শুক্রবার ১৫ই চৈত্র ১৪৩০ Friday 29th March 2024

শুক্রবার ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

Friday 29th March 2024

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

স্বরলিকার না দেওয়া সাক্ষাৎকার: যাও তো এলা তোমরা!

২০২২-০৯-২৭

নাহিদ হাসান

[এবারের সাফজয়ী ফুটবল দলে ছিলেন না স্বরলিকা পারভীন, অথচ মাত্র ৪ বছর আগে স্বরলিকার হাতে দেশসেরা ফুটবলারের পুরষ্কার হাতে তুলে দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সদ্য ভারত-বাংলাদেশ বিলুপ্ত ছিটমহলের বাংলাদেশীদের কাছে পাওয়া প্রথম উপহার হচ্ছে, স্বরলিকা পারভীন। খেলার মাঠ থেকে স্বরলিকা পারভীনরা কোথায় হারায়, কিভাবে হারায়, সেই গল্পের সন্ধানে তার বাড়িতে গিয়েছিলেন নাহিদ হাসান।]
 

ট্রফি হাতে স্বরলিকা পারভীন

 


আবার ভূরুঙ্গামারী। ভাঙা পা নিয়ে ১১.৩০ টায় ভূরুঙ্গামারীতে যখন পৌঁছুই তখন সেখানে বৃষ্টি। ডেকে নেই জাকিরকে, ওর ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও নেবো বলে। বৃষ্টি, গ্রামের বৃষ্টি। অপ্রশস্ত সড়ক, প্রাচীন সকল গাছ যেন আকাশ ঘিরে রেখেছে। জাকিরসহ ওর বাড়িতে ভিজে পৌঁছুতে বেলা সাড় বারোটা। যাচ্ছি এই সেদিন, ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দেশসেরার পুরস্কার নেয়া হ্যাট্রিককন্যা স্বরলিকার বাড়ী। কয়দিন আগে এসে ওর দেখা পাইনি। ফোনে কান্নার আওয়াজ পেয়েছি, ফুঁপিয়ে কাঁদছিল স্বরলিকা। স্বরলিকার সেই আবেগের প্রকাশের ওপর ভরসা রেখে আজ আবার ভাগ্য সম্বল করে যাচ্ছি সাক্ষাতকার নিতে, যদি পেয়ে যাই!

অটো রিক্সায় বাশঁজানি স্কুল পার হয়ে গেছি স্বরলিকার বাড়ী। নেমে একজনকে স্বরলিকার বাড়ীর কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন "সামনেই বাড়ী তবে ও ত বাড়ীতে নেই, এসএসএসি পরিক্ষা দিতে গেছে। তখন বাজে দুপুর ১টা। আর বাড়িতে না ঢুঁকে বাঁশজানি বাজারে গেলাম। কখন পরীক্ষা শেষ হবে?


কখন দুইটা বাজবে! অপেক্ষার পালা যেন ফুরায় না। পরীক্ষার হল থেকে আসতেও তো সময় লাগবে। তাই আড়াইটার দিকে চলে গেলাম স্বরলিকাদের বাড়ি।
বাড়ি বলতে একটা টিনের ঘরে ৩টা কক্ষ। একটা ভাঙা রান্না ঘর আর একটা গোয়ালঘর।

ক্যামেরার ব্যাগ অটোতে রাখলাম। ফটোগ্রাফার অনুজ জাকিরকে বললাম, যা অনুমতি নিয়ে আয় আগে। বাড়িতে ঢুকতেই এগিয়ে আসেন স্বরলিকার মা। পরিচয় পর্ব শেষে বাড়ির উঠোনের এক পাশে বেঞ্চে বসতে দিলেন আমাদের। দেখলাম বাবা শহীদুল ইসলাম গোসল করছেন কলতলায়। আর দরজার আড়ালে সন্তানসহ স্বরলিকা পারভীন। বুঝতে বাকী রইলো না আমাদের দেখেই আড়ালে যাওয়ার ইশারা করা হয়েছে স্বরলিকাকে। ওর বাবার কাছে অনুমতি প্রার্থনা করি সাক্ষাতকার নেওয়ার। উনি সম্মত হলেন না। পরে ওর মাকে বলি এবং বুঝানোর চেষ্টা করি। বলি, সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলে স্বরলিকার প্রতি দেশবাসীর দৃষ্টি আবারও আকৃষ্ট হবে। হয়তো ওকে পুরষ্কার দেওয়া হবে। কিন্তু না, উনারা রাজি হলেন না।

 

 

কোথাও থেকে কোন টাকা না দিলো নাই, যদি প্রতি মাসে একবার করে হলেও কেউ খোঁজ নিত, তাহলেও এই পরিস্থিতি হত না স্বরলিকার

 


তবে চাপা ক্ষোভ বাবা আর মায়ের কথায় কথায় বেরিয়ে আসলো। কলতলা থেকেই ওর বাবা বললেন, "কোথাও থেকে কোন টাকা না দিলো নাই, যদি প্রতি মাসে একবার করে হলেও কেউ খোঁজ নিত, তাহলেও এই পরিস্থিতি হত না স্বরলিকার। যখন খেলা আসে তখন খোঁজ হয়, আর সারা বছর কেউ খোঁজ নেয় না।
 

 

"কোথাও থেকে কোন টাকা না দিলো নাই, যদি প্রতি মাসে একবার করে হলেও কেউ খোঁজ নিত, তাহলেও এই পরিস্থিতি হত না স্বরলিকার। যখন খেলা আসে তখন খোঁজ হয়, আর সারা বছর কেউ খোঁজ নেয় না।



আধাঘন্টা পার হলো। একবারের জন্যও স্বরলিকা বের হল না। বাবা-মার এক কথা, বিয়ে হয়েছে এখন আর ওর পক্ষে খেলাও সম্ভব না। আর সাক্ষাৎকার দেওয়াও সম্ভব না।
 


২.
স্বরলিকার বাবার নামটা তবু জানা গেলো, মায়ের নামটা জিজ্ঞেস করবারই সাহস পাইনি। নিজে থেকে গজড়াতে গজড়াতে বলছিলেন, “ছাওয়ার মুখোত দুইটা ভাত তুলি দিবের পাই নাই। যে ছাওয়ারা বিমানত চড়ি বিদ্যাশ গেলো, জিতি আসিল; মোর বেটিটাও তো গেইল হয়৷ বাপ পায় না ভাত, তার বেটি বিমানত চড়িল হয়! কার না হাউস হয়?” কাঁদছিলেন তিনি, উঠোন ঝাঁট দিচ্ছিলেন আর আমাদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন, ঢাকা থাকি আসার পর প্রত্যেক মাসে যদি একবার করি কাইও আসি খোঁজ নিলে হয়, তাইলে বেটিক কি আর সাগরত ফেলে দেই? যাও তো তোমরা। হামরা গরীব মানুষ। হামাক সংসার করি খাবার দেও।

 

 

কাঁদছিলেন তিনি, উঠোন ঝাঁট দিচ্ছিলেন আর আমাদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন, ঢাকা থাকি আসার পর প্রত্যেক মাসে যদি একবার করি কাইও আসি খোঁজ নিলে হয়, তাইলে বেটিক কি আর সাগরত ফেলে দেই? যাও তো তোমরা। হামরা গরীব মানুষ। হামাক সংসার করি খাবার দেও।

 


কতোজন কত কথা কইছে। শুনি নাই। বেটিক খেলবার দিছনু। কী হৈল, শেষে ওই চুলায় ঠেলা নাগিল। সগাইরে আলগা পীড়িত। যাও তো তোমরা।

 

স্বরলিকর সাথে একবার দেখা করবার জন্য মতই মিনতি করি, স্বরলিকার মা বলেন, এখন বিয়ে হৈছে, সাক্ষাৎকার নিয়ে আর কি হবে? তার থেকে সংসারটা করছে করুক শান্তিতে থাক। যখন খেলেছে, বাড়ীতে আসছে ঢাকা থেকে, তখন কয়েকদিন সাংবাদিকরা আসছে, নিউজ হইছে। তখনও অনেকে কৈছে টাকা পাইবে,  এটা পাইবে ওটা পাইবে কিন্তু কিছুই পাইনি। 
 

 

এখন বিয়ে হৈছে, সাক্ষাৎকার নিয়ে আর কি হবে? তার থেকে সংসারটা করছে করুক শান্তিতে থাক। যখন খেলেছে, বাড়ীতে আসছে ঢাকা থেকে, তখন কয়েকদিন সাংবাদিকরা আসছে, নিউজ হইছে। তখনও অনেকে কৈছে টাকা পাইবে,  এটা পাইবে ওটা পাইবে কিন্তু কিছুই পাইনি।

 


ইতিমধ্যে স্বরলিকার বাপ শহিদুল ইসলাম গা মুছে এসেছেন। তিনি এসে একটা পিড়া নিয়ে মাটিতে বসলেন। গো স্বরলিকার মাও, হউক তার, এমাক পান দেও তার। এতক্ষণে হুঁশে ফেরেন স্বরলিকার মা। চিনা মাটির পিরিচে দুই টুকরা সুপারিসহ গাছের পান দেন। বোঝা গেল, ঘরের ভেতর কেউ একজন পান প্রস্তুত করে অপেক্ষায় ছিলেন। ঘনিষ্ঠতা একটু বাড়াবার আশায় আমরা পান খাই। তিনি ঢোঁক গিলে বলতে শুরু করেন, ভাই বেটি এলা মাইনষের ঘরোত গেইছে। জামাই খেলার শুনলে মেজাজ খারাপ করে। মাইনষের বেটা। এলা কপালত যা আছে তাই হৈবে।

আমরা ভাবছি, সানজিদা আক্তার, মারিয়া মান্দা, রূপনা চাকমা, কৃষ্ণা ও স্বপ্নার পাশে আরেকটি নাম স্বরলিকা পারভীনও জ্বলজ্বল করতে পারতো। তখন কত বিজ্ঞাপনি বাহিনী অভিনন্দন জানাতে আসত। তখনও কি দেবব্রত সিংহের 'তেজ' কবিতার মত স্বরলিকাও বলত, আমি জামবনির কুঁইরিপাড়ার/ শিবু কুঁইরির বিটি সাঁজলি। তখনও নিশ্চয়ই, কাগজওলারা, টিভিওলারা, মেম্বার, চেয়ারম্যান এমএলএ, এমপিরা বলত, তুমি কী করি কামলা দিয়া হেট্রিক করলু গো মাইয়া? সেও কি তখন স্বপন দেখত? আর কথাগুলো শুনে কেঁদে ভাসাত শহিদুল ইসলামের বেটি স্বরলিকা পারভীন! তার মত মেয়েরা যদি উঠে আসে, তাহলে গোটা দেশটাই উঠে আসে। তাই বললাম, বেটিকে তো এখনও পড়াচ্ছেন। জামাই বা শ্বশুড়বাড়ির লোকেরা কিছু কয় না? এই দম কই পাইলেন?


তিনি বললেন, গার্মেন্টস করি খাবার গেইলেও তো পড়া খাইবে। তার নিজের ছাওয়াকো পড়া খাইবে। ওই জইন্যে পড়ে। গরীব মানুষ। প্রাইভেট মাস্টার দিবের পাইনে। ভাতের অভাবে বেটিক বিয়া দিছি, করোনায় দ্যাশ অচল। স্কুল-কলেজ খুইলবে কিনা ঠিক নাই। কী করব? কাইও তো খবর নেয় নাই!

তারপর তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কোথাও যাবেন এমনভাব করলেন। ত্রস্ত হয়ে বলে উঠলেন, এলা তো বিয়ে হৈছে সাক্ষাৎকার নিয়ে কী হৈবে! তোমরা আরও কি কিছু কইবেন?

আশা দেখালাম. কাগজে সাক্ষাতকার ছাপা হলে সরকার হয়তো পুরষ্কার দিবে। -এই কথা শুনে সাপের মতো ফোঁশ করে করে উঠলেন, “যাও তো এলা তোমরা। কুটি টেকা দিলেও মোর বেটিক মুই আও কইরবের দিবের নং।“ এরপর সরবে  চিৎকার দিয়ে উঠলেন স্বরলিকা পারভীনের বাবা: “যাও তো তোমরা, যাও!”

এরই মধ্যে দরোজার ওপাশে একটি শিশুর কান্নার শব্দ শুনলাম। স্বরলিকার বদলে কি তার সন্তান কেঁদে উঠল? নাকি, দরোজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দুঃখিনি বাংলাদেশই কেঁদে উঠল?

 


নাহিদ হাসান

লেখক ও সংগঠক
nahidknowledge@gmail.com

Your Comment