হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের তীর ক্ষমতাসীনদের দিকে তবে সুনির্দিষ্ট করে ক্ষমতাসীন ব্যক্তির পরিচয় দিতে পারেননি যুবদল নেতার পরিবার। বিএনপি’র সমাবেশ ঘিরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মাঝে গত ৭ ডিসেম্বর রাজধানীর ওয়ারীতে নিজ বাড়িতে সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলায় নিহত হন একজন সাধারণ বাবা, মো. মিল্লাত হোসেন। বিএনপি’র অঙ্গ সংগঠন ওয়ারী থানা যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফয়সাল মেহবুব মিজু’র বাবা ছিলেন তিনি। এসময় মিজুর চাচা শাহাদাত হোসেন স্বপনকে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। সবমিলিয়ে চরম নিরাপত্তা সংকটে রয়েছে এই পরিবারটি।
ওয়ারীর এই নিজ বাড়িতেই হামলায় নিহত হন যুবদল নেতা ফয়সাল মেহবুব মিজু’র বাবা মো. মিল্লাত হোসেন
রাজধানীর ওয়ারী থানার, গোপী মোহন বসাক লেনের ৩০ নম্বর বাড়ি, একটি পুরনো দ্বিতল ভবনে এই যৌথ পরিবারটির বসবাস। রাত ১২টা, বাড়ির অনেক সদস্যই তখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। এসময় যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফয়সাল মেহবুব মিজু’র খোঁজে এই বাড়িতে হামলা চালায় প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন দুর্বৃত্তকারী। যুবদল নেতা ফয়সাল মেহবুব মিজু বাড়িতে ছিলেন না। তবে তাকে না পেয়ে তার চাচা সাবেক বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেন স্বপনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় পরে ওনার সন্ধান মেলে কেন্দ্রীয় কারাগারে। ১৯৯০ সালের এর আগে ও পরে বিএনপি’র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। সেসময় রাজনৈতিক সহিংসতায় এক আক্রমণের শিকার হয়ে মাথায় আঘাত পান, তখন থেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন মিজু’র এই চাচা।
বাঁ থেকে যুবদল নেতা ফয়সাল মেহবুব মিজু, বাবা মিল্লাত হোসেন ও চাচা শাহাদাত হোসেন স্বপন/ছবি- সংগৃহিত
পরিবারটি জানায়, স্বপনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় বাধা দেন বড় ভাই মিজু’র বাবা। সেসময় দুর্বৃত্তকারীরা তার মাথার নিচে আঘাত করলে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন ৬৫ বছরের মিল্লাত হোসেন। এরপর পরিবারের সদস্যরা ওনার মাথা তুললে মেঝেতে রক্ত দেখতে পান। পরে ওনাকে নিয়ে যান আজগর আলী হাসপাতালে, সেখানে চিকিৎসকরা মিল্লাত হোসেনকে মৃত ঘোষণা করেন। ডেথ সার্টিফিকেটে মাথার নিচে ক্ষতচিহ্ন রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মো. মিল্লাত কর্মময় জীবনে পারিবারিক ব্যবসার পাশাপাশি একসময় বাংলাদেশ আন্তঃজিলা ট্রাক চালক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
নিহত মো. মিল্লাত হোসেনের ডেথ সার্টিফিকেটে মাথায় ক্ষতচিহ্ন রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ/ছবি- সংগৃহিত
এলাকার পঞ্চায়েত কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নিহত মিল্লাত হোসেন। এলাকাবাসী জানান, তিনি ছিলেন শান্ত প্রকৃতির এবং ভালো মানুষ। এই পরিবারের বিরুদ্ধে কারো কোনো ধরনের অভিযোগ নেই।
এই যৌথ পরিবারের সবচেয়ে বায়োজ্যেষ্ঠ, ৮৫ বছর বয়সী ফজিলাতুন্নেসা। সন্তান মিল্লাত হোসেনকে হারানোর নির্মম ঘটনার সাক্ষী তিনি। মা ফজিলাতুন্নেসা কাঁপা কন্ঠে জানান, স্বামী মারা যাওয়ার পর ১০ ছেলে-মেয়েকে অনেক কষ্টে বড় করেছেন তিনি। সেদিন মেঝ ছেলে মিল্লাতের সাথে ঘুমাতে যাওয়ার আগে কথা হয় ওনার। চিৎকার-চেঁচামিচি শুনে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। এরপর ছেলেকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেন।
কান্নারত এই বৃদ্ধ মানুষটির কথা বলার শক্তি নেই। তারপরেও বলেন, “এরকম তো কোনো দিন দেখিনাই! কারও কাছে শুনি নাই! আমি কি এটা দেখার জন্য বেঁচে ছিলাম?” সেদিনের পর থেকেই যেকোনো শব্দ শুনলেই ভয় পান তিনি। এই প্রবীন মানুষটি তার সন্তান ও নাতী-নাতনিদের নিরাপত্তা চান।
এই পরিবারটির অভিযোগ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাথে সংশ্লিষ্টতা না থাকলে কারো বাড়ি এসে এমন ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। “যদি পুলিশ বা সরকারের প্রশ্রয়ে এই ঘটনা না ঘটে তবে আমার ভাই স্বপনকে ধরে নিয়ে গিয়ে পুলিশের কাছে কেন হস্তান্তর করলো আর পুলিশই বা কেন রাখলো? আমাদেরকে আর দেখা করার সুযোগ না দিয়ে কেন অজ্ঞাত আসামি করে কারাগারে পাঠালো?”- এমন প্রশ্ন করেছেন নিহত মিল্লাত হোসেনের বোন অ্যাডভোকেট বুলবুল ইয়াসমিন। এই পরিবারটি থানায় বেশ কয়েকবার খবর নিলে জানতে পারেন তাদের ভাই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কেরাণীগঞ্জ আছেন। তবে কোন মামলায় কী অপরাধে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এই বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য এই পরিবারকে থানা থেকে দেয়া হয়নি।
ওয়ারী থানায় শাহাদাত হোসেন স্বপনের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি কবির হোসেন হাওলাদার বলেন, “এই বিষয়ে কথা বলা নিষেধ আছে।” দৃকনিউজের ক্যামেরা চালু করতে দেননি তিনি। জনাব স্বপনের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি জানান, সম্প্রতি কাউন্সিলর অফিসের সামনে ২টি ককটেল ফাটানোর ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে গ্রেফতার আছেন। বাড়ি থেকে কিছু লোক তুলে এনে থানায় দিলেই পুলিশ এভাবে রাখতে পারেন কিনা প্রশ্নের জবাবে ওসি আবারও জানান, কথা বলা নিষেধ আছে। মামলার কাগজ দেখতে চাইলেও এই প্রতিবেদককে ঠিকমত দেখতে দেননি ওসি কবির হোসেন হাওলাদার। তবে ভিকটিম পরিবারটি জানায়, সেই ৯০ সালের পর থেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত স্বপন বাড়িতেই থাকতেন। বিগত ২৫ থেকে ৩০ বছর আগেই রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।
ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে সক্রিয় এলাকার কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী গৌরব বলেন, “মিল্লাত চাচা মারা যাওয়ার আগের দিন তার হাতে এলাকার মসজিদের জন্য টাকা দিয়েছি। উনি এলাকার পঞ্চায়েত কমিটির সাধারণ সম্পাদক। আমার সাথে চাচার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। বিএনপি’র রাজনীতিতে যারা আছেন বিশেষ করে ইশরাক হোসেন, তিনি এই বিষয় নিয়ে রাজনীতি করছেন। এরপর আমি মিডিয়ায় জানতে পারি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, আমাকে আসামি বানানো হচ্ছে।” তাহলে এলাকার একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে এই পরিবারের সাথে দেখা করতে গিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, “যারা আমাকে আসামি বানাচ্ছে তাদের সাথে আমি কেন যাব দেখা করতে?
রাতের অন্ধকারে একটি বাড়িতে এমন একটি সন্ত্রাসী হামলার পর এলাকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে কী ভাবছেন প্রশ্নের জবাবে রাজধানীর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের উত্তর, “আমরা কী ভেবেছিলার ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যা করা হবে?” আর কেউ কি কাউন্সিলরের কাছে এসে অভিযোগ করেছে?” আমাকে তো আসামি ভাবে তারা আমি আর কি ভাববো? আই ডোন্ট ওয়ান্ট ট্যু কনসার্ন অ্যানিবডি অ্যাবাউট ইট। মিল্লাত চাচার আরেকজন ভাই আছেন ইয়াসির আরাফাত সবুজ, অস্ট্রেলিয়া থাকেন। ২০০৯ সালের পলাতক আসামি। তারা যদি বলেন, আমি এটা করছি তাহলে আমি আর তাদের বিষয়ে কিসের নিরাপত্তা ভাববো আর মানবতা ভাববো। তাইলে কি আর আমার নাম দেয় নাকি।”
জনাব গৌরবের কাউন্সিলর কার্যালয়ের সামনে ককটেল ফাটানোর ঘটনায় অজ্ঞাত আসামি হিসেবে শাহাদাত হোসেন স্বপনকে পুলিশ গ্রেফতার দেখালেও এই বিষয়ে কিছুই জানেন না, বলে জানান এই কাউন্সিলর।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী গৌরব/ছবি- সংগৃহিত
তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেও কার নেতৃত্বে কারা কারা এই গভীর রাতে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছেন এই বিষয়ে নিশ্চিন নন এই পরিবার। এলাকার কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী গৌরবের বিরুদ্ধে এই প্রতিবেদকের কাছে কোনো অভিযোগ আনেননি এই পরিবারের সদস্যরা। নিজ থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরে দাবি করে নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রসঙ্গ এনেছেন কাউন্সিলর গৌরব।
বাবা’র মৃত্যুর বিষয়ে নিজেকে দায়ী করে এই ঘটনার পরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফয়সাল মেহবুব মিজু বলেছিলেন, “ছেলে রাজনীতি করার জন্য বিএনপি করার জন্য বাবাকে মেরে ফেলার ঘটনা ইতিহাসে নাই। আমাকে খুঁজে না পেয়ে আমার বাবাকে মেরে ফেলছে এটা আমি কীভাবে ভুলি? এদেশে বিএনপি করা কি অপরাধ?” তবে এরপর অনেক চেষ্টা করে তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এই বিষয়ে পরিবারের সদস্যরা জানান, নিরাপত্তাহীনতার কারণেই আর কথা বলতে চান না যুবদলের এই সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক।
নিহত মিল্লাত হোসেন মারা যাওয়ার পরদিন ৮ ডিসেম্বর সেই বাসার সামনে মুখে রুমাল বেধে মিছিল হয়েছে বলেও জানান, জনাব মিল্লাতের বোন বুলবুল ইয়াসমিন। এতে এই পরিবারটি আরও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। তবে মিছিল প্রসঙ্গে এলাকার কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী গৌরব বলেন, “কোনো এলাকায় মিছিল হলে তো কাউন্সিলর জানবেন। কোনো মিছিল হয়নি, এটা অসম্ভব।”
মিল্লাত হোসেন খুন হওয়ার অভিযোগে এই পরিবার এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেনি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি’র পক্ষ থেকে মামলার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো মামলার খবর পাওয়া যায়নি।
মিল্লাত হোসেনের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসতে অন্তত দুই মাস সময় লাগবে জানিয়ে পুলিশ দাবি করেন, তিনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী ছিলেন এবং সেসময় স্ট্রোক করে মারা গেছেন। (উল্লেখ্য ডেথ সার্টিফিকেটে মাথার নিচে ক্ষতচিহ্ন উল্লেখ করা হয়েছে) তবে বাড়িতে এত লোকের প্রবেশ করার ঘটনাটি অস্বীকার করেননি। এই পরিস্থিতিতে একটি স্বজন হারানো পরিবার বারবার নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়েছে। তবে জননিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ মনে করেন না, তাদের নিরাপত্তার প্রয়োজন রয়েছে। দৃকনিউজ প্রতিবেদক, ওসি কবির হোসেন হাওলাদারকে ভিকটিম পরিবার নিরাপত্তা চান জানালে তিনি বলেন, “আমি মনে করি না, তাদের নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে।”
এই ঘটনার বেশ কয়েকদিন পর সূত্র জানায়, এরইমধ্যে ওয়ারী থানা থেকে ওসি কবির হোসেন হাওলাদারকে অন্য কোথাও স্থানান্তর করা হয়েছে। এই আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি’র রাজনীতিতে যুক্ত থাকার কারণে দলটির অনেক নেতাকর্মী কারাগারে আছেন, আটক বা পলাতক রয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা যেকোনো রাজনৈতিক দল করার দায়ে বাড়িতে হামলা, বাবা হত্যা, পরিবারের সদস্যদের তুলে নিয়ে যাওয়াও মতো নির্মম ঘটনার পুনরাবৃত্তি চান না দেশবাসী।
মো. মিল্লাত হোসেন হত্যা প্রসঙ্গে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী গৌরবের বক্তব্যের কিছু অংশ