বহুদিন পর বাংলা ছবির পালে হাওয়া লেগেছে। আইলা সিডরের বেগে নেহাত রসকষহীন ঝানু লোকটিকেও উড়িয়ে তুলে সিনেমা হলে নিয়ে ফেলছে। বাড়ি, অফিস, চায়ের আড্ডা থেকে ইন্টেলেকচুয়াল আভাঁগার্দ বাগবিতণ্ডা, ইস্কুলের ক্লাসরুম থেকে অফিসের জ্যাম, গরুর রচনায় ঢুকিয়ে দেওয়া হাওয়া ছবির সারমর্ম থেকে পত্রিকার পাতা কিংবা ফেসবুকের ওয়াল থেকে বাথরুমের দেওয়াল, সদ্য প্রেমিক জুটির অন্তরঙ্গ আলোচনা থেকে এলিট-শ্রেণীর সমালোচনা, মধ্যবিত্তের ক্লান্তিকর একঘেয়ে জীবনের কোনদিক দিয়ে হাওয়া ঢুকে কোনদিকে বেরিয়ে যাচ্ছে তারা নিজেরাও টের পাচ্ছে না। অথবা 'নাজিফা তুষিকে সেক্স অবজেক্ট করে ফেলে নি তো?' থেকে 'ছবিতে ফরাসী পরাবাস্তববাদ আন্দোলনের প্রভাব কতোখানি?', এই নিয়ে বাঙালি 'পন্ডিত সমাজে এক বিস্তর অশান্তির কারণ ঘটিয়াছে'। যেহেতু হাওয়া নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে এবং হচ্ছে তাই অশান্তির মিমাংসা শীঘ্রই হবার অবকাশ নেই। অতএব এই নিবন্ধে 'ছবির গল্পটা বেহুলা-লক্ষীন্দরের মডার্ন ভার্সন কিনা অথবা সেই গল্পের আড়ালে নৌকার কর্মচারীদের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্যের অত্যন্ত প্রকট রাজনৈতিক চিত্র ফুটিয়ে তুলে পরিচালক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক দিতে চাইছেন কিনা' জাতীয় হাওয়ার সর্বজনবিদিত দিকগুলো পাশ কাটিয়ে চলচ্চিত্রশিল্পের মৌলিক কিছু জায়গার নিরিখে হাওয়া ছবিতে দৃষ্টি রেখে বোঝার চেষ্টা করব আদৌ এই হাওয়ায় টান আছে তো? নাকি এটা 'Old wine in new bottles' থেকে বেশি কিছু নয়?
“এ হাওয়া আমায় নেবে কত দূরে!”
মাঝ সমুদ্রে জেলেদের জালে উঠে আসে একটি জীবন্ত মেয়ে। রহস্যময় এই মেয়েটির পরিচয়, ঠিকানা কিছুই জেলেরা কুল কিনারা করতে পারে না। তবে উপায়হীন হয়ে মেয়েটিকে তারা মাছ ধরার সপ্তাহটায় তাদের সাথে রাখবে ঠিক করে। মেয়েটিও আস্তে আস্তে জেলেদের সাথে স্বাভাবিক হতে শুরু করে (কোনো কথা কয় না যদিও)। কিন্তু সে যে সাধারণ কোনো মেয়ে নয়, সে যে তার সাথে করে নিয়ে এসেছে অভিশাপ! ভরা মৌসুমে জেলেরা কোনো মাছ পায় না, ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়, জাল ভেসে যায়, নোঙর হারিয়ে তারা গভীর সমুদ্রে অজানার অপেক্ষায় ভাসতে থাকে। যতই ছবি এগোয় ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় এই রহস্যময়ীর পরিচয় এবং সর্বনাশ ডেকে আনে নৌকোর জেলেদের জীবনে। সংক্ষেপে এই হল ছবির গল্প।
মূল আলোচনায় যাবার আগে দুটো বাড়তি কথা বলে রাখা চাই। আমি এখনো সত্যিকার চলচ্চিত্র, বা সেই নামে আদৌ যদি কিছু থেকে থাকে, তাতে বিশ্বাস হারাই নি। অর্থাৎ শব্দের কাঠামোর ওপর দৃশ্যের চাদরে যে শিল্পমাধ্যমের অবয়ব গড়ে ওঠে, বাস্তব-ন্যাচারাল-রিয়াল-সুররিয়াল কোনোরকম অভিনয়ের যেখানে কোনো স্থান নেই এবং অপর শিল্পমাধ্যমগুলির ওপর যে বিন্দুমাত্র নির্ভরশীল নয়। "অভিনয় নেই মানে? কি বলছেন? গত একশ-বিশ বছরের ইতিহাসে কোন ছবিটা হয়েছে যাতে অভিনয় নেই?" জানি। কিন্তু সে তো বিস্তর তর্ক-আলোচনা-বাহাস ও অনুসন্ধানের বস্তু। নাহয় অন্য একদিনের জন্য তোলা রইল।
তবে একটা সহজ কিন্তু অত্যন্ত বাস্তব উদাহরণ দিয়ে মূল সমস্যাটার একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করি। ধরুন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শেষজীবনে করা ছবিগুলোর একটা আপনি দেখেননি। এখন সেই ছবিটা থেকে একপাতা সংলাপ এনে যদি আপনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলি, মনে মনে একবার কল্পনা করুন তো সৌমিত্রবাবু এই সংলাপগুলো কিভাবে বলবেন? আপনি পারবেন কি? আমার বিশ্বাস শতকরা নব্বই জন লোকই পারবেন। এবার ব্যাপারটা সামান্য বদলে যদি এমন সংলাপ আনি যা কোনো ছবি থেকে নেয়া হয়নি বরং বার্ধক্যের কোনো এক উদাস দিনের চায়ের আড্ডায় ঘনিষ্ঠ কোনো বন্ধুর সাথে তাঁর ব্যক্তিগত কথোপকথনের সংলাপ? এবার মনে মনে জিনিসটা সেকেন্ডে ২৪ ফ্রেম স্পিডে চালিয়ে দেখুন তো। পারছেন কি? কোন কথাটা বলার আগে তিনি দু’সেকেণ্ড ভাবছেন, কোনটাতে পাঁচ মিনিট, কোনটাতে ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠছে আর কোনটাতেই বা চোখের কোণে ঝিলিক মেরে উঠছে? আপনার না ধরতে পারার কারণ এই নয় যে আপনি তাঁকে সরাসরি দেখেননি, যদিও বহু রিয়েলিটি শোতে তাঁকে দেখেছেন ফলে তাঁর কথা বলার ধরণ সম্পর্কে অবগত। আসলে মানুষ কি এতটাই সরল জীব যে তাকে দু'চারটে সংলাপ আর কয়েকটা মুখস্থ অঙ্গভঙ্গিতে বেঁধে ফেলা যাবে? নাকি সে এতটাই জটিল যে প্রতিমুহূর্তে হাজার হাজার চিন্তা, ছবি, স্মৃতি, আতঙ্ক, ভয়, বিশ্বাস, চেতনা ও স্বাদ-গন্ধ-স্পর্শের সাগরে সে হাবুডুবু খাচ্ছে এবং একটা কথা বলার সময় তার অবচেতনে কি পাঁচ বছর বয়সের কোনো স্মৃতি নাকি গতকাল টেলিভিশনে চলা রিয়েলিটি শোয়ের প্রভাব কাজ করেছে তার হদিস দিতে পারা অসম্ভবেরও অতীত।
আসলে মানুষ কি এতটাই সরল জীব যে তাকে দু'চারটে সংলাপ আর কয়েকটা মুখস্থ অঙ্গভঙ্গিতে বেঁধে ফেলা যাবে? নাকি সে এতটাই জটিল যে প্রতিমুহূর্তে হাজার হাজার চিন্তা, ছবি, স্মৃতি, আতঙ্ক, ভয়, বিশ্বাস, চেতনা ও স্বাদ-গন্ধ-স্পর্শের সাগরে সে হাবুডুবু খাচ্ছে এবং একটা কথা বলার সময় তার অবচেতনে কি পাঁচ বছর বয়সের কোনো স্মৃতি নাকি গতকাল টেলিভিশনে চলা রিয়েলিটি শোয়ের প্রভাব কাজ করেছে তার হদিস দিতে পারা অসম্ভবেরও অতীত
মানুষের দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপের ১০ ভাগের ৯ ভাগই নিয়ন্ত্রণ করে তার অবচেতন। এবং স্বাভাবিকভাবেই এই অবচেতন মনের ওপর সচেতন মনের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। বার্নার্ড শ মজার ছলে বলেছেন, Your breathing goes wrong the moment your conscious self meddles with the unconscious। মানুষ মুলত নিয়ন্ত্রিত হয় এই অবচেতনের ক্রিয়া দ্বারাই। সচেতন মন বা তার সচেতন সত্তা logical thinking পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। বাকি মানুষের দৈনন্দিন ওঠা-বসা-হাঁটা-চলা থেকে কামনা বাসনা ভাবনা যাতনা রটনা ঘটনা সবকিছুই অবচেতনের দখলে। এবং যেকোনো রকম অভিনয় হচ্ছে যেহেতু সচেতন মনের অত্যন্ত সচেতন প্রচেষ্টা তাই ফিল্মে অভিনয় ব্যবহারের মানে হলো হলো পুঁটিমাছের বড়শি (conscious) দিয়ে বোয়াল মাছ (subconscious) গাঁথার প্রচেষ্টা! অভিনয় একটা স্বাধীন আর্ট এবং তার জায়গা থিয়েটারে। সকল আর্টের মত থিয়েটারেরও কাজ যেহেতু জগৎ ও জীবনের সারবস্তুটা নিয়ে সেটা নিজের ভাষায় প্রতিফলিত করা, তাই থিয়েটারে বাস্তব জীবনটা যে কারণে তিন দেয়ালের কক্ষে ধরা দিতে দেখি, লম্বা লম্বা ডায়লগ কিংবা মনোমুগ্ধকর অভিনয়ও দেখি একই কারণে। তাই থিয়েটারের মনস্তত্ত্বের সাথে চলচ্চিত্রের মনস্তত্ত্ব গুলিয়ে ফেললে চলবে কি করে!
‘হাওয়া’ কি একটা ফটোগ্রাফড থিয়েটার? এককথায় উত্তর- হ্যাঁ
এবার হাওয়া ছবি নিয়ে একটা সোজাসাপটা কথা বলি। 'হাওয়া' কি একটা ফটোগ্রাফড থিয়েটার? এককথায় উত্তর- হ্যা। কারণ রাতে বাড়ি ফিরে যখন ছবিটার কথা ভাবছিলাম তখন মাথার মধ্য দিয়ে চঞ্চল চৌধুরীদের মারামারি, হল্লা, চিৎকার, আর্তনাদের একটা সম্মিলিত তালপাকানো গোলমালের ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল। বিরাট কোনো ঝগড়া থেকে বেরিয়ে এলে যেমনটা লাগে। কিন্তু ফিল্মে তো সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা হবার কথা। বলা হয় মোৎসার্টের পর যে সাইলেন্সটা আসে সেটাও মোৎসার্ট। হাওয়া ছবির সেই নিরব কম্পনটা অবচেতনকে কোনো বিশেষ সুরে ধ্বনিত করছে কি? কই, টের তো পেলাম না।
ছবির সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য নিশ্চিতভাবেই এর একাধিক চরিত্রের উপস্থিতি। ছবির নামও তাই নির্দেশ করে, একাধিক চরিত্রের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা সম্পর্কের ঠান্ডা হাওয়া। কোনো তত্ত্ব-তালাশে যাবো না কিন্তু বাড়ি ফিরে যখন চরিত্রগুলো মনে করছিলাম তখন প্রত্যেকটি চরিত্র একে একে বিনা কোশিশে মনের পর্দায় পরিষ্কার ফুটে উঠছিল। এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে যে ছবির screen time চরিত্রগুলোর মধ্যে সুষমভাবে বন্টিত হয়েছে। মাঝ সমু্দ্রে ট্রলারের মত সীমাবদ্ধ একটা ক্ষেত্রে দশটা চরিত্রের ভারসাম্য রক্ষা করতে বহু অভিজ্ঞ পরিচালকও হাবুডুবু খাবেন, সেজায়গায় প্রথম ছবিতেই মেজবাউর রহমান সুমন যে পরিপক্বতার পরিচয় দিলেন তা নির্দ্বিধায় প্রশংসনীয়।
"কিছুক্ষণ পরপর দর্শককে বিনোদন দেওয়ার জন্য দিতে পরিচালক রেখেছেন নাসির উদ্দিন খানের নাগু চরিত্রটিকে। "
ছবির প্রধান চরিত্র তিনজন- চানমাঝি চঞ্চল চৌধুরী, সমুদ্র থেকে উঠে আসা মেয়ে গুলতী ওরফে নাজিফা তুষি এবং শরীফুল রাজ ওরফে ইব্রাহিম (ইবা)। এবং কিছুক্ষণ পরপর দর্শককে বিনোদন দেওয়ার জন্য পরিচালক রেখেছেন নাসির উদ্দিন খানের নাগু চরিত্রটিকে। একটা অপ্রিয় সত্য এখানেই বলে রাখা ভালো। চানমাঝি চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরীর প্রচেষ্টা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ এবং ছবির শিল্পগত ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ। মুশকিলটা হলো চঞ্চল চৌধুরীর সত্তা থেকে চানমাঝি চরিত্রের দূরত্ব একশ মাইল এবং তিনি চেঁচিয়ে লাফিয়ে হাঁপিয়ে কিংবা পান চিবোতে চিবোতে মুখ বাঁকিয়ে হাত নাড়িয়ে যতই চানমাঝি হতে চাইছেন ততই তাঁর না হতে পারাটাই আরো প্রকট হয়ে ধরা দিচ্ছে।
একটা অপ্রিয় সত্য এখানেই বলে রাখা ভালো। চানমাঝি চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরীর প্রচেষ্টা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ এবং ছবির শিল্পগত ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ। মুশকিলটা হলো চঞ্চল চৌধুরীর সত্তা থেকে চানমাঝি চরিত্রের দূরত্ব একশ মাইল এবং তিনি চেঁচিয়ে লাফিয়ে হাঁপিয়ে কিংবা পান চিবোতে চিবোতে মুখ বাঁকিয়ে হাত নাড়িয়ে যতই চানমাঝি হতে চাইছেন ততই তাঁর না হতে পারাটাই আরো প্রকট হয়ে ধরা দিচ্ছে
চঞ্চল চৌধুরী ব্যবহৃত এই গৎবাঁধা অভিনয়ের টেকনিক থিয়েটারের জন্য ঠিক আছে বটে কিন্তু হাওয়া ছবিকে মাঝ দরিয়ায় ডোবাতে তার ভুমিকা কিছু কম ছিল না। প্রশ্ন উঠতে পারে দোষটা কি চঞ্চলবাবুর মত অভিনেতাদের? মোটেই না। ডি ডব্লিউ গ্রিফিথের যুগে যেদিন মঞ্চের শিল্পীদের আনিয়ে চলচ্চিত্রে অভিনয় প্রবেশ করিয়ে মস্ত ভুলটা ঘটানো হলো, সেদিনকার সেই ভুলের মাশুল আজও এঁরা দিয়ে চলেছেন। তাই হাওয়া ছবিতে চঞ্চল চৌধুরীর যে ব্যর্থতা, গডফাদার ছবিতে মার্লোন ব্র্যান্ডোরও ঠিক একই ব্যর্থতা। আবার ঠিক উল্টোটাও বলা যায়। গডফাদার ছবিতে মার্লোন ব্র্যান্ডোকে যদি সফল ধরেন তাহলে হাওয়া ছবিতে চঞ্চলবাবুকেও সফল ধরতে হবে। তবে চলচ্চিত্রকে অভিনয়ের কূপে আটকে রেখে নিজেকে কূপমণ্ডূক প্রমাণ করবেন কিনা সেটা পাঠক নিজেই বিচার করুন।
ধরুন ছবির ক্লাইম্যাক্স মুহূর্তে যে violent দৃশ্যটা আছে, যে দৃশ্যে একইসাথে চার-পাঁচটা খুন হয়ে ছবির মোড় সম্পূর্ণ ঘুরে যায়, (সুনিপুণভাবে অভিনীত) সেই দৃশ্যটি একবার মঞ্চে কল্পনা করুন তো- অন্ধকার হলে পিনপতন নীরবতায় রুদ্ধশ্বাস অভিনয়, অভিনেতাদের চিৎকার, আর্তনাদ, সংলাপ বলার অসামান্য ভঙ্গি, সাবলীল অভিনয়ে দ্রুত অথচ নিখুঁত কম্পোজিশনের সৃষ্টি, চরিত্রদের মধ্যবর্তী টেনশন এসব মঞ্চের আলোআঁধারি ঘরে লোম খাঁড়া করে দেয়ার মত নয়কি? কিন্তু ফিল্মে এজিনিস চলবে কি? ফিল্মের নিজস্ব ভাষা ব্যবহার না করলে ধাক্কাটা দর্শকের অন্তরের অন্তঃস্তলে পৌঁছাবে কি করে? হাওয়া ছবির দৃশ্যে যে ভায়োলেন্সটা এসেছে অভিনয়ের (পড়ুন অভিনয়ের ফটোগ্রাফড ভার্সন) মাধ্যমে তার জন্ম আদপে হওয়ার কথা এডিটিঙের মাধ্যমে, ইমেজ বিশেষত সাউন্ডকে সৃজনশীলভাবে কাজে লাগিয়ে। পাঠকের কাছে নিশ্চয়ই এসব নিছক রসকষহীন থিওরির মত লাগছে? লাগবে নাই বা কেন? একশ কুড়ি বছর ধরে আমাদের ভুলপথে শিক্ষিত করা হয়েছে যে!
"কোনো কোনো সময় গুলতি (নাজিফা তুষি) বিরাট রহস্যময়ী (যার আবির্ভাবে অলৌকিক সব কাণ্ড ঘটছে) আবার অপরদিকে কোনো কোনো সময় তার ব্যবহারে ফুটে ওঠে সাধারণ গ্রাম্য জেলেনীর সরলতা।"
ছবির একমাত্র নারীচরিত্র গুলতি ওরফে নাজিফা তুষি শুরু থেকেই অদ্ভুত contradiction এ ভরা! কোনো কোনো সময় (মাঝরাতে) সে বিরাট রহস্যময়ী (যার আবির্ভাবে অলৌকিক সব কান্ড ঘটছে) আবার অপরদিকে কোনো কোনো সময় তার ব্যবহারে ফুটে ওঠে সাধারণ গ্রাম্য জেলেনির সরলতা। একদিকে যেমন তার ভয় লজ্জা দুর্বলতা কিংবা প্রেম যেকোনো স্বাভাবিক মানবীর মতোই, অপরদিকে তার উদ্দেশ্য হলো এই নৌকা ডোবানো এবং জেলেদের হত্যা করা (কোনো অজ্ঞাত প্রতিশোধ নিতে!)। এবং ছবির শেষাংশে (যেখানে সে আক্ষরিক অর্থেই অনুপস্থিত এবং আমরা শুধু ঘটে চলা ঘটনা ও এতে চরিত্রদের প্রতিক্রিয়া দিয়ে তার অতিপ্রাকৃত উপস্থিতি টের পাই) তার এই কথাগুলো সব অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়! আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। কারণ ছবিতে চরিত্র উন্মোচনের একটা ব্যাপার আছে। আমরা শুরু থেকে ধীরে ধীরে একটা চরিত্রের সাথে পরিচিত হই; ছবির শেষে গিয়ে হয়ত দেখা গেল সে অনেকটাই বদলে গেছে; তখন সেই যাত্রার মধ্য দিয়ে আমরা চরিত্রটিকে তথা গোটা ছবিটিকে অনুভব করতে পারি। কিন্তু যদি দেখা যায় সে সারাদিন সহজ সরল বালিকা হয়ে ঘোরে আর মাঝরাত হলেই তার মধ্যে কেবল নাগিনকন্যা ভর করে তাহলে? আর ছবিজুড়ে কখন যে কোনটা হয়ে যায় তারও কোনো যুক্তি নেই। এরকম অদলবদল মেলে শুধু সুপারম্যানের ছবিতে। আমরা জানি contradiction চরিত্রকে বৈচিত্র্যময় করে তোলে কিন্তু যুক্তিহীন contradiction কে চরিত্রের গলদ ধরা ছাড়া উপায় কি!
ছবিতে বোধহয় শরীফুল রাজের চরিত্রটার উপস্থিতিই সবচেয়ে ভালোভাবে অনুভুত হয়েছে, বিশেষত ইঞ্জিনরুমের দৃশ্যগুলোয়, যেখানে সে সবচেয়ে বেশি নীরব ছিল। পাশাপাশি কোনো রকম সেন্টিমেন্টালিটির আশ্রয় না নিয়ে ছবির প্রথম থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত রাজ ও তুষির চরিত্রদুটির সম্পর্ককে পাকাপোক্ত করতে যে দুটো অসামান্য জিনিস করা হয়েছে তা ভোলবার মত নয়! প্রথমত কোনো অভিনয়, সংলাপ বা নাটকীয় দৃশ্য ছাড়া শুধুমাত্র দৃষ্টির বিনিময়ে (শট বাই শট) ধীরে ধীরে তাদের মনের পরিচয় ঘটানো এবং দ্বিতীয়ত তাদের সাক্ষাৎ ও অন্তরঙ্গতার মুহূর্তগুলো সব দর্শকের কল্পনার ওপর ভর করে off screen এ ছেড়ে দেওয়া। দুটো চরিত্রের মিলন ঘটানোর এর চেয়ে cinematic কোনো পদ্ধতি ভাবতে পারি কি?
প্রথমত কোনো অভিনয়, সংলাপ বা নাটকীয় দৃশ্য ছাড়া শুধুমাত্র দৃষ্টির বিনিময়ে (শট বাই শট) ধীরে ধীরে তাদের মনের পরিচয় ঘটানো এবং দ্বিতীয়ত তাদের সাক্ষাৎ ও অন্তরঙ্গতার মুহূর্তগুলো সব দর্শকের কল্পনার ওপর ভর করে off screen এ ছেড়ে দেওয়া। দুটো চরিত্রের মিলন ঘটানোর এর চেয়ে cinematic কোনো পদ্ধতি ভাবতে পারি কি?
বিশ্বের সকল চিত্রপরিচালক অন্তত একবারের জন্য হলেও দর্শকের সাথে বসে নিজের ছবি দেখেন এবং দর্শকের প্রতিক্রিয়া থেকে শিক্ষা নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু হাওয়া ছবির দর্শকের প্রতিক্রিয়া থেকে যে শিক্ষাটা পেলাম সে তো ভোলবার মত নয়! আমার বিশ্বাস পরিচালক সুমনের বাংলা ছবির দর্শকের ধৈর্যের ওপর আস্থা নেই। থাকা উচিতও নয় হয়ত। আজকের যুগের টিভি নিউজ ইন্টারনেট ও সোশাল মিডিয়ার দৌরাত্মে যখন ১০ মিনিট মনোযোগ ধরে রাখাই দায়, তখন দু'ঘন্টার ছবিতে হেলাফেলা করলে সে মনোযোগ যে উড়ে চলে যাবে তাতে আর সন্দেহ কি! সেজন্য সহজ পন্থা হিসেবে সুমন গল্পে নাসির উদ্দিন খানের নাগু চরিত্রটি এনেছেন। ছবির শুরু থেকেই যে মশলাদার সংলাপ, বিচিত্র চাহনি, চটুল অঙ্গভঙ্গি কিংবা অতিনাটকীয় ভাঁড়ামোর মাধ্যমে দর্শককে ক্ষণে ক্ষণে সুড়সুড়ি দিতে থাকে। আমাদের সাধারণ দর্শকেরও সেই ভাঁড়ামোতে সাড়া দিতে বেগ পেতে হয় না। ক্ষণে ক্ষণে ঘরভাঙা হাসির রোল কিংবা সম্মিলিত হাততালির জোয়ারে (থিয়েটারের ছোঁয়াচ লাগা রোগ) হল ভেসে যায়। নির্মাতাও খুশি, দর্শকও খুশি কিন্তু আপত্তিটা বাঁধে ছবির শেষটায় গিয়ে! যখন শুধু দুটো চরিত্র টিকে আছে (নাগু আর চানমাঝি) এবং ছবির শুরু থেকে ধাপে ধাপে তৈরি করা সব উপাদান দিয়ে নাট্যরস সর্বোচ্চ ঘনীভূত হয়েছে, তখনই পরিচালক তাঁর কর্মের ফলস্বরূপ ধাক্কাটা খান। দুটো চরিত্রের জীবন-মরণ মুহূর্তে যখন টেনশন সর্বোচ্চ তখন নাগুর যেসব ক্রিয়া ভয় ও নাট্যরস তৈরি করার কথা, সেগুলো সব হাসির উদ্রেক করে। পুরো হলের সবগুলো মানুষের পেট থেকে ভসভসিয়ে খিলখিল পেটফাটা হাসি বেরিয়ে আসে! ভেস্তে যায় পরিচালকের বহু কষ্টে তৈরি করা ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যটি!
দুটো চরিত্রের জীবন-মরণ মুহূর্তে যখন টেনশন সর্বোচ্চ তখন নাগুর যেসব ক্রিয়া ভয় ও নাট্যরস তৈরি করার কথা, সেগুলো সব হাসির উদ্রেক করে। পুরো হলের সবগুলো মানুষের পেট থেকে ভসভসিয়ে খিলখিল পেটফাটা হাসি বেরিয়ে আসে! ভেস্তে যায় পরিচালকের বহু কষ্টে তৈরি করা ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যটি!
কিংবা হয়ত পরিচালক ইচ্ছে করেই কমেডিটা এনেছেন? সেদিক দিয়ে বিচার করলেও তো তা ব্যর্থই ঠেকে, কারণ ছবির চরম মুহূর্তে এই রহস্যের বাতাবরণে এধরনের কমেডি যাবে কি করে? হিচককের তুমুল সাসপেন্সফুল ছবিগুলোতেও আমরা দেখেছি underlying humor, কিন্তু সে তো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস!
“হাওয়া ছবির সবচেয়ে বড় দোষ? প্রধান চারটি চরিত্রের একটির অনুপস্থিতি। সমুদ্র।”
হাওয়া ছবির সবচেয়ে বড় গুণ? একাধিক চরিত্রের সুষ্ঠু বিন্যাস। আর সবচেয়ে বড় দোষ? প্রধান চারটি চরিত্রের একটির অনুপস্থিতি। সমুদ্র। কারণ ছবির তুষির যে রহস্যময়তা কিংবা জেলেদের যে ভয় সে বস্তু তো চিরন্তন। এবং সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া প্রতিটি জেলেই মনের কোণায় সে ভয় ও উৎকন্ঠাটা সাথে করেই ভাগ্য সন্ধানে বের হয়, এ তো তাদের জীবনের অঙ্গ, ফলস্বরূপ সেই অঞ্চলের লোকগল্পেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই চিরকালীন ভয়ের উৎস কি সমুদ্র নয়? সেই সমুদ্র যার কোণায় কোণায় রহস্য ও অনিশ্চয়তার হাতছানি, যে অকল্পনীয় গভীর ও সমগ্র চরাচর জুড়ে বিস্তীর্ণ, যেখানে একবার হারিয়ে গেলে আর বেঁচে ফেরার উপায় নেই। সেই সমুদ্রে দিক হারিয়ে জেলেরা যে কতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তা দর্শককে বারবার মনে করিয়ে না দিলে চলবে কি করে? চানমাঝির ওই ট্রলার মাঝ সমুদ্রে না থেকে যদি কোনো শহরতলী বা গ্রামের বড়বাজারের মোড়ে থাকত (আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলের সমাবেশে মাঝেমধ্যে যেমনটা চোখে পড়ে) তাহলে ছবির যাবতীয় ভয়, রহস্য, সাসপেন্সের ছিটেফোঁটাও আর অবশিষ্ট থাকত না। সর্দার চান মাঝি থেকে শুরু করে সকলেই সাসপেন্সের বিপরীতে গিয়ে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরে যেতেন।
একঘেয়েমি সাথে ভয়ের একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে। পাল ভেঙ্গে, নোঙর হারিয়ে দিকহীনভাবে ভাসতে থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা কুলহারা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মানুষের উৎকন্ঠা একঘেয়েমিকে ছাপিয়ে ও হারিয়ে যাওয়ার ভয় কি দশগুণ বেড়ে যায় না? কিন্তু ছবিতে এই ব্যাপারটা দেখানো হলো কই? দর্শককে যদি এই হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি (ভয়) দিতে হয় তবে অবশ্যই তাকে একঘেয়েমিরও অনুভুতি দিতে হবে। কিন্তু আমাদের ছবিতে এসব গুরুত্বপূর্ণ মানবিক অনুভূতিগুলো সব বাদ দিয়ে শুধু প্লটের পেছনে ছোটা হয়েছে। চিত্রনাট্যকার ভুলে গেলেন কি যে প্লট হচ্ছে ঔপন্যাসিকের জিনিস, ফিল্মে এর কি প্রয়োজন?
দর্শক পরিচালকের সব কথা বিশ্বাস করবেন তখনি যখন পরিচালক দর্শককে ভুলিয়ে দেবেন যে তিনি ছবির চরিত্রদের বাইরের একজন। এই দর্শকমনকে পরিচালিত করার কিছু সাধারণ নীতি আছে চলচ্চিত্রে, যার একটি হল পয়েন্ট অব ভিউ রক্ষা করা। ১৯৪৪ সালে হিচকক Lifeboat বলে একটি ছবি তোলেন। হাওয়া'র সাথে সাদৃশ্য আছে। ছোট্ট একটা নৌকোয় মাঝ সমুদ্রে আট-দশজন লোক আটকা পড়ে। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হল পুরো ছবিজুড়ে একবারের জন্যও ক্যামেরা নৌকোর বাইরে যায় না। কেন? কারণ ছোট্ট নৌকোয় চরিত্রদের মধ্যে ক্রস কাটিঙের মধ্য দিয়ে যে বদ্ধ আটকে পড়ার অনুভূতি দর্শকের মনে তৈরি হয়েছে তা ভেঙে যাবে এবং গল্প থেকে দর্শকের একধরনের দূরত্ব তৈরি হয়ে যাবে বলে। কিন্তু হাওয়া ছবিতে পরিচালক যেন কতক ইচ্ছে করেই পয়েন্ট অব ভিউ বারে বারে ভেঙে দেন। তিনি দর্শককে মাঝ সমুদ্রে নৌকায় আটকে ফেলতে চান না, পাছে তারা বিরক্ত হয়ে যায়। তাই তো কিছুক্ষণ পরপর নাগু চরিত্রের কমেডি বা কুড়ি-ত্রিশহাত দূরের শট কিংবা আকাশ থেকে তোলা বার্ডস আই ভিউ শটে নৌকো ও জেলেদের দেখান, রিলিজ হিসেবে। নির্মাতা হয়ত দাবী করতে পারেন তিনি এসব শট ব্যবহার করেছেন জেলেদের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বোঝাতে। কিন্তু এখানে চলচ্চিত্রশিল্পের একেবারে গোড়ার একটা প্রশ্ন এসে পড়ে। কে বেশি দরকারি? ছবির চরিত্র না দর্শক? দর্শককে রিলিজ করে দিয়ে চরিত্রদের বিচ্ছিন্নতা বোঝানোর কোনো মানে আছে কি?
তাছাড়া শুরু থেকেই ছবিটা বর্ণনা করা হয়েছে কোনো নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ ছাড়া। তাই আমরা ন্যারেটিভের সাথে ঠিক একাত্ম হতে পারি না। আমার মতে গল্পটা বলার সবচেয়ে সুবিধাজনক পথ ছিল গৌণ চরিত্রদের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে। কারণ তাদের সাথেই দর্শক একাত্ম হতে পারে বেশি যেহেতু প্রধান চরিত্রদের মত তাদের কোনো নির্দিষ্ট কাঠামোর ছাঁচে ফেলে দেওয়া হয়নি। এবং ছবিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোতে দর্শকের মত তাদেরও কোনো স্বার্থ নেই, ফলস্বরূপ ভয় ও উৎকন্ঠা তাদেরই সবচেয়ে বেশি থাকে। পাশাপাশি ভুললে চলবে না প্রথমদিকে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে তুষিকে দেখালে তার রহস্যময়তাটা পুরো ছবিজুড়ে টিকে থাকত, সময়ে সময়ে সরল গ্রাম্য সখীর মত লাগত না।
আধুনিক চলচ্চিত্রে সকল প্রকার সংগীত বর্জনই রীতি। হাওয়া ছবিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আবহসংগীত বর্জন করা হয়েছে, সামান্য যা কিছু ধ্বনী ব্যবহৃত হয়েছে তাও রুচির পরিচায়ক। তবে ছবির রহস্যপূর্ণ টানটান মুহূর্তগুলোতে ইলেকট্রনিক সাউন্ড ইফেক্টের কি দরকার ছিল বুঝলাম না! এটা কি বদভ্যাস নাকি দর্শককে সমঝে চলার একটা প্রক্রিয়া? স্বাভাবিক শব্দের বিস্ময়কর জগৎ ফেলে দিয়ে সস্তা ইলেকট্রনিক ইফেক্ট ব্যবহার স্বাধীন শিল্পীর জন্য ব্যর্থতা বলে মনে হয়।
হাওয়া ছবির সবচেয়ে সিনেমাটিক মুহূর্ত কোনটা বলুন তো? একদম শেষের দিকের দৃশ্যে যখন নাগু ঘুম থেকে উঠে দেখে চানমাঝি নিজের অত্যন্ত শখের পাখিটিকে রোস্ট করে খাচ্ছে। কারণ এর আগের দৃশ্যেই নাগু টের পায় নৌকায় এখন সে আর চানমাঝি এই দুজন অবশিষ্ট আছে। বাকিরা কোন না কোনভাবে চানমাঝির হাতে খুন হয়েছে। এবার সঙ্গত কারণেই নাগু ভয় পেয়ে যায়! কিন্তু সুচতুর চানমাঝির কথার চালে সে কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে থাকে। এরপর মাঝরাতে চোখ খুলে নাগু দেখে এই দৃশ্য। পরের শটে চানমাঝি তার দিকে তাকিয়ে উত্তরসুলভ বলে, খুব মাংস খাইতে ইচ্ছা করতেসিল। নাগুর বুঝতে আর বাকি থাকে না চানমাঝির হাতে তার আক্ষরিক অর্থেই পাখির রোস্টের দশা হবে! এই তিনটে শট রিভার্স শটে কিছু না বলেও কৌতুকের মিশেলে যে অব্যক্ত কথাটি বলে ফেলা হলো- এটাই হচ্ছে মন্তাজ বা এডিটিং। চলচ্চিত্রকারের কথা বলার হাতিয়ার।
সবাইকে বলতে শুনছি এ ছবির এডিটিং ভালো। হ্যা, গোছানো তো নিশ্চয়ই। কিন্তু শুধু তাই দিয়ে সন্তুষ্ট থাকা চলে কি? চলচ্চিত্রকারের দুটো টুল -ইমেজ ও সাউন্ড। এডিটিঙে এরা হাতে হাত ধরে চলবে, ছুটবে, থামবে, কাছে আসবে আবার দূরে ছুটে যাবে। শুধু পরপর কয়েকটা ইমেজ সারিবদ্ধভাবে সাজানোই এডিটিঙের সারকথা নয়। (যদিও এজিনিসটা ঠিকভাবে করতে বহু লোকের ঘাম ছুটে যায়। বেশিরভাগ পরিচালককেই দেখি হলিউড ভঙ্গিতে একই জিনিস অনর্থক হুটহাট কাটিং করে পাঁচদিক থেকে দেখান, যা অত্যন্ত বিরক্তিকর ঠেকে। কিন্তু এই সংযমটা সুমনের আছে।) সংগীতের মত করে এখানে ইমেজ ও সাউন্ডের ছন্দকে ইচ্ছেমত গড়ে পিটে নিতে হবে, তাদের মধ্যে counterpoint সৃষ্টি করতে হবে, তাদের দূরত্ব ও সংঘর্ষকে কাজে লাগাতে হবে। ছন্দের চমৎকার ব্যবহার কিন্তু ছবির শুরুতেই আছে। ছবি শুরু হয় একটা দ্রুত মন্তাজ দিয়ে, যেখানে বাজারের কোলাহল, মাঝিদের প্রস্তুতি, ট্রলারে করে পাড়ি দেওয়া এসব দেখানো হয়। এবং ফলস্বরূপ এর পরের দৃশ্যে যখন সমুদ্রে ট্রলারের দৈনন্দিন কাজকর্ম দেখানো হয়, তখন প্রথম দৃশ্যের ধাক্কায় সমুদ্রের নীরবতা আরো চারগুণ হয়ে ধরা দেয়। কিন্তু আপসোস, ছবিজুড়ে এরকম মুন্সীয়ানার আর কোনো পরিচয় নেই!
বাংলা ছবির একটা নতুন ঢেউ দেখা যাচ্ছে, যার বীজটা বোনা হয়েছিল হয়ত গত পাঁচ/ছয় বছরে। আজ থেকে দশ বছর পর নিশ্চিত বাংলা ছবির একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখতে পাব। কিন্তু তার বীজটা বোনা চাই আজ থেকেই। তাকে যেমন একইসাথে থিয়েটারে দর্শক টানতে হবে, ঠিক তেমনি শিল্পগত দিকটাও ভুলে গেলে চলবে না। প্রকৃত আর্ট এবং কমার্স পরস্পর হাত ধরাধরি করে বাঁচে, কাজেই এদের মধ্যে বিরোধ খুঁজতে যাওয়াটা বোকামির কাজ। আগামীকালের বাংলা ছবি বাঁচবে মেজবাউর রহমান সুমনের মত লোকেদের কাঁধে ভর দিয়ে।
চলচ্চিত্র একটা সত্যিকার আর্টফর্ম হতে পারে, কিন্তু এখন পর্যন্ত যা যা করা হয়েছে তাতে একে নেহাত একটা ক্রাফটের বেশি কিছু বলা যায় না। সত্যিকার ছবি হবে কুব্রিকের মতে, more like music than fiction. A progression of moods and feelings. কোভিড পরবর্তী সময়ে বাংলা ছবির একটা নতুন ঢেউ দেখা যাচ্ছে, যার বীজটা বোনা হয়েছিল হয়ত গত পাঁচ/ছয় বছরে। আজ থেকে দশ বছর পর নিশ্চিত বাংলা ছবির একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখতে পাব। কিন্তু তার বীজটা বোনা চাই আজ থেকেই। তাকে যেমন একইসাথে থিয়েটারে দর্শক টানতে হবে, ঠিক তেমনি শিল্পগত দিকটাও ভুলে গেলে চলবে না। প্রকৃত আর্ট এবং কমার্স পরস্পর হাত ধরাধরি করে বাঁচে, কাজেই এদের মধ্যে বিরোধ খুঁজতে যাওয়াটা বোকামির কাজ। আগামীকালের বাংলা ছবি বাঁচবে মেজবাউর রহমান সুমনের মত লোকেদের কাঁধে ভর দিয়ে। তাই তাঁরা যদি আজ কাজে যথেষ্ট সিরিয়াসনেস না দেখান এবং নিজেদের ভুলগুলো থেকে ক্রমাগত শিক্ষা নিয়ে নিজেকে আরো নিখুঁত না করে তোলেন, তাহলে বাংলা ছবির উন্নতি চিরকাল দিবাস্বপ্নই থেকে যাবে!
লিখন চন্দ্র দত্ত
প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক
ইমেইল- likhondatta127@gmail.com