শুক্রবার ১৪ই চৈত্র ১৪৩০ Friday 29th March 2024

শুক্রবার ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

Friday 29th March 2024

সংস্কৃতি আয়োজন

ট্রাঙ্ক কল: ধূসর পৃথিবীর তরে হরিৎ পাণ্ডুলিপি

২০২২-০৬-২০

অলিউর সান

আমার প্রাণে পুষ্পের আঘ্রাণ লেগেছে, জীবনের একেবারে মধ্যবিন্দুতে বৃক্ষজীবনের চলা অচলার ছন্দদোলা গভীরভাবে বেজেছে … সকলে আমার মধ্যে আছে, আমি সকলের মধ্যে রয়েছি।

আহমদ ছফা

 

 

‘শেষ যাত্রা’, নরসিংদী, ঢাকা। আলোকচিত্রী: হাবিবুল হক  

 

 

তখনো ঢাকার বাতাসে ধুলা আর সীসার পরিমাণ ফুসফুসের কার্যক্ষমতাকে ছাপিয়ে যায়নি। গুল্মশোভিত জলাভূমি আর বৃক্ষরাজিকে পুরোপুরি গ্রাস করেনি ভূমিদস্যুদের কোম্পানি কিংবা দালানি উন্নয়ন। তবে বিক্ষুব্ধ অধিকার সচেতন জনতার বুকে পিঠে বহাল তবিয়তেই আঘাত করেছে স্বৈরাচারের গুলি আর পুলিশের লাঠি। তেমনই এক সম্ভাবনাময় সময়ে জ্ঞান ও জীবিকার সন্ধানে রুপসা ছেড়ে বুড়িগঙ্গার পাড়ে পাড়ি জমান তরুণ হাবিবুল হক। আশির দশকের মাঝামাঝি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন চলাকালীন সময়ে জীবন, রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতাকে তিনি আলোকচিত্রে উপস্থাপন করতে শুরু করেন। পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে তার দীর্ঘ কর্মজীবনের প্রথম একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ট্রাঙ্ক কল

 

ঢাকায় পান্থপথে অবস্থিত দৃক গ্যালারিতে ৫ই জুন হতে ১৭ই জুন পর্যন্ত দৃক পিকচার লাইব্রেরির উদ্যোগে প্রদর্শনীটি আয়োজিত হয়। প্রদর্শনীটির একটি ভার্চুয়াল সংস্করণ অচিরেই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। নব্বই দশক পর্যন্ত দূরদূরান্তে টেলিফোনে যোগাযোগ করার পদ্ধতি হিসেবে দীর্ঘদিন প্রচলিত ছিলো ট্রাঙ্ক কল। ট্রাঙ্ক কলের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে একজন অপারেটরের মাধ্যমে দূরবর্তী কাঙ্ক্ষিত নম্বরে যোগাযোগ করা যেতো। যোগাযোগ মাধ্যমের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলে দৈনন্দিন জীবন থেকে এই শব্দ ও প্রযুক্তিটি যেমন বিদায় নিয়েছে, তেমনি নগরজীবনে বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে ট্রাঙ্ক(গাছের কাণ্ড) নিজেই।

 

 

‘জঠর জ্বলে জুম পাহাড়ে’, লামা, বান্দরবন। আলোকচিত্রী: হাবিবুল হক 

 

তবে বৃক্ষের এই বিদায় প্রাকৃতিক এবং সর্বজনীন নয়। নগরীর ধনী অঞ্চলে এখনও বৃক্ষশোভিত উদ্যানের দেখা মেলে। ডিওএইচএস, বারিধারা, ধানমন্ডি কিংবা গুলশানের বৃক্ষবেষ্টিত প্রমোদ কুঠিরসমূহ দেখলে বিপন্ন বনাঞ্চল সংক্রান্ত পরিসংখ্যানকে ভুল মনে হতেই পারে। তবে কড়াইল কিংবা কল্যাণপুর বস্তিতে গেলে ঘনবদ্ধ টিনের ঝলকে মুহূর্তেই এই ভ্রান্তি কেটে যাবে।

 

 

তবে বৃক্ষের এই বিদায় প্রাকৃতিক এবং সর্বজনীন নয়। নগরীর ধনী অঞ্চলে এখনও বৃক্ষশোভিত উদ্যানের দেখা মেলে। ডিওএইচএস, বারিধারা, ধানমন্ডি কিংবা গুলশানের বৃক্ষবেষ্টিত প্রমোদ কুঠিরসমূহ দেখলে বিপন্ন বনাঞ্চল সংক্রান্ত পরিসংখ্যানকে ভুল মনে হতেই পারে। তবে কড়াইল কিংবা কল্যাণপুর বস্তিতে গেলে ঘনবদ্ধ টিনের ঝলকে মুহূর্তেই এই ভ্রান্তি কেটে যাবে। ট্রাঙ্ক কলে প্রদর্শিত আলোকচিত্রগুলোতে যদিও বৃক্ষের এই সামাজিক ও শ্রেণীগত বন্টন প্রত্যক্ষভাবে অনুপস্থিত, তবুও বিভিন্ন আলো ও আয়তনে উদ্ভিদের রুপবিন্যাস আমাদের মননে বৃক্ষচিন্তার শেকড় বুনে দেয়। কংক্রিটের আবরণে মোড়া শহরে টব ছাড়া যেখানে গাছের শেকড় পোঁতার জায়গা নেই, সেখানে এই ছবিগুলোই বৃক্ষের বীজ হয়ে আমাদের ভেতর প্রোথিত হয়। আমরা আঁচ করতে পারি মানুষ ও বৃক্ষের অবিচ্ছেদ্যতা।

 

 

মুক্তির ডাক, প্রহেলিকা সিরিজ কিংবা পেচক – হাবিবুল হকের দৃশ্যায়নের ফলে কান্ডের বাহ্যিক ও ভেতরের বহুরূপের ধাঁধা বারবার অ্যাপোফেনিয়াকে উসকে দিয়ে আমাদেরকে ধাবিত করে এপিফ্যানির লক্ষ্যে। দৃক গ্যালারির সফেদ ঘনকের অভ্যন্তরে দর্শকের সেই বোধোদয়ের মুহূর্তকে ভাষা দান করে এমারসনের আরণ্যক উপলব্ধি-

 

এই নগ্ন জমিনে দাঁড়িয়ে প্রফুল্ল বাতাসে মাথা তুলে আমি অবগাহন করি অনন্তে – আমার সকল অহংবোধ মুছে যায়। আমি হয়ে উঠি এক স্বচ্ছ চোখ – শূন্য; সর্বযামী; আমার ভেতর ঢেউ খেলে ব্রহ্ম তরঙ্গ।

 

ট্রাঙ্ক কলে হাবিবুল হকের স্বচ্ছ চোখের দেখা দর্শককে দেখিয়ে দেয় যা যা দেখানো যায়নি দেয়ালবদ্ধ এক প্রদর্শনী কক্ষে। যে অদৃশ্য ক্ষমতা ও চিন্তা প্রতিনিয়ত চর্চায় প্রাণ-প্রকৃতিকে ধবংস করে চলেছে, উন্নয়নের নামে ইট-কংক্রিটের অব্যবহারযোগ্য আবর্জনা তৈরি করে চলেছে, যে অদৃশ্য বাজার সংস্কৃতি এবং ভোগবাদিতা একের পর এক বন-নদী-পাহাড় গ্রাস করে চলেছে – হাবিবুল হক তার বৃক্ষনির্ভর দৃষ্টি দিয়ে সেই অদৃশ্যকে তাক করেছেন।

 

 

ট্রাঙ্ক কলে হাবিবুল হকের স্বচ্ছ চোখের দেখা দর্শককে দেখিয়ে দেয় যা যা দেখানো যায়নি দেয়ালবদ্ধ এক প্রদর্শনী কক্ষে। যে অদৃশ্য ক্ষমতা ও চিন্তা প্রতিনিয়ত চর্চায় প্রাণ-প্রকৃতিকে ধবংস করে চলেছে, উন্নয়নের নামে ইট-কংক্রিটের অব্যবহারযোগ্য আবর্জনা তৈরি করে চলেছে, যে অদৃশ্য বাজার সংস্কৃতি এবং ভোগবাদিতা একের পর এক বন-নদী-পাহাড় গ্রাস করে চলেছে – হাবিবুল হক তার বৃক্ষনির্ভর দৃষ্টি দিয়ে সেই অদৃশ্যকে তাক করেছেন। ঝাঁ চকচকে ছায়াহীন পার্কের চেয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাড়ন্ত বন যে বহুগুণ শোভন এবং উপকারী কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের রাবার আর সেগুন গাছের হাজার হাজার একরের বন যে আদতে বন নয়, বরং কষ এবং কাষ্ঠ কারখানা সেই উপলব্ধির পথে হাঁটতে নিশানা দেখাতে পারে ট্রাঙ্ক কল

 

গাছটি চলে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে ভিড় করেছে পাখির দল। পাখিদের সাথে আলোকচিত্রী হাবিবুল হকও বলছেন 'বিদায় বন্ধু'। বুয়েট, ঢাকা।

 

ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া রুপে জন্ম নেওয়া ভাববিলাসী চেতনা কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের তুরীয় দর্শনের তরঙ্গ হাবিবুল হকের চোখে বন্দি আলোকমালায় বারবার ধরা দেয়। মানবচোখ বৃক্ষকে কীভাবে দেখে ও দেখতে পারে ট্রাঙ্ক কল সে সম্পর্কিত বৃক্ষকুলবিদ্যা রচনা করে। হাবিবুল হকের প্রগতিশীল রাজনীতি ও উদীচীর সাথে যুক্ততা এই রচনাকে প্রভাবিত করেছে। ফলে তার বৃক্ষ আলোকচিত্রায়নে প্রগতিশীল মহলে প্রচলিত প্রকৃতি সম্পর্কিত রোমান্টিকতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

 


দুই হাজার বাইশ সালে এসেও সর্বগ্রাসী শিল্পায়ন, নগরায়ন, জিডিপি, উন্নয়ন আরও নানান চটকদার নাম ও কর্মের চাপে মানুষ ও প্রকৃতিকে নিয়ে সেই আঠারো শতকের ইউরোপীয় রোমান্টিকতায় নিমগ্ন হওয়ার ভাব ও ভূ-রাজনীতি আমাদের দুইশত বছরের উপনিবেশিক শাসনের কথাই মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু আলোকচিত্রের রোমান্টিকতাকে প্রদর্শনীর সজ্জায়ন নিছকই ভাবালুতায় পর্যবসিত হতে দেয় না। বরং পাখির নিবাস উজাড় হয়ে যাওয়া, কেটে ফেলা গাছ, আবার বৃক্ষকে বাঁচাতে মানুষেরই বানিয়ে দেওয়া খুঁটির ছবিগুলো আমাদের পরিবেশ রাজনীতি নির্ধারণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। ট্রাঙ্ক কল প্রদর্শনীটির মাধ্যমে ট্রাঙ্কিং অপারেটরের মতোই আলোকচিত্রী হাবিবুল হক আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন হরিতের বার্তা। 

 

 

আকাশকে নিরালম্ব ক’রে দিয়ে বোমারু বিমান

উড়ে যায়—পুনরায় প্রাণসাগরের শত ভাষা

মর্মরিত হয়ে ওঠে;—কোন্ কথা বলে দূর নীল?

আর এই হরিতের কি মহাজিজ্ঞাসা।

জীবনানন্দ দাশ

 


অলিউর সান
মূখ্য শব্দকার, দৃক পিকচার লাইব্রেরি

Your Comment