সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমার মোগলাবাজারে একজন সাংবাদিক আত্মহত্যা করে মারা গেছেন। তার নাম নিজামুল হক লিটন। শুক্রবার ৪ জুন ২০২১ সকালে মোগলাবাজার থানা পুলিশ গঙ্গাচক গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ও পুলিশের সংশ্লিষ্টরা বিষয়টিকে আত্মহত্যা ও মানসিক বিপর্যয়কে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে নিহতের পরিবারের দাবি এবং স্থানীয় সাংবাদিকদের অভিযোগ, মিথ্যা মামলা ও নির্যাতনের মাধ্যমে সাংবাদিক লিটনকে এই পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
নিহত নিজামুল হকের পরিবার সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টা ৪৫ মিনিটের দিকে নিজের ঘরে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার রাতের খাবার খেয়ে সবাই যার যার ঘরে চলে যায়। ভোররাতে নিজামুল হক লিটনের মরদেহ নিজ ঘরে ঝুলতে দেখেন তারা বাবা। এ সময় পরিবারের লোকজন ওড়না কেটে মরদেহটি নিচে নামান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দক্ষিণ সুরমার লালাবাজারস্থ একটি মাজারের অনিয়ম আত্মসাৎ নিয়ে ধারাবাহিক সংবাদ প্রতিবেদন করেছিলেন লিটন। প্রতিবেদন প্রকাশের পর একটি মহল ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে মামলা দিয়ে হেনস্তা করার চেষ্টা করে। এই ধারাবাহিকতায় গত ৯ মার্চ সাংবাদিক লিটনকে লালাবাজার এলাকায় সংঘবদ্ধ একটি চক্র আটক করে মারধর করে এবং গাঁজাসমেত তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এ সময় তারা আটক ও মারধরের ভিডিও ধারণ করে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা তাকে থানায় নিয়ে যায় এবং লিটনকে মাদক মামলার আসামি হিসেবে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয়। অবশ্য পরে জানা যায় যে, মারধরকারীদের উদ্যোগে লিটনের বিরুদ্ধে আগেই সিএম আদালতে অপর একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কোতোয়ালি থানা তাকে পরবর্তীতে গ্রেফতার দেখানো হয়।
মোগলাবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামসুদ্দোহা পিপিএম এ প্রসঙ্গে দৃকনিউজকে বলেন, ‘তার স্ত্রী, ভাই ও বাবার কিছু বক্তব্য আমরা রেকর্ড করেছি। এতে জানতে পারি আগেই লিটন মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল। ময়লা-আবর্জনার স্তুপে ঢুকে থাকত। অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে লিটনের ঠিকঠাক চিকিৎসা করাতে পারেনি পরিবার। স্থানীয়ভাবে কিছু চিকিৎসার পর তিনি কিছুটা সুস্থ হন।’
ওসি আরো বলেন, ‘লিটনের ভাই জানিয়েছে, মাজারের ঘটনায় মামলা ও গ্রেফতারের পর তাকে জেল থেকে ফিরিয়ে আনতে পরিবারের বেশ কষ্ট হয়। এরপর বাড়িতে ফিরে লিটন ঘর থেকে বের হতো না। ছোট ভাইয়ের মাধ্যমে মামলার খোঁজ খবর নিত। ঘর থেকে বের না হওয়ার কারণে সে আরো ট্রমাটাইজড হয়ে যায়। যখন সে জানতে পারে মামলার তদন্ত চলছে, তখন সে মানসিকভাবে আরো দুর্বলতার মধ্যে পড়ে যায়। তার আয়ও তেমন ছিল না। সবকিছু মিলিয়ে হঠাৎ করে একরাতে লিটন আত্মহত্যা করে।’
এদিকে সাংবাদিক লিটন দীর্ঘদিন কারাবাসের পর গত মে মাসে জামিনে মুক্তি পান। তার ওপর আইনি-বেআইনি এসব নির্যাতনের ঘটনায় নিরব থাকে সিলেট জেলা প্রেস ক্লাব। লিটনকে গ্রেফতার ও জেলহাজতে প্রেরণের ঘটনায় সিলেট জেলা প্রেস ক্লাব তার সদস্যপদ স্থগিত করে। তবে তার যে মানসিক অসুস্থতা ছিল, সেটি জেনেও প্রেস ক্লাব তার সুচিকিৎসা কিংবা এই অবস্থায় তাকে যেন কোনো ধরনের নিপীড়ন না করা হয়, সেরকম কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের দিকে হাঁটেনি বলে অভিযোগ লিটনের পরিবার ও সহকর্মীদের।
সিলেটের স্থানীয় দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক আব্দুল খালিক-এর ফেসবুক পোস্ট
সিলেট জেলা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছামির মাহমুদ দৃকনিউজকে বলেন, ‘তার মানসিক একটা সমস্যা ছিল। তিনি মাজারে গিয়েছিলেন তারপর সেখানে একটা সমস্যা হয়। এরপর তাকে পুলিশে দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে আরো বেশকিছু অভিযোগ ছিল। এরপর তার প্রেস ক্লাবের পদ স্থগিত করা হয়। তিনি রিপোর্টার নন, তিনি ফটোসাংবাদিক ছিলেন। তাকে আমরা প্রেস ক্লাবের সদস্য করিনি, আগের কমিটি করেছে। পুরো বিষয়টি তদন্তে একটি কমিটি করা হয়। তবে, প্রতিবেদন আসার আগেই তার মৃত্যু হলো।’
জামিনে মুক্তির পর সাংবাদিক লিটন সোশ্যাল মিডিয়ায় তার নির্যাতনের ভিডিও দেখতে পান। এছাড়া সিলেট জেলা প্রেস ক্লাব থেকে তাকে বহিষ্কারের বিষয়টি জানতে পেরেও তিনি চরম অসহায় হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে জেল জুলুম, মিথ্যা মামলা, নগ্ন অপপ্রচার এবং অসহায়ত্বের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে ৪ জুন ভোররাতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন সাংবাদিক লিটন। এ বিষয়ে লিটনের বোন জানান, ‘আমার ভাইয়ের ব্যাগে গাঁজা ঢুকিয়ে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এই কারণে সে বেশ কিছুদিন ধরে হতাশাগ্রস্তু ছিল। তখন তাকে দেখে আমরা বুঝেছি সে টেনশনের মধ্যে আছে।’
স্থানীয় সাংবাদিক দেবাশীষ দেবু দৃকনিউজকে বলেন, ‘কিছুদিন আগে নিজামুল হক লিটনের সঙ্গে একটি ঘটনা ঘটেছে। বলা হয়েছে গাঁজাসহ তাকে ধরা হয়েছে। সেখানে তাকে মারধর করা হয়, এরপর সেই ভিডিও আবার ফেসবুকে দেওয়া হয়। কিন্তু গাঁজাসহ যদি ধরাও হয়, পিটুনি দেওয়ার অধিকার তো কারোই নেই। এটা যে কোনো মানুষের জন্য চরম অপমানজনক ঘটনা। তারা তাকে পুলিশে দিতে পারত। এই যে অপমান করা হয়েছে, এই ধাক্কাটা তিনি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। করোনার সময় অফিসে বেতন ভাতা নেই, অনেকের মতো এই সংকটে তিনিও ছিলেন। তার অফিস হয়তো সম্মানীটা তাকে দিতে পারেনি। সব মিলিয়ে তিনি এক ধরনের মানসিক সংকটে পড়েন। যার ফলে এই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।’