“বন্যার পানি ঠেলে এগোচ্ছেন এক নারী”, শহিদুল আলম, ১৯৮৮। শিল্পীর সৌজন্যে প্রাপ্ত।
“একটা পরিস্থিতি যত রঙহীন বিবর্ণ আর আতঙ্কজনকই হোক না কেন, তা আমাদের পুরোপুরি কব্জা করে ফেলতে পারে না। আমাদের সাড়া দেওয়ার স্বাধীনতা, আমাদের রুখে ওঠার ক্ষমতা তা কেড়ে নিতে পারে না,” লিখেছিলেন রাইডার ক্যারল। শহিদুল আলমের জীবনও এভাবেই এগিয়েছে। রাইটউড ৬৫৯ এ তাঁর শক্তিশালী কাজের প্রদর্শনী চলছে। শহিদুল আলমের জন্ম পূর্ব পাকিস্তানে, যা এখন বাংলাদেশ। আশির দশকে তিনি ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় নানা প্রতিবাদের দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করতে শুরু করেন, আর প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি ক্যামেরাকে কাজে লাগিয়েছেন আলো দূষণ, নিপীড়ন আর বাংলাদেশের মানুষের রুখে ওঠা তুলে ধরতে। সবসময়ই এক সঙ্কট থেকে আরেক সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে, পৃথিবীর এমন এক অংশে বসে শহিদুল আলম তাঁর ছবির যারা বিষয় তাদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন, সেইসঙ্গে তুলে ধরেন এ দেশে চলমান গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম এবং অসমতার মতো বিষয়গুলো।
“কারা ভ্যানে শিক্ষার্থী,” ১৯৯৬, শহিদুল আলম। শিল্পীর সৌজন্যে প্রাপ্ত।
নিখুঁতভাবে আয়োজিত এই প্রদর্শনীতে এমন কিছু ছবি আছে, দেখার পর থেকে যা আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। যেমন, ১৯৯৬ সালে তোলা “কারা ভ্যানে শিক্ষার্থী” ছবিটিতে গরাদ আর যেনতেনভাবে লাগানো লোহার তারের পেছনে একজন মানুষের মুখ কোনোমতে দেখা যায়। চিৎকার করার জন্য খোলা মুখে তার ক্ষোভ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। পশুর মতো তাকে খাঁচায় আটকে রাখার এই ছবি হৃদয়বিদারক। আরেকটা ছবিতে একজন নারী কোমরপানি ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছেন, পাশেই দেখা যাচ্ছে নৌকায় মানুষ নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে। ১৯৮৮ সালের বন্যা এক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা ছিলো, যার পরিণামে আড়াই কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়। এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিত্যকার ঘটনা, কিন্তু ক্ষমতাবানেরা এর বিষয়ে নীরব থেকে নিজেদের সুবিধামণ্ডিত জীবন যাপন করে যান। অন্যদিকে, গরিব লোকেদের নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরকেই দেখতে হয়।
“গামছা,” ২০১০, শহিদুল আলম। শিল্পীর সৌজন্যে প্রাপ্ত।
২০১৮ সালে টাইম ম্যাগাজিন পারসন অব দ্য ইয়ার ছিলেন শহিদুল আলম। তিনি তাঁর বিশ্বাসের জন্য, আর যেসব বিষয় বাংলাদেশকে পঙ্কিল করে তুলছে তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নিপীড়িত হয়েছেন। “রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সহিংসতায় প্ররোচনা দেওয়া” এবং “খুদেবার্তার মাধ্যমে গুজব এবং মিথ্যা তথ্য ছড়ানো”র অভিযোগে তিনি ১০৭ দিন কারাগারে কাটান। যে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যই একটা মাত্র জাতি রয়েছে এ ধরনের জাতীয় পরিচয় প্রদর্শন করা, শহিদুল আলম সেখানে যে অবিচার তিনি সচক্ষে দেখছেন তার বিষয়ে অন্ধ হয়ে থাকতে অস্বীকৃতি জানিয়ে অনন্য হয়ে ওঠেন। দেশের নেতারা যেসব পরিস্থিতিকে অগ্রাহ্য করতে চান বা লুকোতে চান, আলোকচিত্রের মধ্য দিয়ে সেসবকে সামনে নিয়ে আসেন তিনি। “ক্রসফায়ার” বিভাগের কাজগুলোতে দৃশ্যত সাদামাটা, কিন্তু তাড়া করে ফেরার মতো তিনটি ছবি আছে। “গামছা”, “মর্গ” এবং “দেয়ালে বুলেটের গর্ত” নামের এই ছবিগুলো স্পষ্টভাবে টালমাটাল পরিস্থিতির কথা ঘোষণা করে। এই ছবিগুলো যখন একটি বাংলাদেশি গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছিলো, সেখানে পুলিশ ঢুকে বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে চলতে থাকা প্রদর্শনীটি বন্ধ করে দেয়। ছবিতে প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন যে, ক্রসফায়ারের অস্তিত্ব কখনোই ছিলো না।
প্রদর্শনীর শিরোনামটা খোদ শহিদুল আলমের একটা কথা থেকেই নেওয়া। “সাংবাদিক হিসেবে আমাদেরকে আগুনের কাছে দাঁড়িয়ে তাপটা অনুভব করতে হয়, পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে হয়। এক পা পিছিয়ে আসলেই আপনি আর কাজ করতে পারবেন না। কাজেই উপায়টা হলো আঁচ লাগলেও পুড়ে না যাওয়া।” বাংলাদেশে যেসব আগুন জ্বলে, তার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে শহিদুল আলম পার করেছেন প্রায় অর্ধ শতক। তাঁর এবং তাঁর ছবির প্রভাব দেশের প্রতি তাঁর অনুরাগের মতোই বিপুল।
সুসান অরিনকো, ১ মে ২০২৩ তারিখে নিউ সিটি আর্টে প্রকাশিত
অনুবাদ: দীপান্বিতা কিংশুক ঋতি