শনিবার ৭ই বৈশাখ ১৪৩১ Saturday 20th April 2024

শনিবার ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

Saturday 20th April 2024

বহুস্বর মতামত

লোকায়ত মান্দি বিবর্তনবিদ্যার বয়ান

২০২২-০৮-০৯

পাভেল পার্থ

জাতিসংঘ ‘লোকায়ত জ্ঞানকে’ ২০২২ সনের আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য করেছে। ঘোষণা করেছে ‘লোকায়ত জ্ঞান সুরক্ষা ও জ্ঞানপ্রবাহ বিস্তার করে আদিবাসী নারী’। ‘লোকায়ত জ্ঞান’ এবং ‘আদিবাসী নারীর ভূমিকা’ প্রসঙ্গকে প্রতিদিন পাড়ি দিতে হয় এক দীর্ঘ তর্কের ময়দান। অস্বীকৃতি, রাজনীতি, কাঠামোগত বৈষম্য, প্রাণডাকাতি কিংবা মেধাস্বত্ত্ব লঙ্ঘন ঘিরে যেকোনো আলাপে চট করেই ‘আদিবাসী নারী ও লোকায়ত জ্ঞান’ এর কোনো না কোনো উদাহরণ আমাদের সামনে উঁকি দেয়। আর এসব উদাহরণ ‘অপরত্বের বাহাদুরিতে’ আড়াল করে রাখলেও, কোনোভাবেই অনৈতিহাসিক নয়। বরং এসব উদাহরণ আমাদের সামনে মেলে ধরে টানটান বহুত্ববাদী সম্পর্ক, দর্শনের তল, সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও বিজ্ঞানমনস্কতা।

 

 

জাতিসংঘ ঘোষিত ২০২২ সালের আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য থেকে আমরা কী আন্দাজ করব? এই প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে ‘লোকায়ত জ্ঞানকে’ স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে? নাকি ‘লোকায়ত জ্ঞান’ সুরক্ষা ও বিস্তারে আদিবাসী নারীর ভূমিকাকে সম্মান জানানো হচ্ছে? কিন্তু অধিপতি কাঠামো ও জ্ঞানকাণ্ডে প্রবলভাবে আড়াল ও অদৃশ্য করে রাখা ‘লোকায়ত জ্ঞান’ ও ‘আদিবাসী নারীর’ মতোন এমন ‘জমজ প্রান্তিকতা’কে এককাতারে গেঁথে ফেলার কারণ কী হতে পারে? হয়তো সমাজের প্রবীণজন, প্রচলিত মৌখিক বয়ান কিংবা কোনো কাঠামোগত বিদ্যায়তনিক পরিসর এর ব্যাখা দাঁড় করাতে পারবে। তবে চলতি আলাপের কাজ এই দীর্ঘ বাহাসকে ধাক্কা দেওয়ার মানত করা নয়। আদিবাসী নারীর লোকায়ত জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনের কোনো সূত্র পাওয়া যায় কীনা, তার কিছু অমূদ্রিত প্রাথমিক খসড়া উদাহরণ হাজির করছে এই আলাপ।

 

 

লোকায়ত জ্ঞান, আদিবাসী নারীর ভূমিকা, মেধাস্বত্ত্ব তর্ক, অপরত্বের রাজনীতি বিষয়ে সতর্ক থেকেই চলতি আলাপ শুরু হচ্ছে। একটা বিষয় হরহামেশাই ঘটে, বিদ্যায়তন থেকে শুরু করে চারধারের আপাত নিরীহ কী হিংস্র জিজ্ঞাসাগুলোতেও। জ্ঞানপ্রবাহ সুরক্ষা ও বিস্তারে আদিবাসী নারীর ভূমিকা কী? অধিপতি কাঠামোতে বরাবরই ‘ভেষজবিদ্যা’, ‘বুনন ও সেলাই’, ‘কৃষি ও জুমচাষ’ কিংবা ‘পশুপালনবিদ্যাকেই’ মূলত আদিবাসী নারীর লোকায়ত জ্ঞানকাঠামোর ভিত্তি হিসেবে পাঠ করা হয়। খুব বড়জোর ‘পূর্বাভাস ও আবহাওয়াপঞ্জিকা’ কিংবা ‘স্থাপত্যবিদ্যার’ ক্ষেত্রে কিছু বিরল উদাহরণ হাজির করে অধিপতি কাঠামো। এমনকি ‘লোকায়ত জ্ঞান’ বিষয়েও আমাদের রয়েছে তীব্র বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও শ্রেণিকরণের রাজনীতি।

 

 

লোকায়ত জ্ঞান বলতে চট করে আমাদের সামনে মুখস্থ উদাহরণ হাজির হয়, কোনো আদিবাসী নারী বনের লতাগুল্ম পিষে পেট ব্যথার ভেষজ বানাচ্ছে কিংবা বাঁশের চটি দিয়ে বুনছেন কোনো কৃত্যের উপকরণ। মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশ, বিবর্তনবিদ্যা, প্রযুক্তিবিজ্ঞান কিংবা জ্যোর্তিবিদ্যা বিষয়ে ‘লোকায়ত জ্ঞানের’ খুব কম উদাহরণই আমাদের সামনে হাজির হয়। কেন হয় না? কারণ আমাদের মনের গহীনে আমরা টেনে চলছি ঐতিহাসিক কাঠামোগত বৈষম্য। এমন কী জ্ঞানবিস্তারে আদিবাসী নারীর ভূমিকাকে কেন আমরা জীবনের সকল প্রান্তব্যাপী আন্দাজ করতে পারি না? এর কারণও আমাদের সমাজ ও মনের গহীনে দগদগ হয়ে থাকা এক প্রশ্নহীন উপনিবেশিকতা। তো চলতি আলাপখানিও কোনোভাবেই এই উপনিবেশিক ও বৈষম্যমূলক ঐতিহাসিকতার ময়দানের বাইরের কেউ নয়। তবে সতর্ক ও সংবেদনশীল।

 

 

বাংলাদেশে বাস্তুতন্ত্রের নানা ভাগ ও বিন্যাস আছে। এর সাথে জড়িয়ে আছে মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতির নানামুখী সম্পর্ক। সকল সমাজ একভাবে একই কায়দায় নদী, পাহাড়, অরণ্য কী ভূমিকে দেখে না। যেমন, মান্দি বা গারো জাতির বসতিস্থাপনমূলক ভূবিদ্যা অনুযায়ী বাস্তুতন্ত্রকে প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। হা.বিমা, হা.ফাল এবং হা.রঙ্গা। মান্দিকুসুকে (আচিক ভাষায়) এর সরল অর্থ ‘মায়ের মাটি’ বা ‘গর্ভভূমি’। সমসাময়িককালে এই অঞ্চলটি ‘মধুপুর শালবন’ হিসেবে অনেকে চিহ্নিত করেন। আসলে এটি এমন এক অঞ্চল যার উত্তরে পর্বতশ্রেণি এবং দক্ষিণে জলপ্রবাহ অঞ্চল বিস্তৃত। হয়তো প্রস্তরযুগের পরপর কৃষিযুগের সূচনায় এই অঞ্চলে গড়ে ওঠেছিল আদি জুমসভ্যতা। মধুপুরের মান্দি গ্রামে খুঁজে পাওয়া কিছু মৌখিক আখ্যানে দেখা গেছে এই অঞ্চলে অরণ্যসৃষ্টির সাথে ‘বীজবৃষ্টির’ একটি কাহিনী আছে। মিদ্দি (দেবতা) মিশিসালজং ওপর থেকে নানা জাতের বীজ ছড়িয়ে দিয়ে এই অঞ্চলে এক বিরাট অরণ্যের জন্ম দিয়েছিলেন। এই কাহিনী জানান দেয়, এই অঞ্চলের মাটি ও পানিস্তরের এক প্রাচীন বৈশিষ্ট্য যেখানে গড়ে ওঠেছে এক বিশেষ মিশ্র শালবন। আবার একইসাথে এই কাহিনী জানায়, কৃষিসভ্যতার সূচনালগ্নে হয়তো প্রাচীন মানুষেরা এই অঞ্চলের নানা প্রজাতির বীজ বহন করে এনেছিলেন এবং বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। তো এই অরণ্য কতখানি বিস্তৃত ছিল প্রাক-কৃষিযুগে তা বলা মুশকিল।

 

 

মধুপুরের মান্দিদের কিছু মৌখিক আখ্যান জানান দেয়, হা.বিমার এক বড় অংশ জুড়ে ছিল বলসালব্রিং (শালবন)। বনবিভাগের ঘনফুটমাপের ‘কাঠ-মনস্তত্ব’ কিংবা নয়াউদারবাদী বনবিদ্যা দিয়ে অরণ্যভূমি আন্দাজ করা যায় না। কারণ অরণ্যর সাথে জড়িয়ে থাকে প্রাণের দীর্ঘ বিবর্তন, সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও মানববসতির স্মৃতিবিস্মৃতি।

 

 

কিন্তু মধুপুরের মান্দিদের কিছু মৌখিক আখ্যান জানান দেয়, হা.বিমার এক বড় অংশ জুড়ে ছিল বলসালব্রিং (শালবন)। বনবিভাগের ঘনফুটমাপের ‘কাঠ-মনস্তত্ব’ কিংবা নয়াউদারবাদী বনবিদ্যা দিয়ে অরণ্যভূমি আন্দাজ করা যায় না। কারণ অরণ্যর সাথে জড়িয়ে থাকে প্রাণের দীর্ঘ বিবর্তন, সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও মানববসতির স্মৃতিবিস্মৃতি।

 

 

বিলুপ্তির পথে মধুপুরের শালবন।

 

 

তো আমি যখন এই প্রাচীন অরণ্যর সাথে পরিচিত হলাম, তখন এটি কেবলই এক রক্তাক্ত কাঁটাতারঘেরা বন্দী বনভূমি আর ‘মধুপুর শালবন’ও রাষ্ট্র ঘোষিত ‘জাতীয় উদ্যান’ নামে পরিচিত। ১৯৫০ সনে এই বনে রাষ্ট্র জুমচাষ নিষিদ্ধ করে। জলবায়ু-দুর্গত আজকের দুনিয়ায় ‘বনের ভেতর’ নাকি ‘বনকে ঘিরে’ জুমআবাদ এ নিয়ে তর্ক হতে পারে। যা হোক, প্রাচীন মান্দি হাবাহুয়ার (জুম আবাদ) ধরণ অনুযায়ী এক একটা জুমচক্রে কোনো পরিবার কী মাহারী (বংশগত গোত্র) এক এক বছর স্থানান্তর করত। আর তাই আজকের ভাওয়াল থেকে মধুপুর শালবন ঘিরে গড়ে ওঠে প্রাচীন মান্দি সঙ (গ্রাম)। মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য এই গহীন শালবনে শিকার করতে এসে বনের ভেতর এসব গ্রাম দেখেছিলেন।

 

 

শতবছর আগে ১৩১৩ বাংলায় ‘শিকার কাহিনী’ নামে তার একটি বই প্রকাশিত হয়। চলতি আলাপখানি মধুপুর শালবনের এমনসব প্রাচীন মান্দি গ্রাম থেকে পাওয়া বিরল সব জ্ঞানপ্রবাহের ওপর আশ্রয় করেছে। আর এই জ্ঞানপ্রবাহের সাথে আমার সখ্য গড়ে ওঠে প্রবীণ সব মান্দি নারীদের বয়ান ও বিস্তারে। এই যে আমরা, মানে আজকের ‘মানুষেরা’, আমাদের বৈজ্ঞানিক নাম ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’। বিদ্যায়তনিক বিবর্তনবিদ্যা আমাদের সামনে এই মানুষের ক্রমবিবর্তন ও মানবসভ্যতার বিকাশের জ্ঞানকাণ্ড হাজির করেছে। হাজির করেছে বস্তুগত ও জ্ঞানগত নানা প্রমাণ ও দলিল। আজকের আলাপে আমরা কিছুটা বোঝার চেষ্টা করবো মধুপুর শালবনের মান্দি নারীরা কীভাবে নিজেদের লোকায়ত বিবর্তনবিদ্যার মাধ্যমে আমার কাছে মেলে ধরেছিলেন মানুষের ক্রমবিকাশের ইতিহাস।  

 

 

‘লোকায়ত জ্ঞান’ নিয়ে তর্ক

মানুষের ক্রমবিকাশের ইতিহাস ও বির্বতনবিদ্যা নিয়ে ‘পড়ালেখা না জানা’ বনের ভেতরে থাকা গ্রামীণ মান্দি নারীদের জটিল বয়ানে প্রবেশের আগে আলাপের শুরুতেই ‘লোকায়ত জ্ঞান’ বিষয়ে একটা প্রাথমিক ফায়সালা দরকার। ‘জ্ঞান’ এর কি কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে? সংজ্ঞায়ন নিয়ে দেন দরবার থাকলেও আছে জ্ঞানকে ঘিরে রাজনীতি ও বিভাজন। তাই আমরা দেখতে পাই কোনো জ্ঞান ‘বৈজ্ঞানিক জ্ঞান’ এবং কোনো জ্ঞান ‘লোকজ জ্ঞান’, ‘প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান’, ‘লোকায়ত জ্ঞান’, ‘দেশীয় জ্ঞান’, ‘স্থানীয় জ্ঞান’, ‘কৃষকের জ্ঞান’ কি ‘আদিবাসী জ্ঞান’ নানান নামে ও প্রত্যয়ে উপস্থাপিত হচ্ছে। লোকায়ত জ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের এ তর্ক বহু পুরনো।

 

 

সমাজবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানী, লোকসংস্কৃতিবিদ, জনউদ্ভিদবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, নারীবাদী, উন্নয়নবিদ ও প্রতিবেশবাদীদের কাজে এ তর্ক এখনো জিইয়ে আছে। ম্যালিনস্কি, বোয়াস, লেভী ব্রোহল, মস, ইভান্স প্রিচার্ড, হর্টন, লেভিস্ত্রস, এসক্যুবার, পল সিলিটো, ক্লিফোর্ড গির্টজ, এস কে জৈন, বন্দনা শিবাদের লেখায় ‘লোকায়ত জ্ঞান’ নিয়ে নানান তর্ক বাহাস আমরা দেখতে পাই। বাংলা একাডেমির ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ এ লোকায়ত বলতে বলা হয়ছে, প্রাকৃতজনের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস-সংস্কার-ধারণা ও আচার, প্রাচীন হিন্দু দার্শনিক চার্বাকের মতানুসারী, নাস্তিক, পরলোক ও ঈশ্বরে অবিশ্বাসী, ধর্মনিরপেক্ষ, জড়বাদী। কিছু বিষয় আছে, সংজ্ঞা ছাড়াও যার একটি সাধারণ চেহারা আমাদের সামনে হাজির হয়, যেমন ‘লোকায়ত জ্ঞান’। সাধারণভাবে আমরা বুঝি এ জ্ঞান গ্রামীণ জনগণের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত, প্রাতিষ্ঠানিক নয় এবং এটি বাজারে বেচাকেনা হয়না। এর কোনো ‘স্টেরিওটাইপ’, নির্দিষ্ট, একরৈখিক, আবদ্ধ চেহারা ও রূপকল্প নেই।

 

 

নৃবিজ্ঞানী ক্লিফোর্ড গির্টজ (১৯৯২) ‘লোকায়ত বা স্থানীয় জ্ঞান’ নিয়ে তার এক বিখ্যাত লেখায় জানান, ‘স্থানীয়’ ধারণাটি আপাদমস্তক একটি আপেক্ষিক প্রত্যয়। সময় এবং স্থানভেদে এটি বদলে যায় । কিন্তু জ্ঞানের সমসাময়িককালের সংজ্ঞায় বলা হয়, ‘বিজ্ঞান’ ও ‘স্থানীয় জ্ঞান’ পরস্পর নির্ভরশীল, কারণ উভয়েই বিজ্ঞানের সত্যকে প্রকাশ করে এক বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে। বলা হয়, ঐতিহ্যগত জ্ঞান অনেকখানি স্থানীয় জ্ঞান কী জনবিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত যা কোনো ঐতিহাসিক বা সামাজিক জায়গাকে নির্দেশ করে । সাম্প্রতিক প্রাণপ্রযুক্তিবিদেরাও মনে করেন, প্রকৃতি সম্পর্কিত স্থানীয় জ্ঞানই ভবিষ্যতের চিকিৎসা কি ঔষধশাস্ত্রের গবেষণার দ্বার উন্মোচনের পথ। কিন্তু এই চিন্তার সাথে বিশ্বায়িত দুনিয়ার বাণিজ্য রাজনীতি সম্পর্কিত, যে জায়গা থেকে ঐতিহ্যগত জ্ঞানের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের প্রসঙ্গগুলো বিশ্বব্যাপী উচ্চারিত। প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পর্কিত গবেষণার ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণের জ্ঞান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । বিশ্বব্যাপী গ্রামীণ জনগণের প্রতিদিনের টিকে থাকার জন্য স্থানীয় জ্ঞান দৃশ্যত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। কী কৃষি, কী খাদ্য নিরাপত্তা, কী প্রতিদিনের জীবনসংগ্রামে স্থানীয় জ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ জীবন কৌশল ।

 

 

স্থানীয় জ্ঞানকে ‘অবৈজ্ঞানিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও ম্যাকিনসন ও নোস্তাদ মৎস্যসম্পদ সম্পর্কিত একটি গবেষণার ভেতর দিয়ে দেখিয়েছেন, মাছ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্থানীয় জ্ঞান অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘বৈজ্ঞানিক জ্ঞান’ এর চেয়েও। তারা তাই উভয়জ্ঞানের সম্মীলনকে মৎস্যসম্পদ সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। স্থানীয় জ্ঞান রাষ্ট্রীয় রাজনীতির আইন, শাসন ও ক্ষমতার ঘেরাটোপে প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতার সীমানায় ঝুলে থাকে। স্থানীয় জ্ঞান কি ব্যাক্তিগত না সামষ্টিক এ তর্কও রাষ্ট্রীয় চোখরাঙানির বাইরে নয় । স্থানীয় জ্ঞানের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে রাষ্ট্র কখনোই নিম্নবর্গের পক্ষে দাঁড়ায় না, হাজির করে ‘আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান’ এর দাপট।

 

 

স্থানীয় জ্ঞানকে ‘অবৈজ্ঞানিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও ম্যাকিনসন ও নোস্তাদ মৎস্যসম্পদ সম্পর্কিত একটি গবেষণার ভেতর দিয়ে দেখিয়েছেন, মাছ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্থানীয় জ্ঞান অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘বৈজ্ঞানিক জ্ঞান’ এর চেয়েও। তারা তাই উভয়জ্ঞানের সম্মীলনকে মৎস্যসম্পদ সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। স্থানীয় জ্ঞান রাষ্ট্রীয় রাজনীতির আইন, শাসন ও ক্ষমতার ঘেরাটোপে প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতার সীমানায় ঝুলে থাকে। স্থানীয় জ্ঞান কি ব্যাক্তিগত না সামষ্টিক এ তর্কও রাষ্ট্রীয় চোখরাঙানির বাইরে নয় । স্থানীয় জ্ঞানের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে রাষ্ট্র কখনোই নিম্নবর্গের পক্ষে দাঁড়ায় না, হাজির করে ‘আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান’ এর দাপট।

 

 

অনেকেই বলে থাকেন ‘খনার বচন’ হচ্ছে স্থানীয় বা লোকায়ত জ্ঞান। অনেকেইে আজকাল উন্নয়নে লোকায়ত জ্ঞানের সংযুক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে মনে করেন। উন্নয়নের সুফলকে গরীব ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষে কাজে লাগানোর জন্য যারা চিন্তা ভাবনা করছেন তারা লোকায়ত জ্ঞানকে কখনো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন । প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাজগতে বলা হয় জলবায়ু এবং পরিবেশগত পরিবর্তনগুলো বৃক্ষের বর্ষবলয়, পরাগরেণু, ফসিল, মাটি, আবহাওয়ামন্ডলে তার ছাপ এবং প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ রেখে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগণ কেবলমাত্র বস্তুগতভাবে নয় নিজেদের যাপিত জীবনের গল্প কথা গান বাদ্যে জীবনের কথ্য ইতিহাসেও সেইসব প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার পরিবর্তনের কাহিনীগুলোর প্রমাণ বংশপরম্পরায় চর্চার ভেতর দিয়ে বাহিত করেন। এটিই এই জনপদের পরিবেশ ও আবহাওয়ার ইতিহাস এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে স্থানান্তরের কায়দা ও অনুশীলন।

 

 

জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত জনগণের ভাবনা এবং অবস্থান নিয়ে খুব বেশী গবেষণা কাজের নজির নেই। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তন ডিসকোর্সে এই প্রসঙ্গটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনকে ঘিরে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভাবনা চিন্তা এবং উদ্যোগসমূহকে উন্নয়নধারায় যুক্ত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের নানান সূচক এবং উদ্যোগের ক্ষেত্রে আদিবাসী ও লোকায়ত জনগোষ্ঠীর জ্ঞানকে যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হচ্ছে বেশ জোরেসোরেই। সম্প্রতি নীতিনির্ধারকেরাও এই বিষয়ে একমত হয়েছেন, যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অভিযোজন প্রক্রিয়ায় জনগোষ্ঠীর স্থানীয় জ্ঞান অভিজ্ঞতাকে যুক্ত করা এবং গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা জরুরি। বাংলাদেশে দুই বছর স্থানীয় মানুষদের সাথে দলীয় আলোচনার প্রেক্ষিতে অনেক নীতিনির্ধারক জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন প্রক্রিয়ায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নিজস্ব খাপ খাওয়ানোর পদ্ধতি এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর প্রস্তাব রেখেছেন। এক্ষত্রে তারা প্রচলিত ‘উপর থেকে নিচ’ এই ধরণের উন্নয়ন অভিযোজন ব্যবস্থাকে খারিজ করে ‘তৃণমূল থেকে শীর্ষ’ এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাথে স্থানীয় জ্ঞানের সমন্বয় করে জনগোষ্ঠীর অভিযোজন এর জন্য একটি পরিকল্পিত স্বায়ত্ত্বশাসিত অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন নীতি গ্রহণের প্রস্তাব তুলেছেন ।

 

 

উন্নয়নের মূলধারায় বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লোকায়ত কি স্থানীয় জ্ঞানের স্বীকৃতি না মিললেও বিশ্বব্যাপী এ গরিব মানুষের সর্বজনীন জ্ঞানকে উন্নয়ন, গবেষণা কি বায়োপ্রসপেক্টিং এর নামে জনগোষ্ঠীর কোনো ধরণের সম্মতি ও অংশগ্রহণ ছাড়াই বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার ও বিক্রি করা হচ্ছে। লোকায়ত জ্ঞান চুরির এ ঘটনাকে আজকাল প্রাণ ডাকাতি হিসেবে দেখা যায়।

 

 

উন্নয়নের মূলধারায় বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লোকায়ত কি স্থানীয় জ্ঞানের স্বীকৃতি না মিললেও বিশ্বব্যাপী এ গরিব মানুষের সর্বজনীন জ্ঞানকে উন্নয়ন, গবেষণা কি বায়োপ্রসপেক্টিং এর নামে জনগোষ্ঠীর কোনো ধরণের সম্মতি ও অংশগ্রহণ ছাড়াই বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার ও বিক্রি করা হচ্ছে। লোকায়ত জ্ঞান চুরির এ ঘটনাকে আজকাল প্রাণ ডাকাতি হিসেবে দেখা যায়।দেখা যায় এভাবে বিভিন্ন করপোরেট কোম্পানির মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণের ‘বুদ্ধিস্বত্ত্ব অধিকার’ ক্ষুন্ন হয়ে পড়ছে।

 

 

বিশ্বব্যাপী লোকায়ত জ্ঞানের অধিকার সংরক্ষণের জন্য আন্তজার্তিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ ১৯৯২ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারা তৈরি করেছে। ১৯৯২ সালের ৫ জুন ব্রাজিলের রাজধানী রিওডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনে স্বাক্ষরের জন্য সনদটি উন্মুক্ত করা হয়। ১৯৯৩ সালের ৪ জুন পর্যন্ত তা স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত থাকে এবং ১৬৮টি দেশ তাতে স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ এই আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ (Converntion on biological diversity 1992/CBD 1992) ) স্বাক্ষর ও অনুমোদন করেছে। উক্ত সনদের আলোকে বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে “Biodivercity and community knowledge protection act”  নামে একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ‘উদ্ভিদজাত সংরক্ষণ ও কৃষক অধিকার আইন’ তৈরি করে, যেখানে লোকায়ত জ্ঞান সুরক্ষার বিষয়টি অর্ন্তভূক্ত করেছে। আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ প্রাণবৈচিত্র্যের সংরক্ষণ, প্রাণসম্পদের অধিকার ও জনগণের নিজস্ব জ্ঞান-সম্পদ-অভিজ্ঞতার সুরক্ষার জন্য বেশ কিছু আইনগত সিদ্ধান্ত হাজির করেছে। “লভ্যাংশ বিনিময়” এই সনদের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো জনগোষ্ঠীর জ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রাণসম্পদ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ব্যবহারকারী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে জনগোষ্ঠীর সাথে তার উৎপাদন ও মুনাফা বা লাভালাভের কী অংশ, কোনো অংশ, কতটুকু কিভাবে, কতদিন, কী প্রক্রিয়ায়, কার সাথে ভাগ বিনিময় করবে এবং লাভালাভের ন্যায্য সুফল বন্টন করবে তাই “লভ্যাংশ বিনিময়ের” বিষয়।

 

 

দক্ষিণ আফ্রিকার শান আদিবাসীরা প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো হদিয়া গাছটি ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহার করতেন। এই গাছের রস শানদের শরীরে জোগাত উদ্যম আর ক্লান্তি দূর করে দিতো। চাঙ্গা করে তুলতো শরীর। আর কিছু না খেয়েও কেবলমাত্র এই হদিয়া গাছের রসই শানদের মাইলকে মাইল মরুভূমির পথ পাড়ি দিতে সহযোগিতা করত। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারি বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান, লন্ডনভিত্তিক চিকিৎসা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফাইটোফার্মার কাছে গাছটির স্বত্ত্ব বিক্রি করে দেয়।

 

 

দক্ষিণ আফ্রিকার শান আদিবাসীরা প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো হদিয়া গাছটি ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহার করতেন। এই গাছের রস শানদের শরীরে জোগাত উদ্যম আর ক্লান্তি দূর করে দিতো। চাঙ্গা করে তুলতো শরীর। আর কিছু না খেয়েও কেবলমাত্র এই হদিয়া গাছের রসই শানদের মাইলকে মাইল মরুভূমির পথ পাড়ি দিতে সহযোগিতা করত। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারি বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান, লন্ডনভিত্তিক চিকিৎসা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফাইটোফার্মার কাছে গাছটির স্বত্ত্ব বিক্রি করে দেয়। ফাইটোফার্মা গাছটির শান ব্যবহারের তথ্য ও গাছটির আইনগত পেটেন্ট বিক্রি করে কর্পোরেট ঔষধ কোম্পানি ফাইজারের ((pfizer) কাছে। পরবর্তীতে ফাইজার কোম্পানি এই গাছ পেটেন্ট করে ও লক্ষ লক্ষ বিলিয়ন টাকার ব্যবসা করে। ফাইজারের এই এক তরফা অন্যায় বাণিজ্য বিতর্কের জন্ম দেয়। ব্যবসার ক্ষতির সম্ভাবনা দেখে ফাইজার দক্ষিণ আফ্রিকায় শান আদিবাসীদের জন্য হদিয়া থেকে উদ্ভাবিত ঔষধ বিক্রয়ের লাভের ১% অংশ দিয়ে তাদের শিক্ষার জন্যে স্কুল ও চিকিৎসার জন্যে হাসপাতাল করে দেয় এবং এভাবে অপপ্রচার থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করে।“লভ্যাংশ বিনিময়”এর সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ এবং দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী রূপরেখা হিসেবে এখনও পর্যন্ত “দক্ষিণ ভারতের কেরালার কানি আদিবাসী রূপরেখাটিকেই’ সর্বোচ্চ ইতিবাচকভাবে গণ্য করা হয়।

 

 

এই হদিয়া গাছের পেটেন্ট এখন বহুজাতিক করপোরেশনের কাছে

 

 

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা নিয়ন্ত্রিত করপোরেট বিশ্বায়নের দুনিয়ায় মানুষের সম্পদ, সম্ভাবনা, জ্ঞান, মেধা সবই একতরফা দখল ও মালিকানাধীন করার বৈধতা তৈরি করেছে বহুজাতিক কোম্পানিরা। গবেষণা ও উন্নয়নের নামে জনগণের মেধা ও বুদ্ধিজাতসম্পদের একতরফা ছিনতাই ও ডাকাতি হচ্ছে। এক্ষেত্রে লোকায়ত জ্ঞান ও প্রাণসম্পদ হচ্ছে করপোরেট বাণিজ্যের অব্যর্থ নিশানা। জনগণের লোকায়ত ঔষধি জ্ঞান ও প্রাকৃতিক উৎসের উপরেই দাঁড়িয়েছে কর্পোরেট ঔষধ বাণিজ্য। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ২৩টি অসম চুক্তির একটি হচ্ছে “বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ত্ব চুক্তি(Agreement on trade related aspects of Intellectual Property rights/TRIPS)। ট্রিপস চুক্তির ২৭.৩ (খ) অনুচ্ছেদে প্রাণসম্পদ, জ্ঞান, প্রযুক্তির উপর পেটেন্টের অধিকারের রাখা হয়েছে। চুক্তিবদ্ধ পক্ষ রাষ্ট্রসমূহ তাদের নিজ দেশের জ্ঞান ও সম্পদ সুরক্ষায় একটি কার্যকর আইন তৈরির কথাও বলা হয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অসম ময়দানে বাংলাদেশের মতো ক্ষমতাহীন একটি গরিব দেশ তার নিজ মেধাসম্পদ সুরক্ষায় যে আইন কাঠামোই তৈরি করুক না কেন তা উত্তরের ধনী দেশের বাহাদুরির কাছে কখনোই ‘কার্যকর’ হিসেবে ঠেকে না। বুদ্ধিজাত সম্পদ ও স্বত্ত্ব ঘিরে বাংলাদেশে কিছু সরাসরি আইন আছে। ট্রেডমার্ক আইন ২০০৯, দ্য পেটেন্ট এন্ড ডিজাইন অ্যাক্ট ২০০৩ (১৯১১ সনের আইন), কপিরাইট আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০০৫) এবং ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য নিবন্ধন ও সুরক্ষা আইন ২০১৩। এছাড়াও নিদারুণভাবে ‘বায়োডাইভার্সিটি এন্ড কমিউনিটি নলেজ প্রটেকশন অ্যাক্ট’ নামে একটি আইনের খসড়া ১৯৯৮ সন থেকে চূড়ান্ত অনুমোদনের দিন গুণছে। কিন্ত লোকায়ত জ্ঞানের মেধাস্বত্ত্ব অধিকার সুরক্ষা এবং আদিবাসী নারীর লোকায়ত জ্ঞানের মেধাস্বত্ত্বের সুরক্ষা বিষয়ে এখনো কোনো জোরদার আইনী কাঠামো বা কর্মতৎপরতা নেই।

 

 

তো, এই হলো মোটাদাগে ‘লোকায়ত জ্ঞান’ নিয়ে বহুমাত্রিক তর্কগুলোর একটা ছোট্ট ফিরিস্তি। চলতি আলাপ প্রথমেই কৃতজ্ঞতা জানায় মধুপুর বনের জুমিয়া নারীদের, যাদের জ্ঞানপ্রবাহ ও বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে মানুষের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসকে অধিপতি জ্ঞানকাণ্ডের বাইরে থেকেও বোঝার চেষ্টা হয়েছে। গায়রা গ্রামের নইজ্জ্য নকরেক, জনবি নকরেক ও অনমি নকরেক, রাজাবাড়ি গ্রামের নিরালা চিরান, চুনিয়া গ্রামের অনিতা মৃ ও তিরি রেমা, জলছত্রের মনসা দেবী চাম্বুগং, বেদুরিয়ার ফমনী নকরেক, পীরগাছার নেকজি মৃ, শয়ন নকরেক, জলমি নকরেক এবং পয়নী নকরেক, ক্যাজাই গ্রামের কানচ নকরেক, কাকড়াগুনির সই মাজি, জয়নাগাছা গ্রামের ঈমন দালবত, গাছাবাড়ি গ্রামের সরনী চিসিম ও সমলা আজিম, উজান গাছাবাড়ির জেনু সিমসাং ও আতমি ম্রং, গেচ্চুয়া গ্রামের আন্দ্রি নকরেক মূলত চলতি আলাপের মূল তথ্যভান্ড। যাদের অনেকেই আজ আর এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই। পাশাপাশি আমার শিক্ষক বিশিষ্ট স্কুথং (দার্শনিক) চুনিয়া গ্রামের জনিক নকরেক মান্দি লোকায়ত জ্ঞানের ভেতর দিয়ে মানুষের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস বুঝতে দৗর্ঘসময় সহযোগিতা করেছেন।

 

 

জীবনের বিবর্তন ও মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশ

পৃথিবী সৃষ্টি এবং পৃথিবীতে জীবনের উদ্ভব বিষয়ে নানারকম মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এখানে আমরা বিবর্তনবিদ্যা এবং মহাকাশবিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক নজির গুলো দেখার চেষ্টা করব। সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত গ্রহ ও উপগ্রহ নিয়ে আমাদের সৌরজগত। মহাজাগতিক বিস্ফোরণের ভেতর দিয়ে এই সৌরজগত বর্তমানের রূপ পেয়েছে। সৌরজগতের তৃতীয় এক নীলরঙের গ্রহ হিসেবে পৃথিবীতে জীবনের উদ্ভব হওয়ার মত পরিবেশ তৈরি হতে লক্ষ কোটি বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ধারণা করা হয় সৌরজগত সৃষ্টির মোটামুটি ১০০ মিলিয়ন (১ মিলিয়ন=১০ লাখ) বছর পর পৃথিবী গ্রহের সৃষ্টি। আজ থেকে ৪.৫৪ বিলিয়ন (১ বিলিয়ন=১০০ কোটি) বছর আগে পৃথিবী গ্রহের আকৃতি পায়। জীবনের উদ্ভবের জন্য পানি ও বাতাস অপরিহার্য। সৌরজগত কী সমগ্র বিশ্বনিখিলে এখনও পর্যন্ত কেবল পৃথিবীগ্রহেই শুধুমাত্র প্রাণের অস্তিত্ব ও বিকাশ দেখা গেছে। পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব ঘটেছে ৬৫০ মিলিয়ন বছর আগে। প্রথমে এককোষী জীবের আর্বিভাব ঘটে। দীর্ঘ বিবর্তন এবং লক্ষ-কোটি বছরের নানা ঘাত-প্রতিঘাত সামাল দিয়ে এককোষী জীব থেকে বহুকোষী জীবনের বিবর্তন ঘটে। সৃষ্টির শুরু থেকে পৃথিবীর পরিবেশ সবসময় একরকম ছিল না। পৃথিবীকে পাড়ি দিতে হয়েছে উত্তপ্ত গরমের দিন, দীর্ঘ বরফ যুগ। প্রতিটি সময়েই জীবনের উদ্ভব এবং অবসান ঘটেছে। তারপর ধীরে ধীরে পৃথিবীর প্রকৃতি শান্ত ও অধিক্তর জীবন বিকাশের উপযোগী হয়েছে। পৃথিবীতে জীবনের উদ্ভব সম্পর্কিত নিচের বিবর্তন ছকটি দেখা যেতে পারে:

 

 

 

       (উপরের ছকচিত্রটির সূত্র: https://en.wikipedia.org/wiki/Timeline_of_human_evolution ২২/১১/২০১৭)

 

 

পৃথিবীর প্রথমদিকে সরল, এককোষী এবং অমেরুদন্ডী জীবের উদ্ভব ঘটে। তারপর ধীরে ধীরে দীর্ঘ বিবর্তনের ভেতর দিয়ে জটিল, বহুকোষী এবং মেরুদণ্ডী জীবের বিকাশ ঘটে। মানুষ এই সৌরজগতের পৃথিবী নামক গ্রহের জটিল বহুকোষী এক মেরুদণ্ডী প্রজাতির জীব। মানব বিবর্তনের মানচিত্রে দেখা যায়, প্রায় ২৫ তেকে ৩৫ লাখ বছর আগে হোমিনিড নামে পরিচিত প্রাচীন মানুষের উদ্ভব ঘটে পৃথিবীর বুকে। হোমিনিডরা সোজা হয়ে হাঁটাচলাফেরা করতো। ১৮ থেকে ২৩ লাখ বছর আগে হোমো হ্যাবিলিসদের দেখা পাওয়া যায়। হোমো হ্যাবিলিসরা কথা বলার মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারতো। ৪ থেকে ১৯ লাখ বছর আগে হোমো ইরেকটাসদের সাক্ষাত পাওয়া যায়। যারা আগুন আবিষ্কার করেছিল এবং দলবদ্ধ হয়ে শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো। ৩৫ হাজার থেকে দেড় লাখ বছর আগে প্রাচীন মানব নিয়ানডার্থালদের বিচরণ ছিল। নিয়ানডার্থালরা নানা ধরণের অস্ত্র ও তৈজস নির্মাণ করেছিল এবং সংঘবদ্ধ বসতি গড়ে তুলেছিল। প্রায় ৪০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার বছর আগেই আজকের ‘আধুনিক মানবপ্রজাতি হিসেবে পরিচিত হোমো স্যাপিয়েন্স বা মানুষের’ বিকাশ ঘটেছে। ‘হোমো স্যাপিয়েন্স নামে পরিচিত মানবপ্রজাতিই প্রথম শিল্পকলার সূচনা করে, হাড় ও ধাতু দিয়ে নানা অস্ত্র ও ব্যবহার্য উপকরণ আবিষ্কার করে। নিচে মানববিবর্তন বিষয়ক ছবিটি দেখা যেতে পারে (জানি এসব নিয়ে তর্ক আছে, কেন বির্বতনে শুধু পুরুষের ছবি থাকে কিংবা এখানে উপস্থাপনেও প্রতিষ্ঠিত হয় আরো নানা উপনিবেশিকতা):

 

 

(মানুষের বিবর্তনের এই ছবির সূত্র: https://socialscienceshighlandssev.wordpress.com/2014/09/08/timelines-unit-1-1-human-evolution/)

 

 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ায় জাভা, সুমাত্রা, বালি, পাপুয়া, তিমুর, বোর্ণিও, নিউ গিনি, লম্বক, মাদুরা কী সুলাউশির মতোই এক দ্বীপঅঞ্চল ফ্লোরেস। পর্তুগীজ উপনিবেশের কারণে পর্তুগীজ শব্দ ‘ফ্লোরেস’ বা ফুল থেকে এই দ্বীপের এমন নাম। এমনকি ডাচ উপনিবেশর কারণে ইন্দেস বা দ্বীপ থেকেই আজকের ‘ইন্দোনেশিয়া’ নাম। নানা কারণে ফ্লোরেস দ্বীপখানি গুরুত্ববহ। আেেগ্নয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ফ্লোরেস সাগরে গড়ে ওঠা দ্বীপ বলে নয়, এই দ্বীপেই ‘হোমিনিডদের’ সভ্যতা গড়ে ওঠেছিল। মানবপ্রজাতি বিবর্তনের ক্ষেত্রে হোমিনিডরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ হোমিনিডদের পৃথিবীর সবচে খর্বাকৃতির মানব প্রজাতি হিসেবে ভাবা হয়। আর এই ফ্লোরেস দ্বীপের নামেই তাদের নামকরণ হয়েছে (H. floresiensis)।  বিদ্যায়তনিক এই মানববির্বতন ও ক্রমবিকাশের যে জ্ঞানপ্রবাহ এখানে পৃথিবীতে ছড়িয়ে ।  বিদ্যায়তনিক এই মানববির্বতন ও ক্রমবিকাশের যে জ্ঞানপ্রবাহ এখানে পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা লোকায়ত জ্ঞানভাষ্য কী বলে? নিম্নবর্গের লোকায়ত বিবর্তনবিদ্যা আমাদের সামনে মানবপ্রজাতির বিবর্তনের ইতিহাসকে কেমন করে তুলে ধরে, না কী আমরা সেই ভাষ্য ক্ষমতার গণিতে আড়াল ও অদৃশ্য করেই রাখছি। এবার আমরা মান্দি লোকায়ত বিবর্তনবিদ্যার বয়ানে মানবপ্রজাতির ক্রমবিকাশের ইতিহাসকে বোঝার চেষ্টা করবো।

 

 

মান্দি নি আগানমিয়াফা

মান্দি বয়ানে মানুষের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে মূলত তিথেং, গেণাল, মাচ্ছি, দেরমা-দরজং এবং মান্দি এই পাঁচ প্রজাতির মানুষের কথা জানা যায়। এদের উদ্ভব ও বিচরণকাল ভিন্ন ভিন্ন। এদের বৈশিষ্ট্য এবং আচরণ ভিন্ন ভিন্ন। আমিও যখন শুনেছি তখনি এসব কাহিনী কোনো বহুল আলোচিত ‘রূপকথা ধরণের’ ছিল না। মৌখিক বয়ান, এর ভাষ্য, অর্থ এবং বিশেষ করে প্রত্যয়গুলি তখনি প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল।

 

 

প্রবীণ মান্দি নারীদের ছিন্ন স্মৃতিতে এই বিবর্তনের আখ্যান এতোটাই জীর্ণ ও শীর্ণ হয়েছিল অল্প একটু আলতো ছোঁয়াতেও তা ঝুরঝুর করে ঝরে ঝরে কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বহুদিন বহুরাত মান্দি নারীদের এইসব দুর্লভ বয়ান বারবার আমার কাছে মেলে ধরেছিল পৃথিবীর নানাপ্রান্তের মানুষের ক্রমবিকাশের ইতিহাস ও বিবর্তনের কাহিনী। পাশাপাশি এটিও প্রমাণ করে তুলেছিল এখনো দুনিয়াব্যাপি মানুষের বয়ানে বিবর্তনের ইতিহাসের নানা প্রতœআখ্যান ও স্মৃতিবিস্তৃতির বহু ক্ষয়িষ্ণু কী টিকে থাকা নমুনা বা ইশারা পাওয়া সম্ভব। যা সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও মানবসমাজের বিবর্তন বুঝতে আমাদের দারুণ সহায়তা করতে পারে।

 

 

প্রবীণ মান্দি নারীদের ছিন্ন স্মৃতিতে এই বিবর্তনের আখ্যান এতোটাই জীর্ণ ও শীর্ণ হয়েছিল অল্প একটু আলতো ছোঁয়াতেও তা ঝুরঝুর করে ঝরে ঝরে কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বহুদিন বহুরাত মান্দি নারীদের এইসব দুর্লভ বয়ান বারবার আমার কাছে মেলে ধরেছিল পৃথিবীর নানাপ্রান্তের মানুষের ক্রমবিকাশের ইতিহাস ও বিবর্তনের কাহিনী। পাশাপাশি এটিও প্রমাণ করে তুলেছিল এখনো দুনিয়াব্যাপি মানুষের বয়ানে বিবর্তনের ইতিহাসের নানা প্রতœআখ্যান ও স্মৃতিবিস্তৃতির বহু ক্ষয়িষ্ণু কী টিকে থাকা নমুনা বা ইশারা পাওয়া সম্ভব। যা সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও মানবসমাজের বিবর্তন বুঝতে আমাদের দারুণ সহায়তা করতে পারে।

 

 

তিথেং: তিথেংরা ছিল অরণ্যবাসী। এরা গাছের ডালে ঝুলে থাকতে পারত। এদের শরীর লোমশ থাকলেও মাথায় চুল কম ছিল। হাত পা কাটাছেঁড়া ক্ষত হলে তারা থুথু দিয়ে ঘষে চিকিৎসা করতে জানতো। তারা গাছের ওপরে এবং মাটির গুহায় বাস করতো। বড় গাছের নিচে এসব গর্ত গুহা থাকতো। এরা কাঁচা জিনিস খেত। গাছের ডাল ও ঝুরি দিয়ে ওঠানামা করার মই বানিয়েছিল তারা। এসব মই ব্যবহার করে তারা গাছ থেকে নিজেদের গর্তে ঢুকে ঘুমাত।

 

 

গেণাল: এরা তিথেংদের থেকে উচ্চতায় বড় ছিল। এরা বেশ শক্তিশালী ছিল। এরা এক জায়গায় বেশিদিন বসবাস করতো না। ঘুরেফিরে বেড়াত। এদের শরীরেও লোম ছিল। এরা পাথর দিয়ে অনেক কিছু শিকার করতে পারতো। এরা বড় বড় পাথর তুলতে পারতো। বন্যপশু শিকার করতে পারত।

 

 

মাচ্ছি: মাচ্ছিদের মাথায় চুল ছিল। নারী-পুরুষ উভয়ের লম্বা চুল ছিল। এরা তিথেংদের থেকে উচ্চতায় লম্বা ছিল। এরা গাছের ডালে ঝুলতো না। এরা মাটিতেই থাকতো। এরা তুলনামূলকভাবে দ্রæত দৌড়াতে পারতো। এরাও বনের ভেতরে থাকতো। এরা বসতির আশেপাশে বীজ ছিটিয়ে বুনতো। এরা আগুন জ্বালাতে জানতো। এরা চাল স্ধি করে খেত। এরা কখনোই চুরি করতো না। কারো জিনিস নিত না।

 

 

দেরমা-দরজং: দেরমা-দেরজংয়ের বৈশিষ্ট্যের ভেতর বলা হয় এরা সর্বভূক। এরা ৬ মাস ঘুরেফিরে, শিকার করে ও খাদ্যগ্রহণ করে বেড়াত। আর ৬ মাস এরা বিশ্রাম নিত ও আহার করত।

 

 

মান্দি: চিগেলবাড়িওয়ারিখুট্টি নামের এক জলবেষ্টিত অরণ্যভূমিতে ‘মান্দি’ প্রজাতির বিস্তারের কথা জানা যায়। এই মান্দিরাই আজকের ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ প্রজাতির মানুষ। মান্দিসামজে মৌখিকবয়ানে প্রচলিত ইতিহাস, আখ্যান ও বসতিস্থাপন সবকিছু এই প্রজাতির মানুষকে ঘিরেই। মৌখিক মান্দিপুরাণ জানায়, দিমারিসি ও নুরুমান্দি হলো আদি নারী ও পুরুষ। আবার এই মান্দি প্রজাতির বিবর্তনের প্রথম দিকের কিছু মানুষের নাম ও বৈশিষ্ট্য জানা যায়। যেমন, দিমারিসি-নুরুমান্দি, নুসি-দেমসি, আনাল-গুণাল। এছাড়া মান্দি মহাকাব্য শেরানজিংপালাতেও সমসাময়িককালের মান্দিসভ্যতার একটা আদি বিবরণ পাওয়া যায়। 

 

 

প্রত্নবিদ, বিবর্তনবিদ কিংবা ইতিহাসবিদেরা মূলত নানা বস্তুগত প্রত্নতাত্ত্বিসম্পদ, ফসিল ও প্রত্নতাত্ত্বিক জৈবরাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণ করে মানববিবর্তনের ক্রমবিকাশের একটি রূপরেখা দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু পৃথিবীতে নানা সমাজে মৌখিক বয়ান ও স্মৃতিবিস্মৃতির ভেতর এখনো ক্ষয়িষ্ণু হয়ে থাকা বিবর্তন সম্পর্কিত নানা উপাদান ও ভাষ্য আমাদের কাছে সামগ্রিকভাবে প্রাণের উদ্ভব ও জীবনের বিবর্তন ও বিকাশকে বুঝতে সহযোগিতা করতে পারে। আর এজন্য আমরা লোকায়ত জ্ঞানপ্রবাহের ওপর আস্থা তৈরি করতে পারি। চলতি এই আলাপখানি মধুপুর শালবনের প্রবীণ মান্দি নারীদের ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতিভান্ড থেকে পাওয়া কিছু নমুনার মাধ্যমে একটা প্রাথমিক পর্যায়ের আলাপের সূত্রপাত করলো মাত্র। এই আলাপখানি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের সামগ্রিক প্রস্তুতি, দৃষ্টিভঙ্গি ও কাঠামোকে মজবুত করা জরুরি।

 

 

পাভেল পার্থ

গবেষক ও লেখক।

ই-মেইল: animistbangla@gmail.com    

 

Your Comment