এই বইয়ে দেখিয়েছেন—কীভাবে বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের খবরগুলো ক্রমে কর্পোরেট পিআর এজেন্সি ও কয়েকটি বড় সংবাদসংস্থার নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে।) সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে কয়েকটি পিআর এজেন্সি এবং কিছু নিউজ এজেন্সি মিলেই সব নিউজ নিয়ন্ত্রণ করছে। শুধু ইংল্যান্ডেই নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও, এমনকি আমেরিকাতেও। একটি পিআর কনটেন্ট তৈরি করা হলো, সেটা দেওয়া হলো রয়টার্সকে, এখন রয়টার্স তো সেটি সবার কাছে পাঠাবে, ফলে সেই খবর সর্বত্র প্রচারিত হবে। (অর্থাৎ, অনেক সময় সংবাদ আর স্বাধীন অনুসন্ধান নয়—বরং কর্পোরেট বা সরকারি স্বার্থে তৈরি পিআর তথ্যই বিশ্বব্যাপী ‘খবর’ হিসেবে ছড়িয়ে যায়।)
এই যে রূপান্তরটা ঘটেছে ২০০৭–০৮ সালের পর থেকে, এর আগেও নোম চমস্কি কাজ করেছেন, ১৯৯৮ সালে। (চমস্কি ও এডওয়ার্ড হারম্যান তাঁদের বিখ্যাত বই Manufacturing Consent-এ দেখিয়েছিলেন, সংবাদ কীভাবে ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হয়ে ওঠে) কিন্তু সেই সময়ে এই বাস্তবতা এতটা প্রকট ছিল না। যখন নিক ডেভিস বইটি লিখেছেন, তারপরেও ইংল্যান্ডের বাস্তবতা বদলে গেছে, আর বাংলাদেশের তো বটেই। এই বাস্তবতাটা আসলে আমাদের কমিশনের রিপোর্টে খুব বিস্তারিতভাবে আসেনি। ফলে, এখনকার মিডিয়া কোন বাস্তবতায় আছে, সেটি আমরা বুঝতে পারব না। মনে হবে, আমাদের মিডিয়া খুব খারাপ জায়গায় চলে গিয়েছিল, আর এই কাজগুলো করলে ভালো জায়গায় চলে আসবে, এমন একটি আকাঙ্ক্ষা রিপোর্টে দেখা যায়। অর্থাৎ, কমিশনের রিপোর্টে মিডিয়ার নৈতিক বা কাঠামোগত সংস্কারের কথা থাকলেও, বৈশ্বিক ডিজিটাল ইকোনমির প্রভাব, কনটেন্ট মনিটাইজেশন, অ্যালগরিদম-নির্ভর সাংবাদিকতার মতো জটিল বাস্তবতাগুলো অনুপস্থিত।
মীর হুযাইফা আল মামদূহ: আওয়ামী আমলে সাংবাদিকরা নানা ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ছিলো। আইনে হয়রানি থেকে শুরু করে শারীরিক নির্যাতন, জেল-জুলুম কিছুই বাদ যায়নি। সঙ্গতকারণেই কমিশন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছেন এবং সাংবাদিক সুরক্ষা আইনের একটা খসড়া তৈরী করা হয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু সাংবাদিকদের দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গকে তেমন জোরারোপ করা হয় নাই, প্রেস কাউন্সিলকে পুনর্গঠন করার কথা বলা হয়েছে। এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
অধ্যাপক আ-আল মামুন: আপনার পর্যবেক্ষণের সাথে আমি একমত। সাংবাদিকের দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গটি অনুপস্থিত। শুধু একটি বিষয় আছে, যদি সেটাকে দায়বদ্ধতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে চান, সেটা হলো, মিডিয়া হাউজগুলো একটি নির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতার মানুষকে চাকরি দেবে। আমি মনে করি, এটা আসলে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে না। কারণ, শিক্ষিত মানুষরাই আমাদের মিডিয়ায় বেশি চাকরি করে, এবং তারাই কিন্তু সবচেয়ে বেশি অন্যায় কাজগুলো করেছে, আমাদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা তাই বলে।
ফলে, ‘শিক্ষিত, ডিগ্রিধারী মানুষই চাকরি পাবে’, এই কথা না বলে বলা উচিত ছিল, সাংবাদিক হওয়ার উপযুক্ততা যাচাইয়ের জন্য একটি পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা দরকার। সাংবাদিকের অবশ্যই রাজনৈতিক মতামতের স্বাধীনতা থাকবে। আমি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করতে পারি, কিংবা একটি নির্দিষ্ট ধরনের ব্যবসায় বিশ্বাস করতে পারি, যা মানুষের ভালো করে বলে মনে করি, বা একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় ধারণায় বিশ্বাস করতে পারি। কিন্তু যখন এসব প্রতিফলিত হয় নিউজ কনটেন্টের ভেতরে, এবং মিডিয়া হাউজ সেগুলোকে অনুমোদন দেয়, সেগুলো বিপজ্জনক। দায়বদ্ধতার জায়গাটা এখানে খুব স্পষ্ট নয়। একটা ভারসাম্যমূলক প্রতিবেদন কীভাবে করতে হয়, এমনকি সার্ফেস রিপর্টিংয়েও কোন কোন এংগেল থাকা দরকার, তথ্য যাচাই করা- এগুলোর ঘাটতি প্রায় প্রতিটা সংবাদমাধ্যমেই দেখা যাচ্ছে। সামজিক মাধ্যমের একটা পোস্টকেই অনেক সময় নিউজ হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে, এমনকি পোস্টদাতার অনুমতি না নিয়েই। অনেক সময়, গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে ব্যাক্তিগত ফোনকল ইন্টারসেপ্ট করে মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে- যা কোনভাবেই সাংবাদিকতা হিসেবে গণ্য হতে পারে না! কিন্তু মিডিয়াকর্মীদের অধিকাংশের নিউজের এই ‘সেন্স অব হাইজিন’ সম্পর্কে কোন ধারণা নাই। সম্প্রতি একজন সম্পাদক আমাকে বলছিলেন- বাংলাদেশে এখন যদি কেউ একজন খুব উঁচু মানের একটা দৈনিক পত্রিকা করতেও চায়, পর্যাপ্ত দক্ষ সাংবাদিক খুঁজে পাবেন না! এই দিকগুলো গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে গুরুত্ব পেতে পারতো।
মিডিয়া কমিশনের প্রস্তাবগুলো দেখে অনুমান করা যায়, ভবিষ্যতে কিছু নতুন বিধি-বিধান তৈরি হতে পারে, যেগুলোর মাধ্যমে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার চেষ্টা হবে। প্রশিক্ষণের কথাও কিছু বলা হয়েছে। তবে প্রশিক্ষণের পরিধি অত্যন্ত সীমিত, সেটি বাড়ানো দরকার। আমার মনে হয়, ইনটেনসিভ ট্রেনিংয়ের দিকেই যাওয়া উচিত। যে কেউ মিডিয়া হাউজে যোগ দিতে চাইলে, তাকে একটি ইনটেনসিভ ট্রেনিংয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। এমন একটি ইনস্টিটিউশনাল ব্যবস্থাও থাকা উচিত, যেখানে যারা সাংবাদিক হতে চায়, তারা পাশ করার পর প্রশিক্ষণ নেবে। সেই প্রশিক্ষণে যদি তারা যোগ্যতার সনদ (এলিজিবিলিটি সার্টিফিকেট) পায়, তবে কোনো মিডিয়া হাউজ তাদের নিয়োগ দিতে পারবে। এভাবে করা গেলে হয়তো ভালো ফল পাওয়া যাবে।
পাকিস্তানের উদাহরণ দিলে দেখা যাবে, তাদের মিডিয়া অনেক বেশি কার্যকর (ভায়াবল)। সেখানে যারা মিডিয়া হাউজে কাজ করে, তারা খুব সচেতনভাবে কাজ করে। ভালো বেতন পায়, এবং তাদের অন্য কোনো দায় থাকে না। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, কোনো চিন্তা ছাড়াই অসংখ্য নিউজ পোর্টাল, সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেলের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যাকে লাইসেন্স দেওয়া হলো, তার সাংবাদিককে খাওয়াবে কে?
লোকাল করেসপন্ডেন্টদের শুধু একটি কার্ড দেওয়া হয়। দৈনিক পত্রিকায় আগে যেমন লাইনেজ দেওয়া হতো, এখনও হয়তো দেওয়া হয়, কিন্তু সেগুলোতে সাংবাদিকের চাহিদা মেটে না। এক অর্থে মিডিয়ার মালিকরা না বলেও বলে দেয়, ‘তুমি একটি কার্ড পেয়েছো, এখন যাও, যেমনভাবে পারো করেকম্মে খাও।’ এটা হতে দেওয়া ঠিক নয়। এখানেই আমার ধারণা, কিছু সুরক্ষা ব্যবস্থা ( সেফগার্ড ) খুব দরকার। এটা একধাপের বিষয় নয়। প্রথমত, মালিকানার প্রশ্ন, দ্বিতীয়ত বিজ্ঞাপনের প্রশ্ন, যেভাবে অনিয়মিতভাবে বিজ্ঞাপন বণ্টন করা হয় বা সরকার ও বিভিন্ন গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, এইগুলো যদি পরিবর্তন করা যায়, এবং নিয়মিতভাবে গুণগত মান যাচাই (কোয়ালিটি চেক) করা যায়, তাহলে একটি দায়বদ্ধতার কাঠামো তৈরি হতে পারে।
নইলে আমরা সাংবাদিকের কাছ থেকে দায়বদ্ধতা আশা করতে পারি না। কারণ, প্রকৃত অর্থে সে সাংবাদিক হওয়ার উপযুক্তই নয়। আর সেই অনুপযুক্ত মানুষকেই মিডিয়াতে নিয়োগ দেওয়া হয়। আপনি দেখবেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে মিডিয়ার মালিকানা কীভাবে রূপান্তরিত হলো, এবং কারা কারা মিডিয়াতে গুরুত্বপূর্ণ পদে গেল। বিষয়টি মনোযোগের দাবিদার। আগে প্রবণতা ছিল, আমি পেশাদার সাংবাদিক, আমি সাংবাদিক নেতাও, তাহলে আমি একটি পত্রিকার সম্পাদক হতে পারি। কিন্তু এখন যা ঘটছে, পেশাদার সাংবাদিকরা খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যাচ্ছেন না। বরং যাচ্ছেন সাংবাদিক নেতারা, জামায়াত ও বিএনপির নেতারা, যাদের সাংবাদিকতা সম্পর্কে বিশেষ কোনো জ্ঞান নেই, এবং যারা সাংবাদিকতা থেকে অনেক বছর ধরেই বিচ্ছিন্ন। এই লোকগুলোর এখন সম্পাদক, সিএনই ইত্যাদি হওয়া আমার কাছে খুব বিপজ্জনক প্রবণতা বলে মনে হয়।
মীর হুযাইফা আল মামদূহ: পতিত সরকারের অনুগত সাংবাদিকগণ যারা নানাভাবে আওয়ামী বয়ান তৈরি করার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসন এবং নিপীড়নকে বৈধতা দিয়েছে, তাদের রিকনসিলেয়েশনের বিষয়টিও কমিশনের আলোচ্য ছিলো না। এই বিষয়ে আপনার মতামত কি?
অধ্যাপক আ-আল মামুন: এটা তো শুধু মিডিয়ার ক্ষেত্রে নয়; এটা সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পুরো সমাজেকেই একটি রিকনসিলিয়েশন প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আগে যে কেউ সরকারের বিরোধিতা করলে জামায়াত বা রাজাকার বলা হতো। এখন শাহবাগী, নাস্তিক বা ফ্যাসিবাদের দোসর, এসব ট্যাগ দেয়া হচ্ছে। এবং এসব বলে, আমি জানি যে, অনেক পেশাদার সাংবাদিক, যারা আগের আমলেও কোনো সুবিধা নেয়নি, তাদের বিপদে ফেলা হয়েছে। আগস্টের পরের সময়েও এরকম অনেক উদাহরণ আছে। ফলে, মিডিয়ার মধ্যে যে রিকনসিলিয়েশন দরকার ছিল, সেটা হয়নি। অন্যান্য ক্ষেত্রেও হয়নি।
আমার মনে হয় কমিশনের রিপোর্টে এই প্রসঙ্গটি থাকলে ভালো হতো। যেহেতু আমরা একটি ফ্যাসিস্ট বাস্তবতার মধ্যে দীর্ঘ সময় ছিলাম, তাই রিকনসিলিয়েশন একটি জরুরি প্রশ্ন। সাংবাদিকতার এই দিকগুলো দেখা ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়ার বিষয়টি রিপোর্টে উল্লেখ করা উচিত ছিল। কমিশন এক বছর ধরে রিপোর্ট প্রণয়নের কাজে লিপ্ত ছিল, তবু রিকনসিলিয়েশন না হওয়ার অভিজ্ঞতা এবং সেক্ষেত্রে পেশাদার সাংবাদিকরা কীভাবে বিপদে পড়ছে, কিংবা পার্টিজান সাংবাদিকদের কীভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, এসব পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। পার্টিজান তো থাকতে পারে; অনেকেই আছেন। কিন্তু অনকেই তো অপরাধী নয়। তাদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তলব বা জব্দ করা, এসব ঘটনা ঘটেছে। ফলে এগুলো প্রতিকারের সুপারিশ থাকতে পারতো।
উদাহরণ স্বরূপ, প্রেসক্লাবের সদস্যপদ প্রক্রিয়া দেখুন, সদস্যপদ বন্ধ ছিল, পরে বাতিল করা হলো। তখন দেখা গেল ছাত্র-রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কিছু লোকেরও এক্রিডিয়েশন কার্ড ছিল; যারা মন্ত্রিপরিষদে দালালি করত, তাদের কার্ড অবশ্যই বাতিল হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাতিলের প্রক্রিয়ায় অনেক পেশাদার সাংবাদিকও ভোগান্তিতে পড়েছেন, তাদের বাতিল হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। এসব ঘটনা তো হরেদরে ঘটেছে। রিকনসিলিয়েশনের বদলে আমরা প্রতিশোধকে বেছে নিয়েছি। পূর্বেও প্রতিশোধের প্রক্রিয়া ছিল; এখন সেটি আরও জঘন্য রূপে ঘনীভূত হয়েছে। এটা একটি চক্র, আর এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।
মীর হুযাইফা আল মামদূহ: আপনাকে সময় দেবার জন্য ধন্যবাদ।
অধ্যাপক আ-আল মামুন: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ, আর শুভকামনা হুযাইফা!
মীর হুযাইফা আল মামদূহ, দৃকের গবেষণা ও পাবলিক ক্যাম্পেইন বিভাগে গবেষক হিসেবে কর্মরত আছেন।