দেশের গার্মেন্ট ও বস্ত্র (টেক্সটাইল) শিল্পে নারীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে লৈঙ্গিক সমতা ও ক্ষমতায়ন হয়েছে। তবে সম্প্রতি এই খাতে নারীদের সুযোগ সংকোচনের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। অভ্যন্তরীণ নানা সংকটের পাশাপাশি অটোমেশনের ধাক্কা এবং বৈদেশিক বিভিন্ন তৎপরতায় এই সংকট ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাচ্ছেন আনিস রায়হান
পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকের মোট সংখ্যা ২০১৩ সালের ১৭ লাখ ৪ হাজারের তুলনায় ২০১৮ সালে ১৫ লাখ ৩১ হাজারে নেমে এসেছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৮ সালের ওই জরিপে আরও দেখা যায়, শ্রমিকদের মধ্যে পুরুষের অনুপাত ৫৩ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং নারীর অনুপাত ৪৬ দশমিক ১৮ শতাংশ। যার অর্থ হলো চাকরি হারানো শ্রমিকদের বেশির ভাগই নারী। নতুন করে যাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে তাদের বেশির ভাগই পুরুষ এবং প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন।
নারী শ্রমিকদের কাজ হারানোর পেছনে বেশ কিছু প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলো হচ্ছে,
১) কারখানাগুলোতে নতুন ও দামি যন্ত্রপাতি বসানো হচ্ছে। ব্যবস্থাপকরা মনে করেন, নারীরা দামি মেশিন চালাতে পারবে না।
২) প্রযুক্তি বিষয়ক প্রশিক্ষণ নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীরা পিছিয়ে আছে। পারিবারিক সীমাবদ্ধতা ও অনুৎসাহ প্রদানকেই এর জন্য দায়ী করা হয়।
৩) গার্মেন্ট শিল্পে বেতন বাড়ায় পুরুষরা এ খাতে কাজ পেতে আগের চেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা করছে।
৪) নারীরা গড়ে ৭ বছরের মতো সময় গার্মেন্টে কাজ করে। এরপর বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে তারা কারখানা ছেড়ে দেন।
ধরেই নেওয়া হয়েছে যে, পোশাক খাতে চলমান রূপান্তরণের ফলে নারীরা বাদ পড়তে বাধ্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নারী শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা পোশাক খাতকে আজকের অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। শুধু তাই নয়, নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে নারীরা এ খাতে যুক্ত হয়েছে। এটা অর্থনীতিকে গতিশীল করার পাশাপাশি রাষ্ট্রকেও এনে দিয়েছে নারী ক্ষমতায়নে অগ্রসর হওয়ার মর্যাদা। তাই এই শিল্প খাত ও সরকার নারীদের পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না।
অটোমেশনের প্রভাব
কয়েক বছর আগেও প্রতিটি কারখানায় বেশির ভাগ মেশিনে দু’জন করে শ্রমিক কাজ করতেন। একজন সুইং অপারেটর মেশিন চালাতেন; আরেকজন হেলপার অপারেটরের উল্টো দিকে বসে তাকে সাহায্য করতেন। ২০১৫ সালের পর থেকে আধুনিক প্রযুক্তির নতুন মেশিন আসতে থাকায় বেশির ভাগ কারখানায় হেলপারের পদ খালি হয়ে গেছে।
সুতা কাটা, আয়রন করা, কাটিং, ড্রয়িং, লে-আউট, লোডিং-আনলোডিং-এর মতো অনেক কাজই এখন মেশিন দিয়ে করানো সম্ভব। বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে পণ্যের নকশা করা এবং তার বিনির্মাণ প্রক্রিয়ায়ও অটোমেশন শুরু হয়েছে। যেমন: থ্রিডি স্যাম্পলিং, অটোক্যাড, অটোকাটার এগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে। হাইটেক সেন্সর মেশিন, বারকোড রিডার ব্যবহার করা হচ্ছে।
ম্যাককিনসি অ্যান্ড কোম্পানির ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, কারখানার সুইং বা সেলাই পর্যায়ে ৯০ ভাগ শ্রমিকের কাজই এখন যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব। একইভাবে ওয়্যারহাউজ, বন্ডিং, নিটিং, ফিনিশং প্রতিটি ধাপেই যন্ত্র ব্যবহার করে বিভিন্ন মাত্রায় শ্রমিক কমিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে।
২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) একটি গবেষণায় অনুমান করা হয়, অটোমেশন যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে এশিয়ার কিছু দেশে বস্ত্র, বয়ন ও তৈরি পোশাক সংশ্লিষ্ট উৎপাদন খাতের ৮০ শতাংশেরও বেশি কর্মসংস্থান হারিয়ে যাবে।
নিউইয়র্কের শিমি টেকনোলজি নামের একটি প্রযুক্তি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সারাহ ক্রেসলি বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাত নিয়ে বলেছেন, ১০ বছর পরে পোশাক কারখানায় খুব অল্প শ্রমিকই আসলে কাজ করবে। এদের ৬০ হতে ৮৮ শতাংশ কাজ হারাবে অটোমেশনের কারণে। যেভাবে অটোমেশন গাড়ি নির্মাণ শিল্পকে পাল্টে দিয়েছে, এবার পোশাক শিল্পে তারই পুনরাবৃত্তি দেখা যাবে।
অটোমেশনের ফলে কারখানা বন্ধা বা কর্মসংস্থান কমলেও উৎপাদন কমবে না। ২০০০ সালে বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব ছিল আড়াই শতাংশের মতো। এখন তা সাড়ে ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ, অটোমেশন শ্রমিক ও ছোট পুঁজির মালিকের জন্য বিপদ বয়ে আনলেও বড় পুঁজির মালিকদের জন্য সুবিধাই তৈরি করবে।
শ্রম অধিকার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ঊদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে নারী শ্রমিকদের উত্তরণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পাঠ দিয়ে দক্ষ টেকনিশিয়ান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রকে এক্ষেত্রে একাডেমি সৃষ্টিতে বিনিয়োগ করতে হবে। শিল্প মালিকদের নিয়োগ নীতিমালায় নারীকে অগ্রাধিকার প্রদানের বিধান নিশ্চিত করতে হবে।