সম্প্রতি পঞ্চগড়ের নৌকাডুবির ভিডওটি সকলেই নিশ্চয়ই দেখেছেন, এই লেখার শেষেও সেটি আবারও থাকলো। সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই ভিডিও দেখে অনেকের মত আমিও নৌকাডুবির জন্য প্রথমে দায়ী করেছিলাম মানুষগুলোর অসচেতনতাকেই। তারপর সরেজমিন তদন্তে নেমেই বুঝতে পারলাম, খালি চোখে যেটুকু সত্য দেখা যায়, সেটা আসলে প্রায়ই আসল অপরাধীকে আড়াল করে ফেলে।
বসে নয়, যাত্রীদের দাঁড়িয়েই থাকতে হয় বদেশ্বরী ঘাটে। যাত্রী ও মালামাল বোঝাই করে তবে খেয়া ছাড়া এখনো বন্ধ হয়নি
পঞ্চগড়ের নৌকাডুবির আসল দানব সেখানকার ইজারাদারি প্রথা, বালুদস্যদের দৌরাত্ম্য আর জেলা প্রশাসনের লোভ। এই লেখার শেষে যে ভিডিওটি দেয়া হয়েছে, সেখানেও দেখতে পাবেন, ইজারাদারের লোকেরা আছে, আছে দমকল বিভাগের লোকও। তাদের আলাপ থেকেও বোঝা যাচ্ছে কতটা বিপদজনক ছিল এই ভাবে যাত্রী বোঝাই করাটা। কিন্তু তারা সকলেই মিলেই নৌকাটাকে গাদাগাদি করে ঠাসাঅবস্থায় পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে, যাতে এক নৌকাতেই বেশি যাত্রী তোলা যায়। শুধু এটুকু নয়, নদীপথকে বিপদজনক করতে আছে আরও অনেকগুলো পক্ষের লুণ্ঠন।
দেবীগঞ্জ জিরো পয়েন্ট। তখন বেলা সাড়ে দশটা। চড়া রোদ। সহযাত্রী আবু সায়ীদ ভাইয়ের কিনে দেওয়া খাদ্য উপকরণ নিয়ে জিয়ারুল ভাইয়ের (৪০) ইঞ্জিন চালিত ভ্যানগাড়িতে চড়লাম। সায়ীদ ভাই ধরলেন পুরাতন নাম বিন্নার দীঘি, বর্তমানের নীল সাগরের পথ। ওই দিক দিয়ে তিনি নীলফামারী হয়ে রংপুর ফিরবেন। আমি ভ্যানে পূর্ব থেকে পশ্চিম মুখে করতোয়া সেতু পার হয়ে যাবো পাকড়িতলা। পুস্তকি ভাষার পাকুড়তলাকে এখানে পাকড়িতলা ডাকে। পাকড়িতলা থেকে করতোয়াকে হাতের ডাইনে রেখে উত্তরমুখে পিচঢালা পথ। পথে পথে কিছু কিছু গামার গোটার গাছ( স্থানীয় নাম ভাল্টিং গাছ), ছাতিম, শিমুল গাছ আর বেশীরভাগই একাশিয়া আর ইউক্যালিপটাস। রাস্তার পাশে শটি হলুদ আর মাঝে মাঝে চা বাগান।
সোনাতলা, সুলতানপুর পার হওয়ার পর সেতনাই নদী। করতোয়ার আরেকটি উপনদী। তারপর টাকাহারা বাজার। জিয়ারুল ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, এমন নাম কেন? তিনি বললেন, সহজসরল হাটুরেরা পকেট কাটা যাবার উপদ্রবে হয়তো জায়গার নাম রেখেছেন টাকাহারা বাজার। আবার হতেও পারে একবারে কেউ হয়তো এত বেশি টাকা হারিয়েছিলেন যে, বাজারটা এই খ্যাতি পেয়েছে। তারপর বিশাল বিল অতিক্রম করে এলাম ধানমারা গাঁয়ে। এই এলাকায় ধানের ফলন হয় খুব ভালো। তারপর কালুপীর ভাঙ্গার পাড়। জায়গাটা অতিক্রম করার ২০০ মিটার অতিক্রম করতেই রাস্তার পাশে ধারে একচিলতে জায়গা। সেখানে টিনের ওপর লেখা- কালুপীরের মাজার। এরপরই ধুলাঝাড়ির ঘাট ও বাজার। এখানেও লোকজন করতোয়া পার হচ্ছে। তারপর শালডাঙ্গা বাজার ও ১৯০৫ সালের প্রাইমারী স্কুল- অমরখানা ও ছত্রশিকারপুর প্রাইমারী স্কুল। জিয়ারুল ভাই জানালেন, এই পাকড়িতলা থেকে এই পর্যন্ত পুরোটাই লক্ষ্মীর হাট ইউনিয়ন। এখানকার বেশিরভাগ লোকই ভাটিয়া। ভাটিয়া বলতে, এদের চেয়ে ভাটি এলাকা থেকে যাঁরা এসেছেন। এদের মধ্যে গাইবান্ধার লোকই বেশি। এছাড়া আছেন চিলমারী, ময়মনসিংহ ও জামালপুরের লোকও । “প্রায় ৬০ ভাগ লোকই ভাটির দেশ থাকি আইসছে।“
তারপর মাড়েয়া বাজার। পাশের মাড়েয়া মডেল স্কুল এণ্ড কলেজ মাঠে প্রচুর লোকজন। মাঠের কোণায় জনসভা দেখে ভ্যান থামালাম। স্টেজের একেবারে সামনে যেতেই জনসভা শেষ। শেষ বক্তব্য দিচ্ছিলেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। পাশে সাবেক উপ মন্ত্রী আসাদুল হাবীব দুলু। আর কাউকে চিনি না। কয়েকটা ফটো তুললাম। সম্প্রতি নৌকা ডুবিতে নিহতদের জন্য ১০ হাজার টাকার খাম দিয়েছেন, এমনটা শুনতে পেলাম।
মৃতদের স্বজনদের সাথে সাক্ষাত
দীপন ও পরিতোষ। বড়জনের বয়স ১৩ কি ১৪, আরেকজনের বয়স ১০ বছর। দীপনের সাথে যখন কথা বলছিলাম, তখন পাশে রাখা সাইকেলে প্যাডেল চালাচ্ছিলো পরিতোষ। সে যেন বিরক্ত সাক্ষাৎকার দিতে। বাড়িতে আছে তাদের আরেকটি ছোট ভাই। শালডাঙ্গা ইউনিয়নের ছত্রশিকারপুরে তাদের গ্রামের বাড়ি। এদের দুইজনকে বাড়িতে রেখে মহালয়ার দিন, ২৫ সেপ্টেম্বর ছোট ভাইকে নিয়ে বাবা-মা সেদিন বদেশ্বরী মন্দিরে গেছিলেন। ২ বছরের ছোট ভাইটি বেঁচে গেলেও মারা গেছেন বাবা ও মা। লেখাটি লেখার সময় জানা গেল, রেলমন্ত্রী সুজন সাহেবের স্ত্রী ২ বছরের শিশুটিকে নিজের সন্তান বলে ঘোষণা দিয়েছেন। জেষ্ঠ্য ভাই দীপন যেন বাকরূদ্ধ। সে কেমন করে চলবে পরিতোষকে নিয়ে? সমস্ত আকাশ কি ভেঙে পড়েছে দীপনের মাথায়?
নাম প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। তাঁর গলা ভেঙে গেছে। সম্ভবত, কাঁদতে কাঁদতে এই দশা। বাড়ি মাড়েয়া শালবাড়ি। ২ বছরের ছেলেসহ তাঁর স্ত্রী নিহত হয়েছেন নৌকাডুবিতে।
ননীবালা (৬৫), বিমলচন্দ্র রায় (৫০), পার্বতী রাণী(৬০) ও কৃষ্ণ(৬০)। সবার বাড়ি মাড়েয়া বটতলি। ননীবালার একমাত্র ছেলে জগদীশ মারা গেছেন। পার্বতী রাণীর একমাত্র ছেলে সেন্টু রায় ও তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন।
বিমলচন্দ্ররা সেদিন নৌকায় ছিলেন বাবা ও ছেলে। তিনি বলেন, “সেদিন বদেশ্বরী ঘাটে সকাল ১১টায় উপস্থিত হই। তাদের দুই ঘাটে নৌকা ছিল ৩ টা। দড়িটানা নৌকা কালিয়াগঞ্জ ঘাটে আর বাকি দুইটা বদেশ্বরী ঘাটে ছিল। এত ভিড় ছিল। যখন আনুমানিক দুপুর দুইটা পার হৈছে, নৌকা ছেড়ে দেয়। ভাগ্যক্রমে আমার ভায়রাটা ও তার ভাইস্তেটা এখন কয় কি, সবাই যাচ্ছে আমরাও যাই। নৌকা তো এরকম ঢুলাঢুলি করিয়েই যায়। তারপর এইভাবে নৌকায় উঠে পড়লাম। উঠে পড়ার পর শ্যালোটা যেইখানে আমরা সেইখানে চড়লাম। শ্যালোটা আমি এক হাত দিয়ে ধরছি আর এইরকম একটা ছেলে আমার ছিল তাক আমি ধরছি। ধরার পর আমার ভায়রাটা কিন্তু আমার বা পাশে ছিল। আর নদী কিন্তু ডান পাশে। তো নৌকা যখন আস্তে করি ছাড়ি দিল, তো ছাড়ি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নৌকা কিন্তু না হইলেও একযোগে ১শ হাত দূরে চলি গেল। যাওয়ার পর মাঝি ভাই বলতেছে, তোমরা চুপ করি বসি যাও, নাওত কিন্তু পানি উঠতেছে। ওই তখন কী করল? আস্তে করি হাইলটা ঘুরাইল। যখন ঘুরাইল তখন নৌকায় পানি উঠে আস্তে করি ডুবি গেল। তখন আমার সাড়ে আট বছরের একটা ছেলে ছিল, সে তখন হরে কৃষ্ণ হরে রাম কয়ে আমাক বাঁচাও কয়ে উঠল। তখন মাঝি ভাইকে বললাম, আমার বাবাকে বাঁচাও। তখন সে এক হাত দিয়ে আমার ছেলেটাক ধরল। আমরা তখন ডাঙ্গার দিকে ছুটে যাচ্ছি, আমাক তখন কেউ ধরতে পারে না। ওরা তখন ভাসি যাচ্ছে, কুছু কিছু আমার পিছে আসতেছে। যখন দেখি আর ১০/১৫ হাত ডাঙ্গা আছে, তখন দেখি মাঝি ভাই আমার ছেলেকে ছেড়ে দিছে। তখন উঠে দৌড়ে যায়া বসি আছি। আমি হতাশ একেবারে।
আর বলছি, আমার বাবাক আমি হারে ফেলাছি। ওদিকে চা বাগানের ভাইয়েরা পানসি নিয়া দ্রুত গেইছে। দ্রুত যায়া নৌকাটাক ঠেলে দিছে, আমার ছেলেটা উঠে বইসছে। আমি অনেক দূর থাকি দেখতে পাচ্ছি, না হৈলেও ৫শ হাত দূর থাকি দেখতে পাছি। আমার বাচ্চাটার যে গায়ের রং, শার্টটা যে চিকির মিকির আর বাচ্চাটা যে চিকন চাকন আমি একেবারে সুন্দরভাবে দেখতে পাছি।
আমার বাবাক আমি হারে ফেলাছি। ওদিকে চা বাগানের ভাইয়েরা পানসি নিয়া দ্রুত গেইছে। দ্রুত যায়া নৌকাটাক ঠেলে দিছে, আমার ছেলেটা উঠে বইসছে। আমি অনেক দূর থাকি দেখতে পাচ্ছি, না হৈলেও ৫শ হাত দূর থাকি দেখতে পাছি। আমার বাচ্চাটার যে গায়ের রং, শার্টটা যে চিকির মিকির আর বাচ্চাটা যে চিকন চাকন আমি একেবারে সুন্দরভাবে দেখতে পাছি।
নদীপথে ভাড়া কেন সড়কপথের চাইতে বেশি?
আউলিয়ারঘাট। উত্তরে কালিয়াগঞ্জ। এখানে দড়ি ব্যবহার করে একটি নৌকায় পারাপার হয়। আর পূর্ব-পশ্চিমে যথাক্রমে দেবীগঞ্জের বড়শশী ইউনিয়ন ও বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়ন। এখানে ২টি নৌকা, একটি স্যালো ইঞ্জিন চালিত আরেক লগি-বৈঠার। ২৫ সেপ্টেম্বর মহালয়ার দিন ইঞ্জিন চালিতটি ডুবে গেছে। এই ঘাট দিয়েই বদেশ্বরী মন্দিরে পুণ্যার্থীরা যাতায়াত করেন। ঘাটটির ইজারাদাতা পঞ্চগড় জেলা পরিষদ। ঘাটটি ডাক হয়েছে ৯ লক্ষ ৫০ হাজার টাকায়, ভ্যাট-আয়করসহ মোট ১১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকায়। এবারের ইজারাদার আব্দুল জব্বার। তার সঙ্গে শেয়ার আছে ইউপি সদস্য তারা মিয়াসহ মোট ৫ জনের।
প্রতি বছরই ঘাটের ইজারার ডাক বাড়ে। বাড়ে পারাপারের ভাড়া। সড়কপথে যেমন রাষ্ট্রের প্রতি বছরের মেরামতির খরচ আছে, নৌপথে ততটা নেই। বরং আয় বিপুল। ঘাট পারাপারে যাত্রীদের খাজনা দিতে হয়। ইজারাদারের নিয়ন্ত্রণ থাকায় মাঝিরা আলাদাভাবে কোনো যাত্রী বহন করতে পারেন না।
জেলা পরিষদের ইজারাদারির কারণে এই অঞ্চলে প্রকৃতির দেয়া নদীপথে তাই খরচা এখন খরচা করে বানানো সড়ক পথের চাইতে বেশি।
সড়কপথে ৩০ কি.মি. যেতে যাত্রী ভাড়া যেখানে ৪০ টাকা, সেখানে নৌপথে ১০ কি.মি. লাগে ১শ টাকা। অন্যদিকে একটি অটো বা ভটভটিতে যে তেল খরচ করে ৬-৮ জন যাত্রী পরিবহণ করা যায়, সেখানে নৌপথে ১শ জন। এমনকি একটি অটোর দাম যেখানে ২ লক্ষ টাকা, সেখানে একটি নৌকার দাম দেড় লক্ষ টাকা। তবু এত ভাড়া কেন? কারণ নৌপথের ইজারা ব্যবস্থা। ইজারা ব্যবস্থা না থাকলে নৌপথের ভাড়া সড়কপথের দশ ভাগের এক ভাগে নেমে আসত।
সড়কপথে ৩০ কি.মি. যেতে যাত্রী ভাড়া যেখানে ৪০ টাকা, সেখানে নৌপথে ১০ কি.মি. লাগে ১শ টাকা। অন্যদিকে একটি অটো বা ভটভটিতে যে তেল খরচ করে ৬-৮ জন যাত্রী পরিবহণ করা যায়, সেখানে নৌপথে ১শ জন। এমনকি একটি অটোর দাম যেখানে ২ লক্ষ টাকা, সেখানে একটি নৌকার দাম দেড় লক্ষ টাকা। তবু এত ভাড়া কেন? কারণ নৌপথের ইজারা ব্যবস্থা। ইজারা ব্যবস্থা না থাকলে নৌপথের ভাড়া সড়কপথের দশ ভাগের এক ভাগে নেমে আসত
ইজারাদাররা নির্ধারিত সময় পর পর খেয়া ছাড়ে। যাত্রী সবসময় লেগে থাকলেও, নির্ধারিত পরিমাণ যাত্রী হলেও নৌকা ছাড়বে না। যাত্রীদের তাড়া থাকলে ১০ জনে ১টি নৌকা রিজার্ভে যেতে দেওয়া হবে। তাতে খরচা হবে বিশাল। সামর্থ্যবান যাত্রীরা বা দলবদ্ধ যাত্রীরা এভাবেই যাতায়াত করেন। যতজন যাত্রীই থাকুন না কেন, ১০ জনের বেশি যাত্রী নেওয়া যাবে না। এতে দেখা যায়, একবারে ৩/৪ টা রিজার্ভ নৌকা ছেড়ে দিল। ফলে আগে যে টাকায় যেতে পারতেন, তাড়া থাকায় কয়েকগুণ টাকা দিয়ে পার হতে হবে। আর অপেক্ষা করে থাকলে যখন ইজারাদারের মনমত পরিমাণে যাত্রী হবে, তখনই খেয়া ছাড়বে। এভাবেই খেয়া নৌকায় ডুবুডুবু অবস্থায় পারাপার করতে হয়। ফলে যাঁরা যাত্রীদের দোষ দেন, তাঁরা আদতে ভেতরের ঘটনাটা জানেন না। জেনে শুনেই জীবন হাতে করে এই নৌকায় চড়তে হয় যাত্রীদের।
ইজারাদারদের জুলুম চালু থাকায় যাত্রীরা সেতুর দাবি তোলেন। নদীমাতৃক দেশের নাগরিকরা জানেন, সেতু নদনদীকে হত্যা করে। তবুও এই দেশে সেতুর দাবি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। ঘাটে ঘাটে তো আর সেতু বসানো সম্ভব নয়। এছাড়া তাতে নদীতে চর হওয়া, স্রোত বদলে যাওয়া সহ নানান উপদ্রব দেখা দেয়। বরং হয়রানিমুক্ত সুলভ নৌকার প্রচলন থাকলে নানান ঘাটে মালামাল ও যাত্রী পরিবহন সম্ভব। কিন্তু সেটার জন্য সবার আগে দরকার ইজারাদারদের এই দৌরাত্ম্য থেকে মানুষগুলোকে মুক্তি দিয়ে একটা কার্যকর নৌ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ সানিউল কাদের বলেন, 'জেলা পরিষদ খেয়াঘাটের ইজারা দিলেও নৌযানের তদারকি ও যাত্রী পারাপারের বিষয় দেখে স্থানীয় প্রশাসন।'
সাধারণত ঘাটের ইজারা পান ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা। আউলিয়া ঘাটের ইজারাদারও সরকারি দলের ওয়ার্ড কমিটির ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত আছেন মাড়েয়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি ও চেয়ারম্যানের ভাইয়েরা। তাদের দাপটে জনগণের সংগঠিত প্রতিরোধও গড়ে ওঠে না। বছর বছর আইনিভাবে ঘাটের ডাকের পরিমাণ বাড়ায় জনগণকে এই দৌরাত্ম্য সহ্য করে যেতে হয়। অথচ সরকার খাজনার বিনিময়ে মাঝিদের লাইসেন্স দিলে এবং পরিবহনের দর এবং যাত্রীর সংখ্যা বেঁধে দিলে মাঝিরা নিজেরাই বাকি বন্দোবস্ত করে নিতেন। ইজারার এই প্রথা এমনকি মাঝিদের জন্যও ভালো না। কেননা একদিকে তারা নিজের ও যাত্রীর জীবনের ঝুঁকি নিতে বাধ্য হন, আরেকদিকে আয়ের বড় অংশই ইজারাদার নিয়ে নেন। তারপর আছে একই নৌকায় অজস্র যাত্রী নিতে বাধ্য করায় মোট পারাপারের সংখ্যা কমে গিয়ে মাঝিদের বেকার বসে থাকা।
বালুদস্যুরা যেভাবে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধিকে নিশ্চিত করলো
সাধারণত করতোয়া নদীতে পানি বেশি থাকে না, আর নৌকাও কম। ফলে যাত্রীরা বিশ্বাস ও সাহসে ভর করে এভাবেই যাতায়াতে অভ্যস্ত হয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোদা রিপোর্টার্স ক্লাবের একজন সংবাদকর্মী জানান, ওই পানিতে নৌকা ডুবলেও কিছু হত না। কিন্তু ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করায় মাঝে মাঝে চোরা গর্ত সৃষ্টি হয়েছে নদীতে। ফলে নদীতে তীব্র পাকের সৃষ্টি হয়েছিল, অন্যদিকে লাশ তোলার সময় দেখা গেছে, গর্তগুলোতে লাশ জড়ো হয়েছে।
ওই পানিতে নৌকা ডুবলেও কিছু হত না। কিন্তু ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করায় মাঝে মাঝে চোরা গর্ত সৃষ্টি হয়েছে নদীতে। ফলে নদীতে তীব্র পাকের সৃষ্টি হয়েছিল, অন্যদিকে লাশ তোলার সময় দেখা গেছে, গর্তগুলোতে লাশ জড়ো হয়েছে
বোদা থেকে ফেরার সময় প্রায় একই কথা জানালেন ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার উপজেলা প্রাণী সম্পদ অফিসার কায়েস বিন আজিজ। তিনি জানান, ওই ঘটনার দুই দিন আগে পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে হঠাৎ করতোয়ার পানি বেড়ে যায়। আর পানি বাড়লে বালু তোলার পয়েন্টগুলোতে তীব্র পাকের সৃষ্টি হয়। ভিডিওতে দেখবেন, নৌকাটি সোজা যেতে গিয়ে হঠাৎ ঘুরে গিয়ে ডুবে গেছে। বালু উত্তোলন বন্ধ না হলে আরও দুর্ঘটনা ঘটতে থাকবে।
নিখোঁজের স্বজনেরা বঞ্চিত থাকবেন?
এখনও ৩ জনের লাশ পাওয়া যায়নি। এই তিনজনের স্বজনেরা পাননি কোনও আর্থিক সহযোগিতা। সরকার থেকে ৫০ হাজার, রেলমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ৫ হাজার, জামায়াতের ৩০ হাজার ও বিএনপির ১০ হাজার। মোট ৯৫ হাজার এর ১টি টাকাও তাঁরা পাননি। নামও ওঠেনি তাঁদের। গতকাল ১ অক্টোবর বেলা ২ টায় যখন আউলিয়া ঘাটে পৌঁছাই তখনও নিখিল চন্দ্র তাঁর পিতার ফটো নিয়ে পিতাকে খুঁজে ফিরছেন। তিনি বলেন, “আমি বাবাকেও খুঁজে পাইনি, পাইনি কোনও আর্থিক সহযোগিতাও। বাপকে না পেলে কী হবে!”
ইজারাদার কিংবা প্রশাসনের কারও শাস্তি হবে না?
রাজনৈতিক দল কিংবা ব্যক্তি যেসব ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে, সেটার ভালো মন্দ যাই থাকুক, এই ভয়াবহ মৃত্যুগুলোকে কোনভাবে কি দুর্ঘটনা বলা যায়?
অতিরিক্ত বোঝাই যাত্রীর জন্য ইজারাদার কিংবা জেলা পরিষদের কি দায় নিতে হবে না? জেলা প্রশাসনের বা পুলিশের কোন দায় নেই? এই প্রশ্নগুলো গণমাধ্যমে বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দিক থেকে ততটা আসেনি। কারও ইচ্ছাকৃত গাফিলতিতে যদি অন্য কারও মৃত্যু বা ক্ষতি হয়, সেটা তো স্বেচ্ছাকৃত অপরাধ। এই কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডকে বিনা বিচারে ছেড়ে দেয়া যায় কীভাবে? বালু তোলার কারণে যদি সেখানে মৃত্যুকূপ তৈরি হয়, সেগুলো বন্ধ করা কিংবা অবৈধভাবে যারা বালু তোলে, তাদের শাস্তি দেয়ারই বা কী হবে?
অতিরিক্ত বোঝাই যাত্রীর জন্য ইজারাদার কিংবা জেলা পরিষদের কি দায় নিতে হবে না? জেলা প্রশাসনের বা পুলিশের কোন দায় নেই? এই প্রশ্নগুলো গণমাধ্যমে বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দিক থেকে ততটা আসেনি। কারও ইচ্ছাকৃত গাফিলতিতে যদি অন্য কারও মৃত্যু বা ক্ষতি হয়, সেটা তো স্বেচ্ছাকৃত অপরাধ। এই কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডকে বিনা বিচারে ছেড়ে দেয়া যায় কীভাবে? বালু তোলার কারণে যদি সেখানে মৃত্যুকূপ তৈরি হয়, সেগুলো বন্ধ করা কিংবা অবৈধভাবে যারা বালু তোলে, তাদের শাস্তি দেয়ারই বা কী হবে?
দেশে প্রতিবছর অজস্র নৌ দুর্ঘটনা ঘটে। কোনোদিন কোনো তদন্তে কি পাওয়া গেলো, কাদের কাদের অবহেলা, লোভ আর গালফিলতির কারণে এই মৃত্যুগুলো ঘটছে?
মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ কী দায়ী ব্যক্তিদের সম্পদ থেকেই আদায় করার কথা না? কে তুলবে এসব প্রশ্ন? সকলের যৌথ সম্পদ নৌপথকে ইজারার নামে কেন কতিপয়ের মুনাফার কলে পরিণত করা হবে? সেই প্রশ্নও আসতেই হবে এই মৃত্যুর মিছিল থামাতে হলে।
উত্তর বঙ্গের অতি প্রাচীন মন্দির বদেশ্বরী। প্রতি বছর সেখানে দর্শনার্থীরা যান। ছোটখাট দুর্ঘটনা আগেও এখানে ঘটেছে। কিন্তু ইজারাদারের বেপরোয়াপনা, প্রশাসনের মুনাফার লোভ আর বালুখেকো ডাকাতদের এই রাজত্ব অব্যাহত থাকলে বদেশ্বরী মন্দিরের তীর্থযাত্রা নিয়মিতই মৃত্যুযাত্রাতে পরিণত হতে পারে। ট্রলার ও লঞ্চডুবিতে প্রতিবছর অজস্র মৃত্যুর পেছনের কারণগুলো তাই অসচেতন যাত্রীদের বোঝাই হয়ে নৌকায় উঠবার হুড়মুড় ততটা নয়, যতটা নিরুপায় মানুষগুলোকে একটা ট্রলার বা নৌকায় গাদাগাদি করতে উঠতে বাধ্য করা।
স্বজন হারানো মানুষগুলোর উদাসীন চেহারাগুলোর কথা ভাবছিলাম ফিরতে ফিরতে। এই মানুষদের করের টাকায় বেতন পাওয়া কর্তারা এই মানুষদের নদীযাত্রার ওপরও বিপুল খাজনা বসিয়ে শান্ত্রী পাহারায় ধূলা উড়িয়ে নিরাপদে যাত্রা করেন। তাঁদের জন্য অন্যদের ফেরি বন্ধ থাকে, রাস্তা আটকে তাদের রাস্তা ফাঁকা করা হয়। খেয়া নৌকা কিংবা কাঠের ট্রলারে কোনদিন তাঁরা চড়েন না, বালুডাকাতদের কার্গো তাদের বাহনকে কোনদিন ভুস করে গুঁতো দিয়ে ডুবিয়েও দেয় না। সব অনিশ্চয়তা আর উদ্বেগ থেকে নিরাপদে দূরে থাকা এই মানুষগুলোকে কিভাবে স্পর্শ করবে এই মানুষগুলোর বেদনা, কিংবা নিত্যদিনের প্রবঞ্চনা? তাই তাঁরা কেবল বাধ্য হওয়া মানুষগুলোর হুড়মুড়কেই কারণ হিসেবে আঙুলে দেখিয়ে দিতে পারেন। আসল সঙ্কটগুলোকে জেনেও সমাধান করার চেষ্টা করেন না।
বাকহারা মানুষগুলো যদি মুখ না খোলে, নদীকে ঘিরে মুনাফার এই মৃত্যুফাঁদ বন্ধ হবার নয়।
যাত্রীতে টইটম্বুর নৌকা এবং শেষ পর্যন্ত সেটির ডুবে যাওয়ার ক্লিপটি