শুক্রবার ১৫ই চৈত্র ১৪৩০ Friday 29th March 2024

শুক্রবার ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

Friday 29th March 2024

বহুস্বর মতামত

চা শ্রমিক যে কারণে আধুনিক দাস

২০২২-০৮-২৪

অনুপম দেবাশীষ রায়

যতবার চা শ্রমিক নেতাদের দিয়ে আন্দোলন বন্ধ করার ঘোষণা দেয়ানো হযেছে, চা শ্রমিকরা ততবার রাস্তায় নেমে এসেছেন। ছবি: সুমন পাল

 

 

চা শ্রমিকেরা তাদের দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকায় উন্নীত করবার জন্য একটি মরণপন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন। তাদের দৈনিক বেতন এতদিন ধার্য ছিল ১২০ টাকায়, এই মজুরিতে এই বাজারে টিকে থাকা অসম্ভব। তীব্র সংগ্রাম ও দরকষাকষির মুখে সরকারের পক্ষ থেকে চা কোম্পানির মালিকদের চাপ প্রয়োগ করে এই মজুরি ১২০ টাকা থেকে ১৪৫ টাকায় উন্নীত করার একটি প্রস্তাব আসে এবং চা শ্রমিকদের ইউনিয়ন এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ডাক দেন। কিন্তু সাধারণ চা শ্রমিকেরা এই প্রস্তাব মানেননি। তারা ৩০০ টাকার আন্দোলন চলমান রেখেছেন। তাদের এই আন্দোলন পরিচালনায় যে দক্ষতা ও দৃঢ় প্রত্যয় দেখা গিয়েছে, তাতে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়েও তাদের একটি সম্ভাবনাময় শক্তিশালী আন্দোলন পরিচালনা করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। চা শ্রমিকদের দৈনন্দিন বাস্তবতাই তাদেরকে সংগ্রাম ও সংঘাতের পথে ঠেলে দিয়েছে। কোম্পানির জুলুমের শাসনের থেকে নিজেদের মুক্ত করে অধিকার আদায় করবার জন্য তাদের কাছে লড়াই ছাড়া আর কোনো উপায় খোলা নেই।

 

 

দাসত্বের হিসাব নিকাশ

চা শ্রমিকেরা যে জমিতে বসবাস করেন সে জমির দলিল তাদের কাছে নেই। অর্থাৎ তাদের বসতভিটার জমিটি চা কোম্পানির জমি। অতএব, যেসব আর্মচেয়ার বুদ্ধিজীবী আজকে চা শ্রমিকদের তাদের বংশান্তরে করে আসা শ্রমটি ছেড়ে শহরে চলে এসে অন্য জীবিকা খুঁজে নেবার সহজ বুদ্ধিটা দিয়ে ফেলছেন, বাস্তব ভিত্তিতে এই কাজটি করা তাদের জন্য অত্যন্ত দুরূহ। কারণ নিজের ঘর ছেড়ে শহরে চলে আসতে চাইলে তাদের বাস্তুভিটাটি হারাতে হয় কিংবা অন্যভাবে বললে তাদের আর কোনো ফেরত যাবার জায়গা বা কোনো ধরনের বিকল্প নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে না। ব্রিটিশ উৎখাতের এতগুলো দশক পরেও যে জায়গাটি এখনও ব্রিটিশ পদ্ধতির জমিদারি প্রথায় চলমান, তা হলো এই চা শ্রমিকদের বাসস্থানের অঞ্চলটি। এরকম একটা অবস্থায়, যেখানে তাদের বসবাসের জায়গাটি নিশ্চিত করতে হলে তাদের কাজে লেগে থাকতে হয়, সেখানে তাদের কাজ ছেড়ে অন্য কাজ খোঁজার বিষয়টি নিতান্তই অসম্ভব হয়ে পড়ে। কাজেই সহজ ভাষার “চাকরি ছেড়ে দাও” বললেই তাদের সমস্যার শেষ হয়ে যায় না। যেহেতু এই চাকরিতে তারা নানান উপায়ে বাধা পড়ে আছেন, সে কারণেই বরং তাদের এই অবস্থাটিকে আমরা আধুনিক যুগের দাসত্ব হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।

 

 

এছাড়া আরও বলা হচ্ছে, চা শ্রমিকদের বেতনের বাইরেও তাদের নানান সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়। যার মাঝে রয়েছে চিকিৎসা সুবিধা, রেশন, পেনশন, প্রাথমিক শিক্ষা সুবিধা, শ্রমিকদের নিজেদের জমিতে নিজেদের ফলমূল উৎপাদনের সুবিধা, ঘর ভাড়ার সুবিধা, শ্রমিক কল্যাণ কর্মসূচি সুবিধা,পারফরমেন্স বোনাস, ওভারটাইম ইত্যাদি। এর মাঝে যদি দৈনিক মজুরি, রেশন, পেনশন ইত্যাদি হিসেব করাও হয় তাহলেও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক জিয়া হাসানের মতে চা শ্রমিকদের দৈনিক বেতন দাঁড়ায় ১৭২.৬১ টাকায়, মালিকপক্ষের দাবি করা ৪০২.৮৮ টাকা নয়। এর মাঝে খেয়াল রাখতে হবে যে, ওভারটাইমকে মৌলিক মজুরি হিসেবে ধরা যাবে না, কারণ সেটা মূল বেতনের বাইরে। ঘরের আঙ্গিনায় ফল চাষের মূল্য মালিক শ্রেণি নিজের জন্য হিসেব করতে পারেনা। কারণ অধিকারের হিসেবে সেই জমি চা শ্রমিকদের নিজেদের হবার কথা এবং তাতে ফলানো সব ফসলের অধিকারও শ্রমিকদের হবার কথা। যে চিকিৎসা সেবা আর শিক্ষা সুবিধা দেয়া হয় তা মানসম্মত কি না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
 

 

শ্রমিকরা জানিয়েছিলেন, চিকিৎসা সেবার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। কয়েকটা বেসিক ট্যাবলেট, যার অনেকগুলোই ডেট এক্সপায়ার্ড, তা ব্যতীত আর কোনো ভালো সেবা সেখানে পাওয়া যায় না। প্রাথমিক শিক্ষার একটি ব্যবস্থা সেখানে আছে কিন্তু তা চা শ্রমিকদের জনসংখ্যার অনুপাতে যথেষ্ট নয়। রয়েছে শিক্ষক সংকট।

 

 

আমি নিজে যখন ২০২০ সালের ৮ মার্চে চা শ্রমিকদের এলাকা পরিদর্শন করতে গিয়েছিলাম, শ্রমিকরা জানিয়েছিলেন, চিকিৎসা সেবার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। কয়েকটা বেসিক ট্যাবলেট, যার অনেকগুলোই ডেট এক্সপায়ার্ড, তা ব্যতীত আর কোনো ভালো সেবা সেখানে পাওয়া যায় না। প্রাথমিক শিক্ষার একটি ব্যবস্থা সেখানে আছে কিন্তু তা চা শ্রমিকদের জনসংখ্যার অনুপাতে যথেষ্ট নয়। রয়েছে শিক্ষক সংকট। আর এই অঞ্চলে রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধার তো বালাই নেই বললেই চলে। সব ছেড়ে দেয়া হয়েছে কোম্পানির হাতে। যেন এই শ্রমিকদের রাষ্ট্র বলে কিছু নাই, কোম্পানিই সর্বেসর্বা। অথচ এই শ্রমিকদের অবদানে কিন্তু রাষ্ট্র ঠিকই ফুলে ফেঁপে উঠছে। সেই বেলায় কোনো অভিযোগ নেই।

 

 

অনেকে হয়তো জানেন যে, উত্তর আমেরিকায় দাসত্ব ব্যবস্থাতেও দাসদেরকে নানান ধরনের সুযোগ সুবিধা দেয়া হতো, কিন্তু অধিকার দেয়া হতো না। সুযোগ সুবিধা আর অধিকারের মাঝে ব্যাপক ফারাক রয়েছে। সুযোগ সুবিধা হলো এক ধরনের প্রতিরোধকারী শক্তি যেটি সত্যিকারের অধিকার আদায়কে আটকে রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়। কাজেই আজ চা শ্রমিকেরা মজুরির জন্য লড়াই করছেন ঠিকই, কিন্তু তাদের দীর্ঘতর লড়াইটা হচ্ছে অধিকারের, নাগরিকত্বের কাঠামোতে অন্তর্ভুক্তির। সেই লড়াইয়ের স্বরূপ না বুঝতে পারলে আমরা কেবলমাত্র মজুরি বাড়ানোর দিকে নজর দিয়ে চা শ্রমিকদের প্রকৃত সংগ্রাম বুঝতে পারব না।

 

 

৩০০ টাকা মজুরি দিয়ে কী হবে?

যে ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরির জন্য লড়াই চলছে তাও কিন্তু খুব বেশি নয়। এই মজুরির পেছনেও মালিকপক্ষ নানান শর্ত জুড়ে দেবে। দৈনিক উত্তোলিত চায়ের পরিমাণসহ নানান শর্ত থাকে এই মজুরি পাবার ক্ষেত্রে। তার পরেও যদি শ্রমিকেরা এই দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরি পেতে পারেন, তাতে করে তারা অনেকাংশেই তাদের জীবনমানের একটা উন্নতি ঘটাতে পারবেন। শ্রমিকদের জন্য যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, সামাজিক উন্নয়নের সিঁড়ি বা সোশ্যাল মোবিলিটি। বর্তমানের মানবেতর মজুরির কারণে যে সিঁড়িটি তাদের কাছে অধরা থেকে যাচ্ছে।

 

 

উন্নততর একটা মজুরি পেলে চা শ্রমিকরা তাদের সন্তানদেরকে শিক্ষিত করতে পারবেন। মোহন রবিদাসের মতন অনেকে হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন জায়গায় পড়তে পারবেন এবং পড়ে ফিরে গিয়ে তার উদাহরণ অনুসরণ করে চা শ্রমিকদের অধিকারের জন্য লড়াই করতে পারবেন। একটি উন্নততর মজুরি তাই কেবলমাত্র এই মুহূর্তে খরচযোগ্য কিছু অতিরিক্ত টাকার জোগান দেয় না, বরং দীর্ঘ সময়ের প্রেক্ষিতে চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের লড়াইয়ের জন্য অতিরিক্ত রসদ জোগায়। সেই দিক থেকে মজুরি বৃদ্ধির এই লড়াইকে চলমান রাখতে হবে আর উদাসীন উন্নাসিক মধ্যবিত্তকে এই লড়াইয়ের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে।

 

 

অনুপম দেবাশীষ রায়

স্বাধীন লেখক ও কলামিস্ট

 

Your Comment