শুক্রবার ১৪ই চৈত্র ১৪৩০ Friday 29th March 2024

শুক্রবার ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

Friday 29th March 2024

বহুস্বর মতামত

জুবাইদার চিত্রে ১৯৭১ এবং সালিমা হাশমীর সঙ্গে দু’চার কথা

২০২২-১১-২৪

আহমেদ শামীম

চিত্রশিল্পী সালিমা হাশমী (১৯৪২-), তাঁর বাবা ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের (১৯১১-১৯৮৪) কিছু অধুনা প্রকাশিত চিঠি এবং পাকিস্তানের মডার্ন আর্টের প্রথম চিত্রকর জুবাইদা আগা (১৯২২-১৯৯৭)'র কাজ নিয়ে আজ আমাদের বিভাগে (এশিয় অধ্যয়ন, ইউটি-অস্টিন) একটা বক্তব্য উপস্থাপন করলেন। মহাফেজখানা থেকে তুলে আনা চিঠি আর চিত্রের সমাহার আর সেই সঙ্গে প্রতিটার পটভূমি বর্ণনা করলেন, নিজের পর্যালোচনাসহ। তাঁর উপস্থাপনায় উঠে এলো জুবাইদার ছবিতে এবং ফয়েজের কবিতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা। উপস্থাপনা শেষে তাঁর সঙ্গে আমার দু’চার কথা হলো। সে কথাগুলো শেষে বলব, আগে সালিমার বক্তব্যটির প্রাসঙ্গিক অংশ সংক্ষেপে বলা যাক।    

 

প্রথাবিরোধী জুবাইদার জীবন তাঁর শিল্পের চেয়ে কম কিছু নয়। তাঁর ছবি আঁকা শুরু পাকিস্তানে, তারপর চলে যান লন্ডন, পরে সেখান থেকে প্যারিসে গিয়ে ঘাঁটি গাড়েন। অসংখ্য ছবি আঁকেন। ছবিতে পিকাসো, এমন কি ভ্যান গগের প্রভাব পাওয়া যায়। প্যারিসের পাট চুকিয়ে ফিরে আসেন আবার পাকিস্তানে। জুবাইদার সঙ্গে সালিমার সাক্ষাতকার এবং জুবাইদার জীবন পরিক্রমা দিয়ে সালিমা কথা বলে গেলেন ছবি ধরে ধরে। জুবাইদার চিত্রগুলো বিমূর্ত বিধায় ভয়ানক নিন্দার সম্মুখীন হয়েছিলো কোনও কোনও সময়, মূলত তাঁর ছবিতে পাকিস্তান কোথায়- সমসাময়িকদের মধ্যে এমন সমালোচনা হতো। জুবাইদার থোড়াই কেয়ার করতেন ওইসব কথায়। জুবাইদার কথা শুনতে শুনতে বাংলাদেশের ভাস্কর নভেরার (১৯৩৯-২০১৫) কথা মনে পড়ছিল।

 

একপর্যায়ে পর্দায় এলো জুবাইদার ১৯৭১ সালে আঁকা একটি চিত্রকর্ম। চিত্রটি বাম দিকে মাঝ থেকে নিছের দিকে কতগুলো সবুজ গাছ, এবং ডান দিকে মাঝ থেকে উপর দিকে ছয়টি ফুল, দুটি সাদা, দুটি লাল, দুটি সবুজ। ফুলগুলোর পশ্চাৎপটে একটা কার্টোগ্রাফিক আবছা জমিন, বাংলাদেশের ম্যাপ মনে হবে (আমার হয়েছে)। সেই জমিনের উপর আরও আবছা একটা সবুজ ছোপ, সেই ছোপের মাঝে গোলমত আবছা একটা লাল ছোপ। ছবিটা সম্পর্কে সালিমা বললেন, চিত্রকর এখানে ১৯৭১ সনের যুদ্ধ দ্বারা আন্দোলিত সেটা ছবিতেই অনুমান করা যায়। ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা আছে এমন যে কারো কাছে ধরা পড়বে ছবিটার বিষয় বস্তু এবং ছবির কোন অংশে কোন দেশ। সেই দুই অংশের মাঝে একটা আঁকাবাঁকা সবুজ দাগ আছে। সেই দাগটি হয় সীমানা কিংবা সংযোগ হিসেবে পড়া যেতে পারে। যাহোক, এই ছবির প্রসঙ্গে সালিমা চলে গেলেন জুবাইদার সঙ্গে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের চিত্রকরদের যোগাযোগ থাকা প্রসঙ্গে।

 

জুবাইদার সঙ্গে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের (১৯১৪-১৯৭৬) খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিলো। জুবাইদা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের তরুণ শিল্পীদের পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। সেসব শিল্পী বাছাই করে দিতেন জয়নুল আবেদীন। সালিমা বলে গেলেন। আমার মনের কোণে জয়নুল সম্পর্কে জানা কথাগুলো ভেসে উঠলো। জয়নুল আবেদীন তরুণ শিল্পীর আধুনিক শিল্পের চর্চার খুব সমাদর করতেন। নভেরার কাজ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, নভেরা আজ যা করছে তা আমাদের বুঝতে আরও অনেক সময় লাগবে। ও সেই রকমই একজন শিল্পী। যাহোক, সালিমার একটি কথায় আবার মনোযোগ ফিরে এলো। তিনি বললেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাঁর বাবার সঙ্গে বাবার ঢাকার বন্ধুদের সম্পর্কে কেমন অভিঘাত ফেলেছিল।  

 

জয়নুল আবেদীন ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের পারিবারিক বন্ধু। সালিমার প্রিয় জয়ন চাচা। প্রসঙ্গত ১৯৭৪-এ ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের ঢাকা ভ্রমণের কথা এলো, পুরনো বন্ধু অনেকেই দেখা করেননি সেবার ফয়েজের সঙ্গে। ফয়েজের তা মর্মে লেগেছে। পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে লিখেছেন সেই বিখ্যাত কবিতা “ঢাকা সে ওয়াপসি পর” যার প্রথম লাইন “হম কি ঠেহ্‌রে অজনবী ইতনী মুদারতোঁ কে বা’দ। ফির বনেঙ্গে আশনা কিতনী মুলাকাতোঁ কে বা’দ।” তবে সালিমা এরপর যা বললেন তাতে মনে হলো এই কবিতার মধ্যে জয়নুল উপস্থিত আছেন।

      

ঢাকা থেকে ফিরে ফয়েজ পাকিস্তানে পৌঁছানোর সাথে সাথেই সালিমা তাঁকে জিজ্ঞেস করেন জয়ন চাচার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো কিনা। ফয়েজ খুব ভারাক্রান্ত কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ হোটেল লবিতে, কিন্তু ও আমার কামরায় এলো না। এটা নিয়ে তাঁর কষ্ট সেই “ঢাকা থেকে ফেরার পর” কবিতায়ও ফুটে উঠেছে: এতো মেহমানদারির পরও আমরা আজনবি রয়ে গেলাম, কতো মোলাকাতের পর ফের বন্ধু হব। সালিমা বললেন, তাঁর বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জয়ন চাচার অবাধ যাতায়ত ছিলো ফয়েজের ঘরে। সেই জয়ন চাচা ঢাকায় ফয়েজের হোটেল রুম পর্যন্ত আসেননি। ফয়েজের ওই কবিতায় সেই ব্যক্তিগত বেদনার ছাপও পড়েছে।

 

জুবাইদার ১৯৭১ চিত্রটিতেও তেমন একটা বিষাদ, চাপা কষ্টের ছাপ আছে কালার এবং কম্পোজিশনে। একথা বলে সালিমা পরের চিত্র প্রসঙ্গে চলে গেলেন। কিন্তু আমি তো আটকে গেলাম সেখানে। দুইটা প্রশ্ন মাথায় পাক খেতে শুরু করল। চেপে রেখে শুনে গেলাম। ভাষণ শেষে প্রশ্ন-উত্তর, তারপর ব্যক্তিগত আলাপ-পরিচয়। আমি সেই সুযোগে সালিমার কাছে গেলাম। পরিচয় দিয়ে প্রশ্ন করলাম, শিল্পী জয়নুল আবেদীনের সঙ্গে সেই ঘটনার কথা, এবং আপানার কাছে এসে আক্ষেপ করার কথা ফয়েজ কি কোথাও লিখেছেন বা বলেছেন কোনও সাক্ষাতকারে? সালিমা বললেন, না।

 

আমি এবার তাঁকে জিজ্ঞেস ফয়েজ কি আর কিছু বলেছেন এ ব্যাপারে? তিনি আমার কণ্ঠে কী টের পেলেন জানি না তবে গল্পটা আবার বললেন, বলে এবার এও বললেন, অবশ্যই একথা অনুমেয় যে বাবা জয়ন চাচার মনের কষ্টটাও অনুভব করতে পেরেছিলেন। আফটার অল যা ঘটেছে তা তো তাঁদের দুজনের জীবনের চাইতে অনেক বড় বিষয়। আমি কবিতাটার শেষ দুই লাইনের সঙ্গে সালিমার কথাগুলো মেলালাম মনে মনে।

 

ঢাকা থেকে ফেরার পর

মূল: ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ

এতো মেহমানদারির পরও আমরা আজনবি রয়ে গেলাম

কতো মোলাকাতের পর ফের বন্ধু হব

কবে নজরে আসবে নিদাগ সবুজ বসন্ত

কতো বর্ষার পর ধুয়ে ফেলব রক্তের দাগ

ভালোবাসার দরদ খতম হবার মুহূর্ত ছিলো খুবই নির্দয়

ভীষণই নিষ্ঠুর ছিলো সকালটা দয়ালু রাতগুলো পর

মন তো চেয়েছিলো তবে দিলো না সুযোগ মনের ভাঙন 

মোনাজাতের পর করে নেয়া যেতো কি শোক অভিযোগ

যখন বলতে গেলো ফয়েজ তাকে সদ্গায় দিয়ে জান

না বলাই রয়ে গেলো সেই কথা অনেক কথার মাঝে

 

ফয়েজ লিখছেন উন সে জো কহনে গয়ে থে ফয়েজ... অন-কহী হী রহ গেঈ ওয়্‌ বাত...। আমার মনে হলো ঠিক এইখানে, এই উন্‌ সর্বনামে জয়নুল উপস্থিত। আমি তড়িৎ বাস্তবে ফিরে সালিমাকে বললাম বললাম আপনি লিখবেন এ কথাগুলো? তিনি বললেন, হ্যাঁ লিখবো আমার স্মৃতিকথায়। এই বলে তিনি আমার পিঠে মৃদু চাপড় দিলেন কয়েকবার। আমার বিশ্বাস হলো, উষ্মা উবে গেলো। আমি আসি বলে চলে এলাম। দ্বিতীয় প্রশ্নটি আর করলাম না।

 

এখন এখানে দ্বিতীয় প্রশ্নটা এবং তা না জিজ্ঞেস করার কারণটা বলে শেষ করছি। আমার দ্বিতীয় প্রশ্নটি ঠিক প্রশ্ন নয়, মন্তব্য, ওই ১৯৭১-এর ছবিটা প্রসঙ্গে। ছবিটা দেখে আমার মনে হয়েছে শিল্পী তেমন বিমূর্ত নন ওই ছবিতে। ছবির বিষয় বস্তুর কথা বলে কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় বলেন তো শিল্পী ছবিটির বাম দিকের অধিবাসী নাকি ডান দিকের, আমার ধারণা ওই লোক উত্তর দেবে, শিল্পী বাম দিকের অংশের অঞ্চলের অধিবাসী। আমার এমন মনে হবার কারণ, গাছগুলো বাম দিকে এবং তা অগ্রপটে, আর ডান দিকে বিচ্ছিন্ন ফুলগুলো পশ্চাৎপটে এবং কার্টোগ্রাফির পটভূমি অধিকরতর গাঢ়। আবার আকারের তারতম্য ব্যবহার করে একটা দূরত্বে চলে যাওয়ার আভাস ফোটানো হয়েছে। আমার মনে হয় শিল্পীর দেশ কোথাও না কোথাও উঁকি দিয়ে যায় তাঁর শিল্পে এবং অনুভূতিতে। এবং এই কারণেই হয়তো জয়নুল আবেদীন সেদিন যেতে পারেন নি ফয়েজের রুম পর্যন্ত। সালিমা নিজে একজন শিল্পী, জয়নুল তাঁর আপনজন; জয়নুলের মনের ভাবের কথা তিনি অনুধাবন করেছেন অনেক গভীরভাবে। তাই তাঁকে আর এটা বলার আর প্রয়োজন ছিলো না। 

 

আহমেদ শামীম  

সহকারী অধ্যাপক (প্রশিক্ষণ)  

এশিয় অধ্যয়ন বিভাগ  

ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস (অস্টিন) 

 

Your Comment