শুক্রবার ১৫ই চৈত্র ১৪৩০ Friday 29th March 2024

শুক্রবার ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

Friday 29th March 2024

সংস্কৃতি বইপত্র

বলিউডি সিনেমার পতন: #বয়কট ট্রেন্ডই কি একমাত্র কারণ?

২০২২-১০-১৬

জয়ন্তী রায়না

একে একে বয়কটের তালিকায় উঠে ফ্লপ সিনেমা নিয়ে হাজির হয়েছেন আমির খান,

অক্ষয় কুমার সহ আরো অনেকেই


 

সম্প্রতি পাল্লা দিয়ে বলিউড সিনেমা বয়কট করা শুরু হয়েছে ভারতে। হ্যাশট্যাগ দিয়ে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে সিনেমাগুলোকে বয়কট করার আহ্বান জানানো হয়েছে, বিপুল সংখ্যক মানুষ সেগুলো নিজেরাও শেয়ার করেছেন। অন্যদিকে একের পর এক বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক ছবি লোকসান গুনেছে, বিপদে পড়েছেন প্রযোজকরা। আমির খানের লাল সিং চাড্ডা থেকে শুরু করে ডার্লিংস বা অক্ষয়ের রাখী বন্ধন সবার সিনেমাই আছে এই বয়কটের কাতারে। বয়কটের ধারাবাহিকতায় হুমকির মুখে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। লাল সিং চাড্ডা তুলতে পারেনি ১৮০ কোটি বাজেটের অর্ধেকও। একই অবস্থা রাখী বন্ধন এরও। যুগ যুগ জিও বাজেটের অর্ধেক ছুঁতে পারলেও তুলতে পারেনি পুরো বিনিয়োগ। ভুলভুলাইয়া ২-ই একমাত্র বাজেট তুলতে পেরেছে এ বছর। এই সিনেমাটি বক্স অফিসে ৭৫ কোটি বাজেট নিয়ে তুলে এনেছে ১৮৫ কোটি।

 

 

তারকাদের বিরুদ্ধে যা যা বলা হচ্ছে…

দেশ ক্রমশ অসহনশীল হয়ে যাচ্ছে, সম্প্রতি এমন বক্তব্য দিয়েছেন অভিনেতা আমির খান। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর নতুন সিনেমা লাল সিং চাড্ডা বয়কটের ডাক এসেছে। রণবীরের ব্রহ্মাস্ত্র বয়কটের পেছনে কারণ হিসেবে বলা হয়েছে এর আগে সিনেমায় জুতো পায়ে মন্দিরে উঠতে দেখা গেছে রণবীরকে। একেক সিনেমা বয়কটের পেছনে অভিযোগ ভিন্ন হলেও গোড়ায় গেলে বক্তব্যগুলোর মধ্যে একটা সাধারণ মিল পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করা অথবা রাষ্ট্রের সমালোচনা করার অভিযোগ উঠেছে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বিরুদ্ধে। এই ডাকগুলো সফলভাবেই তারকা এবং দর্শকদের মধ্যে একটা দূরত্বও তৈরি করছে বলে বয়কটকারীরা মনে করছেন।

 

তবে দর্শকদের সিনেমা বয়কট করা নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হতে দেখা যায়নি সকল অভিনেতা-অভিনেত্রী বা পরিচালকদের। অনেক বিশ্লেষকও মনে করেন বয়কটের আহবান নয়, বরং আরও অনেকগুলো কারণ মিলে একের পর এক বলিউডি ছবির বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এই কারণগুলোর মধ্যে হিন্দুত্ববাদ ছাড়াও ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার বদলেরও প্রতিফলন আছে বলে মনে করেন বহু বিশেষজ্ঞ। দর্শকদের একের পর এক হিন্দি সিনেমা নাকচ করে দেয়া থেকে এই বিষয়টা স্পষ্ট যে দর্শকরা হিন্দি সিনেমার গল্পের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এর পেছনে কোনো একক কারণ নয়, বরং একাধিক কারণ কাজ করছে এবং এই ট্রেন্ড তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াও এক দিনের নয়। বরং দীর্ঘদিনের নানান বিষয় বলিউডকে পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়াটা দর্শকদের একাংশের জন্য সহজ হয়ে যাচ্ছে।

 

 

অভিনেতা নন, বলিউডে এখন আছেন অজস্র তারকা

৫০-৬০ এর দশক থেকে যদি ৮০ বা ৯০ এর দশকের কথাও ভাবি, অনেক গুণী মানুষের উপস্থিতি পাওয়া যাবে হিন্দি চলচ্চিত্র মহলে। কেবল পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী বা গায়ক-গায়িকা নন; অনেক লেখক, কবিও কাজ করেছেন এই ইন্ডাস্ট্রিতে। হৃষিকেশ মুখার্জী, বিমল রায়, মুকুল আনন্দ এর সময়কার পরিচালক ও শিল্পীরা দিয়ে গেছেন অসাধারণ সব কাজ। আবার ভারতীয় সিনেমার একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে গান। বহু সিনেমার গান এর আগে মূল সিনেমাকেও ছাপিয়ে গেছে। গুলজার সাহেবের কথা যদি বলি, তিনি কেবল গান লিখে ক্ষান্ত হননি। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন চলচ্চিত্রে, লিখেছেন চিত্রনাট্য, করেছেন পরিচালনা। বিখ্যাত উর্দু কবি মজরুহ সুলতানপুরী বা আসরার উল হাসান খান হিন্দি সিনেমার সঙ্গীতেই কেবল অবদান রাখেননি, দিয়েছেন অনেক নতুন শব্দও। ভূমিকা রেখেছেন প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনে। এই আন্দোলনেই সম্পৃক্ত ছিলেন সাদাত হাসান মান্টো, আলী সরদার জাফরি, সাহির লুধিয়াভনির মতো মানুষেরা। আনন্দ বকশি, সলিল চৌধুরী, গোপালদাস নীরাজ থেকে শুরু করে জাভেদ আখতার, কিশোর কুমার, মোহাম্মদ রফিরা ভারতের সঙ্গীত জগতের সাথে সাথে একইরকম গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র জগতেও।

 

প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনের সদস্যরা ভূমিকা রেখেছেন চলচ্চিত্র জগতেও

 

 

এখনকার সময়ে অভিনেতা অভিনেত্রীরা ‘শিল্পী’ পরিচয়ের চেয়ে ‘তারকা’ পরিচয়ে বেশি পরিচিত হচ্ছেন। শিল্পী এবং তারকা উভয়ের কাজের উদ্দেশ্য, ধরণ ও যাপন ভিন্ন। যদিও বলা হয় যে সেসময়ে শিল্পীদের নিজেদের কাজের প্রতি শ্রদ্ধা ছিলো বর্তমান সময়ের চেয়ে বেশি, তারপরেও ঢালাওভাবে এটি বলা যায় না যে অতীতেই সব প্রতিভাবানেরা কাজ করতেন, এবং এখন তাঁদের অভাবেই বলিউডের এই গরিবি হাল। তবে চলচ্চিত্র মহলের চর্চার ধরন-ধারন কেমন, তার ওপর এর গুণগত মানও নির্ভর করে। চলচ্চিত্রকে যেহেতু শিল্প হিসেবেই বিবেচনা করা হয়, সেখানে বিভিন্ন মাধ্যমের মিশ্রণ এবং জ্ঞানের আদান প্রদান থাকা জরুরি। সিনেমার সংখ্যা কম হলেও, মানের দিক থেকে এগিয়ে ছিলো বলিউডের অতীত। গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় যা এই কিছুদিন আগেও ছিলো হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে, তা হলো তুলনামূলকভাবে সামাজিক দায়বদ্ধতা, সিনেমার গল্পের সাথে সমাজের তুলনামূলক বেশি সম্পৃক্ততা।

 

 

জাঁকজমকপূর্ণ একঘেয়ে গল্প কিংবা রিমেক

বর্তমান সময়ে হিন্দি সিনেমার প্রতি দর্শকদের নেতিবাচক মনোভাবের একটা বড় কারণ, স্বকীয়তার অভাব। কারিগরি দক্ষতা ও জাঁকজমক যতই বাড়োক, একই গল্প, একই ধরণের ক্যামেরার কাজ বা একশন দেখার ক্ষেত্রে মানুষের আগ্রহ কমান্বয়ে কমতে থাকাটাই স্বাভাবিক। সিনেমায় নতুনত্ব না থাকলে মানুষ সঙ্গতকারণেই চলচ্চিত্রে বিনোদন পান না, পান একঘেয়েমি। অধিকাংশ বলিউডি চলচ্চিত্রই এই দোষে দুষ্ট। মধ্যবিত্ত দর্শকদের একটা অংশকে বলিউডবিমুখ করেছে এই বাস্তবতা।

 

অনেকের মতেই, হিন্দি সিনেমায় একরকম একঘেয়েমি চলে এসেছে দর্শকদের। সেটা কেবল কন্টেন্ট এর ক্ষেত্রে নয়, বরং পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রেও। বলিউড ইন্ডাস্ট্রির নির্দিষ্ট কিছু মানুষের একচ্ছত্র আধিপত্যকে ‘মাফিয়া সংস্কৃতি’ও বলে থাকেন অনেকে। এখনও ইন্ডাস্ট্রির নির্দিষ্ট কিছু মানুষের হাতে রয়েছে হিন্দি সিনেমার মূল নিয়ন্ত্রণ, এমন মত সিনেমা বোদ্ধাদের। দর্শকরাও বলছেন, একই মুখ দেখতে দেখতে তাঁরা এখন ক্লান্ত। শিল্পচর্চার জায়গাটি উন্মুক্ত থাকা প্রয়োজন। এই মুহূর্তে কন্টেন্ট এর মানোন্নয়নের দিকে মনোযোগ না দিলে সামনের দিনগুলোতে সাফল্যের মুখ দেখা আরো কঠিন হয়ে যাবে বলিউড ইন্ডাস্ট্রির জন্য। দর্শকদের এই একঘেয়েমি, তারকাদের উদ্ধত আচরণ এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাদের নেতিবাচক ভূমিকা হিন্দুত্ববাদী বয়কট প্রচারণাতে সুবিধা করে দিলেও মূল সঙ্কটটি তাই বলিউডেই খুঁজতে হবে।

 

বলিউডের সিনেমাগুলোর অধিকাংশই রিমেক করা হয় দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা থেকে। বর্তমানে দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার মান আগের তুলনায় ভালো হওয়ায় রিমেক সিনেমা নিয়ে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকাটা হিন্দি সিনেমার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিন্দি ভাষায় ডাবিং করে ভারতজুড়ে দক্ষিণী ছবিটি পৌঁছে যাওয়ায় এই ছবির হিন্দি রিমেকের সফল হবার সম্ভাবনা যাচ্ছে কমে। ভারতীয় দর্শকের একটা বড় অংশই ফরেস্ট গাম্প দেখে ফেলেছেন বহু আগেই, 'লাল সিং চাড্ডা' দেখতে তাদের আগ্রহ কমে যাওয়াটা খুবই সম্ভব। ফলে এটা আমির খানকে বয়কটের সাফল্য, নাকি ছবিটির দুর্বলতা, সেটা নিয়ে আরও ভাবা দরকার।

 

অন্যদিকে, একই সিনেমার রিমেক বা কপি ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু হরহামেশাই হয়ে থাকা এই বিষয়টা সিনেমার জন্য নানান দিক থেকে সমস্যাজনকও। বলিউডের রাওডি রাথোর, সিঙ্ঘাম, বডিগার্ড, গজিনি এর মতো সুপারহিট সিনেমাগুলো দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার রিমেক। এর আগে এই বিষয় নিয়ে কিছু দর্শক কথা বললেও সেই সময় ভাষা সমস্যার কারণে মূল সিনেমাগুলো ভারতজুড়ে সাধারণ দর্শকদের কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ায় তা খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি। এইসব ক্ষেত্রে সাধারণত রিমেক করা সিনেমা যদি মূল সিনেমার চেয়ে মানসম্মত হয়, তবেই রিমেক সিনেমার দর্শকদের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বলিউডের সিনেমাগুলোর অধিকাংশই রিমেক করা হয় দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা থেকে। বর্তমানে দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার মান আগের তুলনায় ভালো হওয়ায় রিমেক সিনেমা নিয়ে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকাটা হিন্দি সিনেমার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিন্দি ভাষায় ডাবিং করে ভারতজুড়ে দক্ষিণী ছবিটি পৌঁছে যাওয়ায় এই ছবির হিন্দি রিমেকের সফল হবার সম্ভাবনা যাচ্ছে কমে। ভারতীয় দর্শকের একটা বড় অংশই ফরেস্ট গাম্প দেখে ফেলেছেন বহু আগেই, 'লাল সিং চাড্ডা' দেখতে তাদের আগ্রহ কমে যাওয়াটা খুবই সম্ভব। ফলে এটা আমির খানকে বয়কটের সাফল্য, নাকি ছবিটির দুর্বলতা, সেটা নিয়ে আরও ভাবা দরকার।

 

 

 

 বডিগার্ড সিনেমার দৃশ্যে সালমান খানকে অনুকরণ করছেন কারিনা কাপুর।

ঘটনাক্রমে এই আস্ত সিনেমাটিই  দক্ষিণ থেকে নকল করে বানানো হয়েছে

 

 

দক্ষিণ ভারতের প্রসঙ্গ

বলিউডের সাম্প্রতিক দুর্দশার কারণ হিসেবে দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমাকে দুষছেন অনেকে। একটা বড় অংশই মনে করেন, দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার ব্যাপক উন্নতিই হিন্দি সিনেমাকে মার খাওয়াচ্ছে। বলিউড ও দক্ষিণ ভারতের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে বরাবরই একটা দূরত্ব ছিলো। নিজেদের অঞ্চলে সফল হওয়া সত্ত্বেও দক্ষিণ ভারত সবসময়েই আঞ্চলিক সিনেমার তকমা পেয়ে এসেছে। মূলধারার সিনেমা বা ভারতীয় সিনেমা বলতে লোকে যা বোঝে, তার মধ্যে ঢুকতে পারেনি দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা। অন্যদিকে বলিউড দীর্ঘদিন একা রাজত্ব করার পর বর্তমান সময়ে এসে সেই আধিপত্য কেড়ে নিচ্ছে দক্ষিণ ভারত।

 

দক্ষিণ ভারতের প্রসঙ্গে যদি আসি, এই অঞ্চলের দর্শকদের বলা হয় সমগ্র ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিনেমাপ্রেমী। এই দর্শকদের জন্য সপ্তাহে ৩টি সিনেমা দেখা খুবই সাধারণ ব্যাপার। এ কারণে দক্ষিণ ভারতে তাদের নিজেদের সিনেমার গ্রহণযোগ্যতা সবসময়েই ছিলো। আরো একটি বিষয় হলো, দক্ষিণ ভারতের ৫টি রাজ্য, অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক, কেরালা, তামিল নাড়ু ও তেলেঙ্গানার মধ্যে ভাষার সামঞ্জস্য থাকায় দর্শকেরা ৪ থেকে ৫ টি ভাষা অনায়াসেই বুঝতে পারেন। বড় পর্দায় সিনেমা দেখার চলটা যেখানে অন্যান্য জায়গায় তুলনামূলক কমবয়েসীদের মধ্যে প্রচলিত, দর্শকবান্ধব দক্ষিণ ভারতে তা সকল বয়েসি, সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে প্রচলিত। এই চিত্র এই অঞ্চলে নতুন নয়। 

 

 

 

সাম্প্রতিক সময়ের দক্ষিণ ভারতের বেশ কয়েকটি সিনেমা রেকর্ড পরিমাণ উপার্জন করেছে।

আরআরআর আয় করেছে ১০০০ কোটি রুপিরও বেশি

 

 

দক্ষিণ ভারত বরাবরই চেষ্টা করেছে কন্টেন্ট নির্ভর কাজ করতে। মানুষ যখন ঘরের বাইরে বড় পর্দায় সিনেমা দেখতে যায়, তাদের প্রত্যাশার জায়গাও থাকে বড়। সেই জায়গায় থিয়েটারে সিনেমার পুরো সময়টা জুড়ে দর্শকদের মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে দক্ষিণের সিনেমাগুলো। সাম্প্রতিক সময়ের আর আর আর, পুষ্পা বা কে জি এফ ২ সিনেমাগুলো তারই প্রমাণ। সিনেমার সেট, গান, একশন কোনো জায়গাতেই ছাড় দিচ্ছেন না পরিচালকেরা। সেইসাথে কাজে ভিন্নতা এনে নতুন নতুন পরীক্ষামূলক কাজও হচ্ছে। দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন এইক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে। কন্টেন্ট এর এই মানোয়ন্নয়ন নিঃসন্দেহে দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার জন্য বড় সংযোজন।

 

 

সিনেমা হল বনাম মাল্টিপ্লেক্স

সিনেমার প্রদর্শনী কোথায় হচ্ছে, মানুষ কোথায় যাচ্ছে সিনেমা দেখতে, সেখানের পরিবেশ কেমন, তার ওপরে সিনেমার সাফল্য বা ব্যর্থতা অনেক অংশে নির্ভর করে। একক পর্দার হল, একাধিক পর্দার সিনেপ্লেক্স বা ৭-১০ পর্দার বিশাল মাল্টিপ্লেক্স - সব জায়গাতেই সিনেমা দেখা গেলেও সবগুলোর ভূমিকা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে একরকম নয়।

 

ভারতে প্রথম মাল্টিপ্লেক্স আসে ১৯৯৭ তে। এরপর ২০০৩ থেকে উত্তর ভারতের সিনেমাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে মাল্টিপ্লেক্স। সিনেমা দেখার ক্ষেত্রে মাল্টিপ্লেক্স গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে সেখানে সময় আর সিনেমার ক্ষেত্রে বাছাই করার সুযোগ বেশি থাকে এবং বিনোদনের জায়গা হিসেবে মাল্টিপ্লেক্স এক পর্দার সিনেমা হলের চেয়ে অনেক এগিয়ে। মাল্টিপ্লেক্সে একইসাথে একাধিক পর্দায় সিনেমা চলার সুযোগ থাকে। সেইসাথে থাকে খাওয়া, কেনাকাটা, খেলার জায়গাও। যেই কারণে বিনোদনের একটা বড় পরিসর তৈরি হয় মাল্টিপ্লেক্সে। এক জায়গায় অনেক ধরনের বিনোদনের সুযোগ থাকায় মানুষের খরচ করার সুযোগ বাড়ে। তবে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মাল্টিপ্লেক্সে ছবি দেখা তুলনামূলক ব্যয়বহুল। যেই কারণে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের জন্য তা উপযোগী নয়। তাই দর্শকদের একটা অংশকে আর্থিক সঙ্গতির অভাবেই সিনেমা থেকে দূরে সরে যেতে হয়। বছর কয়েক আগেও মাল্টিপ্লেক্সে দর্শক থাকলেও করোনা পরবর্তী মন্দার সময়ে দর্শকের সংখ্যা কমে গিয়েছে বলেই মনে করেন বহু পর্যবেক্ষক। অন্যদিকে, দক্ষিণ ভারতে এখনো কম দামের টিকেটে সিনেমা দেখা যায় পুরনো প্রেক্ষাগৃহগুলোতে।

 

 

 

ভারতের প্রথম মাল্টিপ্লেক্স প্রিয়া ভিলেজ রোড শো

 

 

একঘেয়ে গল্প তো দক্ষিণেরও, তাদের জনপ্রিয়তার রহস্যটা তাহলে কী?

এর উত্তরও একই, এক পর্দার বড় এবং কম খরচের পুরনো সিনেমাহল।

যেই দর্শকরা মাল্টিপ্লেক্সে যেতে পারছেন না বা যাচ্ছেন না, তাদের জন্য উপযোগী জায়গা কোনটি? উত্তর হলো এক পর্দার সিনেমা হল। এই সিনেমা হলগুলো সাধারণত সকল শ্রেণী পেশার মানুষের সামর্থ্যের মধ্যে থাকে। এক পর্দার সিনেমা হল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা হলো, প্রিয় তারকাকে যথাসম্ভব সকল সময়ে সকল উপায়ে সমর্থন যোগানো। যে কারণে তামিল নাড়ুতে সমালোচকদের কাছ থেকে গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও থালাপতি বিজয়ের ‘বিস্ট’ সিনেমা দেখার জন্য মাঝরাত থেকে দর্শকরা অপেক্ষা করেছেন। হিন্দি ছবিতে একদিকে দরিদ্র দর্শককে কোণঠাসা করা হয়েছে, আরেকদিকে মধ্যবিত্ত দর্শককে টানতেও তা ব্যর্থ। কিন্তু এ-ও সত্যি যে অনেক সময় তারকার জন্য ভালোবাসা একটি তুলনামূলক খারাপ গল্পের সিনেমাকে পতনের হাত থেকে বাঁচাতেও পারে, যদি দর্শকের সেখানে যাবার সামর্থ্য থাকে। এইক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে এক পর্দার সিনেমা হল। সিনেমা সফল হওয়ার জন্য যদি আমজনতাকে প্রয়োজন হয়, তাহলে সেই আমজনতার জন্য উপযোগী জায়গাও প্রয়োজন। কম আয়ের ভারতে তাই সিনেমাকে টিকিয়ে রাখতে বেশি ভূমিকা রাখছে এক পর্দার হল, দক্ষিণ ভারত এদিক দিয়ে এগিয়ে।

 

তারকার জন্য ভালোবাসা একটি তুলনামূলক খারাপ গল্পের সিনেমাকে পতনের হাত থেকে বাঁচাতেও পারে, যদি দর্শকের সেখানে যাবার সামর্থ্য থাকে। এইক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে এক পর্দার সিনেমা হল। সিনেমা সফল হওয়ার জন্য যদি আমজনতাকে প্রয়োজন হয়, তাহলে সেই আমজনতার জন্য উপযোগী জায়গাও প্রয়োজন। কম আয়ের ভারতে তাই সিনেমাকে টিকিয়ে রাখতে বেশি ভূমিকা রাখছে এক পর্দার হল, দক্ষিণ ভারত এদিক দিয়ে এগিয়ে।

 

দক্ষিণ ভারত এক পর্দার সিনেমা হলের জন্য বিখ্যাত। অনেক পুরানো সিনেমা হল দক্ষিণ ভারতে এখনো সগৌরবে টিকে আছে। সিনেমা হলের আমেজ দেয়ার জন্য এই হলগুলো অনন্য। এর বাইরে বিগত কয়েক বছরে দক্ষিণ ভারতের সিনেমা বাজারে উল্লেখযোগ্য একটি সংযোজন হলো মাল্টিপ্লেক্স। চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালোর সহ বেশ কিছু শহরে রয়েছে ৭ থেকে ১০ পর্দার মাল্টিপ্লেক্স। এই অঞ্চলে এর আগে শতকরা ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ একপর্দার সিনেমা হল থাকার পরেও বক্স অফিসের ৬০% আয় ছিলো মাল্টিপ্লেক্স থেকে আসা। বর্তমানে এই সংখ্যা আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা চলছে এবং এক পর্দার থিয়েটারগুলোর জায়গা দখল করে নিচ্ছে মাল্টিপ্লেক্স। আগামী ৫ বছরের মধ্যে দক্ষিণ ভারতজুড়ে প্রায় ১০০০ এর মতো মাল্টিপ্লেক্স হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দক্ষিণ ভারতে দর্শকদের জন্য সিনেমা দেখার জায়গার তাই অভাব নেই। তবে মাল্টিপ্লেক্স যদি সব এক পর্দার সিনেমা হলকে সরিয়ে দেয়, সেইক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারতের সিনেমার ধারা কোনদিকে যাবে, তা এখনি নিশ্চিত করে বলা যায় না।

 

 

কোভিড এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্ম

করোনার সময়ে মানুষের দেখার অভ্যাসে এসেছে একটা বড় পরিবর্তন। পরিবর্তিত হয়েছে সিনেমা দেখার মাধ্যম এবং ধরণ। বর্তমানে নেটফ্লিক্স, আমাজন প্রাইম বা অন্যান্য বিনোদন প্ল্যাটফর্মগুলোর কল্যাণে মানুষ অনেক ধরণের কন্টেন্ট দেখার সুযোগ পাচ্ছে। এই ব্যাপারে অভিনেতা আর মাধবনও বলেন যে করোনাকালীন বিভিন্ন ধরণের কন্টেন্ট দেখার সুযোগ হয়েছে মানুষের। অখণ্ড অবসরে মানুষ গ্লোবাল কন্টেন্ট এর সাথে পরিচিত হওয়ায় দর্শকদের রুচিতেও এসেছে ভিন্নতা। এর আগে উত্তর ভারতীয় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি থিয়েটারে প্রায় একই ধরণের কাজ বা একক জনরা নিয়ে টিকে ছিলো। বর্তমানে আরো অনেক ধরণের কাজ দর্শকদের কাছে সহজলভ্য হওয়ায় এই একক জনরার ধারা আর কাজ করছে না।

 

এসব কারণে হিন্দি সিনেমাই এখন আর দর্শকদের একমাত্র বিনোদনের জায়গা না। আবার সিনেমার পাশাপাশি ভারতে বিভিন্ন সিরিজও এখন ব্যাপক জনপ্রিয়। একশন এবং নাচ-গানবিহীন ছোট পর্দার এই সমস্ত কন্টেন্ট মানুষের বিনোদনের একটা বড় জায়গা নিয়ে নিচ্ছে।

 

এই প্ল্যাটফর্মগুলোর জনপ্রিয়তা পাওয়ার আরেকটা কারণ এগুলো সাশ্রয়ী। নেটফ্লিক্স বা আমাজনে যে পরিমাণ রুপি খরচ করে হাজার হাজার সিনেমা দেখা যাবে, হলে গিয়ে দেখলে হয়তো তা দিয়ে দেখা যাবে একটা বা দুটো সিনেমা। বড় পর্দায় সিনেমা দেখার সাথে নতুন সংযোজন হয়েছে বন্ধুদের সাথে স্ক্রিনশেয়ার করে একসাথে সিনেমা দেখা। ফলে প্রেক্ষাগৃহের আবেদন এ কারণেও কমেছে।

 

 

তারকাদের অকল্পনীয় পারিশ্রমিক

এখনো কম বাজেটের অনেক হিন্দি সিনেমাই ব্যবসাসফল হচ্ছে কিন্তু বেশি বাজেটের অনেক সিনেমাই সেই জায়গায় যেতে পারছে না। এর কারণ কী? বড় বাজেটের একটি সিনেমা, ধরা যাক, তার বাজেট ১৫০ কোটি। এখন, এই সিনেমাটি যদি বক্সফিসে ১৫০ কোটি আয় করতে না পারে, তাহলে সিনেমাটি ফ্লপ। যদি ১৫০ কোটি এর চেয়ে কিছু বেশি আয় করে, তবে সাধারণের কাতারে। আর যদি সিনেমাটিকে ব্যবসাসফল বা হিট হতে হয়, তাহলে আয় করতে হবে ৩০০ কোটি। এই বিপুল অংকের টাকা বক্স অফিস থেকে তুলে আনা দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

 

সঙ্গত কারণেই বলিউডের তারকাদের পারিশ্রমিক নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। বড় তারকাদের পারিশ্রমিক অনেক বেশি হওয়ায় তাঁদের সিনেমার বাজেটও বেশি হচ্ছে। এক পরিচালক সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন যে অজয় দেবগন একটি সিনেমার জন্য পারিশ্রমিক দাবি করেছেন ১০০ কোটি রুপি। সেই সাথে এক মাসের মধ্যে শ্যুটিং শেষ করার জন্য সময় বেঁধে দিয়েছেন পরিচালককে। তারকাদের এ ধরণের আবদারের কারণ তাঁরা যাতে বেশি কাজ করতে পারেন। এই ১০০ কোটি পারিশ্রমিকের তালিকায় রয়েছেন আরো অনেক তারকাই। সালমান খান এবং আমির খানের পারিশ্রমিক সিনেমা প্রতি ১০০ থেকে ১৫০ কোটি রুপি। শাহরুখ খানের ১০০ থেকে ১২০ কোটি রুপি, হৃতিক রোশনের ৮০ থেকে ১০০ কোটি এবং অক্ষয় কুমারের ৭০ থেকে ১২০ কোটি রুপি। সিনেমায় একজন তারকাকেই এই পরিমাণ পারিশ্রমিক দিতে হলে সিনেমার বাজেট কোনো অবস্থাতেই কম রাখা সম্ভব হয়না। বলিউডের প্রায় সব “বড় তারকা”র পারিশ্রমিকই ৫০ কোটি ওপরে। অথচ সেই পারিশ্রমিকের বিপরীতে তাঁদের সিনেমা তুলে আনতে পারছেনা কাঙ্ক্ষিত আয়। এরপরেও কিসের ভিত্তিতে কাজ পাচ্ছেন এই তারকারা সে বিষয়ও ভাবা প্রয়োজন। বলিউডে মাফিয়াতন্ত্র আর তারকাতন্ত্রের প্রভাব দীর্ঘদিনের। এই সংস্কৃতির ভেতরে থেকে অনেক প্রতিভাবান অভিনেতা, পরিচালকই আসতে পারেন না মূল ধারায়। একদিকে তারকাতন্ত্রের পেছনের বিপুল ব্যয় আরেকদিকে সাধারণ দর্শকদের টানতে মাল্টিপ্লেক্সের ব্যর্থতা, দুয়ে মিলে বলিউডের চলচ্চিত্র জগতের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে।

 

 


সিনেমার বাজেটের বড় অংশই তারকাদের পারিশ্রমিকে চলে যাওয়ায় সিনেমার বাজার আরো বেশি কাটতির মুখে পড়ছে


 

অন্যদিকে, কম বাজেটের সিনেমার ক্ষেত্রে বক্স অফিসে হিট হওয়ার জন্য বিপুল আয় করতে হবে, এই চাপটা থাকে না। যেই কারণে মানে ভালো হলে মোটের ওপর কম আয় করেও এই সিনেমাগুলো মূলধনের ওপর লাভ তুলে আনতে পারে। কাহানি, লাঞ্চবক্স, তানু ওয়েডস মানু এর মতো ছবিগুলি কম বাজেট নিয়েও বক্স অফিসে রাজ করেছে। বড় বাজেটের সিনেমার সাথে তুলনা করলে এই ছবিগুলোর মোট আয় হয়তো কম। কিন্তু বিনিয়োগ কম থাকায় উঠে এসেছে বিপুল পরিমাণ লাভ। সেই সাথে পেয়েছে জনপ্রিয়তাও। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো কানতারা সিনেমাটি। এর বাজেট মাত্র ১৬ কোটি রুপি। এই ছবিটি বক্স অফিস থেকে এরই মধ্যে তুলে এনেছে ৫০ কোটি রুপি। অর্থাৎ একই কথা আবারো সামনে আসে। ব্যবসাসফল হওয়ার জন্য ভালো সিনেমা তৈরির কোনো বিকল্প নেই।

 

 

 

চলচ্চিত্র ভালো হলে তা দর্শকদের টানবেই। তারই প্রমাণ কানতারা সিনেমাটি

 

 

ব্রহ্মাস্ত্র কেন সফল?

সিনেমাটি বয়কটের ডাক দেয়ার পরেও সফল হয়েছে। সিনেমাটি রয়েছে হিন্দি, ইংরেজি, তামিল, তেলেগু, কন্নড় ও মালায়লাম ভাষায়। আয়ান মুখার্জীর এই সিনেমা কেবল ভারতেই আয় করেছে ২০০ কোটির বেশি এবং বিশ্বব্যাপী সিনেমাটির আয় ৪০০ কোটি। অথচ বয়কটের কাতারে ছিলো এই সিনেমাও। সমালোচকদের কাছ থেকেও পায়নি ইতিবাচক সাড়া। তারপরও দর্শকদের কেন টানছে সিনেমাটি?

 

হিন্দু পুরাণের গল্প নিয়ে বানানো আরেকটি সিনেমা ‘আদিপুরুষ’। ৫০০ কোটি রুপি বাজেটের এই সিনেমা মুক্তি পাবে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে। অথচ এরই মধ্যে ভারতীয় টিভি চ্যানেলে ব্যাপক আলোচনা (পড়ুন সমালোচনা) হয়েছে এই সিনেমাটি নিয়ে। সিনেমাটিতে রাবণের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাঈফ আলী খান। মুসলিম এই অভিনেতাকে সিনেমাতে নাকি দেখা গেছে একজন মুসলমানের মতো। অর্থাৎ রাবণকে দেখে অনেকেরই তাঁকে মুসলিম মনে হয়েছে। এই “মুসলমান দেখানো” বিষয়টি কতোটা সাঈফ আলী খানের উপস্থিতির কারণে, কতোটা উপস্থাপনের কারণে তা নিশ্চিত করে বলা যায়না। সেই সাথে হিন্দু দেব দেবীদের ভুল উপস্থাপনের অভিযোগও আছে। অনেকে বলছেন সিনেমাটি আসলে “রামায়ণের ইসলামীকরণ”

 

ব্রহ্মাস্ত্র দর্শকদের তাহলে কী দিচ্ছে তা বোঝার চেষ্টা করা যাক। সিনেমা যারা দেখে থাকেন, তাঁরা ভিএফএক্স এর সাথে পরিচিত। ভিএফএক্স হলো মূলত ভিজ্যুয়াল এফেক্ট যা অবাস্তব বিষয়কে বাস্তবের মতো করে দেখায়। ব্রহ্মাস্ত্রের মতো পৌরাণিক কাহিনী ভিত্তিক ও ফ্যান্টাসিনির্ভর সিনেমায় ভিএফএক্স এর ব্যবহার থাকবে,এটা কোনো বিশেষ ঘটনা নয়। কিন্তু তা যদি ছাড়িয়ে যায় পৃথিবীর যেকোনো সিনেমাকে? সংখ্যাগত জায়গা থেকে দেখা যাক। ‘এভেঞ্জারস : এন্ড গেম’ এ ভিএফএক্স শট রয়েছে ২৪০০টি। আর ব্রহ্মাস্ত্র সিনেমাতে ভিএফএক্স শট রয়েছে ৪৫০০ টি। ব্রহ্মাস্ত্রের ভিএফএক্স এর কাজ করেছে ভারতীয় কোম্পানি প্রাইম ফোকাসের ২৫০ জনের একটি দল। এই কোম্পানি এর আগে কাজ করেছে ব্লেড রানার, ইন্টারস্টেলার, ইনসেপশনের মতো বাঘা বাঘা সিনেমাতে। তাঁদের ঝুলিতে আছে অস্কারজয়ী সিনেমাও। ভিজ্যুয়াল এফেক্টের দিক দিয়ে পৃথিবীর যেকোনো সিনেমাকে ছাড়িয়ে রেকর্ড করেছে ব্রহ্মাস্ত্র। আগেই বলেছি, সিনেমাকে সফল হতে হলে দর্শকদের এমন অভিজ্ঞতা দিতে হবে যা সে অন্য কোথাও পাবেনা। ব্রহ্মাস্ত্র এর ভিজ্যুয়াল এফেক্ট ভারত তো দূর, হলিউডের সিনেমাতেও পাওয়া যাবে না। এই জায়গা থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় কেন বয়কটের আহবান সত্ত্বেও ব্রহ্মাস্ত্রকে উপেক্ষা করেননি দর্শকরা।

 

 

 

ভিএফএক্স এর ইতিহাসে এখন সবচেয়ে এগিয়ে ব্রহ্মাস্ত্র

 

 

হিন্দু পুরাণের গল্প নিয়ে বানানো আরেকটি সিনেমা ‘আদিপুরুষ’। ৫০০ কোটি রুপি বাজেটের এই সিনেমা মুক্তি পাবে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে। অথচ এরই মধ্যে ভারতীয় টিভি চ্যানেলে ব্যাপক আলোচনা (পড়ুন সমালোচনা) হয়েছে এই সিনেমাটি নিয়ে। সিনেমাটিতে রাবণের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাঈফ আলী খান। মুসলিম এই অভিনেতাকে সিনেমাতে নাকি দেখা গেছে একজন মুসলমানের মতো। অর্থাৎ রাবণকে দেখে অনেকেরই তাঁকে মুসলিম মনে হয়েছে। এই “মুসলমান দেখানো” বিষয়টি কতোটা সাঈফ আলী খানের উপস্থিতির কারণে, কতোটা উপস্থাপনের কারণে তা নিশ্চিত করে বলা যায়না। সেই সাথে হিন্দু দেব দেবীদের ভুল উপস্থাপনের অভিযোগও আছে। অনেকে বলছেন সিনেমাটি আসলে “রামায়ণের ইসলামীকরণ”। এই বিতর্ক ছাড়াও আরো কিছু দুর্বলতা এরই মধ্যে নজরে এসেছে দর্শকদের। দুর্বল ভিএফএক্স এর কারণে মুক্তির আগেই সিনেমাটি নিয়ে বানানো হয়েছে অসংখ্য মিম, হয়েছে ট্রল। এমনকি সিনেমাটির পোস্টার বানানোর পেছনেও যে যথেষ্ট শ্রম দেয়া হয়নি, তাও প্রমাণ হয়ে গেছে। বিশাল বাজেটের এই সিনেমা মুক্তির পরেই কেবল বোঝা যাবে এই সবকিছু সিনেমাটিকে কোন দিকে নিয়ে যায়।

 

 

এনিমেশন থেকে কপি করে বানানো আদিপুরুষ সিনেমার পোস্টার

 

 

আরো একটি সিনেমার কথা উল্লেখ করতে হয়। তা হলো ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’। বিবেক অগ্নিহোত্রীর ১৫ কোটি বাজেটের সিনেমাটি অপ্রত্যাশিতভাবে আয় করেছে ৩৪০ কোটি রুপি। ভারত সর্বশেষ কোনো কম বাজেটের সিনেমা নিয়ে এতো পরিমাণ আয় করেছিলো কয়েক দশক আগে। ১৯৯০ এর দিকে কাশ্মীরি পন্ডিতদের ওপর হওয়া নির্যাতন নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমাটি। নিঃসন্দেহে এর একটি  রাজনৈতিক পটভূমি রয়েছে এবং কেবল বিনোদনের উদ্দেশ্যে এই সিনেমাটি তৈরি হয়নি। অসমাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবী ও গবেষকরা সিনেমাটিকে মিথ্যাচারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করলেও সিনেমাটি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে বিপুল ভাবে।  অনেক রাজ্যে সিনেমাটিকে করা হয়েছে করমুক্ত। এখানে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ভাবনা অর্ধসত্য ইতিহাসবোধ ও দুর্বল চিত্রনাট্যের একটি ছবিকে ব্যবসা সফল হতে সাহায্য করেছে।

 

 

কোনো একক কারণ দিয়ে হলিউডের ব্যর্থতাকে বোঝা যাবে না

একটা চলচ্চিত্রের সফল হতে অনেকগুলো শর্তের অন্তত কোন একটি পূরণ করতে হয়, একাধিক হলে তো কথাই নেই। আমরা দেখলাম বলিউড চলচ্চিত্র শিল্পের  দিক দিয়েই অনেকগুলো দুর্বলতায় ভুগছে। সংক্ষেপে সেগুলো হলো, নায়কদের পেছনে বিপুল ব্যয়, কম খরচের একক পর্দার প্রেক্ষাগৃহ কমে যাওয়া, একঘেয়ে গল্প, নতুন যুগের দর্শকের উপযোগী বিষয় আনতে না পারা, প্রতিযোগী বিনোদনের ক্ষেত্র তৈরি হওয়া, প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণের আরও এগিয়ে আসা ইত্যাদি। এই পতনের কালেই হিন্দুত্ববাদী প্রচারণার পক্ষে হালে পানি পাওয়া সম্ভব হয়েছে। এই বিরূপ পরিবেশের মাঝেও প্রযুক্তির চটকদারিত্বে কোন কোন ছবি দর্শক টানতে পারলেও এমন দৃষ্টন্ত অজস্র হবে না। ফলে সামনের দিনে বলিউড হয় অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে যাবে, কিংবা ব্যয়বহুল মহাতারকাদের বদলে সাশ্রয়ী ভালো অভিনয়শিল্পীদের দিয়ে মাঝারি বাজেটে নতুন যুগের দর্শক উপযোগী চলচ্চিত্র তৈরি হবার দিকে মোড় নেবে।

 

Your Comment