‘নাম বললে চাকরি থাকবে না’—হালের একটা জনপ্রিয় প্রবচন। ঠিকঠাক মত নাম জপ করতে পারলে অবশ্য সাত খুনও মাফ হবে। কিন্তু এই চাকরির ভয় বা লোভ তো কেবল যারা ‘চাকর’, তাদেরই পাবার কথা। চাকরি করে যারা খান না, তারাও যখন আতঙ্কে ভোগেন, তখন বোঝা যায়, মাসে মাসে বেতন পাওয়া বাদেও আরও বহু রকমের চাকরি সংসারে আছে, এমনকি বেঁচে বর্তে থাকাটাও এই চাকরির মাঝেই পড়ে।
‘নাম বললে চাকরি থাকবে না’—এই প্রবাদে তাই শুধু বেতন পাওয়া চাকরিটার কথা বোঝানো হয় না। রীতিমত ধুকপুক করা জানটারও কথা বোঝায়।
১.
ফলে কবিদের বিপদ বহুমুখী। কবির স্বভাব নাম বলা। কবিদের নিয়ে আছে এক পুরনো আফ্রিকান লোকপ্রবাদ: ‘যতক্ষণ বেঁচে আছো, কথা বলো’। কিন্তু কথা বললে তো সেই বিপদ, প্রায়শই চাকরি কিংবা জান, খোয়াতে হয়। একদিকে জিহ্বার ডগায় কথারা লকলক করছে, অন্যদিকে চাকরি যাবার ভয়, এমন টানাটানিতে মানুষ করে কী? এই নিয়ে একটা পুরনো গল্প।
রোমে তখন সম্রাট অগাস্টাসের কঠোর শাসন, ফলে নিজের গর্দান ঠিকঠাক রেখে পেটের ভেতর যা গুড়গুড় করছে, তা প্রকাশ করতে ওভিদ (৪৩ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ-১৮ খ্রিস্টাব্দ) গ্রিক পুরানের পুরনো একটা গল্পকে নিজের মত করে বানিয়ে নিয়েছিলেন—লেখকের চেতনা আর রাষ্ট্রের হুমকির মাঝেকার দ্বন্দ্বটাকে ফুটিয়ে তুলতে। গল্পটা আরও একবার নতুন করে বলা যাক:
আরাখ্নি নামে এশিয়া মাইনরের এক তাঁতীর মেয়ে নাকি দেবতাদের চেয়ে সুন্দর নঁকশীকাপড় বোনে! আরাখ্নি মুখেরও লাগাম ছিল না, মনের কথা স্পষ্ট করেই বলতো সে। মেয়েটা আবার দাবি করতো কলুষিত মনের দেবতাদের চাইতে আরাখনির শিল্পকর্মে অনেক বেশি সত্য আর সৌন্দর্য আছে।
কথাটা সত্যি বা মিথ্যা হোক, দেবকূল ক্ষুদ্ধ হলেন, তাদের মাঝেও সবচেয়ে বেশি রেগে গেলেন এথেন্সের মানবতার মা-জননী অ্যাথেনা, বিশেষকরে জ্ঞান আর সৌন্দর্যবোধের জন্যই ভক্তকূলে তার দেমাগ। ‘কী, আরাখ্নির এত বড় সাহস!’ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন তিনি, ‘আরাখ্নি যা বলছে তা যদি প্রমাণ করতে পারে, তো এই দেবপ্রভা ত্যাগ করবো, ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে আমজনতার মত থাকবো। আর আরাখ্নি যদি প্রমাণ করতে না পারে, তবে তার রেহাই নেই’।
সতর্ক আরেক দেব-উপদেষ্টা তটস্থ হয়ে বললেন, ‘অমন ভীষণ প্রতিজ্ঞা কখনো করবেন না মা-জননী। ও যদি প্রমাণ করে ফেলে? ‘অ্যাথেনা ফিক করে হেসে বললেন, ‘আরাখ্নির প্রমাণ বিচারকেরা মানলে তো!’
তারপর এক সূচিকর্মের প্রতিযোগিতায় দেবী এথেনা বুনলেন দেবতাদের মহত্ব, কীর্তি, দেবপ্রকল্পে পৃথিবী জুড়ে কতরকম পুষ্টিকর ফসল, চোখ ধাঁধানো জৌলুস আর উন্নয়নের জোয়ার কত বৃদ্ধি পেয়েছে... স্বর্গীয় পটে ঐশ্বরিক সুতোয় অনুপম তুলির মত আঙুলে অ্যাথেনা বুনে গেলেন তার সূচীকর্ম। যেই দেখলো, ধন্য ধন্য করলো।
ওদিকে আরাখ্নি আঁকলো নিতান্ত নৈমত্তিক চিত্র। আঁকলো অপুষ্ট মানুষদের ছবি, আঁকলো দেবতাদের লুণ্ঠনের ছবি, নারীদের অপহরণের দৃশ্য, স্তাবকদের মিথ্যাচার আর ভণ্ডামির ছবি। প্লাবন আর মহামারীর ধাক্কায় বিপর্যস্ত জনপদের ছবি। আঁকলো সাধারণ মানুষকে দেবতারা যা বলে, ঠিক তার বিপরীতটাই যে তারা নিজেরা করে, তার বিবরণ। দেবকূলের গোমস্তা প্রশাসকরা যে মানুষকে নিত্য অমর্যাদা করছে, তা আঁকতেও আরাখ্নি ভুললো না। আর আঁকলো এজলাশে ঘুমিয়ে থাকা বিচারকদের দৃশ্য।
আরাখ্নির বিষয় মানবীয়, উপকরণও মানবিক।
সকলেই বুঝলো কার শিল্পে বেশি সত্যি আছে, সৌন্দর্য আছে। কিন্তু স্বর্গীয় জনপ্রশাসনের এক পরিপত্রে বারণ করা ছিল মানী লোকের মান ভঙ্গ করা যাবে না, কেউ তাই কিছু বললোই না। আর ওদিকে এথেনা? তিনি তো বলেই রেখেছিলেন আরাখ্নির প্রমাণ তিনি মানবেন না! মিথ্যা দম্ভ দেখাবার জন্য তাই আরাখ্নিরই শাস্তি হলো, তাকে ফাঁসিতে ঝুলে মরতে হলো, আর পরজন্মে সে হলো ঊর্ণনাভ— নিজের নাভি থেকে থেকে সুতোর জাল বুনে বুনে সে বিগত-জন্মের অনন্য শিল্প নৈপুন্যের ব্যর্থ স্মৃতিচারণ করতো।
এই হলো গ্রিক পুরাণে মেলা মাকড়সার জন্মকাহিনী, রোমান ওভিদের নিজের করে দেয়া রূপটাকেই আরেকবার এখানে বলা হলো।
আরাখ্নি আর অ্যাথেনার সূচিকর্মের প্রতিযোগিতা। পেছনে দেখা যাচ্ছে আরাখ্নির একটা সূচিকর্ম, যেখানে বর্ণনা করা হয়েছে ইউরোপার ধর্ষিতা হবার কাহিনী। চিত্রকর ডিয়েগো রড্রিগোজ ডি সিলভা ভেলাজকোয়েজ (১৫৯৯-১৬৬০)
ওভিদ এই গল্প বলে অগাস্টাসের কী সমালোচনা করতে চাইছিলেন, তা নিশ্চিত করে জানি না—হয়তো বোঝাতে চাচ্ছিলেন যে, শিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা সূচীশিল্পীকে পরিণত করে নিছক মাকড়শায়, চিন্তাশীল অধ্যাপকরা পরিণত হন পতঙ্গজীবীতে, কবি পরিণত হয় মোসাহেবে। এতে সমাজেরই সামগ্রিক ক্ষতি। হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন প্রাণশক্তিতে ভরপুর আরাখ্নির বদলে তখন মেলে এক নিঃসঙ্গ গোপনশিকারী মাকড়সাকে; প্রতিভার শিল্পকর্মের বদলে সে তখন মেলে ধরে সুবিধার জাল। হয়তো ওভিদ দেখাতে চাইলেন শিল্পীর এই মৃত্যু কিংবা বিকৃতির ফলে আত্মস্বকৃত মোসেহবরা তাদের দুর্বল অকবিতা দিয়ে তখন শোরগোল তোলে। কিন্তু ব্যক্তি, সমাজ আর রাষ্ট্রের ক্ষতিটা যে বোঝাতে চাইছিলেন ওভিদ, তাতে তো কোনো সন্দেহ নাই।
ওভিদ এই গল্প বলে অগাস্টাসের কী সমালোচনা করতে চাইছিলেন, তা নিশ্চিত করে জানি না—হয়তো বোঝাতে চাচ্ছিলেন যে, শিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা সূচীশিল্পীকে পরিণত করে নিছক মাকড়শায়, চিন্তাশীল অধ্যাপকরা পরিণত হন পতঙ্গজীবীতে, কবি পরিণত হয় মোসাহেবে। এতে সমাজেরই সামগ্রিক ক্ষতি। হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন প্রাণশক্তিতে ভরপুর আরাখ্নির বদলে তখন মেলে এক নিঃসঙ্গ গোপনশিকারী মাকড়সাকে; প্রতিভার শিল্পকর্মের বদলে সে তখন মেলে ধরে সুবিধার জাল। হয়তো ওভিদ দেখাতে চাইলেন শিল্পীর এই মৃত্যু কিংবা বিকৃতির ফলে আত্মস্বকৃত মোসেহবরা তাদের দুর্বল অকবিতা দিয়ে তখন শোরগোল তোলে। কিন্তু ব্যক্তি, সমাজ আর রাষ্ট্রের ক্ষতিটা যে বোঝাতে চাইছিলেন ওভিদ, তাতে তো কোনো সন্দেহ নাই।
ওভিদের কপালে খারাপি ছিল, এত কায়দা করে গল্প লিখেও লাভ হলো না। সম্রাট অগাস্টাসের রোষাণলের শিকার হয়ে চাকরিটা কিন্তু হারালেন তিনি—তখনকার দিনে মৃত্যুদণ্ডের পরই যা ছিল দ্বিতীয় প্রধান দণ্ড, সেই বনবাসেই তাকে যেতে হয়েছিল। তবু, দুইদিনের দুনিয়াবি চাকরি হারালেও এত হাজার বছর পরও মানুষের হৃদয়ের চাকরিটা তার পাকাপোক্তই আছে।
২. অগাস্টাসদের শাসনে চাকরি পাকাপোক্ত করার অনেক তরিকা অবশ্য আছে। তার প্রথম শর্ত: মোসাহেব হতে হবে। এই নিয়েও মজার একটা গল্প আছে, এই সংস্করণটা সত্যজিৎ রায় থেকে স্মৃতিচারিত, হোজ্জার এই গল্পটা তিনি কোত্থেকে পেয়েছিলেন জানি না। আমরাও নিজের মত করে আবারও বলছি।
একদিন দুপরে বেগুন ভাজি খেয়ে বাদশাহ নামদার ভারী খুশি, ‘এখন থেকে রোজ বেগুন ভাজি খাবো।’
‘বেগুন ভাজির ওপর কথাই নাই, রোজ পাতে দেয়ার মতই খাবার এটা।’ হোজ্জাও সায় দিলো।
কদিন বেগুন ভাজি খেয়েই একঘেয়েমিতে বাদশাহ অগ্নিশর্মা, ‘দূর করো বেগুন ভাজি, কক্ষণো যেমন আমার পাতে আর না দেখি।’
‘বটেই, মুখপোড়া বেগুন ভাজা! জঘন্য একটা খাবার।’ হোজ্জার তড়িৎ সম্মতি।
বাদশা তো অবাক। ‘তুমিই না সেদিন বললে, বেগুন ভাজির ওপর কথা নাই!’
‘বলেছি বটে, জাঁহাপনা। কিন্তু আমি তো আপনার মোসাহেব, বেগুন ভাজির নই।’ হোজ্জার ঝটপট উত্তর।
রাজার চাকরিতে পাকাপোক্ত থাকতে গেলে জ্ঞানীকেও হতে হবে রাজার মোসাহেব, সত্যের না, এইটুকুই গল্পটার সারমর্ম।
৩. বাদশাহী রাজত্বে তাহলে এমন মোসাহেবদের চাকরি চিরস্থায়ী থাকবে যারা মহারাজ-মহারানীদের কথার সুরে তাল মেলাবার প্রতিভা দেখাতে সক্ষম হবেন, সেই একই বেগুনভাজির নিন্দা কিংবা প্রশংসায় রাতারাতি সুর মেলাতে পারবেন। এই রকম প্রতিভার অভাব আসেপাশে নাই, তারা কর্তার ইচ্ছা অনুযায়ী বেগুনভাজি রূপী বাকস্বাধীনতার, গণতন্ত্রের প্রশংসা বা নিন্দা করতে পারবেন চোখের নিমেষে।
কিন্তু নশ্বর এই জীবনে নশ্বরতর চাকরির লোভে সত্যিকারের মেধা কতক্ষণ আর শুধু প্রশংসা করে যেতে পারে?
ফলে মোসাহেবি যার ধর্ম নয় এমন প্রতিভারা প্রায়ই ‘প্রতিভাবান আবিষ্কার’ করে বসেন। যেমন শওকত ওসমান। আইয়ুব খাঁর কঠোর শাসনে তখন দেশবাসী অস্থির, ওদিকে ফরমান জারি আছে: প্রজারা যে হাসিখুশী আছেন, তাই সর্বদা জপতে হবে লেখককে। শওকত ওসমান ১৯৬২ সালে তাই কল্পিত এক সহপাঠিনীর বাড়িতে বেড়াতে যেয়ে এক জ্ঞানবৃদ্ধের কিতাবখানায় ‘আবিষ্কার’ কিংবা ‘উদ্ভাবন’ করলেন একটা পুরনো পাণ্ডুলিপির হারানো পাতা, সেখানে জানা গেলো আরব্য রজনী আসলে এক হাজার দুই রাত্রির গল্প!
‘জাহাকুল আবদ্: ক্রীতদাসের হাসি’ নামের এই কাহিনী অনুযায়ী খলিফা হারুনর রশীদের তাতারী দাস— দিলখোলা হাসি হাসে, তার অট্টহাস্যের রেশ শুনে খলিফাও আলোড়িত: এত প্রবল ক্ষমতা নিয়েও তিনি যেখানে ঘুমাতেই পারেন না, গোলাম কেন এমন করে হাসতে পারে এই নিশুতি রাতে!
শওকত ওসমানের সেই একহাজার দ্বিতীয় রাত্রির অভিনব গল্পটার পরিণতিতে দেখা গেলো, প্রেয়সীর সান্নিধ্যে রাতের নিস্তবদ্ধতা ভাঙা হাসির অনুরণন তোলা ওই তাতারী অমন পরাক্রমশালী বাদশাহর হুকুমের বশে হাসতে পারেই না, যতই সেই তাতারী ক্রীতদাসকে গোলামি থেকে মুক্তি, ধন-দৌলত কিংবা দাসী-বাদীর লোভ দেখানো হোক না কেন।
শওকত ওসমান এখানে টিটকিরিই মেরেছিলেন আইয়ুব খাঁ-কে, উন্নয়নের বড়াই করে মানুষের কথা বলার অধিকার কেড়ে নিয়েছো, ওদিকে আবার মানুষের হাসিটাকেও হুকুমমতো চাও! মানুষের উন্নতি যদি হতোই তাহলে তাদের জবান বন্ধ করা লাগতো না।
এখানেও কিন্তু এক স্বকৃত হুকুমবরদার মশ্রুর চরিত্রটি এঁকেছেন শওকত ওসমান, তাদের জন্য দুর্দান্ত একটা সংলাপও তিনি তৈরি করেছিলেন: আসসামায়ো তায়তান-- শ্রবণ অর্থ পালন! এই হুকুমবরদার চাকররা বাদশাকে খুশী করতে নিরাপরাধীর জান কবচের মত ভয়াবহ কাজে কিংবা স্রেফ ভাঁড়ামি, কোনো কাজেই বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না।
এখানেও কিন্তু এক স্বকৃত হুকুমবরদার মশ্রুর চরিত্রটি এঁকেছেন শওকত ওসমান, তাদের জন্য দুর্দান্ত একটা সংলাপও তিনি তৈরি করেছিলেন: আসসামায়ো তায়তান-- শ্রবণ অর্থ পালন! এই হুকুমবরদার চাকররা বাদশাকে খুশী করতে নিরাপরাধীর জান কবচের মত ভয়াবহ কাজে কিংবা স্রেফ ভাঁড়ামি, কোনো কাজেই বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না।
শওকত ওসমান সেই আমলে চাকরি হারাবারই ঝুঁকি নিয়েছিলেন, সেই ভয়কে অতিক্রম করেই তিনি লিখতে পেরেছিলেন এই অমর উপন্যাসটি। প্রথম প্রকাশের ৩৪ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে লিখেছিলেন: “জুয়ারীর মত আমি দান ধরেছিলাম। হয় জয়, অথবা সর্বনাশ সুনিশ্চিত। জিতে গিয়েছিলাম শাসক শ্রেণির মূর্খতার জন্যে। একই বছরের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের পুরস্কার পায় ‘ক্রীতদাসের হাসি’।”
আমার বিপুল সংশয় আছে, শাসক শ্রেণির নিছক মূর্খতার জন্য তিনি বেঁচে গেছিলেন, নাকি তখনও এইটুকু আড়াল রেখে নাম বলবার স্বাধীনতা ছিল, সে নিয়ে। কিংবা শাসকরা হয়তো আরেকটু বুদ্ধিমান ছিল, সেটার সম্ভাবনাই বেশি। সম্ভবত এই ঘটনায় তারা বুঝতে পেরেছিল, কবিকে চাবুক মারলে তার নালিশের সত্যতাই স্বীকার করা হয়, তাকে ছড়িয়েই দেয়া হয়। বহু মানুষ যেমন অদেখা কবির কবিতাটাকে খুঁজে বের করেছেন সামাজিক গণমাধ্যমে: কী কবিতা লিখে শাস্তি পেলেন কবি, সেটা জানার আগ্রহও তো মানুষের বিপুল!
‘ক্রীতদাসের হাসি’ তবু ওই বছরের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের পুরস্কারের তকমাটি পেলেও আজকের পাঠকের কাছে সেই পুরস্কারের অর্জনটা গৌণ, বরং অমর হয়ে আছে খুন হয়ে যেতে যেতেও তাতারীর সেই সংলাপের চিরকালীন আবেদন: “শোনো হারুনর রশীদ, দিহরাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা সম্ভব, বান্দী কেনা সম্ভব, কিন্তু হাসি কিনতে পারবে না...”
যতবার ওই সংলাপটা পড়ি, মনে হয় ‘হাসি’ শব্দটার রূপকে শওকত ওসমান ওইখানে কবির দৃশ্যকল্প, দার্শনিকের দূরকল্পনা কিংবা ভাবুকের ভাবনাকে বুঝিয়েছেন, সেখানে সৃষ্টির বেদনা ও আর্তি এত প্রবল যে চাকরির থাকার লোভ কিংবা ক্ষমতার পরোয়া সে আর করতে পারে না।
৪. চাকরি থাকা বিষয়ে এই রকম গল্পের কিন্তু অভাব নেই দুনিয়াতে। করোনা ভাইরাস যে চীন দেশ থেকে এসেছে (প্লেগের জন্মও নাকি সেদেশেই) সেই চীনা একটা কাহিনীই শোনা যাক। চীনা রাজমাতা সিশি-র (১৮৩৫-১৯০৮) আমলে একবার নাকি নৌবাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য পাওয়া বরাদ্দের পুরোটা লোপাট হয়ে গিয়েছিল বেইজিং-এ গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ নির্মাণে, ফলে গ্রীষ্মপ্রাসাদে ফূর্তি প্রচুর হলেও নৌযুদ্ধে ঘটলো পুচকে জাপানের কাছে পরাজয়। চীনের একটা বিরাট এলাকা চলে গেলো জাপানের দখলদারিত্বে। জনগণ ক্রুদ্ধ, বিশেষজ্ঞরা ক্ষুদ্ধ, অভিযোগের তীর সম্রাজ্ঞীর প্রিয়জনদের দিকেই।
সম্রাজ্ঞী সিশি রেগেমেগে বললেন, প্রমাণ দিয়ে কেউ যদি আমাকে মানাতে পারে, রাজত্ব ছেড়ে দেবো। আর প্রমাণ দিয়ে বুঝিয়ে দিতে না পারলে কারও চাকরি থাকবে না।
যেন ওভিদেরই ছকে কাটা গল্প। মন্ত্রী বলেন, ‘কী প্রতিজ্ঞা করেন, রানীমা! সর্বনাশ হয়ে যাবে...’
সম্রাজ্ঞী হেসেই খুন, ঠিক যেন এথেনা: আরে মন্ত্রী, ঘাবড়াও কেন? প্রমাণটা আমি মানলে তো...”
সম্রাজ্ঞী সিশি আর দেবী অ্যাথেনার গল্পটার প্রমাণ বিষয়ক অংশটুকু কাকতাল নয়, সমপরিস্থিতির অনিবার্য ফল। এই সব লোকরঞ্জন গল্পের ঐতিহাসিক খুঁটিনাটি সারবত্তা খুঁজতে নেই, বরং যখন গল্পগুলো বানানো হয়, কিংবা যখন গল্পগুলো পুনকথিত হয়, কিংবা গল্পগুলো যখন রুপান্তরিত হয়, সেই সময়ের বাস্তবতার অনুষঙ্গ মিলিয়েই তাদের পাঠ করতে হয়। এমনকি আলগোছেই বহু নতুন উপকরণ আসলে প্রতিবারের কথনের সময়ে গল্পের ভেতর ঢুকে পড়ে।
৫. কবি বিপ্লব ফলাতে চাইলে আবার চাকরি করবে কেন, এই প্রশ্নও কারও কারও কাছ থেকে এসেছে। এই প্রশ্নটা শুনলে মনে হয় যেন দেশটা সম্রাট অগাস্টাসেরই জমিদারি, গণমানুষ যুদ্ধ করে এই দেশটাকে স্বাধীন করেনি। আধুনিক নাগরিকতন্ত্রের সাথে ওই প্রাচীন রাজতন্ত্রের ফারাক তো এইখানে: নাগরিক এইখানে যদি চাকরি করতে যায়, চাকরির সময়টুকুতে চাকরির কাজগুলো তাকে করে যেতে হবে। কিন্তু চাকরির বাইরে তার যে স্বাধীন নাগরিক জীবন, সেইখানে রাষ্ট্র আর হস্তক্ষেপ করবে না। এমনকি রাজতান্ত্রিক জার্মান প্রুশিয়াতে দার্শনিক কান্ট স্বাধীনতা ও এবং আলোকপ্রাপ্তি বলতে বুঝিয়েছিলেন এমন একটা পর্যায়কে যেখানে একজন সৈনিকও নিজের নাগরিক অধিকারের অংশ হিসেবে যুদ্ধ বিষয়ে তার ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারবেন, কিন্তু একইসাথে যোদ্ধা হিসেবে বাহিনীতে নিজ দায়িত্ব পালনেও বাধ্য থাকবেন। এই দার্শনিক পরম সম্ভাবনাকে বাস্তবে যে সমাজ যতখানি কার্যকর করতে পারে, নিজের সমাজের ভেতরে তারা ততটুকু গণতান্ত্রিক। কবি তাই চাকরি করবেন যেখানে সেখানে তিনি প্রতিষ্ঠানের অধীন, কিন্তু তার কবিতার ক্ষেত্রকে রাখতে হবে স্বাধীন। সেইখানে তিনি কারও চাকর না।
সত্যি যে, আইন আছে যে সরকারী চাকরি করতে গেলে আপনাকে ‘অরাজনৈতিক’ হতে হবে। কিন্তু দেখবেন দিব্যি চাকরি করেও নিত্য রাজনৈতিক হচ্ছেন মোসাহেবরা। তাদের লেখাপত্র পড়লে তিনি রাজনীতি করেন না নাগরিকতন্ত্রের চাকরি করেন, বোঝা ভারি মুশকিল। এর জন্য একটা শর্ত মানলেই চলবে: বেগুনভাজির নয়, বাদশাহ নামদারের মোসাহেব হতে হবে, অর্থাৎ বাতাস বুঝে সেই অনুযায়ী রাজনৈতিক হওয়া চলবে। আরেক রকম রাজনৈতিক হতে গেলেই চাকরি নট্।
আরেকদল বলছেন বাস্তবতার কথা, “ভাইরে, রাখো ওই ‘দার্শনিক পরম সম্ভাবনা’। দেশের মাঝে এই তো পরিস্থিতি! এইখানে চাকরি বুঝেই কবিতা লিখতে হবে।”
সমাজের সত্যিকারের সম্পদ হলেন সেই সব মানুষ যারা ভবিষ্যত কল্পনা করেন, সেই কল্পনা অবাস্তব হতে পারে, সৃজনশীলও হতে পারে। মোট কথা কল্পনা যার সম্বল, সে সর্বদা ভাবে “এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে, এই দিনেরে নেবো আমি সেই দিনের কাছে”। যারা বুঝে শুনে দিনক্ষণ বুঝে কবিতা করতে চান, রাজকীর্তণ করতে চান, তাদের কেউ বাধা দিচ্ছে না, কিন্তু যিনি সেই দিনের আশায় লিখছেন, তাকে থামাতে যাওয়াটা অন্যায়। নিজেদের অক্ষমতা দিয়ে পরের ক্ষমতায় বেড়ি বাধতে চাওয়াটা তাদেরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য, যারা এমনকি কল্পনায়ও হতদরিদ্র।
এইখানে একটা কথা বলাই যায়। স্থুল বাস্তবতা বুঝে নিত্যকৃত্য করারা সমাজে তো আছেনই, সমাজের ঘাড়ে চেপে সিন্দাবাদের ভূতের মতই নানান কিছু করেও খাচ্ছেন। কিন্তু সমাজের সত্যিকারের সম্পদ হলেন সেই সব মানুষ যারা ভবিষ্যত কল্পনা করেন, সেই কল্পনা অবাস্তব হতে পারে, সৃজনশীলও হতে পারে। মোট কথা কল্পনা যার সম্বল, সে সর্বদা ভাবে “এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে, এই দিনেরে নেবো আমি সেই দিনের কাছে”। যারা বুঝে শুনে দিনক্ষণ বুঝে কবিতা করতে চান, রাজকীর্তণ করতে চান, তাদের কেউ বাধা দিচ্ছে না, কিন্তু যিনি সেই দিনের আশায় লিখছেন, তাকে থামাতে যাওয়াটা অন্যায়। নিজেদের অক্ষমতা দিয়ে পরের ক্ষমতায় বেড়ি বাধতে চাওয়াটা তাদেরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য, যারা এমনকি কল্পনায়ও হতদরিদ্র।
আরও একটা মর্মান্তিক কথা আজকাল আসছে। একজন যেমন বললেন, কবিতায় অমুক কিংবা তমুক শব্দটার ব্যবহার কুরুচিপূর্ণ। ভাবা যায়, কবিতা বিষয়ক আলাপ দেশে কতটা শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়েছে। কবিতায় ‘হারামজাদা’ শব্দটার ব্যবহারের জন্য কবি রফিক আজাদকে রক্ষীবাহিনীর কার্যালয়ে মুচলেকা দিতে হয়েছে, মাফটাফ চেয়ে তিনি ছাড়াও পেয়েছেন। কিন্তু অন্তত সমকালের কবিকূল এই আলাপ করেননি শব্দটার ব্যবহার কবিতায় বৈধ কি-না!
কবির জন্য শব্দতালিকা ঠিক করে দেয়ার জাতীয় পরিষদ গড়ে তোলাটা মোসাহেবদের এখন সমকালীন দাবি।
তবে শওকত ওসমানের কাহিনীতে আমরা বুঝতে পারি, স্বৈরতন্ত্র খানিকটা চালাক চতুর হলে রূপকার্থে বলা সমালোচনাকে নিজের শরীরে টেনে না আনা। কোনো কবিতা ক্ষমতাবানদের রোষ উদ্রেক করে থাকলেও তাদের দিক থেকে অনেক বুদ্ধিমানের কাজ হয় কবিতাকে উপেক্ষা করা। গল্পে যেমন আমরা পাই, ক্রুদ্ধ তৈমুর লঙকে কবি হাফিজ বলেছেন, কবিরা তো অমনই। আপনি গায়ে না মাখলেই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হবে। রফিক আজাদকে যে মুচলেকা দিতে হয়েছিল রক্ষীবাহিনীর কার্যালয়ে গিয়ে, সেই কাহিনী এখনো শাসকদেরই কলঙ্ক হিসেবেই টিকে আছে। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার কীর্তণে যুক্ত হতে অস্বীকার করায় কিশোর কুমারের গান বেতারে বন্ধ হয়েছিল, প্রেক্ষাগৃহে বন্ধ হয়েছিল তার অভিনীত চলচ্চিত্র। কিন্তু প্রতিবাদের এই কাহিনী ইন্দিরার ভাবমূর্তিতে চিরস্থায়ী আঁচড় টেনেছে, একইসাথে অজস্র শিল্পীর প্রেরণারও উৎস হয়েছে।
৫. চাকরি বিষয়ক গভীরতম দার্শনিক উপলদ্ধির গল্পটি মনে হয় ঈসা নবীর। দিনভর পরিশ্রমে শ্রান্ত, দাদনগ্রস্ত, অনিশ্চয়তায় দগ্ধ রোমান শাসনের উন্নয়নের যাঁতাকলে পিষ্ট সেই দুই জেলের পাশ দিয়ে যাবার সময়ে ঈসা ডাক দিলেন: “ও জেলেভাই, কি মাছ ধরার চাকরি নিলা! আসো আমার সাথে, আমি তোমাদের মানুষ ধরা জেলে বানাবো...”
ঈসা নবীর আপাত সাধারণ গল্পটা কেন ধর্মগ্রন্থে ঠাঁই পেলো? আসলে এখানে আছে গভীর এক অন্তর্দৃষ্টি। চাকরি থেকে চাকরত্ব বা চাকরভাব দূর করতে হলে ‘নাম বললে চাকরি হারাবার’ এই ভয়টাকেই সমাজ থেকে দূর করতে হবে। তখন চাকরিটা দাসত্বের চাইতে অনেক বেশি দায়িত্বের হয়ে ওঠে। সেটা নিশ্চয়ই একদিনে হবার নয়। সে জন্য আপাতত তাই কিছু মানুষকে মাছ ধরার চাকরির মায়া ত্যাগ করে, কখনো প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও মানুষ ধরা জেলের চাকরি নিতেই হবে।
চাকরি থাকুক বা না থাকুক, নাম তাই বলে যেতে থাকতে হবে।
[পাদটীকা: এই নিবন্ধ তৈরির বহু পরেকার ঘটনা। ইঙ্গিতে নাম বলেছেন, এই অপ্রমাণিত অভিযোগে চাকরি গেছে কবি রহমান হেনরির। চাকুরিচ্যুতির কারণ হিসেবে সরকারী প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে “একজন সরকারি কর্মচারী হয়েও সরকারপ্রধানকে ইঙ্গিত করে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় কবিতা প্রকাশ করেছেন, তা তদন্তে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়।”
যদিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সরকার সমর্থক বহু ব্যক্তি দাবি করেছেন দুর্নীতি, মারধর ইত্যাদি কারণে রহমান হেনরির চাকরি গিয়েছে। কিন্তু প্রজ্ঞাপনের যতখানি অন্তত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বোঝা গিয়েছে কোনো কথিত দুর্নীতিকে আমলে নিয়ে সরকার বাহাদুর তাকে চাকরিচ্যুত করেননি। বরং বহু দৃষ্টান্তে আমরা সাম্প্রতিক কালেই দেখেছি, রাত দুপুরে বাড়ি থেকে ধরে এনে সাংবাদিককে পিটিয়ে এবং মাঝরাতেই ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে সেই বেচারা সাংবাদিককে কারাগারে পাঠিয়ে আলোচিত হওয়া জেলা প্রশাসকেরও শাস্তি না হবার মত অজস্র ঘটনা দেশে আছে। বড়বড় দুর্নীতি বাদ দিন, গরিবতম সাহারা বেগমের ছাগল আটকে সেটাকে জরিমানার নামে হজম করার অভিযোগও এই দেশে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আছে, সেটাও প্রতিকারহীন। তাই ধরেই নিচ্ছি মোসাহেবরা সরকারের পৃষ্ঠদেশ বাঁচাবার চিরাচরিত চাকরিই করে গেছেন। সরকার রহমান হেনরির ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রসঙ্গ তোলেনি, কিন্তু ভাবমূর্তি রক্ষার সৈনিক মোসাহেবরা তাই নিজেরাই উপযাচক হয়ে দুর্নীতি ইত্যাদি অন্য অপরাধের প্রসঙ্গ এনেছেন।
দুর্নীতি ও জনগনের ওপর বহু দৃশ্যমান এবং প্রমাণিত অভিযোগের বেলাতে সরকার কেন প্রশাসনের লোকদের শাস্তি দেয় না, সেই প্রশ্ন নিয়ে এই মোসাহেব বুদ্ধিজীবীদের ভাবায় আগ্রহ নাই। বরং বিষয়টা এই্ রাজত্বে এমন না যে আজকে এই দুর্নীতিবাজকে ধরা হয়েছে, কাল বাকিদেরও ধরা হবে। দুর্নীতির বেলাতেও তাই বিষয়টা বরং এই রকম: তুমি যদি আমার পোষা দুর্নীতিবাজ হও, তাহলে লুটেপুটে খাও। কিন্তু খবরদার, কুনজরে পড়লে পিঠ সামলাও।
অর্থাৎ, নাম বলে চাকরি হারাবার দেশে গরিবের ছাগল চুরি করলেও আমলার চাকরি যায় না, কিন্তু ইঙ্গিত রেখে কবিতা লিখলেও চাকরি যেতে পারে।
ব্যক্তিগতভাবে আমার মত, ব্যক্তিগত স্তরে সরকারি চাকুরের মত প্রকাশের অধিকার থাকাটা জরুরি, সেটা যে মাত্রায় থাকে সেই মাত্রায় তা সমাজের গণতান্ত্রিকতার প্রতিফলন। তিনি আইনের সীমার মাঝে থাকবেন এবং অপরাধমূলক বা কারো প্রতি হিংসাত্মক কিছু করবেন না, এইটুকু শর্ত তো যে কোন নাগরিকের মত প্রকাশের জন্যই প্রযোজ্য। অন্যদিকে তার ব্যক্তিগত মতামত যাই থাকুক, তার দায়িত্বের জায়গাতে পক্ষপাতের প্রকাশ যেন সেই মতামতে না থাকে। কেননা চাকুরে হিসেবেই তিনি নিরপেক্ষভাবে তার নিজের দায়িত্ব পালন করে যাবেন, সেটা তার কাজের শর্ত।]
ফিরোজ আহমেদ
লেখক ও গবেষক