এডওয়ার্ড এস হারম্যান ও নোম চমস্কির বই ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিকাল ইকোনমি অব ম্যাস মিডিয়া প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। অধুনা প্রচারমাধ্যম/গণমাধ্যমকে বুঝতে সেই বইটি খুব কার্যকর। হারম্যান ও চমস্কি যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমের সমালোচনা করেছেন মূলত দেশটির সাম্রাজ্যবাদী ও সামরিক চরিত্রের বিরোধিতার অংশ হিসেবে। ভিয়েতনাম-লাওস-কম্বোডিয়া, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, কসোভো, ইরাক এরকম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় বা পরে মিডিয়া কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ও সামরিক বাহিনীকে সমর্থন যুগিয়েছে, তার সাক্ষ্য-প্রমাণ বইতে তারা হাজির করেছেন। যাহোক, সেই বইতে লেখকদ্বয় এক ‘প্রচারণা মডেল’ (প্রপাগান্ডা মডেল) করেন, যে মডেলে রয়েছে পাঁচটি ফিল্টার বা ছাঁকনি। একটি ঘটনার সংবাদ হয়ে উঠতে চাইলে, এই পাঁচটি ছাঁকনি পেরুতে হয়। এর যেকোনো একটিতে ধরা পড়লে তার আর সংবাদ আকারে প্রকাশ বা প্রচারের সুযোগ থাকে না।
হারম্যান-চমস্কির মডেলটি পশ্চিমা গণমাধ্যম, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমকে ঘিরে প্রণীত। তবে তাদের মডেলকে দাঁড় করাতে ইউরোপে ও আমেরিকায় গণমাধ্যমের বিকাশের ঐতিহাসিক ধারাক্রমকে বিবেচনায় নিয়েছেন তারা। এই বইটি যখন লিখিত হয় তখন যুক্তরাষ্ট্রে আজকের সর্বব্যাপী যে নয়া উদারবাদী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, তার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। সেই নয়া উদারবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতির তত্ত্ব শিকাগো স্কুলের মিল্টন ফ্রিডম্যানদের দ্বারা তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ১৯৫০-এর দশকেই। সিআইয়ের হস্তক্ষেপে ১৯৭৩ সালে চিলির প্রেসিডেন্ট সমাজতন্ত্রী সালভেদর আয়েন্দেকে হত্যা করে সেনানায়ক অগাস্টো পিনোশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।
এরপর ‘শিকাগো বয়েজ’ নামে পরিচিত ফ্রিডম্যানের শিষ্যরা চিলিতে গিয়ে অর্থনীতি ব্যবস্থায় ব্যাপক রদবদলের মধ্য দিয়ে (নাওমি ক্লাইন [২০০৭] যাকে বলেন ‘শক ডক্ট্রিন’) এক পরীক্ষা করেন। চিলির পরীক্ষাগারে নয়া উদারবাদের ধারবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রে রোনাল্ড রিগ্যান ও যুক্তরাজ্যে মার্গারেট থ্যাচারের নেতৃত্বে নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। এর ফলে বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপ কমে যায়, ব্যাপকভাবে বেসরকারিকরণ হয় এবং ভারী শিল্প-চিকিৎসা-শিক্ষার পাশাপাশি মিডিয়া বিনিয়ন্ত্রণের আওতায় পড়ে।
আর নাগরিকদের জন্য সরকারি ও সামাজিক নিরাপত্তা ও সুবিধার নানান কর্মসূচি সঙ্কুচিত হয়। নব্বই দশকের গোড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী আস্থাহীনতা তৈরী হয় এবং নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক ধারণা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। এক দশকের মধ্যেই পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির নীতি গৃহীত হয়। এই প্রেক্ষাপটে মিডিয়াকে বুঝতে হারম্যান-চমস্কির প্রচারণা মডেল দরকারি এক তাত্ত্বিক মডেল।
বাংলাদেশের জন্য এই প্রেক্ষাপটটা তৈরী হয়েছে, একটু পরে, নতুন শতকের গোড়ায়। আর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এর শুরু ছিল আশির দশকের দ্বিতীয় ভাগে, যেসময়টায় বইটি লিখিত হয়েছে। রাজনৈতিক অর্থনীতি বা মার্কসীয় মতাদর্শের আদলে লিখিত বইতে বলা হয়েছে কর্পোরেট মিডিয়া মূলত ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীগুলোর পক্ষে জনগণের সম্মতি আদায় করে। লেখকদ্বয় প্রচারণা মডেল সম্পর্কে বলছেন:
" বহু বছর ধরে মিডিয়ার কর্মতৎপরতা গবেষণার সুবাদে আমাদের যে বিশ্বাস গড়ে উঠেছে, এই মডেল তারই প্রতিফলন। আর সেই বিশ্বাস হলো, মিডিয়া রাষ্ট্রিক ও বেসরকারি কর্মকান্ডে আধিপত্যকারী ‘বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠী "
’গুলোর পক্ষে সম্মতি আদায়ের চেষ্টা চালায় (হারম্যন ও চমস্কি, ২০০২: ৬৯) ।
হারম্যান-চমস্কি এও মনে করেন, যেসব দেশে একনায়কতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদ কায়েম রয়েছে, সেদেশে মিডিয়ার ওপরে নিয়ন্ত্রণটা বোঝা যায়। কিন্তু উদারবাদী গণতান্ত্রিক দেশে নিয়ন্ত্রণটা হয় সূক্ষ্মভাবে, সহজে ধরা যায় না। এবং মিডিয়াকে ব্যবহার করা হয় শাসক শ্রেণির মতাদর্শ প্রচারের জন্য, এবং সেই মতাদর্শের প্রতি যেন জনগণ সম্মতি দেয়, তার জন্য। আন্তনিও গ্রামসিকে সাক্ষী মেনে বলা যায়, এই সম্মতি আদায় জোর করে করা হয় না, বরং এমন এক আধিপত্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় ও প্রচারণা কৌশলের হাতিয়ার হিসেবে মিডিয়াকে ব্যবহার করা হয়, জনগণ ক্রমশ স্বেচ্ছায় সম্মতিটা দিয়ে দেয়। ওই প্রচারণা কৌশলকে বুঝতেই এই প্রচারণা মডেল।
১৯৮৮ সালে হারম্যান-চমস্কির বইটি লিখিত হবার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী হয়েছি। নব্বই দশকের দ্বিতীয় ভাগে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছি। পুরো সময়টা এই বইয়ের বা ওই মডেলের সন্ধান আমাদের দেয়া হয় নি। পরে আমরা যখন শিক্ষকতায় এসেছি, প্রথম যোগাযোগ ও মিডিয়া বিষয়ে গভীরভাবে পড়াশুনা শুরু করেছি, নতুন শতকের গোড়ার দিকে আমরা এই বইয়ের সংস্পর্শে আসি। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। সেখানকারই শিক্ষক-গবেষক আ-আল মামুন ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট বইটির অনুবাদ করেন, ছাপা হয় ২০০৮ সালে সংহতি প্রকাশন থেকে, সম্মতি উৎপাদন: গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮) শিরোনামে।
একই ভাবনার পাটাতন থেকে আমি ‘অসম্মতি উৎপাদন’ শিরোনামে একটি পত্রিকায় লিখতে থাকি ২০০৯-২০১০ সময়কালে এবং বাংলাদেশের মিডিয়ার ব্যবচ্ছেদ করতে থাকি। পরে লেখাগুলো একই শিরোনামর একটি বই (হক, ২০১১) আকারে প্রকাশিত হয়। শিরোনামটি অ-উপসর্গ নিয়ে বিপরীত অর্থ প্রস্তাব করলেও, আসলে বিষয়টা একই - মিডিয়া জনগণের সম্মতি আদায় করে, আর আমি জনগণের পক্ষ থেকে মিডিয়াকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে অসম্মতি উৎপাদন করেছি। রাবিতে বা ঢাবিতে আমরা প্রচারণা মডেল ক্লাসে পড়াই বা পড়িয়েছি।
তবে মূল বই প্রকাশিত হবার তিন দশক পরে এবং আমাদের চর্চার এক দশক পরে পরিবর্তিত মিডিয়াস্কেপে প্রচারণা মডেল কীরকম কার্যকর তার পরীক্ষা করার প্রয়োজন পড়েছে। পরিবর্তিত মিডিয়াস্কেপ বলতে বোঝাতে চাইছি, সংবাদপত্র-রেডিও-টেলিভশনকে এখন বলা হয় পুরনো মাধ্যম আর ইন্টারনেটভিত্তিক নয়া মাধ্যম দ্রুতই বিস্তার লাভ করেছে। অনলাইন মিডিয়ার পাশাপাশি মিডিয়া সম্মিলন বা কনভার্জেন্সের মূল পাটাতন হয়েছে ইন্টারনেটই। নেটওয়ার্কিং নির্ভর সামাজিক মাধ্যম অল্প সময়েই হয়ে উঠেছে বহুবিস্তারী। এই প্রবন্ধে আজকের ডিজিটাল মাধ্যমে প্রচারণা মাধ্যমের ছাঁকনিগুলো কীভাবে প্রযুক্ত হতে পারে, সেই পরীক্ষা ও বিশ্লেষণই করা হবে। তার আগে সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক, কী ছিল প্রচারণা মডেলে?
প্রচারণা মডেলে কী ছিল?
প্রচারণা মডেলে ছিল পাঁচটি ছাঁকনি, যেগুলোর মধ্যে বহু সম্ভাব্য সংবাদ আটকা পড়ে এবং অপ্রকাশিত সেসব সংবাদের কথা আর কেউ কখনো জানতে পারে না। বস্তুত আমরা বসবাস করি ‘মেডিয়েটেড’ জগতে; যা মিডিয়ায় নাই, তার অস্তিত্বও নাই। তো সেই পাঁচখানা ছাঁকনি হলো:
১) প্রাধান্যশীল মিডিয়া-প্রতিষ্ঠানের আকার, কেন্দ্রীভূত মালিকানা, মালিকের সম্পদ ও মুনাফামুখিতা
২) গণমাধ্যমের আয়ের মুখ্য উৎস হিসেবে বিজ্ঞাপন
৩) সরকার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সম্পদ ও ক্ষমতার এসব মুখ্য এজেন্টদের নিয়োজিত ‘বিশেষজ্ঞ’দের দেয়া তথ্যের ওপরে মিডিয়ার নির্ভরতা
৪) মিডিয়াকে অনুশাসনবদ্ধ করার উপায় হিসেবে ‘হুমকি-ধামকির’র ব্যবহার
৫) নিয়ন্ত্রণ-কৌশল হিসেবে ‘সমাজতন্ত্র-বিরোধিতা’।
ছাঁকনিগুলোকে সংক্ষেপ করে এভাবে বলা যায়: মিডিয়ার মালিকানা, বিজ্ঞাপনদাতা, জনসংযোগীয় উৎস, হুমকি-ধামকি ও সমাজতন্ত্রবিরোধিতা। ফিল্টারগুলো সংবাদপ্রবাহকে বা সংবাদের নির্বাচনকে নির্ধারণ করে। হারম্যান ও চমস্কি বলছেন:
এই উপাদানগুলো পরস্পরের সঙ্গে আন্তঃক্রিয়া করে এবং পরস্পরকে আরও শক্তিশালী করে। সংবাদের কাঁচামালকে অনিবার্যভাবেই, প্রকাশযোগ্য হওয়ার জন্য, একে একে ফিল্টারগুলো অতিক্রম করতে হয়। ফলে ছাপার জন্য শুধু পরিশোধিত অবশিষ্টটুকুই টিকে থাকে। ফিল্টারগুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও ডিসকোর্সের সীমানা নির্ধারণ করে দেয়। আর সবার আগে নির্ধারণ করে দেয় কোন ঘটনাটা সংবাদযোগ্য, কোনটা নয়। তাছাড়া, ফিল্টারগুলো সংবাদযোগ্যতার এমন এক ভিত্তি ও কার্যপ্রণালী তুলে ধরে, যা প্রপাগান্ডারই সমার্থক (হারম্যান ও চমস্কি, ২০০২: ৭৯) ।
১৯৮৮ সালের প্রথম সংস্করণের পর ২০০২ সালে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হলে লেখকদ্বয় সেখানে প্রচারণা মডেলকে হালনাগাদ করেন। তবে মূল ফিল্টারগুলোয় কোনো পরিবর্তন তারা আনেন নি। বরং একেকটি ছাঁকনিকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট থেকে অনেক নতুন ঘটনা ও উদাহরণ যুক্ত করেন। এবং তারা দাবি করেন প্রচারণা মডেল ১৪ বছর পরে তা যেন আরো বেশি প্রয়োজ্য হয়ে উঠেছে।
আগেই বলেছি ইউরোপসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে নানান প্রসঙ্গ তাদের বিশ্লেষণে যুক্ত করলেও মডেলটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া-ব্যবস্থাকে লক্ষ্য করেই প্রণীত হয়েছে। তবে সময়ের ব্যবধান থাকলেও বাংলাদেশ বা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মিডিয়াকে বুঝতে মডেলটি প্রাসঙ্গিক। কারণ কিছুটা দেরীতে হলেও নয়াউদারবাদী নীতি অল্প কয়েকটি দেশ ছাড়া বেশিরভাগ দেশেই কমবেশি অনুসৃত হচ্ছে। বেশিরভাগ মিডিয়াই কর্পোরেট মিডিয়া এবং সেসব মিডিয়ায় ওই ফিল্টারগুলো প্রয়োগ করেই সংবাদ নির্বাচন ও প্রক্রিয়াকরণ হয়। তবে মডেলটির সব ফিল্টার সব দেশে একইভাবে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। যেমন পাঁচ নম্বর ফিল্টারটি। পুঁজিবাদের পীঠস্থান যুক্তরাষ্ট্রে লালভীতি বা সমাজতন্ত্রবিরোধিতা যেভাবে বা যেমাত্রায় দেখা যায়, সব দেশে সেরকম নাও হতে পারে। যেমন বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রবিরোধিতা যুক্তরাষ্ট্রের মাত্রায় দেখা যায় না। বা সমাজতন্ত্রকে সেভাবে হুমকি হিসেবে দেখা হয় না।
আবার শত্রু-আদর্শ সমাজতন্ত্রকে স্নায়ুযুদ্ধকালে যতটা গুরুত্ব দেয়া হতো, যুক্তরাষ্ট্রে এখন ততটা দেয়া হয়ও না। অন্যদিকে, নয়-এগারোর পরে নতুন শত্রু হিসেবে দেখা যায় মুসলিম ভুবন, সমাজতন্ত্র বিরোধিতাকে প্রতিস্থাপন করেছে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ বা ‘ইসলামভীতি’। বিষয়টা হারম্যান-চমস্কি এড়িয়ে যান নি। ২০০৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে তারা বলছেন, প্রথম চারটি ফিল্টার এখন আরও বেশি প্রযোজ্য। আর পাঁচ নম্বরটির ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রবিরোধিতা এখনও রয়েছে, কিন্তু তাকে অনেকখানি প্রতিস্থাপন করেছে ‘সন্ত্রাসবিরোধিতা’(হারম্যান ও চমস্কি, ২০০৯, https://chomsky.info/200911__/) ।
তবে সত্যিই যেভাবে কর্পোরেট মিডিয়া সম্মিলন ও অধিগ্রহণের মাধ্যমে মালিকানা কেন্দ্রীভূত হয়েছে, একেকটি মিডিয়া দানবের উদ্ভব ঘটেছে সাম্প্রতিক দশকগুলোয়, মালিকানা-বিজ্ঞাপন-জনসংযোগ আশির দশকের তুলনায় আরও শক্তিশালী এখন। আর মিডিয়াকে সরকার ও ব্যবসায়ী শ্রেণি যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, তা আগের চাইতে বেশি স্পষ্ট। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনুগত ফক্স নেটওয়ার্ক ছাড়া সব মিডিয়াকে ‘ফেইক মিডিয়া’ আখ্যা দিয়েছেন। বাংলাদেশে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আনা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। ভারতীয় মিডিয়াও মোদি সরকারের সময় অনেক নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। অনেক সময় সরকারি ও কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ যৌথভাবেই ঘটে থাকে, একে আমরা বলেছি ‘রাজনৈতিক-বাণিজ্যিক বন্ধন’ (পলিটিকো-কমার্শিয়াল নেক্সাস) (রহমান, রেজা ও হক, ২০১৭)।
ক্রিশ্চিয়ান ফুকস (২০১৮) সমালোচনা করছেন যে, হারম্যান ও চমস্কি সংবাদনির্ভর মডেল দাঁড় করিয়েছেন। বিনোদনকে তারা মডেলে অন্তর্ভুক্ত করেন নি, যেক্ষেত্রে মতাদর্শ প্রচার ও আধিপত্য কায়েমের অন্যতম হাতিয়ার হলো যুক্তরাষ্ট্রের বিনোদন কারখানা। পুঁজিবাদী বা আমেরিকানিজমের মতাদর্শ প্রচারের ক্ষেত্রে হলিউডের ছায়াছবি বা টেলিভিশন শোর চেয়ে শক্তিশালী আর কীইবা আছে? অবশ্য হারম্যান এক লেখায় বলছেন, আমরা কখনোই দাবি করিনি প্রচারণা মডেল সবকিছুর ব্যাখ্যা দিতে পারে... এই মডেল মিডিয়ার আচরণ ও পারফরম্যান্স সংক্রান্ত, প্রভাব সংক্রান্ত নয় (হারম্যান, ২০১৮: ৪৬)। যাহোক, বৈশ্বিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পঞ্চম ফিল্টার নিয়ে একটা সংশোধনের কথা ভাবতে হয়। পঞ্চম ফিল্টারকে ক্রিশ্চিয়ান ফুকস (২০১৮) বর্ণনা করতে চাচ্ছেন ‘প্রাধান্যশীল মতাদর্শ’ হিসেবে, যা মিডিয়াকে প্রভাবিত করে।
ডিজিটাল যুগে প্রচারণা মডেল
এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। ডিজিটাল যুগে পরিবর্তনশীল মিডিয়াস্কেপে প্রচারণা মডেল কীভাবে প্রযোজ্য হবে? সেই আলাপে ঢোকা যাক। প্রথমেই জেনে নেই প্রপাগান্ডা মডেলের অন্যতম প্রবর্তক এডওয়ার্ড এস. হারম্যান এবিষয়ে কী ভেবেছেন:
অনেকেই বলেন যে ইন্টারনেট ও নয়া যোগাযোগ প্রযুক্তি কর্পোরেটের গ্রাস থেকে সাংবাদিকতাকে মুক্ত করবে এবং অভূতপূর্ব মিথস্ক্রিয়ামূলক এক গণতান্ত্রিক মিডিয়া সৃষ্টি করবে। কিন্তু সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগের ক্ষেত্রে এরকম দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে তেমন কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় নি। বরং সমস্যা ঘনীভূত হবার লক্ষণই বেশি দেখা যাচ্ছে। যেহেতু প্রযুক্তির কারণে অল্প আয়াসে অধিক উৎপাদন হয়, তাই নয়া প্রযুক্তির আবির্ভাব মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোয় সাংবাদিক-কর্মচারী ছাঁটাইয়ের সুযোগ করে দিয়েছে। প্রযুক্তি মিডিয়া আধেয়র বৈশ্বিক বিতরণ ব্যবস্থা সম্ভব করেছে, ফলে মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমে গেছে। যদিও নতুন প্রযুক্তি গণতান্ত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্ভাবনা তৈরি করে, সেই সম্ভাবনা বাজারের হাতেই গেছে, ফলে সেব্যাপারে বেশি কিছু আশা করার কারণও কমে গেছে (হারম্যান, ২০১৮: ৫১)।
তাহলে ইন্টারনেটের যুগে, সামাজিক মাধ্যমের কালে কিছু বদলালো না? গণতন্ত্রায়ণের যে সম্ভাবনা নিয়ে ইন্টারনেট এসেছিল, বিশেষত নেটওয়ার্ক নির্ভর যে সমাজ গড়ে উঠছিল, ম্যানুয়েল ক্যাস্টেলস (২০০৭) আশা করেছিলেন, সেখানে মানুষ পরস্পর দ্রুততর সময়ে আনুভূমিক যোগাযোগ করবে এবং মানুষের পাল্টা-ক্ষমতা জারিত হবে। কিছু মাত্রায় তা হয়েওছিল। নেটওয়ার্ক সমাজে, ব্যক্তি মানুষই গণযোগাযোগ করবে (ম্যাস সেল্ফ কমিউনিকেশন)। যেমন একজন ফেসবুক-ব্যবহারকারী চাইলে একইসঙ্গে একজন (লাইভ)ব্রডকাস্টার, লেখক ও সাংবাদিক হতে পারেন।
সে সুবিধা তার এখনও আছে, কিন্তু সে শেষ পর্যন্ত ফেসবুক কোম্পানির (যার এখনকার নাম মেটা) অধীনস্ত যন্ত্রাদির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও গাণিতিক মারপ্যাঁচের (অ্যালগরিদম) আওতাভুক্তই থাকছে। তার অবস্থা বেশ শোচনীয়ই! কারণ মেটা কোম্পানির প্লাটফর্মে সারাক্ষণ সে আধেয় প্রস্তুত করছে, কোটি কোটি ব্যবহারকারীর আধেয়ই মেটার শক্তি/মূলধন। কিন্তু ব্যবহারকারীরা মূলত বেতনবিহীন শ্রমিক। তাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একদিকে নানান বিগ ডাটায় শ্রেণিভুক্ত করছে, বিজ্ঞাপনদাতার কাছে সেই ডাটাবেজ বিক্রি করছে, আবার বিজ্ঞাপনদাতারা সেই ডাটাবেজ ধরে পণ্যের খবর নিয়ে সরাসরি তার কাছে চলে আসছে, টার্গেট অডিয়েন্স হিসেবে। এই প্রেক্ষাপটে প্রচারণা মডেলের (ফুকসের [২০১৮] ভাষায় ‘প্রচারণা ২.০’) একেকটি ছাঁকনি ডিজিটাল প্লাটফর্মগুলোর ক্ষেত্রে কীরকম প্রযোজ তার বিচার করা যাক।
১ম ছাঁকনি: আকার, মালিকানা ও মুনাফামুখিতা
হারম্যান-চমস্কি প্রচারণা মডেলে বলা হয়েছে, ইংল্যান্ডের ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রমজীবী সংবাদপত্রগুলো ছিল পাঠকের ক্রয়মূল্যনির্ভর। পরে ব্যবসায় শ্রেণি সংবাদপত্র প্রকাশনায় এলে পুরো পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ভালো প্রচারসংখ্যা থাকার পরও পত্রিকাগুলো বাজার থেকে হারিয়ে যায়। পুঁজিপতি শ্রেণি বড় পুঁজি নিয়ে পত্রিকা প্রকাশনা শুরু করে এবং ক্রয়মূল্যের পাশাপাশি বিজ্ঞাপননির্ভর সংবাদপত্র প্রকাশনার মডেল চালু করে। যুক্তরাজ্যের পরে যুক্তরাষ্ট্রেও একই ঘটনা ঘটে। মিডিয়ার বিশাল আকার, মালিকানার প্রকৃতি ও মুনাফামুখিতা কেবলই এক ব্যবসায়িক আবর্তে ঘুরপাক খায়।
কেবল ব্যবসায়িক শ্রেণি নয়, মিডিয়া এমনকি ক্ষমতাবান অপর পক্ষ, সরকারের হয়েও কাজ করে। সরকারের সঙ্গে মিডিয়ার সম্পর্ক নির্ভরতার। লাইসেন্স পাওয়া থেকে এই সম্পর্ক শুরু, বিরোধিতা করলে হুমকি সক্রিয় হয়ে ওঠে। নীতিগত সমর্থনের জন্য সরকার-নির্ভরতা, যেমন বাণিজ্য কর, সুদের হার, শ্রমনীতি সংশ্লিষ্ট আইন যেমন ব্যবসায় শ্রেণির অনুকূল হয়। জেনারেল ইলেক্ট্রিক, ওয়েস্টিং হাউসের মতো কোম্পানি পরমাণু শক্তি ও সামরিক গবেষণা উন্নয়নের ভর্তুকি পেয়ে থাকে। বিদেশে অস্ত্র ও প্রযুক্তি বিক্রিতে অনুকূল পরিবেশের জন্য সরকারকে লাগে। বহুজাতিকের বাইরে বিনেয়োগ করতে সরকারকে লাগে। ফলে সরকার ও ব্যবসায়ীদের এক মিথোজীবিতামূলক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে মিডিয়া ক্রমশ কেন্দ্রীভূত হতে থাকে, যে প্রবণতা বর্তমান শতকে ডিজিটাল দুনিয়ায়ও ঘটতে থাকে। এ বছরের জানুয়ারি মাসের হিসেব অনুযায়ী বিশ্বে প্রায় ৪ বিলিয়ন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী রয়েছে। সে হিসেবে পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে। সামাজিক মাধ্যমগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ফেসবুক, এরপরই রয়েছে ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম। এছাড়া উইচ্যাট, টিকটক, স্ন্যাপচ্যাট ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মের অনেক ব্যবহারকারী রয়েছে। শীর্ষ চারটি প্ল্যাটফর্মের মধ্যে ইউটিউব বাদে বাকি তিনটিই মেটা কোম্পানির আওতাভুক্ত। ইউটিউব গুগল কোম্পানির অন্তর্ভুক্ত, যে কোম্পানি আবার ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে একচেটিয়া বাজার রয়েছে। জিমেইল, অ্যাডওয়ার্ডস, অ্যাডসেন্স, ম্যাপ, বুকস, স্কলার ইত্যাদি হলো গুগলের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে বাজারনিয়ন্ত্রক।
এভাবে ডিজিটাল বাজারে অল্প কয়েকটি কোম্পানির একচেটিয়াত্ব দেখা যায়, যাকে কেতাবি অর্থে ‘অলগিপলি’ বলতে হয়। এক হিসেবে, ইন্টারনেটে খোঁজাখুঁজির ৭১% গুগলের দখলে এবং ফেসবুক ও হোয়াটস অ্যাপ ব্যবহারকারীদের অংশ শীর্ষ ১০টি সামাজিক মাধ্যমের ৪৮% (ফুকস, ২০১৮: ৭৩)। ডিজিটাল যুগের আগের মিডিয়া বাজারেও অলগিপলি চলছিল। মালিকানা ক্রমশ কেন্দ্রীভূত বা একীভূত হচ্ছিল, একীভবন (মার্জার) ও অধিগ্রহণের (ইকুইজেশন) মধ্য দিয়ে। এই সময়ের শীর্ষ মিডিয়া কোম্পানি যদি হয়ে থাকে ছয়টি - কমক্যাস্ট, নিউজকর্প, বার্টেলসম্যান, ডিজনি, টাইমওয়ার্নার ও সনি; তবে কেবল ডিজিটাল ভুবনের শীর্ষ কোম্পানি হলো তিনটি - মেটা/ফেসবুক, অ্যালফাবেট/গুগল ও নেটফ্লিক্স। আমাজান বা অ্যাপলকে এই তালিকায় নিলে তালিকাটি বড় হবে, তবে এই দুই কোম্পানির মিডিয়া সংশ্লিষ্টতা কমই (অ্যাপলের অর্থনীতি ডিভাইসকেন্দ্রিক, আমাজনের ই-কমার্সকেন্দ্রিক)। একত্রীকরণ ও অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া ডিজিটাল সময়ে কমে নি, বরং বেড়েছে। ফেসবুক একে একে কিনেছে হোয়াটস অ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম।
গুগল কিনেছে ইউটিউবকে। বোঝাই যাচ্ছে একীভবন ও অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে মিডিয়া মালিকানার আকারের যে বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল, যা উচ্চ মুনাফাকে নিশ্চিত করবে, সেই নীতিতে প্লাটফর্মের আকার বাড়ছে ডিজিটাল যুগে - আরও দ্রুত, আরও মুনাফাসহ। অবশ্য এই যে একীভবন ও অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া এটা পুরনো মাধ্যম আর নয়া মাধ্যমে আজকাল সমান্তরালে হচ্ছে না, বরং মিলেমিশেই হচ্ছে। পুরনো মাধ্যম নতুন মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব হাজির করছে বা নতুনের সঙ্গে মার্জার করে তার গ্ল্যামার বাড়াচ্ছে, স্টক মার্কেটে হাইপ তৈরি করছে। আবার এটা ভুলে গেলেও চলবে না যে গুগল সার্চ ও ফেসবুক নিউজ ফিড হলো আজকের সময়ে অন্যতম সংবাদ-উৎস। বহু মানুষ এখন মনে করে সংবাদের জন্য তার সংবাদপত্র পড়তেই হবে বা টিভি দেখতেই হবে এমন নয়। তার ফেসবুক নিউজ ফিড বা গুগল সার্চ রয়েছে সংবাদ পাবার জন্য।
দ্বিতীয় ছাঁকনি: বিজ্ঞাপন
২০০৯ সালে হারম্যান ও চমস্কি (২০০৯) এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, গুগল ও ইয়াহু বিজ্ঞাপন রাজস্বের ওপরে অনেকখানি নির্ভরশীল। আজকের গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি কেবল সংবাদ ও তথ্যের বড় উৎসই নয়, এরা নিজেরাই বিজ্ঞাপন এজেন্সির মতো বিজ্ঞাপনদাতার পক্ষ থেকে ব্যবহারকারীর কাছে পণ্য ও সেবার খবর পৌঁছে দেয়। এজন্য তারা অপূর্বদৃষ্ট এক কায়দা বের করেছে। তারা তাদের ব্যবহারকারীদের কর্মকান্ডকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করে এবং এভাবে ব্যবহারকারীদের ইচ্ছা ও পছন্দের ধরন অনুযায়ী নানান ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করে এবং সেই ডাটাবেজ তারা বিক্রি করে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে। টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের দর্শক ছিল অ্যানোনিমাস বা অজানা, পেপসির বিজ্ঞাপন কোকাকোলা ভক্তের কাছেও যেত। ইন্টারনেটের বিজ্ঞাপনের অডিয়েন্স নির্দিষ্ট, তাকে লক্ষ করেই বিজ্ঞাপন হানা দেয় তার স্ক্রিনে।
খেলাধুলার ভক্তের কাছে বইপ্রেমীর বিজ্ঞাপন যাবে না, যার ফ্যাশনের প্রতি প্যাশন তার কাছে ফ্যাশনের বিজ্ঞাপনই যাবে। বিজ্ঞাপনদাতা ও টার্গেট অডিয়েন্সের মধ্যকার এই যোগাযোগটা ঘটানোর জন্যই রয়েছে মেটা বা গুগল। এই কাজটি করেই তাদের বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে। সম্ভাব্য ক্রেতাকে টার্গেট করার ক্ষেত্রে তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খুব সফল। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা ঘটছে ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা তছনছ করে (এসব সাইটে অবশ্য হাজার হাজার শব্দের নীতিমালা না পড়েই ‘আই অ্যাগ্রি’ চেকবক্সে টিক চিহ্ন দিয়েই মানুষ রেজিস্টার করে থাকে, এবং গোপনীয়তার অধিকার ক্ষুণ্ণ হবার সম্মতি দিয়ে থাকে)। লক্ষ করার বিষয়, এই প্রক্রিয়ায় ব্যবহারকারী বিক্রি হচ্ছেন দুই দফায় - প্রথমত ডাটাবেজের মধ্য দিয়ে, দ্বিতীয়ত বিজ্ঞাপনের টার্গেট হবার মধ্য দিয়ে। ফেসবুক-টুইটারে বহু পোস্ট দেখা যা কিনা ‘স্পন্সরড’ । আবার বহু ছদ্মবেশি পোস্ট তৈরী হয় যার একটা নিরীহ-স্বাভাববিক চেহারা থাকলেও তা মূলত বিজ্ঞাপিত। আর এসবকিছুই হচ্ছে, কোটি কোটি ব্যবহারকারীর উদ্বৃত্ত ও বেতনবিহীন শ্রমের বিনিময়ে।
বেতনবিহীন শ্রমের বিষয়টি হারম্যান-চমস্কির প্রচারণা মডেলে আলোচিত হয় নি, কারণ সামাজিক মাধ্যমের এই দিকটি পুরনো গণমাধ্যমে প্রযোজ্য ছিল না। তবে প্রচারণা মডেলে যেমন বলা হয়েছিল বিজ্ঞাপনদাতাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো কিছুর সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু গণমাধ্যমে প্রচার হয় না। সংবাদপত্রের রাজস্ব আসতো বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি পাঠকদের দেয়া ক্রয়মূল্য থেকেও। ডিজিটাল প্লাটফর্মে অডিয়েন্স ইন্টারনেটের খরচ ছাড়া আর তেমন কিছু ব্যয় করে না, কিন্তু পুরো অর্থনীতি গড়ে উঠেছে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে তাকেই বিক্রি করে দেবার মধ্য দিয়ে। সনাতনী মাধ্যমে তাকে অনির্দিষ্টভাবে টার্গেট করা হতো এক দফায়, ডিজিটাল মাধ্যমে তা হচ্ছে দুই দফায়, সুনির্দিষ্টভাবে। (মেটাডাটা বিষয়ে টিকা যুক্ত করলে ভালো হয়। প্রবন্ধের নানান জায়গায় প্রসঙ্গটা আছে)
হারম্যান-চমস্কি তাদের মডেলে বলেছিলেন, বিজ্ঞাপনদাতারা নিজস্ব নীতি অনুযায়ী বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য অনুষ্ঠান বাছাই করে। দুর্লভ ব্যতিক্রম ছাড়া এ ধরনের অনুষ্ঠান হয় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে রক্ষণশীল মনোভাবের (হারম্যান ও চমস্কি, ২০০২: ৯৫) । পরিবেশের ক্ষতি, সামরিক-কারখানা-কমপ্লেক্স নির্মাণ কিংবা তৃতীয় বিশ্বে জুলুম-জবরদস্তির প্রতি কর্পোরেশনগুলোর সমর্থন ও মুনাফা বিষয়ে যেখানে আলাপ, সেখানে বিজ্ঞাপনদাতারা বিজ্ঞাপন দেয় না। সেই রক্ষণশীলতা অনলাইনেও সম্প্রসারিত। আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অ্যালগরিদম নির্ভর ডিজিটাল ও অনলাইন প্লাটফর্মগুলোয় সেই আদর্শগুলো বেশি দৃশ্যমান হবে, যাদের অর্থের জোরে পণ্য-সেবা-আদর্শ প্রাথমিকভাবে ‘বুস্ট’করতে সক্ষম। আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেই আধেয়গুলোকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেশি বেশি দৃশ্যমান করে তোলে, যেগুলো ‘বুস্ট’ -এর মাধ্যমে ইতোমধ্যেই ভালো ‘রিচ’ অর্জন করে ফেলেছে। বলা যায় কেবল রাজনৈতিকভাবে ও ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীলতা নয়, ধনিক শ্রেণি ও বিজ্ঞাপনদাতাদের কারণেও অনলাইনে রক্ষণশীলতা বিস্তার লাভ করছে।
তৃতীয় ছাঁকনি: সংবাদ-উৎস
প্রচারণা মডেল বলছে, মিডিয়ার পক্ষে সব জায়গায় সাংবাদিক পাঠানোর সুযোগ নেই। বড়-ছোট সব প্রতিষ্ঠানই বরং জনসংযোগ বিভাগের মধ্য দিয়ে সংবাদ সরবরাহ করে থাকে, মিডিয়া সেসব থেকে কিছু নির্বাচিত বিষয়ে সংবাদ করে। যুক্তরাষ্ট্রে হোয়াইট হাউস, পেন্টাগন, স্টেট ডিপার্টমেন্ট, নগরভবন, পুলিশ, ব্যবসায় কর্পোরেশন এসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিত সংবাদের উৎস। এরা একেকটি আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা। মার্ক ফিশম্যান এই সম্পর্ককে বলছেন, আমলাতান্ত্রিক ঐক্যের নীতি - অন্য আমলাতন্ত্র ও সংবাদ আমলাতন্ত্র। হাজার হাজার স্থানীয় চেম্বার জনসংযোগ ও লবি করে, এভাবে ‘নিয়মিত’ সংবাদসূত্রের সঙ্গে পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক তৈরী হয়। পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সুবাদে মিডিয়ার ওপর সূত্রগুলো প্রভাব বিস্তার করে, মিডিয়া নিয়মিত সূত্রকে অসন্তুষ্ট করতে চায় না।
উৎসের ছাঁকনিটি অনলাইনে ভিন্নভাবে কাজ করে। ইন্টারনেটের আছে বিকেন্দ্রীকৃত ও বৈশ্বিক গঠন বা আর্কিটেকচার। ক্যাস্টেলসের গণ-ব্যক্তি-যোগাযোগ-এর কথা আগেই বলা হয়েছে। তথ্য-উৎসের ধরন ভিন্ন হলেও ফলাফল প্রায় একই। অনলাইন দুনিয়া ব্যক্তি-সেলিব্রিটি (বিনোদন আর খেলাধুলা) আর ইনফ্লুয়েন্সারদের দখলে। প্রতিষ্ঠানের অনলাইন বা সামাজিক মাধ্যম একাউন্ট/পেইজ থাকে বটে, তবে সেগুলো ব্যক্তির কাছে পরাস্ত। তবে শীর্ষ ব্যক্তিরা মূলত বিনোদন বা ক্রীড়াজগতের সেলিব্রিটি। আর আছেন রাজনীতিবিদরা। ২৭শে ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে টপ টুইটার একাউন্ট তালিকায় বারাক ওবামার নাম শীর্ষে (১৩০.৪ মিলিয়ন) থাকলেও, বার্নি স্যান্ডার্সের ফলোয়ার (১৫.৪ মিলিয়ন) সে তুলনায় কম। টপ টুইটার ফলোয়ার তালিকায় এমনকি বারাক ওবামাও ব্যতিক্রম। নয়তো শীর্ষের বাকি নামগুলো হলো কেটি পেরি (১০৮.৭ মিলিয়ন), জাস্টিন বিবার (১১৪.২ মিলিয়ন), রিহানা, টেইলর সুইফট বা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। রাজনীতিবিদদের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদীর অনেক ফলোয়ার।
চতুর্থ ছাঁকনি: হুমকি-ধামকি
প্রচারণা মডেলে বলা হচ্ছে, মিডিয়ার অনুষ্ঠানের প্রতি সরকারের নেতিবাচক সাড়ার মধ্যে থাকে চিঠি, টেলিফোন, মামলা, কংগ্রেসে বক্তব্য, বিল উত্থাপন, হুমকিসহ নানান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। ব্যক্তিগত, স্থানীয় বা কেন্দ্রীয় পদক্ষেপও এর অন্তর্ভুক্ত। সম্পদশালী ব্যক্তি/গোষ্ঠী প্রতিক্রিয়া জানায় মামলার মাধ্যমে ও বিজ্ঞাপন বন্ধের হুমকির মধ্য দিয়ে। এছাড়া কর্পোরেশন থেকে ক্রুদ্ধ অফিসারের জবাবদিহি চাওয়া বা সম্পর্ক অবনতির হুমকি দেয়া তো রয়েছেই। মিডিয়া আক্রমণে তৎপর [? যুক্তরাষ্ট্রে কিছু মনিটরিং সংস্থা আছে ] দক্ষিণপন্থী মিডিয়া-মনিটরকে অনুদান দেয়াও একটা উপায় তাদের কাছে।
হারম্যান-চমস্কি (২০০৯) বলেছিলেন, ফক্স নিউজের মতো ডানপন্থী মিডিয়া, ডানপন্থী রেডিও টক-শো এবং ওই মতাদর্শের ব্লগগুলো হলো আক্রমণ-যন্ত্র ও ইকো চেম্বার বিশেষ যেখানে কেবল পছন্দের আলাপই শোনা যায়। এই বক্তব্যকে স্মরণ করে ক্রিশ্চিয়ান ফুকস বলছেন, জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, জাতিবিদ্বেষ ও ফ্যাসিবাদের সময়ে সামাজিক মাধ্যম অবশ্যই একটি ডানপন্থী আক্রমণ-যন্ত্র (ফুকস, ২০১৮: ৮৩)। ২০১৬ সালের নির্বাচনের সময়ে দেখা গিয়েছিল ট্রাম্প সমর্থকরা হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে নানান অপতথ্য ছড়িয়েছিল। ২০২০-এর নির্বাচনের সময়েও ভুল ও অপতথ্যের ছড়াছড়ি দেখা গেছে। কভিড নিয়ে গুজব ছড়ানোর ব্যাপারে ডানপন্থীরাই অগ্রগামী ছিল। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক যত সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে, সব ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়েছে ফেসবুকের কোনো পোস্টকে। সেই পোস্টদাতা হবেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ, সেই পোস্ট/ভিডিওর বহুল প্রচার হয় দ্রুত, তারপর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের বাড়িতে গিয়ে হামলা করা হয়। তাদের হতাহত করা, বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি অপরাধমূলক কাজ করা হয় ওই একজনের পোস্টের কারণে। ব্যক্তির দায় গিয়ে পড়ে পুরো সম্প্রদায়ের ওপরে। পরে দেখা যায়, যে পোস্টকে ঘিরে এত কান্ড তা হয় ভুয়া, নয়তো ওই ব্যবহারকারীর নিজের করা পোস্ট নয়।
এত কিছুর পরেও সাম্প্রদায়িক হামলায় যুক্তদের বিশেষ শাস্তি পেতে হয় না। তবে সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে অপতথ্য, হুমকি ইত্যাদি সৃষ্টি করতে অন্যরাও পিছপা হয় না। বাংলাদেশে সরকারের দিক থেকে সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারীদের জন্য হুমকি হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। আজকাল মানহানির সব মামলাই হয় এই আইনে, কারণ এই আইনের শাস্তি কঠোর। মুদ্রণ মাধ্যমে লিখলে যা সামান্য অপরাধ, এই আইনে তাই হয়ে যায় জামিনঅযোগ্য অপরাধ।
পঞ্চম ছাঁকনি: প্রাধান্যশীল মতাদর্শ
এই প্রবন্ধের শুরুতে বলা হয়েছে যে, অন্য চারটি ছাঁকনি এখন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক, কিন্তু পরিবরর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পঞ্চম ছাঁকনিটির ভিন্ন নাম দেয়া দরকার। খোদ হারম্যান-চমস্কিই তা একরকম অনুমোদন করেছেন। তাইতো পঞ্চম ফিল্টারের নাম দেয়া হয়েছে প্রাধান্যশীল মতাদর্শ। হারম্যান (২০১৮) এক লেখায় বলছেন, সেই প্রাধান্যশীল মতাদর্শ হলো বাজার-ব্যবস্থার প্রতি ধর্মীয় বিশ্বাসের মতো ভক্তি। রোনাল্ড রিগ্যান একে বলেছিলেন, ‘বাজারের যাদু’ (মিরাকল অব মার্কেট)। তবে মূল প্রচারণা মডেলে পঞ্চম ফিল্টারের আলোচনায় হারম্যান-চমস্কি বলেছিলেন, সমাজতন্ত্র সম্পদ-মালিকদের ভূতের মতো তাড়া করে। সাম্যবাদ তাদের শ্রেণি-অবস্থান ও আধিপত্যের মূলে আঘাত করে। সোভিয়েত, চীন, কিউবার বিপ্লব তাদের কাছে দুষ্টক্ষত। সাম্যবাদ বিরোধিতা পশ্চিমা রাজনীতি ও মূল্যবোধের মৌলনীতি। সনাতনী পশ্চিমা বা মার্কিন মিডিয়া সেই আদর্শ দ্বারাই পরিচালিত। যদিও বিকল্প মিডিয়ার চর্চা পশ্চিমের দেশগুলোয় ছিল বা আছে, সমাজে সেগুলোর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু মূলধারার বিশাল আকার ও প্রভাবের কাছে তা সামান্যই।
এখন ইন্টারনেটের দিকে তাকালে দেখা যাবে, বিষয়টি অবশ্যই সমাজতন্ত্র বিরোধিতার মধ্যে সীমিত নয়। বরং ধর্মীয় উগ্রবাদ, ফ্যাসিবাদ, বর্ণবাদ, জাতীয়তাবাদ, পিতৃতান্ত্রিকতা ইত্যাদির চাষবাস বেশি। ইন্টারনেট সবার জন্যই পরিসর দেয়, সেখানে প্রগতিশীল ও উদারপন্থী মানুষের পাশাপাশি রক্ষণশীল ও ডানপন্থী মানসিকতার ব্যক্তি-মানুষ বা সংগঠিত গোষ্ঠী পুরামাত্রায় হাজির রয়েছে। ২০২১ সালের এপ্রিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাম্প্রদায়িক হামলার প্রেক্ষাপটে জেলার স্থানীয় সাংবাদিকরা হেফাজতে ইসলামের সংবাদ বর্জনের ঘোষণা দিলে, দলটির নেতা মামুনুল হক বলেছিলেন, “আমাদের মিডিয়া লাগবে না, ফেসবুক আছে” (দেখুন, www.newsbangla24.com/politics/131565/ ) । মতাদর্শ নির্মাণ আর কেবল দার্শনিক কিংবা লেখক-সাংবাদিকের মধ্যে সীমিত নয়।
সামাজিক মাধ্যমে মতাদর্শ নির্মাণ ও তার চর্চা হচ্ছে প্রতিদিন, ব্যবহারকারীরাই এর পুনরুৎপাদন করছে, অল্প কথায় ও সরাসরি, এবং শোরগোলের মধ্য দিয়ে। জনপরিসরে নিজের মতাদর্শ ছড়িয়ে দেয়া ও ওপরের ওপর চাপিয়ে দেবার আনন্দ ও সাফল্য ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে আরও সক্রিয় হতে অনুপ্রাণিত করে। অনেকেই লোকরঞ্জনবাদ ও লাইক-কমেন্টের ফাঁদে পড়ে দক্ষিণপন্থী মতাদর্শের কাছে নিজেকে সঁপে দিচ্ছে। আর অ্যালগরিদমের চক্কওে পড়ে সেসবেরই পুনরুৎপাদন হচ্ছে। আমি কলকাতার দু’জন তরুণ ইউটিউবারের ‘Bong Views’ বলে একটি চ্যানেল ফলো করতাম। ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাংলাদেশে বেশি বলে তারা প্রথমে বাংলাদেশের বিভিন্ন গান, টিভি নাটকের দৃশ্য, দর্শনীয় স্থানসহ নানান মজার ভিডিওর ‘Indian reaction’ দিতেন। তাদের ফলোয়ার যত বাড়তে থাকলো, তারা গান-বাজনা থেকে সরে এসে বাংলাদেশের ওয়াজকারীদের ইসলামিক ভিডিওর রিঅ্যাকশন দেয়া শুরু করেছেন।
তবে শুরুটা মন্দ ছিল না। ইন্টারনেটভিত্তিক বিকল্প-মাধ্যম ইন্ডিমিডিয়া এসেছিল, যার জন্ম হয়েছিল ১৯৯৯ সালে সিয়াটলের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সভার বিরোধিতা করতে গিয়ে। এডওয়ার্ড স্নোডেন কিংবা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ জনস্বার্থে তথ্য অবমুক্ত করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু অ্যাসাঞ্জ আজ কারাগারে, স্নোডেন নির্বাসিত। ইন্ডিমিডিয়ার বিভিন্ন শাখায় হামলা হয়েছে (যেমন ইতালির জেনোয়া শাখা), সরকার সার্ভার বাজেয়াপ্ত করেছে (যেমন ব্রিস্টল ও লস এঞ্জেলস শাখা), অনেক শাখা আজ বন্ধ। আরব বসন্তের মতো আন্দোলনও আজকাল হয় না।
কারণ ক্ষমতাবানরা এখন অনেক সতর্ক, গোছানো। তারা জনগণের টাকায় কেনা যন্ত্র দিয়ে জনগণকে পর্যবেক্ষণ করছে, সরকারি অফিসে বসে। যন্ত্র দিয়ে তারা সবসময়ই লক্ষ রাখছেন কোথায় কী ঘটছে? প্রয়োজনে তাদের নিয়োগকৃত ব্যবহারকারীরা সামাজিক মাধ্যমের যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে পড়বে, যথাসময়ে আন্দোলনকে ভণ্ডুল করার জন্য। নয়তো টেলিফোনে আড়ি পেতে তা মূলধারার মিডিয়ায় বা সামাজিক মাধ্যমে তা ফাঁস করে প্রমাণ দেবে, বিরোধীরা কেমন দেশবিরোধী ‘ষড়যন্ত্র’ করে। আর গড়ে তোলা হচ্ছে কঠোর আইন যার মাধ্যমে অনলাইনে অ্যাক্টিভিজম কঠিন হয়ে গেছে। ফলে ক্ষমতাতন্ত্র ও রক্ষণশীলতাই এখন সামাজিক মাধ্যমে প্রাধান্যশীল মতাদর্শ হিসেবে এখন এগিয়ে। তবে তাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য স্বাধীন চেতনার ব্যবহারকারীরা আশ্রয় নিচ্ছেন ভিন্ন উপায় - মিম বা অন্যান্য স্যাটায়ার একারণে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অবশ্য মূলধারার রাজনীতিতে জেরেমি করবিন কিংবা বার্নি স্যান্ডার্সের মতো নেতাদের উপস্থিতি কিংবা ভূমিকা সাম্যবাদের ধারণাকে ফিরিয়ে আনছে এবং তা সামাজিক মাধ্যমেও সম্প্রসারিত হচ্ছে।
উপসংহার
সবকিছুর পরেও সামাজিক মাধ্যমে মানুষ নিজের মতামত, একটু সতর্কভাবে হলেও, প্রকাশ করেই চলেছে। ফেসবুককে ঘিরে মানুষ ইকমার্সসহ নানান ধরনের ব্যবসাবাণিজ্য গড়ে তুলেছে, অনেকে ঘরে বসেই উপার্জন করছে। দেশ-বিদেশের সংবাদ, রচনা শেয়ারের মধ্য দিয়ে তথ্য ও জ্ঞানের আদান-প্রদানও হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমগুলো সামনের সময়ে কোন দিকে যাচ্ছে, তার হদিসও আমাদের রাখতে হবে। গুগল ও মেটার মতো কয়েকটি কোম্পানির একচেটিয়াত্ব একটি বিশেষ আশঙ্কার বিষয়। মূলত ওয়েব ২.০-র ভিত্তিতে সামাজিক মাধ্যম গড়ে উঠেছিল যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মিথস্ক্রিয়া।
অর্থাৎ ব্যবহারকারীরা প্লাটফর্মের সঙ্গে এবং নিজেদের মধ্যে তাৎক্ষণিক মতবিনিময় করবে। ভবিষ্যতের যে ওয়েব ৩.০, সেখানে অল্প কয়েকটি কোম্পানির একচেটিয়াত্ব থেকে সামাজিক মাধ্যমকে উদ্ধার করার এক বাসনা রয়েছে। টেক জায়ান্টের নির্ভরতা এড়িয়ে বিকেন্দ্রিক এক ইন্টারনেটের কথা ভাবা হচ্ছে। ভাবা হচ্ছে তখন ইন্টারনেটভিত্তিক অর্থনীতিও হবে বিকেন্দ্রিক, যেখানে ব্লকচেইন পদ্ধতিতে বিটকয়েনের মতো নিরাপদ ও সুরক্ষিত ডিজিটাল মুদ্রার জনপ্রিয়তা বাড়বে, সরকার ও টেক জায়ান্টদের হস্তক্ষেপমুক্ত হবে সেটা।
কিন্তু ইন্টারনেটকে গণতান্ত্রিক চেতনার জায়গা থেকে পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা কতটুকু সফল হবে কে জানে! কারণ মেটাভার্স প্রযুক্তির কথাও বলা হচ্ছে পাশাপাশি, যাতে সামাজিক মাধ্যমে ব্যবহারকারীর অংশগ্রহণ হবে ইমারসিভ বা নিমজ্জনের। ভার্চুয়াল রিয়ালিটির হেডসেট ব্যবহার করে ত্রিমাত্রিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যমে ব্যবহারকারী আরো ডুবে যাবেন, আরও হারিয়ে যাবেন এবং তার গোপনীয়তা আরও বেশি অরক্ষিত হবে, তাকে বিক্রি করা আরও সহজ হবে। ফেসবুক ইতোমধ্যেই তার কোম্পানির নাম দিয়েছে মেটা প্লাটফর্মস, এবং জুকারবার্গ একে মেটাভার্স ইকোসিস্টেম হিসেবে দাঁড় করানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
সেরকম হলে প্রচারণা মডেলের ছাঁকনিগুলো কীরকম করে কাজ করবে, আরেক দফা, তা আবার পরীক্ষা করতে হতে পারে। তবে তার আগ পর্যন্ত বিকল্প যে সামাজিক মাধ্যমের আলাপ আছে, যার কিছু কিছু নিরীক্ষা ইতোমধ্যে চালুও আছে, সেগুলো নিয়ে আরও কাজ হওয়া দরকার। সেধরনের ওয়েবসাইট জনপ্রিয় হওয়া দরকার যেগুলো ভালো সার্ভিসের নাম করে কুকিজ দিয়ে ব্যবহারকারীকে মনিটর করবে না। সে সামাজিক মাধ্যম হবে এনক্রিপ্টেড অর্থাৎ ব্যবহারকারীর তথ্য সুরক্ষিত থাকবে, প্লাটফর্ম তা কারো কাছে বিক্রি করবে না। বাংলাদেশে না হোক, পশ্চিমা দেশগুলোতেই উন্মুক্ত ইন্টারনেটের জন্য আন্দোলনকারী ও প্রাযুক্তিক উদ্ভাবনীর মানুষ অনেক আছেন, যারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু টেক জায়ান্টরা এত বেশি সর্বগ্রাসী যে আপাতত প্রপাগান্ডা মডেলে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে হচ্ছে না।
তথ্যসূত্র
ক্যাস্টেলস, ম্যানুয়েল (২০০৭)। কমিউনিকেশন, পাওয়ার অ্যান্ড কাউন্টার পাওয়ার ইন দ্য নেটওয়ার্ক সোসাইটি। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব কমিউনিকেশন। ১। পৃ. ২৩৮-২৬৬।
ক্লাইন, নাওমি (২০০৮)। দ্য শক ডক্ট্রিন: দ্য রাইজ অব ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম। লন্ডন: পিকাডর।
ফুকস, ক্রিশ্চিয়ান (২০১৮)। প্রপাগান্ড ২.০: হারম্যান অ্যান্ড চমস্কি’স প্রপাগান্ডা মডেল ইন দ্য এইজ অব দ্য ইন্টারনেট, বিগ ডেটা অ্যান্ড সোশ্যাল মিডিয়া। জে. পেড্রো-কারানানা, ডি. ব্রাউডি ও জে. ক্লাইন (সম্পা.), দ্য প্রপাগান্ডা মডেল টুডে: ফিল্টারিং পারসেপশন অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস। লন্ডন: ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টমিনিস্টার প্রেস। পৃ. ৭১-৯২।
রহমান, আনিস, রেজা, শামীম ও হক, ফাহমিদুল (২০১৭)। দ্য পলিটিকো-কমার্শিয়াল নেক্সাস অ্যান্ড ব্রডকাস্ট পলিসি রিফর্ম ইন বাংলাদেশ। সাহানা উডুপা ও স্টিফেন ডি. ম্যাকডোয়েল (সম্পা.), মিডিয়া অ্যজ পলিটিক্স ইন সাউথ এশিয়া। লন্ডন: রাউটলেজ। পৃ. ১১০-১২৬।
হক, ফাহমিদুল (২০১১)। অসম্মতি উৎপাদন: গণমাধ্যমবিষয়ক প্রতিভাবনা। ঢাকা: সংহতি।
হারম্যান, এডওয়ার্ড এস. ও চমস্কি, নোম (২০০৮[২০০২])। সম্মতি উৎপাদন: গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতি (আ-আল মামুন অনূদিত)। ঢাকা: সংহতি।
হারম্যান, এডওয়ার্ড এস. (২০১৮)। প্রপাগান্ডা মডেল রিভিজিটেড। মান্থলি রিভিউ। DOI: 10.14452/MR-069-08-201801_4|
হারম্যান, এডওয়ার্ড এস. ও চমস্কি, নোম (২০০৯)। দ্য প্রপাগান্ডা মডেল আফটার টুয়েন্টি ইয়ার্স (অ্যান্ড্রু মুলেনকে দেয়া সাক্ষাৎকার)। https://chomsky.info/200911__/, ৫ই জানুয়ারি, ২০২২ তারিখে সংগৃহীত।