হুমায়ুন আজাদের বিখ্যাত কবিতার শিরোনাম, ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’র মতই কি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের অবস্থা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া বোধ হয় খুব একটা মুশকিল নয় আজ। সুপ্রিম কোর্ট বারের গত (২০২২) নির্বাচনে ভোট গণনা নিয়ে সে কি তাণ্ডব! তারপর মাসখানেক দেরিতে যেয়ে ভোটের ফলাফল ঘোষণা, এবং সাধারণ সম্পাদক পদের ফলাফল নিয়ে অসন্তুষ্টি, বিশৃঙ্খলা, হাতাহাতি, পাল্টাপাল্টি আক্রমণ। আর এবার (২০২৩), নির্বাচন কমিশন এর গঠন নিয়ে মতবিরোধ, ব্যালট ছিনতাইয়ের অভিযোগ স্বয়ং আইনজীবীদের বিরুদ্ধে! শারীরিক লাঞ্ছনা, পুলিশি আক্রমণ প্রায় সব কিছুই সাধারণ মানুষ ঘরে বসেই দেখতে পেলো।
এগুলো দেখে আইনজীবীরা কতটা লজ্জা পাচ্ছেন তা অনুমান করা সম্ভব না হলেও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উপর সাধারণ জনগণের আস্থার যে সাংঘাতিক অধঃপতন হলো, তা বলাই বাহুল্য। সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন যে, সামরিক শাসনামলেও সুপ্রিম কোর্টে পুলিশ ঢুকে লাঞ্ছিত করার সাহস দেখায়নি। অথচ এবার তাও দেখতে হলো। দেশে আইনের সুশাসনের যথেষ্ট ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও মানুষ আজও কোর্ট-কাচারি করে তার অধিকার ফিরে পেতে। আর সেই চর্চায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট মানুষের আশার অন্যতম ঠিকানা। কিন্তু বাংলাদেশ সংবিধানের অভিভাবক এই কোর্ট আজ তার নিজের নিরাপত্তা নিয়েই বিপন্ন অবস্থায় আছে। যদিও অনেক অন্যায় আর অবিচার দেখে দেখে এদেশের মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই আর বিচার চায় না; বরং শেষ বিচারের আশায় বসে থাকে। কারণ এদেশে ন্যায় বিচার অটোমেটিক নয়, বরং পারসুয়েসিভ। যাই হোক, সেটা বিশদ আলোচনার বিষয়; সেদিকে না যাওয়াই আজ সমীচীন।
সুপ্রিম কোর্ট বারের এই সদ্য ঘটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছাড়াও জেলা বারগুলোর নির্বাচনও অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। নির্বাচনী হঠকারিতাতে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। সম্প্রতি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে নির্বাচনী কেন্দ্র দখল করে নির্বাচন ভণ্ডুল করেছেন শিক্ষকদের একাংশ। এমনকি স্থানীয় হাটবাজারগুলোর সব বণিক সমিতির নির্বাচনেও চলে সীমাহীন দুর্নীতি আর অবৈধ শক্তির প্রদর্শনী
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে মানুষ আজ আশাহত। জাতীয় নির্বাচন থেকে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সব ক্ষেত্রেই নির্বাচনে কারচুপির ঢের অভিযোগ। এই কারচুপি আর শক্তি প্রদর্শনের নজির আজ প্রায় সবখানেই সংক্রমিত। সুপ্রিম কোর্ট বারের এই সদ্য ঘটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছাড়াও জেলা বারগুলোর নির্বাচনও অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। নির্বাচনী হঠকারিতাতে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। সম্প্রতি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে নির্বাচনী কেন্দ্র দখল করে নির্বাচন ভণ্ডুল করেছেন শিক্ষকদের একাংশ। এমনকি স্থানীয় হাটবাজারগুলোর সব বণিক সমিতির নির্বাচনেও চলে সীমাহীন দুর্নীতি আর অবৈধ শক্তির প্রদর্শনী। কেউ আজ নির্বাচনে হারতে চায় না। নির্বাচন যেন যুদ্ধের ময়দান! মানুষের লজ্জাশরমও অনেকটাই কমে গেছে। জনসমর্থন না থাকা সত্ত্বেও মানুষ খানিকটা নির্লজ্জ ভাবে জনপ্রতিনিধি হতে চায়; চায় ক্ষমতার জাদুর কাঠি।
একবিংশ শতক যেন জাতীয় আর আন্তর্জাতিকভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এক দুঃস্বপ্ন বয়ে এনেছে। একটা প্রজন্ম রাজনীতি আর সমাজ পরিচলনা থেকে বিদায় নিয়েছে বয়সের বিবেচনায়। এদের পরবর্তীতে যারা রাজনীতিতে এসেছে, এরা রাজনীতিতে মেধা আর প্রজ্ঞার পরিবর্তে শক্তি আর ষড়যন্ত্রের প্রয়োগ ঘটাতে চায়। এরা চায় ক্ষমতা হোক আমৃত্যু নিরাপদ। সুস্থ আর স্বাভাবিক প্রতিযোগিতায় এরা বিশ্বাসী নয়। ক্ষমতার বিকল্প কোন কিছুই যেন এরা ভাবতে পারে না।
তবে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে যা ঘটে গেল, তা আইনজীবীদের জন্য খুব একটা ভালো হলো না। এমনটা অবশ্য খুব একটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। বিচার বিভাগে অনেক আগেই রাজনীতির প্রয়োগ ঘটিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এদেশের প্রায় সকল সরকারই খর্ব করেছে। সরকারি আইনজীবী নিয়োগ, বিচারপতিদের নিয়োগ, প্রধান বিচারপতিদের নিয়োগ সকল ক্ষেত্রেই নগ্নভাবে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছে। এমন কি বিচারিক রায়ের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক প্রভাবের কথা প্রায়শই শোনা যায়। আইন আদালতের এমন যাবতীয় ক্ষেত্রেই রাজনীতির গ্রাস নিয়ন্ত্রণ না করে যখন সেটাকে আরও স্থূল আকার দেওয়া হয়, তখন বার এ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন যে সুষ্ঠু হবে তা আশা করা কঠিন।
সুপ্রিম কোর্ট বারের এই সদ্য ঘটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছাড়াও জেলা বারগুলোর নির্বাচনও অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। নির্বাচনী হঠকারিতাতে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। সম্প্রতি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে নির্বাচনী কেন্দ্র দখল করে নির্বাচন ভণ্ডুল করেছেন শিক্ষকদের একাংশ। এমনকি স্থানীয় হাটবাজারগুলোর সব বণিক সমিতির নির্বাচনেও চলে সীমাহীন দুর্নীতি আর অবৈধ শক্তির প্রদর্শনী
এরই পরিক্রমায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা আজ ভুলে গেলেন, তারা প্রথমে আইনজীবী। একজন আর একজনের সহকর্মী, বন্ধু, ভাই। তারপর তারা রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে দলীয় হানাহানিতে যুক্ত হয়ে আজ তারা একজন আর একজনকে অপমান করছেন, করছেন লাঞ্ছিত। পুলিশ ডেকে এনে একে অপরের উপরে চড়াও হয়ে সুপ্রিম কোর্টের পবিত্রতা নষ্ট করছেন। সিনিয়রদেরকে মানেন না। ভুলে গেলেন নিজেদের গৌরবগাথা। সবকিছু উপেক্ষা করে পাওয়ার হাউসের নির্দেশ অনুযায়ী, সব দখল করতে চান। এমনটা তো মানুষ চর দখল করতে গেলেও করে না। এমন জঘন্য নজিরকে পুঁজি করে, ভবিষ্যতে আরও ভয়ানক তাণ্ডব চালানো হবে হয়তো! কারণ এদেশের রাজনীতিকদের তর্কের একটাই যুক্তি, অন্যরা কি খারাপ করেছিল তার রেফারেন্স দিয়ে নিজেদের কুকীর্তিকে জায়েজ করা। মাত্র এক বছর মেয়াদের এই কমিটির নির্বাচনেই আইনজীবীরা যদি এমন অসহিষ্ণু হয়ে পড়েন, তাহলে পেশাগত জীবনে এরা কীভাবে নিজেদের অবস্থান মজবুত করবেন?
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একটা নিজস্ব মেজাজ ও গাম্ভীর্য আছে; যেটা নিঃসন্দেহে নিম্ন আদালত থেকে আলাদা। তাই সুপ্রিম কোর্টের বারের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে উচ্চ আদালতে এনরোলড না হওয়া নিম্ন আদালতের আইনজীবীদের, বা কোনো পক্ষেরই সেখানকার রাজনৈতিক টেকনিক ব্যবহার করা উচিত হয়নি। কেন এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় যে ঘোষিত নির্বাচন কমিশনার পদত্যাগ করেন? কেন ব্যালট পেপারে নির্বাচন কমিশনারদের স্বাক্ষর থাকবে না? কেন বহিরাগতরা ভোট কক্ষে ঢোকার ধৃষ্টতা দেখাবেন? কেন একটা পেশাজীবী সংগঠনের ভোট দানের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকে না? কেন পুলিশ এনে সহকর্মীদের শায়েস্তা করার চেষ্টা করা হবে? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া খুবই জরুরি। শুধু সম্বোধনে ‘লারনেড’ হলেই চলবে না, দরকার সহিষ্ণুতা আর পারস্পরিক শ্রদ্ধা।