প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এর আগে ২০১০ সালে এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর কর আরোপ করা হয়। তবে আদালতে মামলা, ২০১৫ সালে রাজপথে আন্দোলন এবং নাগরিক সমাজের চাপে সে সময় ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। শিক্ষায় কোনো প্রকার ভ্যাট নয়, এমন আন্দোলন তখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ৬ বছর পর এসে এখন দেখা যাচ্ছে, সরকার সেই জনমতকে আমলে না নিয়ে শিক্ষায় ভ্যাট আরোপের পথেই হাঁটছে।
বাজেট বক্তৃতাকালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল জানান, এতদিন মামলার কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্তটি কার্যকর করা যায়নি। কিন্তু এখন সেই মামলা নিষ্পত্তি হওয়ায় নতুন করে কর আরোপ করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে।
জানা যায়, ২০১০ সালে আরোপিত ভ্যাট কার্যকর করতে না পেরে ২০১৫ সালে সরকার তার পরিমাণ অর্ধেক কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রস্তাব করে। কিন্তু পরিমাণ কমিয়েও সে সময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ওপর ভ্যাট কার্যকর করা যায়নি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে সরকার পিছু হটে এবং ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়।
নো ভ্যাট আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের প্রধান স্লোগান ছিল শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ করা যাবে না, শিক্ষার অধিকার সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে, এই খাতে ভ্যাট আরোপ করা হলে জনশক্তির বিকাশ রুদ্ধ হয়ে পড়বে। ধারণা করা হয়েছিল, শিক্ষার্থীদের দাবি সরকার মেনে নিয়েছে। কিন্তু ৬ বছর পরে এসে দেখা যাচ্ছে, সরকার আগের নীতিতেই রয়েছে।
শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেটে অর্থমন্ত্রীর এমন প্রস্তাব দেশের শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। এটা কোভিড পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের ব্যয় বৃদ্ধি করবে, এতে অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। শিক্ষার্থীদের এই শঙ্কা এবং নতুন করে চেপে বসা করের ভার আগের মতো পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে পারে।
জাতীয় সংসদে ৩ জুন ২০২১ বিকাল তিনটায় অর্থমন্ত্রী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেন। বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়, ‘প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রযোজ্য সাধারণ করহার হ্রাস করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা কেবল তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজ থেকে উদ্ভূত আয়ের ১৫ শতাংশ হারে কর নির্ধারণ করা হয়েছিল। মহান এ সংসদে আমি এ করহার অর্থ আইনের মাধ্যমে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করছি।’
করোনার সুযোগ নিয়ে এটি একটি চালাকি
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ
অর্থনীতিবিদ; সংগঠক, জাতীয় সম্পদ রক্ষা আন্দোলন
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। তাদের মুনাফা কিভাবে হয়, বোর্ড অব ডিরেক্টর্সরা কিভাবে সেটি নেয়, দুর্নীতি কী রকম হয় এসব নিয়ে তথ্য বাইরে খুব কম আসে। মুনাফাটি তাদের লক্ষ্য, তাই বেতন-ফি, ফান্ডসহ নানারকম ভাবে তারা অর্থ সংগ্রহ করে। যেহেতু সেখানে উচ্চ মুনাফা রয়েছে, তাই সেখানে ভ্যাট বসানোর যৌক্তিকতা রয়েছে। সমস্যা হয় ভ্যাট বসালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেটি লাভের অংশ থেকে দেবে না। তারা সেটি বেতন-ফি বাড়িয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেবে। অনেক মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা এখানে পড়ে। এমনিতেই তাদের বেতন ফি নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ আছে। অনেকের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে এই ভ্যাট যদি শিক্ষার্থীদের ওপর দেওয়া হয় তাহলে বড় ধরনের চাপ পড়বে, অনেকের লেখাপড়া অব্যাহত রাখাই কঠিন হবে।
এগুলো সরকারের চালাকির একটি ব্যাপার। এর আগে ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছিল। তখন শিক্ষার্থীরা ব্যাপক আন্দোলন করে, অনেক শিক্ষকরাও সেখানে অংশ নেয়। তখন সেটি বন্ধ করা হয়েছিল। এখন করোনার সুযোগ নিয়ে এটি একটি চালাকি এবং সুযোগ নেওয়া। করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকা দেখে মনে হচ্ছে আমরা খুব আনন্দের মধ্যে আছি। করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাখাতে যে মনোযোগের দরকার ছিল, সেটি হয়নি। অনেকেই অনলাইনে পড়ার সরঞ্জাম না থাকায় ক্লাস করতে পারছে না। এগুলো নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, সবার একটি উদ্যোগ নেওয়ার দরকার ছিল, সেটি নেওয়া হয়নি।
সরকারের সংবেদনশীলতা তো নয়ই দায়িত্বশীলতারও পরিচয় পাওয়া যায়নি। কে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, কে বঞ্চিত হচ্ছে এটি সরকারের মাথায় নেই। করোনায় নাগরিকদের অসুবিধার কথা বিবেচনা করার বদলে করোনার সুযোগ নিয়েছে। একদিকে নিপীড়ন চালানো, একদিকে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা শিক্ষা-চিকিৎসার ক্ষেত্রে নানা রকম দুর্নীতির চেষ্টা তারা সম্প্রসারণ করেছে।
এই করের বোঝা বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেবে
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক
এটা অনুচিত হয়েছে এবং বাস্তব বিবর্জিত একটা সিদ্ধান্ত। সরকারের জানা উচিৎ এই করের বোঝা বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেবে। আবার শিক্ষকদের বেতন ভাতাও কমিয়ে দেবে অনেকেই। আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, আমার ক্লাসেও বেশ কয়েকজন অনুপস্থিত। আমি জানি আর্থিক সংকটই এর কারণ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলোতে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থী অনেক।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তানদের কথা কোন বাজেট আমরা পাইনি। এই যে ডিজিটাল বৈষম্য তৈরি হয়েছে, তা নিরসনের কোন উদ্যোগ আমি বাজেটে পাই নাই। আমি দূরদৃষ্টির অভাব দেখছি। এই প্যান্ডেমিকে যে শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়লো তাদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেই। ভবিষ্যতে এই সন্তানরা যে কোথায় যাবে আমি বুঝতে পারছি না। এই সরকারের নীতি-নির্ধারকরা মাঠ পর্যায়ে দৃষ্টি দেন না। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেন না। উল্টো বিরোধী ভাবেন যা ঠিক না।
বারবারই বলছি এই সন্তানদের বিনামূল্যে ল্যাপটপ দিতে হবে। কিছুটা স্বচ্ছল পরিবারের জন্য কিস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং সবাইকেই বিনামূল্যে ইন্টারনেট সংযুক্তির আওতায় আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় খুললেও প্রতিদিন ক্লাস নেওয়া হয়তো সম্ভব হবে না। আরও ১ থেকে ২ বছর আমাদের অনলাইনে নির্ভর হতে হবে। কিন্তু এই পরিকল্পনাটা আমি বাজেটে দেখলাম না। ধরেই নিয়েছে মহামারি শেষ হয়ে যাচ্ছে। তা কিন্তু না।
শিক্ষার্থীদের হাতে ল্যাপটপ তুলে দিতে সরকারের কত টাকা যাবে? আর অনেকেই অনেক মুনাফা করছেন। সিএসআরের (কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতা) মাধ্যমেও তা সম্ভব। এসময় ১টা, ২টা মেগা প্রকল্প স্থগিত থাকলেও কিছু যায় আসে না! কিন্তু শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে যদি ২ বছর হারিয়ে যায়, তারা যদি বৈষম্যের শিকার হয়ে শিক্ষার উদ্যোম হারিয়ে ফেলে, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এটা কি জনপ্রতিনিধিরা জানেন না? সংসদে কেউ এটা তুলনেন না। জাতীয় সংসদে তাকালেই বোঝা যায় ৭০ ভাগ জনপ্রতিনিধি ব্যবসায়ী। তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, ব্যবসা ও শিক্ষা এক নীতিতে চলে না।
ভ্যাট বসালে সরকারের আয় কতটুকু হবে, কত ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে, সেসব বিশ্লেষণ তো জানা যায়নি
বদিউর রহমান
কর বিশেষজ্ঞ; সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যাট আদায়ের চিন্তা সমর্থন করি না। আগের বাজেটগুলোতে যখন আমরা কাজ করতাম, সেসময় বাজেটে কোন খাতে কর বাড়লে বা কমলে তার একটা খসড়া হিসাব থাকত। তা পর্যালোচনা করে সরকার ও জনগণের লাভ-ক্ষতি বোঝা যেত। এখন সেটা করা হয় না।
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। আর এনবিআর থেকে আহরণের লক্ষ্যমাত্রা তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এত বড় আকারের মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে কতটুকু আসবে তা তো জানতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ভ্যাট বসালে সরকারের আয় কতটুকু হবে, কত ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে, সেসব বিশ্লেষণ তো জানা যায়নি। আমি নিশ্চিত না, তবে মনে হয়, সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে এই সুযোগ নিতে চায় কিনা! তবে আগে আন্দোলন হয়েছে, এবারও হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার কারণ কী?
মিঠু মোহাম্মদ
সংগঠক, নো ভ্যাট আন্দোলন ২০১৫; সাবেক শিক্ষার্থী, ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ন্ত্রণে কোন নিয়ম-কানুন মানা হয় না। শুধুমাত্র কাগজে কলমেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে এর আচার-আচরণ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতো। প্রতিবারই যেটা করেছে সেটা শিক্ষার্থীদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছে। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দিয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয় সেমিস্টার ফি বাড়িয়ে দেবে, আর নয় শিক্ষার মান কমিয়ে দেবে। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে তা নিয়ে আমরা সন্দিহান।
অবশ্যই এই জায়গা থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। শিক্ষা আমার সাংবিধানিক অধিকার কিনা, আগে এটা বলতে হবে। তখন প্রশ্ন করব, তাহলে কেন কর আরোপ করা হলো? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার কারণ কী? এর জবাব শিক্ষার্থীদের দিতে হবে।
শিক্ষার্থীরা যাতে কোনো রিপার্কেশান (প্রতিক্রিয়া) দেখাতে না পারে, দাবির কথা তুলতে না পারে, একত্রিত হতে না পারে; সে কারণেই এই করোনার সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে বাজেটে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এবং এই সুযোগটা তারা পরিকল্পিতভাবে নিয়েছে বলেই মনে হয়।