শুক্রবার ১৫ই চৈত্র ১৪৩০ Friday 29th March 2024

শুক্রবার ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

Friday 29th March 2024

বহুস্বর মতামত

সীতাকুণ্ড বিস্ফোরণ: সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের শাস্তি হবে না কেন?

২০২২-০৬-০৭

ফিরোজ আহমেদ

 

১. চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে প্রায় অর্ধশত মানুষের হতাহত হওয়া কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা নয়, বরং একটা হত্যাকাণ্ড। এই বিষয়ে প্রায় সকলেই এখন একমত। কিন্তু গোল বাঁধে, অপরাধী কে বা কারা, সেটা নিয়ে।

 

টার্মিনালের মালিককে অনতিবিলম্বে গ্রেফতার করার দাবি করেছেন অনেকেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও ঘটনাস্থলে গিয়ে আশ্বাস দিয়েছেন, কারো গাফিলতি পাওয়া গেলে বিচার করা হবে। কিন্তু এই ডিপোটি যেভাবে একটি মৃত্যুকূপে পরিণত হলো, সেটা দেখভাল করার দায়িত্ব যাদের ছিল, তাদের গ্রেফতার কিংবা শাস্তির কথা সংশ্লিষ্ট কেউ বলছেন না। 

 

২. টার্মিনালে এই বিষ্ফোরণের মতই এইসব ঘটনা যখন আলাদা আলাদা ভাবে ঘটে, আমরা তখন ভবন মালিকের শাস্তি চাই, কারখানা মালিকের শাস্তি চাই, গুদাম মালিকের শাস্তি চাই। চুনোপুটি হলে কখনো কখনো তাদের শাস্তি হয়। কিন্তু তাজরিন গার্মেন্টসের মালিক কিংবা হাসেম ফুডসের মালিকের মত প্রভাবশালী হলে দৃশ্যত কোনো শাস্তি হয় না।

 

 

অঙ্গার হয়ে যাওয়া একটি মৃতদেহ বয়ে নিয়ে আসছেন উদ্ধারকর্মীরা। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাইড্রোজেন-পার-অক্সাইডের গ্যালন। 

ছবি: মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ খান/দৃকনিউজ  

 

কোনো প্রতিহিংসা থেকে তো আমরা মালিকদের এই শাস্তিটা চাই না। বরং এই শাস্তিটা চাই যাতে অন্য মালিকরা দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেন, কারো গাফিলতির কারণে যেন সাধারণ মানুষের প্রাণহানি না হয়, সেটা নিশ্চিত করতেই। ফলে, এই শাস্তিটা হবার কথা ছিল একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কোনো মালিকের গাফিলতি বা উদাসীনতায় কর্মস্থলে প্রাণহানি হলে তার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা শাস্তি পাবেন, এটা নিয়ে দাবি করারই কোনো কারণ থাকার কথা ছিল না। বরং বাংলাদেশে কথা হওয়ার কথা ছিল ঘটনাটাই যেন না ঘটতে পারে, সেটা নিয়ে।

 

 

বাংলাদেশে পরিস্থিতিটা সেই পর্যায়ে নাই। দুর্ঘটনার আশঙ্কাই এখন স্বাভাবিক বিষয়। প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেখানে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে, সেখানে এটা আগে কিংবা পরে ঘটারই কথা ছিল, ঘটতে বাধ্য ছিল। ডিপো মালিক, কারখানা মালিক, ভবন মালিকের পেছনে আমরা বহু ছুটেছি, তাদের যথাযথ শাস্তি আদায় করা না গেলেও কিছুদিনের জন্য কারাগারে পাঠানো গেছে, কিছু টাকাপয়সাও তাদের খরচা হয়েছে। কিন্তু দুর্ঘটনার মিছিল বন্ধ হয়নি।

 

 

দুর্ঘটনা যখন বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা না, বরং প্রতিরোধযোগ্য ঘটনাকে অবহেলার জন্য ঘটতে দেওয়া হয়েছে, তখন আসলে অন্য একটা গুরুতর অপরাধীর অস্তিত্ব আমাদের শনাক্ত করতে হয়: কারা মালিকদের এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটাতে দিচ্ছেন? তারা কি মালিকের চাইতে কম অপরাধী? শত শত মানুষের জীবনে মৃত্যু, পঙ্গুত্ব বা দুর্যোগ নেমে আসার পেছনে তাদের দায় কি মালিকদের চাইতে বেশি নয়?

হ্যাঁ, আমরা বলছি সরকারি সেই সব কর্মকর্তাদের কথা, যারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে বেতন পান কোনো একটা কারখানা, গুদাম বা যে কোনো কর্মস্থলে যে আগুন, বিদ্যুৎ বা বিষ্ফোরক সম্পর্কিত কোনো দুর্ঘটনার সুযোগ যেন রুদ্ধ করা যায়, সেটার দেখভাল করার জন্য। তারা যদি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেন, তাহলে ‘দুর্ঘটনা’ ঘটার সম্ভাবনাই কমে আসতে থাকে। কিন্তু তারা যদি ঘুষ নিয়ে হোক, রাজনৈতিক ক্ষমতার চাপের মুখে হোক আর নিছক অবহেলা আর উদাসীনতার কারণে হোক, দায়িত্ব না পালন করেন তাহলে দুর্ঘটনা নামের এই সব কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকবে। ফলে তারা কোনোভাবেই কম দায়ী নন, বরং নানান বিবেচনায় হয়তো দেখা যাবে এই সব ঘটনায় তাদের দায়ই বেশি।

৩. দোষী হলে সভ্য সমাজে এই উভয় তরফেরই শাস্তি হবার কথা। কিন্তু খেয়াল করুন, মালিকের অপরাধ আর এই মালিককে যাদের তদারক করার কথা, তার অপরাধ ভিন্ন। মালিকের প্রধান চিন্তা হলো মুনাফাকে সর্বোচ্চ করা। এটা করার জন্য নিয়মিতই তারা আইনও ভাঙেন।

 

 

কারখানা বা গুদামে এই মুনাফাকে সর্বোচ্চ করার কয়েকটা উপায় আছে, যেমন শ্রমিকের মজুরি যথাসম্ভব কম দেওয়া, সরকারকে কর ফাঁকি দেওয়া, কর্মস্থলকে নিরাপদ করতে যে ব্যবস্থাগুলো করাটা বাধ্যতামূলক, সেগুলো না করা। মালিকরা পারলে সবগুলো উপায়ই অবলম্বন করবেন; রাষ্ট্রের দায় হলো এগুলো নিশ্চিত করা।

 

 

৪. বর্তমান ঘটনাটাই দেখা যাক। সীতাকুণ্ডের এই ভয়াবহ বিষ্ফোরণের পর দেখা গেলো মালিকপক্ষ অন্তত তিনটি বড় অপরাধ এখন পর্যন্ত করেছেন।

 

 

ক. একটা হলো বিস্ফোরক পরিদপ্তরের অনুমতি ছাড়াই বিএম কনটেইনার টার্মিনালে বিপজ্জনক রাসয়নিক মজুদ করেছেন। সংবাদমাধ্যম সূত্রে পরিদপ্তরের এই স্বীকৃতিটা জানা যাচ্ছে।

 

 

খ. ফায়ার ব্রিগেডকে তারা আগুনের ঘটনাও অবহিত করেননি, ফায়ার ব্রিগেডকে জানিয়েছেন স্থানীয় মানুষেরা। আরও গুরুতর বিষয় হলো ফায়ার ব্রিগেডকে তারা গুদামে রাসয়নিকের অবস্থান নিয়ে কোনো তথ্য দেননি, এটাই ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীসহ এতগুলো মানুষের মৃত্যুর কারণ।

 

গ. যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা অবলম্বন না করেই রাসয়নিক ও বিস্ফোরক দ্রব্য মজুদ করেছেন বিএম কনটেইনার ডিপোর মালিকরা। এর ফলে বিস্ফোরণের সম্ভাবনা যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি প্রথম বিস্ফোরণের পর তা কাপড় ও অন্যান্য দাহ্য বস্তুকে কাছে পায় যা আগুনকে ছড়িয়ে দিয়ে একদিকে বিপুল আর্থিক ক্ষতি ঘটায়, অন্যদিকে তাপ সৃষ্টি করে নতুন বিস্ফোরণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।

 

 

 

এবার আশা যাক বিস্ফোরক পরিদপ্তরের অনুমতি বিষয়ে। পাঠক, খেয়াল করুন, বিস্ফোরক পরিদপ্তর বলছে এই ডিপোটা তাদের অনুমোদিত তালিকায় নেই। লালবাগে প্রতিবছর রাসয়নিক বা প্লাস্টিকের কারখানায় আগুনের পরপর আমরা জানতে পারি সেখানেও বিস্ফোরক পরিদপ্তরের অনুমতি ছিল না। নিমতলীতে ১২৪ জন, চুড়িহাট্টার সেই মর্মান্তিক ঘটনায় ৭১ জন, আরমানিটোলায় ৪ জন কিংবা হাসেম ফুডসের ৫২ জন শ্রমিকের মৃত্যুর পর আমরা জানতে পারছি সেখানে বেআইনীভাবে রাসয়নিক দ্রব্য মজুদ করা হয়েছিল। তাজরিন গার্মেন্টসে ১১২ জন মানুষকে মৃত্যুবরণ করার পর জানি কারখানাটিতে যে আগুন মোকাবিলায় কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এই সব মৃত্যুর বেলাতেই সংখ্যাগুলো সরকারি হিসাব মাত্র, কেননা বহুক্ষেত্রেই লাশ গুম করাটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

 

 

প্রশ্নটা তাহলে দাঁড়ায় এই, বিস্ফোরক পরিদপ্তরের, কিংবা এমনি আরও সব দপ্তর-অধিদপ্ত- পরিদপ্তরের আসলে কাজটা তাহলে কী? তাদের যা কর্তব্য ছিল, সেক্ষেত্রে গুরুতর গাফিলতি কি আমরা দেখতে পাচ্ছি না?

 

প্রতিবার ঘটনা ঘটার পর, মানুষের জীবনে দুর্দশা নেমে আসার পর, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হবার পরই আমরা জানতে পারব রাসায়নিকের অনুমোদনহীন মজুদের কথা? এবং অনুমোদনহীনতার পাশাপাশি সেগুলো যাকে বলে নিরাপদভাবে না রাখার বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ।

 

 

রাসায়নিক বা দাহ্য বস্তু রাখার কোনো অনুমোদনই টার্মিনালটির ছিল না, সেটা বিস্ফোরক পরিদপ্তর জানাচ্ছে বিস্ফোরণে অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যুর পর।

ছবি: মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ খান/দৃকনিউজ 

 

 

৫.

এইসব নিরাপত্তা বিধি মানতে গেলে সন্দেহাতীতভাবেই মালিকদের স্থায়ী বিনিয়োগ যাবে বেড়ে। কারখানার বা গুদামের আকার বড় করতে হবে, বেশি জায়গায় কম মালামাল রাখতে হবে। অগ্নিনির্বাপন যন্ত্রের জন্য নিরাপত্তার জন্য খরচাগুলোও বাড়বে। প্রশিক্ষিত লোকবল রাখতে হবে। অন্যদিকে এই ব্যয়টা না করে নানান ভাবে ‘ম্যানেজ’ বা 'সামলানো' গেলে ব্যয় কমবে, মুনাফা বাড়বে। মালিক কোনটা করবে?

 

 

সকল সমাজেই, সকল দেশেই মালিক মুনাফাটা বাড়াবারই চেষ্টা করে। কোনো রকম চাপ ছাড়া নিজে থেকে মালিকরা উদ্যোগ হয়ে কর্মস্থলকে নিরাপদ করার চেষ্টা করেছেন, এমন উদাহরণ অল্পকিছু থাকলেও সেটা বিরল ব্যতিক্রম। সভ্য সমাজ বলতে আমরা যা বুঝি, সেখানে শ্রমিকদের এবং তাদের সাথে মিলে অন্যদের আন্দোলন সংগ্রাম করেই এই নিরাপদ কর্মপরিবেশকে আদায় করতে হয়েছে।

 

 

স্মরণীয়, আজ থেকে একশোরও বেশি বছর আগে নিউইয়র্কের ট্রায়াঙ্গল সোয়েটার ফ্যাক্টরির আগুনে ১৪৬ জন শ্রমিক পুড়ে মারা গিয়েছিলেন। মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল দরোজাগুলো বন্ধ থাকায় আগুনের সময়ে শ্রমিকরা কারখানা থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি।

 

 

নিউইয়র্কের ওই ভয়াবহ ঘটনায় দুর্বল আইনের কারণে মালিক সামান্য জরিমানা দিয়ে রেহাই পেয়ে যান। কিন্তু এর অভিঘাতে একদিকে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শ্রমিকদের কর্মস্থলের নিরাপত্তা ও বাঁচার মতো মজুরির দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু হয়, অন্যদিকে এই নির্মাম মৃত্যুদৃশ্যে নাগরিকদের মাঝেও নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবিটি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ধীরে ধীরে কর্মস্থলের নিরাপত্তার নিশ্চিত করার জন্য বহু রকম আইন তৈরি হওয়া শুরু হয়। কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিটা আইনের বিরুদ্ধেই কারখানা মালিক, ভবন মালিক বা উদ্যোক্তারা অবস্থান নিয়েছিলেন। কেননা সেটা তাদের ব্যয় বৃদ্ধি করবে, তারা চান নগদ মুনাফা।

 

৬.

বাংলাদেশের প্রশ্নে বললে খুব সোজা ভাষাতেই বলা যায়, কর্মস্থল নিরাপদ করতে এখানে আইনের তেমন কোনো অভাব নেই। কিন্তু শ্রম আইন বাস্তবায়ন হতে পারে দুভাবে। একদিকে শ্রমিকদের সংগঠন, যারা আইন বাস্তবায়নের জন্য চাপ প্রয়োগ করবে। বাংলাদেশের আইন বরং শ্রমিক সংগঠনগুলোর গড়ে ওঠাকে খুব কঠিন বা অসম্ভব প্রায় করে তুলেছে। অন্যদিকে, শ্রম আইন কার্যকর করার আইনসঙ্গত দায় সরকারের। তাদের অনেকগুলো দপ্তর, অধিদপ্তর আছে, মন্ত্রণালয় আছে যাদের দেখভাল করার কথা কারখানা ভবন স্থাপত্যগত দিক দিয়ে নিরাপদ কি না, সেখানে আগুন বা অন্য কোনো দুর্ঘটনার ঝুঁকি রোধ করার বন্দোবস্ত যথাযথভাবে আছে কি না, বিপদের মুহূর্তে দ্রুত বেরিয়ে আসার পথ আছে কি না এইসব। এগুলো যথাযথভাবে পালন হচ্ছে কি না, তা নিয়মিত তদারক করাটাই তাদের কাজ, সেজন্য তারা রাষ্ট্রের তরফ থেকে বেতন পান।

 

 

মালিকদের আইন মানতে যারা বাধ্য করবে, তারা যদি ঘুমিয়ে থাকেন, তাহলে মালিকরা তাদের মুনাফাকে সর্বোচ্চ করার অবারিত সুবিধাটি কাজে লাগাবে সানন্দে। এবং এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, এই শ্রম আইন যাদের বাস্তবায়ন করার কথা, তারা বিনা লাভে, কোনো রকম লোভের বশবর্তী না হয়েই ঘুমিয়ে থাকেন। বরং কারখানাগুলো পরিদর্শন যে একটা অত্যন্ত লোভনীয় চাকরি, সেটা খুবই পরিষ্কার।

কথার কথা হিসেবে বলা: কারখানা মালিক যদি বছরে এক কোটি টাকা বাড়তি খরচ বাঁচাতে পারেন একটা মাঝারি আকারের কারখানায় শ্রমিকদের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়ে, তাহলে বছরে লাখ তিরিশেক টাকা ঘুষে খরচ করতে তিনি কি আপত্তি করবেন? যদি বছরে একশো কোটি টাকা বাঁচাতে পারেন, তাহলে দশ বিশ কোটি টাকা ঘুষ দিতে তার আপত্তির কী কারণ আছে?এই সহজ অর্থনীতির নিয়মেই এইভাবে শত শত কর্মস্থল একেকটা মৃত্যুকূপে পরিণত হয়ে মালিকদের মুনাফা বৃদ্ধি করছে, পরিদর্শকদের, তাদের উপরস্থদের পকেটও ভারি করছে। ফলে, সরকারি কর্মকতারা, যারা এই সব সনদ মঞ্জুর করেন, কিংবা অননুমোদিত কাজকে চলতে দেন, তাদেরকে আইনের আওতায় না আনলে কোনদিন, কোনকালে এই সব দুর্ঘটনা নামের হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে না।

এখানে অন্য একটি প্রসঙ্গও বিবেচ্য। এ ধরনের জবাবদিহিতার আওতায় শুধু ছোট চাকুরেকে আনলে কোনো লাভ হবে না। কারখানা নিরাপদ কি না, সেটা নিশ্চিত করতে পরিদর্শনের কাজে একেবারে নিচের সারিতে যারা আছেন, তারা দুর্নীতি পরায়ন হন বা না হন, তারা তাদের পদস্থদের হুকুম বরদার হয়ে থাকতেই বাধ্য হন। রাজনৈতিক কিংবা আর্থিক যোগাযোগের সূত্রে তাদের কাছে তাদের উর্ধ্বতনদের যে হুকুম আসে, সেটা তারা পালন করতে একরকম বাধ্যই।

 

 

 

অন্যদিকে, মালিকদের মতোই নিচের সারির পরিদর্শকদেরও একটা ঝুঁকি নেওয়ার একটা রীতিমতো অর্থনৈতিক হিসাব আছে, চাকরি যাবার ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা তার বাড়বে যদি বেতনের চাইতে ঘুষের পরিমাণ বহুগুণ আকর্ষণীয় হয়। কিন্তু 'আকর্ষণীয়' বেতনে যারা চাকরিটা করেন, সেই উচ্চপদস্থদের চাকরিকে ঝুঁকির মাঝে ফেলে দেখুন, এই ধরনের দুর্নীতি বহুগুণ কমে যাবে। কর্মস্থলগুলো বহুলাংশে নিরাপদ হয়ে উঠবে। তারা তাদের নিজেদের চাকরির মালিকদের বাধ্য করবেন কর্মস্থলকে শ্রমিকের জন্য নিরাপদ করতে।

 

 

 

এ কারণেই যে কোনো দুর্ঘটনায় এই পরিদর্শকদের দেখনদারি করাটা যাদের দায়িত্ব, তাদেরকেই কঠোরতম জবাবদিহিতার আওতায় আনাটা জরুরি। রানা প্লাজা, তাজরিন বা ট্যাম্পাকোর ঘটনায় আমরা দেখব, প্রতিটা কারখানা অনুপযুক্ত ছিল, সেখানে যথাযথ শ্রম পরিবেশ ছিল না। শ্রমিকদের জীবন নিয়ে মালিকরা বলা চলে জুয়া খেলেছেন। কিন্তু এটা দেখার দায়িত্ব যাদের ছিল, সেই শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কিংবা মাঠের কাজটি যাদের করার কথা, সেই কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের বিরুদ্ধে কোনো  ব্যবস্থা নেয়া হয়নি রাসয়নিক দুর্ঘটনার বেলায়। বলা চলে বিনা জবাবদিহিতায় এই প্রতিষ্ঠানগুলি ও তাদের কর্তারা দিব্যি হাসিখুশি কাল কাটিয়েছেন।

 

৭.

আবারও মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কারখানা মালিকরা ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করবেন, এটা তাদের অধিকাংশের বৈশিষ্ট্য। কারণ শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গেলে একটা বাড়তি বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। এটা তিনি করতে আগ্রহী না। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো তার নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা। ফলে মালিককে এই কাজে বাধ্য করাটা রাষ্ট্রের কর্তব্য। এই কর্তব্যের প্রশ্নে কোনো অবহেলা বা ছাড়ের প্রশ্ন নেই। রাষ্ট্রের তরফ থেকে যারা এই কাজটি করার জন্য বেতন পান, সেই শ্রম সচিবের ও কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শকের দায়িত্ব পালনরত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকার কথা ছিল। বর্তমান প্রেক্ষিতটাতেও যেমন এদেরই সাথে যুক্তভাবে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের কর্তাদের বাধ্য থাকার কথা।

 

 

মালিকের শাস্তি একটা আইনি, পুলিশি ও বিচারিক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে দীর্ঘসূত্রিতায় তারা বেঁচে যান এই কারণে যে, মালিকের কাছ থেকে বহুরকম উপঢৌকন পাবার সুবাদে এই বিচার প্রক্রিয়াকে আর কখনোই যথাযথভাবে চালু করা হয় না। বরং সময় এসেছে এই পরিদর্শক, মহাপরিদর্শক, অতিপরিদর্শক ইত্যাদি কাতারভুক্তদের জবাবদিতিহার আওতায় আনার।

দুর্ঘটনা নামের কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডগুলো যে জায়গাতে ঘটেছে, সেখানকার নিচ থেকে উচ্চ পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তারা যথাযথ পরিদর্শন করেছিলেন কি না, তারা তা নিয়ে নিজেদের দপ্তরে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন কি না, তারা যথাযথভাবে দুর্ঘটনার আশঙ্কা তুলে ধরে থাকলে তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল কি না, পরিদর্শকদের প্রদত্ত প্রতিবেদনের সাথে মাঠের বাস্তবতার মিল আছে কি না—এইসব বিষয়েই তদন্ত হোক। শুধু একটা ঘটনা প্রসঙ্গে তদন্ত না, এটাকে একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হিসেবেই রাখা হোক। যে কোনো অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড ঘটলেই মালিকের শাস্তির পাশাপাশি এই অব্যবস্থা চলতে দেওয়ার জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত শাস্তির আওতায় আনা গেলে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড ঘটতে দেওয়াটাই তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে যাবে।

প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, বিস্ফোরক পরিদপ্তর সহ আর সকল দপ্তরেই আমরা দেখবো নিরাপত্তা সংক্রান্ত পরিদর্শকের পদগুলোতেই লোকবলের ঘাটতি! বহু সংবাদ দেখেছি যেখানে কর্তাদের চাইতে গাড়ির বহর বেশি, বিদেশ সফর আর প্রশিক্ষণের তোড়জোরের ঘাটতি নেই। কিন্তু সড়ক কিংবা নৌযান হোক, কারখানা পরিদর্শন হোক আর গুদাম কিংবা ডিপো পরিদর্শন হোক—দেখবেন ঠিক লোকবলের ঘাটতি।

 

 

তদারকি করার জন্য যারা জনগণের কাছ থেকে বেতন পান, তাদের অপরাধমূলক অবহেলায় আর একটাও যেন প্রাণহানি না ঘটে, সেইটাই দাবি করতে হবে।

 

 

কিন্তু উল্টোদিকে, এই কথাটিও ঠিক যে বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রে যখন জনগণের সর্বোচ্চ অধিকার-- ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন—সেটিই কেড়ে নেয়া হয়, এত বড় অবিচারের ওপর চলা একটি জনপ্রতিনিধিত্বহীন সরকারের আমলে যে জবাবদিহিতাহীনতা, নৈরাজ্য এবং দুর্নীতি, তারই ফলস্বরূপ এই ‘দুর্ঘটনা’ নামের কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডগুলো বাড়তেই থাকবে, তা সহজেই অনুমেয়।

 

 

শ’দেড়েকেরও বেশি আগে থমাস ডানিং নামের একজন বৃটিশ শ্রমিক সংগঠক পুঁজির ধর্ম নিয়ে বলেছিলেন: “১০০ ভাগ মুনাফার গন্ধ পেলে মালিকরা যে কোন মানবিক আইন ভাঙবে, ৩০০ ভাগ মুনাফা নিশ্চিত থাকলে নিজের ফাঁসি হবার মত ঝুঁকিও নেবে। “বিনিয়োগকারীর দিক থেকে এই ধর্মের কোন ব্যত্যয় হবার কোন কারণ নেই। সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গেলে আমাদের জন্য প্রয়োজন মালিকদের এই চরিত্রের রাশ টেনে ধরা। তার একমাত্র উপায়, এটা যাদের তদারক করার কথা, তাদেরকেও একই মাত্রায়, কিংবা আরও গুরুতর মাত্রায় শাস্তির আওতায় আনা।

 

 

বর্তমান ক্ষেত্রে তাই, বিস্ফোরক পরিদপ্তরের ওয়েবসাইট খুললে যতজনের চেহারা সেখানে দেখা যায়, তাদের কেউই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে এই দুর্ঘটনার নৈতিক ও আইনী দায় এড়াতে পারেন না। এই বিএম কনটেইনার ডিপোর মালিকদের সাথে সাথেই তারাও গুরুতরভাবে দায়ী। বিচারের স্বার্থে তাদের মাঝে কে কে আইনীভাবে দায়বদ্ধ, সেটা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা দরকার, বাকিদেরও ব্যর্থতার এবং অবহেলার নৈতিক দায় স্বীকার করা কর্তব্য।

 

 

শেষ করতে চাই এই কথাটি বলে যে, তদারককারীদের দায়বদ্ধ করা এবং জবাবদিহিতার আওতায় আনার লক্ষ্যটা তাদের দুর্বল করা নয়। বরং এই তদারকের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো-- যেটা হোক অধিদপ্তর, পরিদপ্তর কিংবা অন্য যে কোনো দপ্তর—যেন স্বাধীন, শক্তিশালি, দায়বদ্ধ এবং এবং দায়িত্বশীল রাষ্ট্রীয় সংস্থায় পরিণত হতে পারে, সেটাই এই জবাবদিহিতা কার্যকর করার আসল লক্ষ্য। দায়িত্বশীল একটা সংস্থার কাছেই জবাবদিহিতা চাওয়া যেতে পারে। এবং এই কারণেই এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশাসন ক্যাডারের পরিযায়ী ব্যক্তিদের শীর্ষ পদগুলোতে না বসিয়ে বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানই গড়ে তুলতে হবে। যে কারণে বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বর্তমানে কার্যকর হতে পারছে না, একই কাঠামোগত কারণেই এই রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোও ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকার জন্য দায়ী।

 

ফিরোজ আহমেদ

লেখক ও গবেষক

firoz@driknews.com