বৃহঃস্পতিবার ১৪ই চৈত্র ১৪৩০ Thursday 28th March 2024

বৃহঃস্পতিবার ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

Thursday 28th March 2024

বহুস্বর মতামত

‘হেই সামালো’ কোক স্টুডিও

২০২২-১০-০১

অমল আকাশ

“আলু বেচো ছোলা বেচো বেচো বাকরখানি,

বেচোনা বেচোনা বন্ধু, তোমার চোখের মণি”

কবিতা: সমীর রায়

 

কিন্তু পুঁজিবাদ-কোকাকোলাইজমের কাছে সব কিছুই পণ্য। আলু-ছোলা থেকে গণসংগীত, সব কিছু বেচা যায়, শুধু বুঝে নিতে হবে কখন কোথায় কোনটার কাটতি হবে। যে কেউই গণসংগীত গাইতে পারেন, গান গাওয়া নিয়ে বিরোধিতা করবার কিছু নাই। কিন্তু কোন কনটেক্সটে, কার স্বার্থে গানটি গাওয়া হচ্ছে, সেটা নিয়ে শ্রোতাদের, কোকাকোলার অর্থে “ভোক্তাদের” সতর্ক থাকা বেশ জরুরি। বিশেষকরে যখন চোখে পড়ে ‘প্রগতিপন্থী’ সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও কেউ কেউ আহা-উহু করছেন, নিজেদের দেয়ালে স্বেচ্ছায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন কোকস্টুডিও’র ‘হেই সামালো’ গানের, তখন চিন্তিত হতেই হয়। কালচারাল পলিটিক্সের বাহ্যত নিরীহ কিন্তু জটিল চেহারাটা এখানেই লুকিয়ে থাকে।

 

 

শিল্পের বিবেচনায় এই গোটা আয়োজন তাহলে অর্থ ও দক্ষতার প্রদর্শনী ছাড়া আর কি, যেখানে মর্মের মৃত্যু বা অপসারণ ঘটেছে?

 

 

সম্প্রতি আমরা যেমন দেখলাম খুবই চমৎকার সংগীত আয়োজনে ‘হেই সামালো’ আর ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ গান দুটো ব্লেন্ড করা হলো। জনপ্রিয় শিল্পীদের কণ্ঠে পরিবেশন করা হলো, তার সাথে ব্যয়বহুল ভিডিওগ্রাফি। তো এমন প্রোডাক্ট তরুণ শ্রোতা কেন লুফে নেবে না! তারা যাতে লুফে নেয়, সে জন্যেই তো এত কোটি কোটি টাকার আয়োজন। কেউ কেউ ভাবছেন এতে ক্ষতি কী? আজকের যে ছেলেমেয়েরা সলিল চৌধুরী, আবদুল লতিফের নামটাও জানে না, কোকস্টুডিও তাদের কাছে এই গান পৌঁছে দেওয়ার মহান দায়িত্ব পালন করল। আবারও বলছি, যে কোন গানই যে কেউ গাইতে পারেন। সঙ্গীতের আয়োজনে নতুনত্ব আনাটাও গানকে সমসাময়িক রাখার, বা সমকালের শ্রোতাদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলবার জন্য জরুরি। কিন্তু একটা গানের মর্ম আর একটা গানের বাণিজ্যিক উপস্থাপন যদি সাংঘর্ষিক হয়, সেটার বিষয়ে সচেতন থাকটাও, এবং প্রয়োজনে নিজেদের সাধ্যমতই এই ক্ষতিকর কাজের ক্যানভাসার না হওয়াটাও জরুরি বলে মনে করি।

 

সবচেয়ে সোজা প্রশ্নটিই এভাবে তোলা যায়: কোকস্টুডিও কি তেভাগা বা ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক মতাদর্শ ধারণ করে? কিংবা ‘হেই সামালো’র মূল রেকর্ডে হেমাঙ্গ, সলিলরা তেভাগার প্রেক্ষাপটকে উল্লেখ করে যেভাবে গানটি আমাদের শোনান, কোকস্টুডিও কি তা করেছে? তাহলে এই গান একজন তরুণ শ্রোতার গান শোনার অভিজ্ঞতায়, মিউজিক কম্পোজিশন, সাউন্ড-কালার ছাড়া আর অন্য কোন মানে তৈরি করবে? তার হৃদয়কে তেভাগা আন্দোলনের মতাদর্শের সাথে কি যুক্ত করবে? শিল্পের বিবেচনায় এই গোটা আয়োজন তাহলে অর্থ ও দক্ষতার প্রদর্শনী ছাড়া আর কি, যেখানে মর্মের মৃত্যু বা অপসারণ ঘটেছে?

 

উত্তর এমনটা হতেই পারে, এই দায়িত্ব কেন কোক স্টুডিও নিবে? নেবার কোনও কারণ নেই। তারা গানটুকুই নিয়েই ভাববে, তার কথা, তার নতুন সঙ্গীতায়োজনে ভোক্তাকে মুগ্ধ করাই কোকস্টুডিওর কাজ।

 

সত্যি, যেকোনো গানকে কেবল মাত্র চিত্তবিনোদনের প্রোডাক্ট বানানো ছাড়া কোক স্টুডিও বা এমন প্রতিষ্ঠানের আর কোনো দায়িত্ব নেই। গণসংগীত শুনে তরুণ শ্রোতার চিত্ত বিনোদিত হলে দোষের কিছু নাই, আনন্দের বটে। কিন্তু এই গান তো শুধু চিত্তকে বিনোদিত করবার পুঁজিবাদী প্রোডাক্ট হিসেবে তৈরি হয়নি, হয়েছে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রামের ময়দান থেকে। এই গান গাইতে হলে সেই রাজনৈতিক ময়দানের সাথে শ্রোতার পরিচয় ঘটানোর দায়িত্ব রয়েছে শিল্পীর। ফলে ‘হেই সামালো’ কেবল মাত্র সুর-তাল-লয়ের চমৎকারিত্ব নয়, কৃষকের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের ভাবাদর্শ থেকে জন্ম নেয়া একটি গণসংগীত।

 

 

পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে মুক্তির লড়াইয়েরই গান ‘হেই সামালো’ এবং ‘ওরা আমার মুখের কথা’।

 

 

কোকাকোলা তো সারা দুনিয়াতে পুঁজিবাদী আগ্রাসনের রীতিমত প্রতীক, বহু আগে থেকেই। কোকস্টুডিও তার সাংস্কৃতিক চেহারা। সেই কোক স্টুডিওকে কেন গণসংগীত, ভাষা আন্দোলনের গান গাওয়াতে হলো? নিশ্চয়ই এর কোন গভীর কারণ রয়েছে, বা রয়েছে আধুনিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির নিজের এমন কিছু তৈরির অক্ষমতা, যা গোটা জনগোষ্ঠীর মনযোগ আকর্ষণ করতে পারে। নিজের সেই অক্ষমতা কিংবা পরেরটা লোপাট করবার ভাবাদর্শিক প্রকল্পেরই অংশ বানাতে চেয়েছেন তাঁরা ‘হেই সামালো’ আর ‘ওরা আমার মুখের ভাষা’ গান দুটিকে। আর যাঁরা এই ভাবাদর্শিক প্রকল্পের অংশ, কিংবা সে বিষয়ে অসচেতন, তাঁরা তো কোকাকোলার বিজ্ঞাপন প্রচারে কোক স্টুডিওকে বাহবা দিয়ে যাবেনই।

 

কিন্তু এই প্রকল্পে কোকাকোলার স্বার্থ কী? পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কোকাকোলা সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। সারা দুনিয়াব্যাপী অন্য যেকোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মতো কোকাকোলারও একটাই স্বার্থ, তা হলো ব্যবসা। ফলে কোক স্টুডিও যখন যে দেশে যাবে, সে দেশের ক্ষমতা কাঠামোর সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়েই কাজ করবে। বাংলাদেশে এখন ‘সেক্যুলার-বাঙালি’ ভাবাদর্শ রাষ্ট্রক্ষমতায়, এখানে সে এই ভাবাদর্শ প্রচারের দায়িত্ব নেবে, নির্বিঘ্নে পুঁজির বিকাশের, মুনাফার স্বার্থে। ক্ষমতা ও পুঁজির সাপেক্ষে সুবিধাজনক জায়গায় থাকা পক্ষগুলো পরস্পর পরস্পরের স্বার্থ রক্ষার মধ্য দিয়ে সমাজের গভীরে প্রোথিত করতে থাকে সাংস্কৃতিক, ক্ষমতাশীন ভাবাদর্শের শিকড়-বাকড়।

 

 

এই একচেটিয়া দৈত্যদের হাতে সঙ্গীতের, একাধিপত্য খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে সংস্কৃতির সজীবতার জগতে।

 

 

আচ্ছা কোকাকোলার বিজ্ঞাপন প্রচার করেও যদি ‘ভালো কিছু গান’ হয় তাতে দোষের কী আছে? এমন মন্তব্য বা চিন্তাকে আপাত নিরীহ মনে হলেও আসলে তা মোটেও নিরীহ নয়! ‘আপাত দৃষ্টিতে যে প্রতিষ্ঠান বা অভিব্যক্তিগুলোকে রাজনৈতিক বলে মনে হয় না, সেগুলোর ভিতর দিয়েই ক্ষমতার রাজনীতি সব চাইতে বেশি ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে’: মিশেল ফুকোর পর্যবেক্ষণ এমনই। তাহলে কোকাকোলার কোকস্টুডিও হচ্ছে সেই নিরীহ চেহারা, যা তরুণ সমাজের মাঝে সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আদিবাসী গান থেকে গণসংগীত, সকল গানের ধারক-বাহক হবার সম্মতি আদায় করে নেয়। যে সম্মতি, এলিট ভাবমূর্তি একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে কোকস্টুডিও তথা কোকাকোলার জনপ্রিয়তাকে বহুগুন বাড়িয়ে দেয়। অথচ এই পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে মুক্তির লড়াইয়েরই গান ‘হেই সামালো’ এবং ‘ওরা আমার মুখের কথা’। যাদের বিরুদ্ধে এই গান, অর্থের জোরে, প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার জোরে তারাই সেই গভীর চেতনাটিকে ভুলিয়ে দিচ্ছেন, বিজ্ঞাপনের কৌশলে তা ‘খাওয়াবার’ ব্যবস্থাও করছেন।

 

এ অধিকার কোকাকোলাইজম কেড়ে নিতে জানে, আমরা শুধু জানিনা তাকে কীভাবে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। পুঁজি প্রত্যক্ষ শ্রমশোষণ ছাড়া আরও যেসব রাস্তায় হাঁটে, তার উপস্থিতির অধিকাংশই প্রাথমিকভাবে টের পাওয়া যায় না। কেননা সে তার সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, প্রতীকগুলোকে টাকায় কিনতে পারা শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলে। তারা এমন প্রগতিপন্থী চেহারা, পরিচয় নিয়ে জনতার সমাজে হাজির হয় যে তার আড়ালে পুঁজির আগ্রাসন-আধিপত্য স্বাভাবিক রীতি-প্রথায় রূপান্তরিত হয়। আর এটাই হচ্ছে আজকের কালচারাল পলিটিক্সের দুনিয়ায় সবচাইতে কঠিনতম লড়াইয়ের ময়দান। শ্রমিকের দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগ্রাম খুব স্বচ্ছ-স্পষ্ট বিষয়, কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল, লড়াইয়ের ময়দানে সবই প্রত্যক্ষ। শত্রু-মিত্র চেনা যায় রাজপথে লড়াইয়ে অভিজ্ঞতায়। কিন্তু কালচারাল পলিটিক্সে জনতার সামনে শত্রু চিহ্নিত করা বড় কঠিন কাজ।

 

 

এ অধিকার কোকাকোলাইজম কেড়ে নিতে জানে, আমরা শুধু জানিনা তাকে কীভাবে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। পুঁজি প্রত্যক্ষ শ্রমশোষণ ছাড়া আরও যেসব রাস্তায় হাঁটে, তার উপস্থিতির অধিকাংশই প্রাথমিকভাবে টের পাওয়া যায় না। কেননা সে তার সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, প্রতীকগুলোকে টাকায় কিনতে পারা শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলে। তারা এমন প্রগতিপন্থী চেহারা, পরিচয় নিয়ে জনতার সমাজে হাজির হয় যে তার আড়ালে পুঁজির আগ্রাসন-আধিপত্য স্বাভাবিক রীতি-প্রথায় রূপান্তরিত হয়।

 

 

যেমন এই যে আমি কোক স্টুডিও নিয়ে এত কথা বলছি, একবার কোক স্টুডিও’র গানের সম্ভারে ঢুকে পড়লে কোন তরুণ শুনবে আমার কথা? সুরের মূর্ছনায় ভেসে যাবে সে। এ.আর. রহমানের মতো কত কত মিডিয়াবিখ্যাত শিল্পীরা কাজ করেছেন এখানে। এমন ফাইনেস্ট মিউজিক্যাল প্রোডাক্ট তরুণদেরকে কয়জন দিতে পারে! ফলে খুব, খুব কঠিন সেই তরুণদেরকে কোকাকোলার রাজনীতি বোঝানো। বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক তরুণ ভোক্তার সংখ্যা যেকোনো কোমল পানীয়ের কোম্পানির জন্য ভীষণ আকর্ষণের ও লোভের। পৃথিবীর প্রায় সবদেশেই সফলভাবে ব্যবসা করে আসা কোকাকোলা নিশ্চয়ই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশেও প্রথমস্থানেই থাকবার কথা ছিল। সাংস্কৃতিক আধিপত্যের সাথে মিলিয়ে বাংলাদেশে অচিরেই আবারও তারা প্রথম জায়গাটি দখল করে যে নেবে, তাতে সন্দেহ নাই। কোকাকোলা তো আর যা তা বিষয় নয়, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। দুই শতাধিক দেশে দৈনিক ১৯০ কোটি একক পণ্য বিক্রি হয় কোকাকোলার। সেই কোকাকোলা এই বিরাট তরুণ ক্রেতার বাজারে একচেটিয়া ব্যবসা করতে চাইবেই, একদা তা ছিলও। তারই একটি লক্ষণ-চিহ্ন বাংলাদেশে কোক স্টুডিওর আগমন। কিন্তু সম্ভবত, এর চাইতেও বড় একটি কারণ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও ইউটিউবের যুগে শিল্পকেও অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটা পণ্য হিসেবে হাজির করার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা তৈরি হওয়া। কোকাকোলার পানীয় খেতে খেতে শ্রোতা শুনবেন পাকিস্তানী সুফি সঙ্গীত, কিংবা হেই সামালো ধানের রক্ত নিঙড়ানো গান, এবং কোকাকোলাও দুই দফায় ব্যবসা করতে পারবে, বিনিয়োগের বিচারে হয়তো কোকের ভাবনা এটুকুই। কিন্তু এই একচেটিয়া দৈত্যদের হাতে সঙ্গীতের, একাধিপত্য খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে সংস্কৃতির সজীবতার জগতে।

 

 

বক্তব্যনির্ভর গানকে এভাবে কাটাছেঁড়া করতে হয় না, করলে সে পরিবেশনায় গানের অন্তর-শক্তি নষ্ট হয়

 

 

এই বিশাল পুঁজির কাছে আমরা নিতান্তই ছোটমুখ। আমার বা আমাদের মুখ কেন ‘ছোটমুখ’, কারণ কোক স্টুডিওর কালচারাল হেজিমনি এটা প্রতিষ্ঠিত করে যে, কোক স্টুডিওতে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা অনেক ‘বড় মুখধারী’ শিল্পী। তাঁরা গান নিয়ে যা করবেন সেটাই অথেনটিক, অনুকরণীয়। আপনি অমল আকাশ এইসব নিয়ে কথা বলতে আইছেন, আপনি ফিউশন মিউজিকের কী বোঝেন? আপনেরে কেডায় চিনে? জীবনে এ রকম মিউজিক বানাইতে পারবেন? এই প্রশ্ন, মন্তব্য, চিন্তা কিন্তু কোক স্টুডিও’র করতে হবে না, কোক স্টুডিওর বাছাই করা “উচ্চরুচির” শ্রোতারাই চিন্তার ‘ঔপনিবেশিক’ দায়িত্ব বিনা পারিশ্রমিকে পালন করবেন।

 

তারপরও ‘ছোটমুখে’ কিছু বড় কথা বলা যাক কোক স্টুডিও বাংলার ‘হেই সামালো’, ‘ওরা আমার মুখের কথা’ গানের গায়কী, পরিবেশনা, সংগীত আয়োজন নিয়েও। তো এই ‘বড় মুখের’ প্রতিষ্ঠানগুলোর কী দায়িত্ব ছিল না গানের কথা বা লিরিকের বিষয়ে আরও একটু যত্নবান হওয়ার? উচিত ছিল না অন্তত কথাগুলোর যথাযর্থতা রক্ষা করবার? সেখানে কেন মারাত্মক সব গলতি!

 

এত বিশাল বাজেটের কাজে কেন কোকাকোলা গানের কথাটাকে যথাযথভাবে রাখার চেষ্টা করবে না? সলিল চৌধুরীর গানে তাঁরা গাইছেন ‘ধার জমিতে লাঙল চালাই’,এখানে হওয়ার কথা ‘তার জমি যে লাঙল চালায়’(সূত্র: সুব্রত রুদ্র সম্পাদিত গণসংগীত সংগ্রহ)। অর্থাৎ সলিল এখানে বলতে চেয়েছেন, লাঙল যার জমি তার। পরিষ্কার বোঝা যায় গানটির ওই রাজনৈতিক আবহটুকু। কিন্তু এই লাইনটাকে ‘ধার জমিতে লাঙল চালাই’ গাইলে সলিল যে অর্থ প্রকাশ করতে চেয়েছেন তা পাল্টে যায়। আরেক জায়গায় তারা গাইছেন ‘সাদা হাতির কালা মাহুত তুমি নও’, এখানে হওয়ার কথা ‘তুমিই না’(সূত্র: সুব্রত রুদ্র সম্পাদিত গণসংগীত সংগ্রহ)। অর্থাৎ, সেই সাদা হাতির (কোক স্বয়ং সেই সাদা হাতির দলের অন্তর্ভূক্ত) কালো মাহুত (কোক স্টুডিওর মোসাহেবগণ এই কালো মাহুত গোত্রের মানুষ) বলতে যা বুঝিয়েছেন সলিল চৌধুরী, তা পুরো উলটে গিয়েছে কোক স্টুডিওর গানে। সলিলের গানে বলা হয়েছে ৪৭ পরবর্তী শাসকদের কথা, যারা উপনিবেশেরই তাঁবেদার। অন্যদিকে কোকস্টুডিও বলছে এরা সাদা হাতির কালা মাহুত নন!

 

 

অর্থাৎ, সেই সাদা হাতির (কোক স্বয়ং সেই সাদা হাতির দলের অন্তর্ভূক্ত) কালো মাহুত (কোক স্টুডিওর মোসাহেবগণ এই কালো মাহুত গোত্রের মানুষ) বলতে যা বুঝিয়েছেন সলিল চৌধুরী, তা পুরো উলটে গিয়েছে কোক স্টুডিওর গানে। সলিলের গানে বলা হয়েছে ৪৭ পরবর্তী শাসকদের কথা, যারা উপনিবেশেরই তাঁবেদার। অন্যদিকে কোকস্টুডিও বলছে এরা সাদা হাতির কালা মাহুত নন!

 

 

শিল্পী আবদুল লতিফের ‘ওরা আমার মুখের কথা’ গানের অংশে তারা ‘ঢপ কীর্তন’ এর জায়গায় গাইছেন ‘জপ-কীর্তন’। ‘ঢপ গান’ বা ‘ঢপ কীর্তন’ ছিল বাংলার এক জনপ্রিয় কীর্তনাঙ্গের গান, বিশেষ করে বৈষ্ণব কীর্তনের, যার এখন খুব একটা প্রচলন দেখা যায় না। আর ‘জপ’ হচ্ছে ভগবানের/গুরুর নাম জপ। বলতে পারেন এইসব ‘ছোটখাটো’ ভুলে গানের বড় কোনও ক্ষতি হয় না। এসব নিশ্চয়ই তাদের ইচ্ছাকৃত কোনও ভুল নয়। তারা যে সকল উৎস থেকে কথা সংগ্রহ করেছে, সেখানেই হয়তো সমস্যাগুলো ছিল। কিন্তু ঐ যে বললাম, বিশাল বাজেটের কাজে এই খুঁতগুলো থাকবে কেন? থাকবে এই কারণে যে, তাদের মূল মনোযোগ ফিউশনে, মিউজিকের তেলেসমাতিতে, পোশাকের রঙ বাহারে! মিউজিকের তেলেসমাতি দেখাতে তারা শুরুতেই প্লুং বাঁশির সুরে আমাদের পাহাড়ে নিয়ে যায়, সেখান থেকে হেই সামালো হেই সামালো গাইতে গাইতে সমতলে নিয়ে আসে। খুব সুরেলা, মিহি সুরের কাজ, কান জুড়ায়। কিন্তু কেন প্লুং বাঁশির ব্যবহার এখানে? পাহাড়ের জুম চাষিদের সাথে তেভাগা আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক আছে কি?

 

বলতে পারেন এইসব ‘ছোটখাটো’ ভুলে গানের বড় কোনও ক্ষতি হয় না। এসব নিশ্চয়ই তাদের ইচ্ছাকৃত কোনও ভুল নয়। তারা যে সকল উৎস থেকে কথা সংগ্রহ করেছে, সেখানেই হয়তো সমস্যাগুলো ছিল। কিন্তু ঐ যে বললাম, বিশাল বাজেটের কাজে এই খুঁতগুলো থাকবে কেন? থাকবে এই কারণে যে, তাদের মূল মনোযোগ ফিউশনে, মিউজিকের তেলেসমাতিতে, পোশাকের রঙ বাহারে!

 

তারপর ‘হেই সামালো’র অর্ধেক গানের মাঝখানে ঢোকানো হলো ‘ওরা আমার মুখের কথা’, কেন? এই দুইটা গানকে ম্যাশ-আপ করা যায়? ‘হেই সামালো’ সাম্যবাদের মতাদর্শে রচিত গান, যেখানে বলা হচ্ছে লাঙল যার জমি তার। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান নতুন করে জাতীয়তাবাদের রাস্তায় হাঁটা শুরু করেছে, তারই এক পর্যায় আমাদের ভাষা আন্দোলন, যার প্রেক্ষাপটে আবদুল লতিফের ‘ওরা আমার মুখের কথা’ গানটির সৃষ্টি। সাম্যবাদী মতাদর্শের সাথে জাতীয়তাবাদের ব্লেন্ড যে বা যারা করতে চান করেন, তা নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। কিন্তু সলিল চৌধুরী তো তা করতে চাননি। আমাদের কি এখতিয়ার আছে তাঁর মতাদর্শিক গানকে এভাবে জগাখিচুড়ির ডেকচিতে রান্না করার? সুসম্পূর্ণ একটা গান একটা সুসম্পূর্ণ ভাব এবং চিন্তাকে প্রকাশ করে। সে জন্য বক্তব্যনির্ভর গানকে এভাবে কাটাছেঁড়া করতে হয় না, করলে সে পরিবেশনায় গানের অন্তর-শক্তি নষ্ট হয়। একটা গান শেষ করে তাঁরা আর একটা গান ধরতে পারতেন। না, তাহলে তো মিউজিকের তেলেসমাতিটা দেখানো হবে না! অর্থাৎ মিউজিকের তেলেসমাতি দেখাতে গিয়ে যদি গানের দর্শন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাতে তাঁদের বিশেষ কিছু আসে যায় না।

 

 

‘হেই সামালো’র অর্ধেক গানের মাঝখানে ঢোকানো হলো ‘ওরা আমার মুখের কথা’, কেন? এই দুইটা গানকে ম্যাশ-আপ করা যায়? ‘হেই সামালো’ সাম্যবাদের মতাদর্শে রচিত গান, যেখানে বলা হচ্ছে লাঙল যার জমি তার। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান নতুন করে জাতীয়তাবাদের রাস্তায় হাঁটা শুরু করেছে, তারই এক পর্যায় আমাদের ভাষা আন্দোলন, যার প্রেক্ষাপটে আবদুল লতিফের ‘ওরা আমার মুখের কথা’ গানটির সৃষ্টি। সাম্যবাদী মতাদর্শের সাথে জাতীয়তাবাদের ব্লেন্ড যে বা যারা করতে চান করেন, তা নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। কিন্তু সলিল চৌধুরী তো তা করতে চাননি।

 

 

ঐ দর্শনটুকুর বিষয়েই তো তাদের সবচাইতে অনাগ্রহ, অস্বস্তি! ‘হেই সামালো’ যারা গাইছেন তাদের জীবনদর্শনের সাথে ‘হেই সামালো’ গানের দর্শনের ছিটেফোঁটা কোনও সম্পর্ক নেই। তাদের কাছে এই গান সলিলের একটি ‘কম্পোজিশন’ ছাড়া আর কিছুই নয়। ফলে তাদের গায়কীতে অনেক ধরনের ফ্যান্টাসি দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, গানের ৪ মিনিট ৬ সেকেন্ড থেকে ৪ মিনিট ৩৬ সেকেন্ড অর্থাৎ ৩০ সেকেন্ডে ধরে বাংলা ঢোলের বোল মুখে মুখে ‘...কুড়া কুড় তা কুড়া কুড়...’ ব্যাপক ফূর্তিতে কোরাসে উচ্চারিত হতে থাকে। অথচ শিল্পীরা বুঝতেই পারছেন না, এরপরপরই তার যে লাইন দুটো গাইবেন তার সাথে তাদের এই মুড যায় কিনা! এইসব ‘তা কুড়া কুড়ের’ পর তারা ধরছেন, ‘মোরা তুলব না ধান পরের গোলায়/ মরব না আর ক্ষুধার জ্বালায় মরব না..।’

 

কোক স্টুডিওর শিল্পীদের আহ্লাদে আটখানা, হাসিখুশি চেহারাগুলো দেখে সত্যিই আপনাদের মনে হবেই, এঁরা কোনও দিন ক্ষুধার জ্বালায় মরবেন না। আচ্ছা গণসংগীতের মাঝখান দিয়ে হঠাৎ এমন আচমকা হৃদয়কাড়া ঢোলের বোল বেজে উঠলে কার গালে টোল খাবে না! এই হচ্ছে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির বা ইন্ডাস্ট্রিগিরির মিউজিক, যা একটা গণসংগীতকেও মিহি মোলায়েম সুরের চাদরে ঢেকে আবেদনহীন করে তুলতে পারে। যদিও পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন শিল্পীকে দেখছিলাম মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ছুঁড়ে ছুঁড়ে বিদ্রোহ, প্রতিবাদ বোঝানোর “চেষ্টায়” লিপ্ত, কিন্তু পেছনের সেই ছায়াপ্রায় সহশিল্পীরা হারিয়ে যান ফূর্তির তীব্রতায়।

 

 

কোক স্টুডিওর শিল্পীদের আহ্লাদে আটখানা, হাসিখুশি চেহারাগুলো দেখে সত্যিই আপনাদের মনে হবেই, এঁরা কোনও দিন ক্ষুধার জ্বালায় মরবেন না। আচ্ছা গণসংগীতের মাঝখান দিয়ে হঠাৎ এমন আচমকা হৃদয়কাড়া ঢোলের বোল বেজে উঠলে কার গালে টোল খাবে না! এই হচ্ছে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির বা ইন্ডাস্ট্রিগিরির মিউজিক, যা একটা গণসংগীতকেও মিহি মোলায়েম সুরের চাদরে ঢেকে আবেদনহীন করে তুলতে পারে। যদিও পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন শিল্পীকে দেখছিলাম মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ছুঁড়ে ছুঁড়ে বিদ্রোহ, প্রতিবাদ বোঝানোর “চেষ্টায়” লিপ্ত, কিন্তু পেছনের সেই ছায়াপ্রায় সহশিল্পীরা হারিয়ে যান ফূর্তির তীব্রতায়।

 

 

এ জন্যই আমরা বলতে চাই, চাইলেই যেকোনো ইন্ডাস্ট্রির শিল্পী মানুষের জীবনের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম থেকে জন্ম নেওয়া কোনও গান মঞ্চে গাইতে পারেন না। কারণ আর্ট কেবল পারফর্মিং এর বিষয় নয়, সামগ্রিক জীবনযাপন পদ্ধতি-দর্শনের বিষয়। যিনি যে শ্রেণির মানুষ, তার আর্ট সেই শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করবে, এটাই স্বাভাবিক।

 

কোক স্টুডিও সেই শ্রেণিরই প্রতিনিধিত্ব করে, যারা এখনকার পাহাড়ের মানুষের ‘মুখের কথা কাইড়া’ নিতেছে প্রতিদিন, যারা এখনও কেড়ে নেয় ক্ষুধার্ত মানুষের ধান। কোক স্টুডিওতে যারা কাজ করেছেন, তাদের অনেকেই আমার পরিচিতজন, অনেকেই আছেন আর্থিকভাবে খুব স্বচ্ছলও নন। ‘ক্ষ্যাপ’ মারতে গেছেন কোকস্টুডিওতে। ইন্ডাস্ট্রি এভাবেই সবকিছু, সবাইকে কিনে ফেলার ক্ষমতা রাখে। কারণ একটা আধিপত্যবাদী সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় সবার পক্ষে সিনা টান টান করে লড়াই করা সম্ভব হয়ে ওঠে না, সবার সেই মতাদর্শিক প্রস্তুতিও থাকে না। কিন্তু, তবুও এতগুলো কথা বলার একটাই কারণ, তরুণ শ্রোতারা যাতে সত্যিকার সংগীতকে চিনতে পারেন, কোক স্টুডিও’র কালচারাল পলিটিক্সের বিষয়ে সজাগ থাকেন। কেবল সুরের মুন্সিয়ানা আর ফিউশন, এক্সপেরিমেন্টের নামে মিউজিকের দেখানেপনা, তেলেসমাতিকে গান বলে না। লিরিকের অন্তর্গত দর্শনের সাথে সুরের, যন্ত্রানুসঙ্গের ভাবের মিলন ঘটলে পরে তাকে আমরা একটা যথার্থ সংগীত বলতে পারি। যে গান আপনার শরীর দোলাবে এবং অবশ্য অবশ্যই চিন্তার দরজাও খোলাবে, তাই হচ্ছে জীবনের গান। আসুন আমরা সেই নতুন জীবনের সংগীত রচনা করি, যারা এরমধ্যে করছেন তাদের গানের শ্রোতা হই। পণ্যায়নের কালচারাল পলিটিক্সের বিপরীতে আমাদের চিন্তার চাতালে বিউপনিবেশায়নের লড়াই গড়ে তুলি, যা আমাদের রুচি, কানকে নতুন করে নির্মাণ করবে।

 

অমল আকাশ

গায়ক, শিল্পী, সংগঠক ও সভাপতি, সমগীত সংস্কৃতি প্রাঙ্গন। 

মেইল: amalsamageet@gmail.com

Your Comment