ঔপনিবেশিক শাসনামলে প্রযুক্তিকে শুধুমাত্র পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া ও বিনিময় যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়নি, বরং একে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে ক্ষমতা সম্পর্কের যন্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে। প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে উপনিবেশিত অঞ্চলের ভৌগোলিক এবং মৌলিক পরিবেশের আমূল পরির্বতন ঘটে। প্রাযুক্তিক জ্ঞানকে সর্বজনীন হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশের ওপর প্রয়োগ করা হলেও সবসময়ই অঞ্চলভেদে পরিবেশ, জলবায়ু, বাস্তুসংস্থানের পরিস্থিতি ভিন্ন হয়। ঔপনিবেশিক প্রযুক্তির উন্নয়নকেন্দ্রিক হস্তক্ষেপের উপজাত হচ্ছে বাস্তুসংস্থানের অবক্ষয়। প্রাযুক্তিক হস্তক্ষেপের এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা সবসময়ই বাস্তুসংস্থানের মিথোজীবী সম্পর্কের ক্ষেত্রে সহিংস ভূমিকা পালন করে। ব-দ্বীপ অঞ্চলের বাস্তুসংস্থানের উপর প্রযুক্তির যে হস্তক্ষেপ তা ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতার সম্প্রসারিত রূপ।
ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে যোগাযোগ প্রযুক্তি ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তুসংস্থানের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রযুক্তিকে স্থানীয় বাস্তুসংস্থান বিবেচনায় গ্রহণ ও প্রয়োগ না করার কারণে এর দীর্ঘমেয়াদি জটিল ফলাফল এখনেও বর্তমান। বিশেষত রেলপথের মতো যোগাযোগ প্রযুক্তিকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বাস্তুসংস্থানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ ভারতে রেলপথের দ্রুত বিস্তার ঘটে। ফলস্বরূপ, ভারত ব্রিটিশ উপনিবেশিত দেশগুলোর মধ্যে রেল যোগাযোগ উন্নয়নের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের ফলে ব্রিটিশ শাসকরা নতুন কোনো বিপ্লবের সম্ভাবনাময় পরিস্থিতিকে রহিত করার জন্য তাদের শাসনকৌশল পরিবর্তন করে। জনসাধারণের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব সংগ্রহের পরিবর্তে তারা ব্রিটিশ ভারতের বাণিজ্য সম্পর্কের দিকে বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেছিল।
রেলপথ স্থাপনকালে তার নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে তখন একধরনের আলাপ দেখা যায়। তৎকালীন বাংলায় জনস্বাস্থ্যের পরিচালক সি.এ. বেন্টলি যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, এ অঞ্চলে রেলপথ স্থাপনের প্রভাবে যে পরিবেশগত অবনতি ঘটবে তা ম্যালেরিয়ার মতো বিভিন্ন অসুস্থতা বৃদ্ধি করবে। এছাড়া এটি নদী ও কৃষি ব্যবস্থায় নেতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসবে। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকরা প্রকৃতিকে যথাযথভাবে পরিচালনা করে অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনের ব্যাপারে তাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত সাফল্যের ব্যাপারে ব্যাপকভাবে আস্থাশীল ছিলেন
তারা ব্যক্তিগত ব্রিটিশ বিনিয়োগ এবং বিদেশে পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে ভারতে পুঁজি বিকাশে আগ্রহী হয়ে ওঠে। যার ফলে পরিবহন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আধুনিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল রেলপথের সাথে ভারতের উন্নয়নের বিষয়কে তখন খুবই গুরুত্বের সাথে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। অর্থনৈতিক গুরুত্বকে উপস্থাপনের মাধ্যমে গভর্নর-জেনারেল ডালহৌসি ভারতে প্রথম রেলপথ স্থাপন করেন। এর আগে তিনি বাণিজ্য বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য ভারতে রেলপথ স্থাপন করা প্রয়োজন। একইসাথে ব্রিটিশ শিল্প ও বাণিজ্য কোম্পানিগুলো ভারতবর্ষে রেলপথ স্থাপনের জন্য লবিং শুরু করে। সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় অধীনে না থেকে এসব প্রাইভেট কোম্পানির বিনিয়োগের মাধ্যমে রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। রেলপথ স্থাপনকালে তার নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে তখন একধরনের আলাপ দেখা যায়। তৎকালীন বাংলায় জনস্বাস্থ্যের পরিচালক সি.এ. বেন্টলি যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, এ অঞ্চলে রেলপথ স্থাপনের প্রভাবে যে পরিবেশগত অবনতি ঘটবে তা ম্যালেরিয়ার মতো বিভিন্ন অসুস্থতা বৃদ্ধি করবে। এছাড়া এটি নদী ও কৃষি ব্যবস্থায় নেতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসবে। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকরা প্রকৃতিকে যথাযথভাবে পরিচালনা করে অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনের ব্যাপারে তাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত সাফল্যের ব্যাপারে ব্যাপকভাবে আস্থাশীল ছিলেন। তখন বাংলায় রেলপথের ক্ষেত্রগুলি এতে দ্রুত বৃদ্ধি পায় যে ১৯৩৩ সালে ব্রিটিশ ভারতবর্ষে যুক্ত প্রদেশের পরে বাংলা দ্বিতীয় রেলপথ সম্প্রসারণ এলাকায় পরিণত হয়।
রেলপথ প্রচলনের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ছিল বিধ্বংসী। রেলপথ স্থাপন ও তার জ্বালানি হিসেবে প্রয়োজনীয় কাঠের স্লিপার, নুড়ি এবং কয়লার মতো কাঁচামাল স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করা হতো। রেলপথের উপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসকরা জলপথের আপেক্ষিক গুরুত্বকে তাৎপর্যহীন করে তোলেন। যার ফলে রেলপথ নির্মাণ করতে গিয়ে পূর্ববঙ্গের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করা হয়। পূর্ববঙ্গে অপেক্ষাকৃত উর্বর ও সম্ভাবনাময় এলাকাগুলো তার প্রাকৃতিক অবস্থান হারায়
রেলপথ প্রচলনের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ছিল বিধ্বংসী। রেলপথ স্থাপন ও তার জ্বালানি হিসেবে প্রয়োজনীয় কাঠের স্লিপার, নুড়ি এবং কয়লার মতো কাঁচামাল স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করা হতো। রেলপথের উপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসকরা জলপথের আপেক্ষিক গুরুত্বকে তাৎপর্যহীন করে তোলেন। যার ফলে রেলপথ নির্মাণ করতে গিয়ে পূর্ববঙ্গের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করা হয়। পূর্ববঙ্গে অপেক্ষাকৃত উর্বর ও সম্ভাবনাময় এলাকাগুলো তার প্রাকৃতিক অবস্থান হারায়। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে রেলপথ স্থাপনের ফলে চলনবিলের যে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ছিল তা বাধাগ্রস্ত হয়। পানির মুক্ত প্রবাহ রোধের ফলে এখানকার কৃষি জমি ও ফসলের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এ অঞ্চলের একমাত্র ফসল আমন সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়।
স্বাভাবিক পানিপ্রবাহের অনুপস্থিতে বিলের পলিমাটি সঞ্চয় ও জলধারণ ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পায়। রেলপথ প্রচলনের ফলে এ অঞ্চলের জেলে সম্প্রদায়ের ও মাছ শিল্পের অবনতি ঘটে। রেল যোগাযোগের ফলে স্থানীয় বাজার ও জেলেরা বৃহৎ বাজারের একক আধিপত্যের কারণে অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। বাস্তুসংস্থানকে পরিকল্পিতভাবে গুরুত্ব না দিয়ে রেলপথ স্থাপনের ফলে বাংলার যে প্রাচীন সেচ ব্যবস্থা ছিল তা ব্যাহত হতে থাকে। এর ফলে ম্যালেরিয়া মহামারি আকারে দেখা দেয়। প্লাবন সেচ ম্যালেরিয়া রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। মৌসুমি বৃষ্টিপাত ও বন্যার পানি তখন খুব সহজে নদী থেকে খাল অতিক্রম করতে পারত। এ অবস্থায় মাছের ডিম ও মাছ খাল থেকে ধানক্ষেত, পুকুর ও জলাশয়ে চলে আসত। মাছগুলো কিছু দিনের মধ্যেই মশার লার্ভা খেয়ে ম্যালেরিয়া রোধে ভূমিকা রাখত। ১৮৬১ রেলপথ চালু হওয়ার পর ম্যালেরিয়া মহামারি আকারে দেখা দেয়। কেননা প্রাকৃতিকভাবে পানি চলাচলের যে ব্যবস্থা ছিলে রেলবাঁধ তাকে ব্যাহত করে।
রেলবাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে যদি পানির মুক্ত প্রবাহের জন্য যথেষ্ট পথ রাখা হতো তাহলে ব-দ্বীপ অঞ্চলে সহজে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে ফসল এবং চাষাবাদের ধরন ব্যাপকভাবে ধ্বংস হতো না । এজন্য প্রয়োজন ছিল স্বাভাবিক ও নির্দিষ্ট মাত্রায় জল নিষ্কাশন নিশ্চিত করা। জলপথের প্রতিযোগী হিসেবে রেলপথ নির্মাণ না করে স্থানীয় বাস্তুসংস্থান বিবেচনায় নিয়ে রেলপ্রযুক্তিকে এ অঞ্চলে চালু করা যেত। রেলপথের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য নির্মাণগুলো অর্থনীতিকেন্দ্রিক না হয়ে পরিবেশে ও কৃষিকেন্দ্রিক হলে বাস্তুসংস্থানের সুরক্ষা বজায় রাখা সম্ভব হতো। কিন্তু স্থানীয় জ্ঞান ও প্রকৃতিকে বিবেচনায় নিয়ে রেলপথ প্রচলনের ফলে এটি তখন শুধুমাত্র চাপিয়ে দেওয়া প্রযুক্তিতে পরিণত হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণা দাতা সংস্থা এবং রাষ্ট্রের জন্য প্রকৃতির উপর হস্তক্ষেপ ও পুঁজিকেন্দ্রিক উন্নয়ন যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় পরিবেশকে বিবেচনায় না নিয়ে পাশ্চাত্যের অনুকরণ ও প্রাযুক্তিক সহায়তার মাধ্যমে পুঁজিকেন্দ্রিক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রবণতা এখনও বাংলাদেশে প্রভাবশালী। দাতাগোষ্ঠী, এনজিও এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশ মিলে এসব প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে থাকে
বর্তমানে ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতায় একইভাবে স্থানীয় জ্ঞান ও পরিবেশের প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় না নিয়েই বিভিন্ন প্রযুক্তিকে এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার কৌশল হিসেবে আরোপ করা হচ্ছে। এর অন্যতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও আধুনিকায়নের প্রতীক হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণ। বন্যা প্রতিরোধের প্রকল্পগুলোই বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধের প্রকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রধানত বাঁধ নির্মাণকে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধের অন্যতম কৌশল হিসেবে উপস্থাপন করা হয় যা বাস্তুসংস্থানের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে বলে ইতিমধ্যেই ঐতিহাসিক এবং স্থানীয়ভাবে প্রমাণিত পরিবেশবাদী নৃবিজ্ঞানী ক্যামেলিয়া দেওয়ান তাঁর ‘মিসরিডিং দ্য বেঙ্গল ডেল্টা’ (Misreading the Bengal Delta) গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন ও বন্যা প্রতিরোধে বিশ্ব ব্যাংকের মতো দাতাগোষ্ঠীগুলোর যেসব প্রকল্প রয়েছে তার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশে ব্যাপক বাঁধ তৈরি। ১৯৬১ সালে নবনির্মিত পূর্ব পাকিস্তান পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (EP-WAPDA) উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্পের (CEP) জন্য ইউএসএইড (USAID) এবং বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে তহবিল লাভ করে। এই প্রকল্পের কাজ ছিল বাংলাদেশের সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলে চার হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ।
এসব অঞ্চলে লবণাক্ততা প্রতিরোধের জন্য সাময়িক বাঁধ তৈরি করা হতো। এসব স্থানীয় বাঁধগুলোকে প্রয়োজন মতো সহজেই প্রত্যেক বছর মেরামত করা যেত। অন্যদিকে ব্রিটিশ প্রশাসন কর্তৃক নির্মিত বাঁধগুলো ছিল বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি হিসেবে আধুনিকায়নের প্রতীক, যাকে খুব বেশি মেরামতের প্রয়োজন ছাড়াই সহজে পরিচালনা করা যায়। ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাংলা অঞ্চলের জীবনযাপনের জলভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থাপনায় গুরুতর পরিবর্তন ঘটে
স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে প্রযুক্তিগত সহায়ক হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠান (বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল। সূচনা পর্ব থেকেই এসব প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন ও সহযোগিতার নামে পরিবেশ এবং সমাজের উপর তাদের হস্তক্ষেপকে বৈধতা প্রদান করে আসছে। বিদেশি ঋণের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দাতাগোষ্ঠী সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর প্রযুক্তিগত হস্তক্ষেপ করে থাকে। পশ্চিমা দাতারা আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রকৌশলের জ্ঞানকে ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতার উত্তরাধিকার হিসেবে প্রত্যেক অঞ্চলে সর্বজনীনভাবে প্রয়োগ করে আসছে। দাতা সংস্থা ও দেশগুলো বাংলাদেশের পরিবেশ সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে খুবই সরলভাবে ঔপনিবেশিক দৃষ্টি প্রয়োগ করে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণা দাতা সংস্থা এবং রাষ্ট্রের জন্য প্রকৃতির উপর হস্তক্ষেপ ও পুঁজিকেন্দ্রিক উন্নয়ন যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় পরিবেশকে বিবেচনায় না নিয়ে পাশ্চাত্যের অনুকরণ ও প্রাযুক্তিক সহায়তার মাধ্যমে পুঁজিকেন্দ্রিক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রবণতা এখনও বাংলাদেশে প্রভাবশালী।
ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রধান সমস্যা ছিল, বন্যা হলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে এত সহজে রাজস্ব সংগ্রহ করা যেত না। তখন বন্যার সমস্যাকে প্রযুক্তিগতভাবে মোকাবিলা করার জন্য স্থায়ী বাঁধকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু ব্রিটিশদের এই জলরোধী বাঁধ প্রযুক্তি মৌসুমী বন্যার প্রাকৃতিক পরিস্থিতিকে বাধা প্রদান করত, যার ফলে ধান চাষের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সেচ ব্যাহত হতো
দাতাগোষ্ঠী, এনজিও এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশ মিলে এসব প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে থাকে। উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যা প্রতিরোধের জন্য বাঁধ তৈরির কৌশল হচ্ছে ঔপনিবেশিক শাসনামলের নির্মাণ। যদিও এর পূর্বে এসব অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণ করা হতো কিন্তু তা ছিল ভিন্ন উদ্দেশ্যে। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনের প্রথম বাঁধগুলি বন্যা প্রতিরোধ করার জন্য তৈরি করা হয়নি বরং বন উজাড় করে আবাদযোগ্য জমি সম্প্রসারণের জন্য তৈরি করা হতো। এছাড়া এসব অঞ্চলে লবণাক্ততা প্রতিরোধের জন্য সাময়িক বাঁধ তৈরি করা হতো। এসব স্থানীয় বাঁধগুলোকে প্রয়োজন মতো সহজেই প্রত্যেক বছর মেরামত করা যেত। অন্যদিকে ব্রিটিশ প্রশাসন কর্তৃক নির্মিত বাঁধগুলো ছিল বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি হিসেবে আধুনিকায়নের প্রতীক, যাকে খুব বেশি মেরামতের প্রয়োজন ছাড়াই সহজে পরিচালনা করা যায়।
ঔপনিবেশিক পানি ব্যবস্থাপনা ও স্থায়ী বাঁধের ফলে কৃষির সাথে নদীর যে স্বাভাবিক সম্পর্ক সেটি ব্যাহত হতে শুরু করে। জলনির্ভর অঞ্চলকে তার অর্ন্তনিহিত প্রবণতা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। বিশেষত ঔপনিবেশিক শাসকদের তৈরি বাঁধের ফলে ব-দ্বীপের সমতল জমিতে প্লাবন সেচের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এর ধারাবাহিকতা পাকিস্তান ও বাংলাদেশ শাসনামলে লক্ষণীয়
ঔপনিবেশিক শাসনামলে বাংলা অঞ্চলের জীবনযাপনের জলভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থাপনায় গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। তখন থেকে সবধরনের বন্যাকে দেখা হতো জীবন ও সম্পত্তির জন্য ক্ষতিকারক বিষয় হিসেবে। বিশেষত বর্ষাকালীন বন্যাকে বাস্তুসংস্থানের জন্য উর্বরতার আশীর্বাদ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান থেকে সরে গিয়ে সমস্ত বন্যাকে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাপনা ও জ্ঞানভাষ্যের মধ্যে ক্ষতিকারক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রধান সমস্যা ছিল, বন্যা হলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে এত সহজে রাজস্ব সংগ্রহ করা যেত না। তখন বন্যার সমস্যাকে প্রযুক্তিগতভাবে মোকাবিলা করার জন্য স্থায়ী বাঁধকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু ব্রিটিশদের এই জলরোধী বাঁধ প্রযুক্তি মৌসুমী বন্যার প্রাকৃতিক পরিস্থিতিকে বাধা প্রদান করত, যার ফলে ধান চাষের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সেচ ব্যাহত হতো। ঔপনিবেশিক প্রাযুক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যবস্থাপনা বন্যা ও নদীর গতিশীলতাকে তাৎপর্যহীন করে তোলে। অন্যদিকে স্থানীয় বাঁধকে সেচের দরকারে খুব সহজেই চাষাবাদের জন্য উন্মুক্ত করা যেত। পুকুর এবং নদীর পাড় কেটে প্লাবন সেচ ব্যবস্থায় প্রয়োজন মতো জমিতে পানি আনা হতো। আধুনিক সেচ ব্যবস্থার অন্যতম পুরোধা ও ব্রিটিশ প্রকৌশলী উইলিয়াম উইলকক্স বাংলার প্রাচীন সেচব্যবস্থাকেই এ অঞ্চলের পরিবেশ বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
নেদারল্যান্ডের অনুকরণে ইতিমধ্যে নতুন পানিনীতি "বাংলাদেশ ডেল্টা ওয়াটার ২১০০" প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডের পরামর্শ ও অনুকরণে যে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও প্রাযুক্তিক সমাধান গ্রহণ করা হয়েছে তা স্থানীয় বাস্তুসংস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন এক প্রকল্প। নদী এবং ভূ-প্রকৃতিকে বিবেচনায় নিলে নেদারল্যান্ড এবং বাংলাদেশের বাস্তুসংস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন
বাংলার প্রাচীন সেচব্যবস্থা ছিল প্লাবন সেচব্যবস্থা। এই সেচব্যবস্থা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে অনুকূলে, কেননা প্লাবন সেচ জমির অম্লতা ও বন্ধ্যাত্ব কমিয়ে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। এই সেচ ব্যবস্থা মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ও পানির উচ্চপ্রবাহের মাধ্যমে বসন্তকালে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রতিহত করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখত। কিন্তু ঔপনিবেশিক পানি ব্যবস্থাপনা ও স্থায়ী বাঁধের ফলে কৃষির সাথে নদীর যে স্বাভাবিক সম্পর্ক সেটি ব্যাহত হতে শুরু করে। জলনির্ভর অঞ্চলকে তার অর্ন্তনিহিত প্রবণতা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। বিশেষত ঔপনিবেশিক শাসকদের তৈরি বাঁধের ফলে ব-দ্বীপের সমতল জমিতে প্লাবন সেচের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এর ধারাবাহিকতা পাকিস্তান ও বাংলাদেশ শাসনামলে লক্ষণীয়। জল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে জলবাহী প্রযুক্তির ঔপনিবেশিক রূপান্তর প্রাণ-প্রকৃতির মিথোজীবী সম্পর্কের অবক্ষয় ঘটায়।
এই অবক্ষয়ের মধ্যে রয়েছে প্রথাগত বন্যা নিষ্কাশন ব্যবস্থার বিলুপ্তি, মিঠা পানির মাছের সংখ্যা হ্রাস, লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ, নদীর তীরের ক্ষয়। জল ব্যবস্থাপনা ও সেচপ্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে ব-দ্বীপ অঞ্চলে সাধারণ জনগণ যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রয়োজনীয় মিঠা পানি ব্যবহারের ঘাটতি ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি। জলীয় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের ক্রমাগত 'পোল্ডারাইজেশন' লবণাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব রাখছে। পোল্ডার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও সেচ প্রকল্প উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রকে ব্যাপক আকারে পরিবর্তন করছে। একইভাবে বাণিজ্যিকভাবে বাগদা চিংড়ি চাষ এই অঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধিতে প্রধানতম ভূমিকা রাখছে। এই ধরনের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে স্থানীয় জলীয় ব্যবস্থাপনা ও আমলতান্ত্রিক নীতিমালা যথাযথভাবে পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে। যে কারণে এ অঞ্চলে পানি নিয়ন্ত্রণ ও বিতরণের প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ সার্বিকভাবে কার্যকরী হচ্ছে না।
নেদারল্যান্ডের অনুকরণে ইতিমধ্যে নতুন পানিনীতি "বাংলাদেশ ডেল্টা ওয়াটার ২১০০" প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডের পরামর্শ ও অনুকরণে যে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও প্রাযুক্তিক সমাধান গ্রহণ করা হয়েছে তা স্থানীয় বাস্তুসংস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন এক প্রকল্প। নদী এবং ভূ-প্রকৃতিকে বিবেচনায় নিলে নেদারল্যান্ড এবং বাংলাদেশের বাস্তুসংস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রধান ভিন্নতাগুলো হচ্ছেঃ ১) বাংলাদেশের নদীগুলোতে বিপুল পরিমাণ পলির উপস্থিত রয়েছে, নেদারল্যান্ডের নদীক্ষেত্রে তা খুবই সামান্য। ২) নেদারল্যান্ডের বৃষ্টিপাত ও নদীপ্রবাহ সারা বছর একই থাকলে ঋতুভেদে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাত ও নদীপ্রবাহের পরিমাপ ভিন্ন। ৩) এক-পঞ্চমাংশ ভূমি সমুদ্রের নিচে থাকার কারণে নেদারল্যান্ডের বাস্তুসংস্থানের প্রধান জটিলতা হচ্ছে সমুদ্র প্লাবন, অন্যদিকে বাংলাদেশের জন্য প্রধান জটিলতা হচ্ছে নদী প্লাবন। তাই নেদারল্যান্ডের প্রযুক্তিগত কৌশল রূপান্তর না ঘটিয়ে এককভাবে অনুকরণ, বাংলাদেশের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে অপরিহার্য বা পর্যাপ্ত নয়। বাংলাদেশ ডেল্টা ওয়াটার ২১০০ প্রকল্পের ভিত্তি মূলত স্থানীয় ইতিহাস এবং পরিবেশের জটিলতার কণ্ঠস্বরকে উপেক্ষা করে গড়ে উঠেছে।
অন্যদিকে সিলেটসহ অন্যান্য শহর অঞ্চলে মাঝেমধ্যে বন্যা প্রকোপের মূলে রয়েছে ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতায় প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা। অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে জল-জমির কৃত্রিম ও বিরোধপূর্ণ বিভাজন, স্লুইসগেট ও প্রথাগত জল নিষ্কাশন পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা এবং বর্জ্য পদার্থের মাধ্যমে নদী ভরাট, নগরায়ন ও উন্নয়নের নামে নদী ও খাল দখল ইত্যাদি বিষয়গুলো বন্যার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। যার ফলে শহর অঞ্চলে অধিক বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা দেখা যায়
নেদারল্যান্ডের অনুকরণে পোল্ডার পদ্ধতি প্রবর্তনের ফলে এটি উপকূলীয় অঞ্চলে মুক্ত প্লাবনকে ব্যাহত করবে। কেননা পোল্ডার পদ্ধতির কারণে ইতিমধ্যেই সমতলে পরিমাণ মতো পলি না জমায় জমির উর্বরতা হ্রাস, মাছের নিজস্ব বাস্তুসংস্থানের সংকোচনের মতো পরিবেশের বহুবিধ সংকট তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ সর্বপ্রথম ১৯৬৪ সালে পোল্ডার পদ্ধতিকে মাস্টার প্ল্যান হিসেবে গ্রহণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি’ (আইইসিও) প্রণীত নীতিমালা অনুযায়ী তখন পোল্ডার পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হয়। এটি হচ্ছে নদীসমূহকে অবরোধের একটি পদ্ধতি। কিন্তু এ পদ্ধতি তখন ব্যর্থ হয়। ডেল্টা প্ল্যানের একই পদক্ষপেগুলো এ অঞ্চলের বাস্তুসংস্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এটি বরং জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবতর্নের পক্ষেই সহায়ক। ডেল্টা প্ল্যানের মাধ্যমে মূলত ব-দ্বীপের বাস্তুসংস্থানের মালিকানা কতগুলো করপোরেট কোম্পানির মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে।
ব-দ্বীপ সীমানার বাইরে থাকা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রাযুক্তিক ও অবকাঠামোগত হস্তক্ষেপের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিক বছরে ইতিহাসের ভয়াবহ বন্যা হয়েছে সিলেট এবং সুনামগঞ্জ অঞ্চলে। স্থানীয় বাস্তুসংস্থানের অবক্ষয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে ভারতে থেকে আসা বৃষ্টির পানি এসব অঞ্চলে বন্যা সৃষ্টি করেছে। পরবর্তীতে এসব অঞ্চলে বন্যার তীব্রতা বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে হাওরে নির্মিত বিভিন্ন অবকাঠামো, যা স্বাভাবিকভাবে পানি নামতে বাধা প্রদান করে। হাওর অঞ্চলের জলবিদ্যা চর্চার মডেলটি মানব উন্নয়নকেন্দ্রিক দর্শন দ্বারা পরিচালিত। বাস্তুসংস্থানকেন্দ্রিক কোনো হাইড্রোলজিক্যাল মডেল না থাকার কারণে এসব অঞ্চলে হাওরের সাথে খাল এবং নদীর যে নাব্যতার সম্পর্ক ছিল তার ক্রমশ অবক্ষয় ঘটছে। উন্নয়ন সহিংসতার অধীনে এসে নদী এবং খালগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে পানি শোষণের পরিবেশ সংকুচিত হয়ে আসছে।
সড়ক সম্প্রসারণ ও ড্রেন নির্মাণের কাজ করতে গিয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে ইতিমধ্যে সড়কের পাশের বেশিরভাগ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এই ধরনের কর্মকাণ্ডে মাধ্যমে পানি বাষ্প ও শোষণের পরিসরগুলো ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সব পানি নদীতে পতিত হচ্ছে এবং বৃষ্টিপাত হলেই তার নিকটবর্তী অঞ্চলগুলো প্লাবিত হচ্ছে। অন্যদিকে পানি নিয়ন্ত্রণে বাঁধ নির্মাণের ফলে বৃষ্টির পানি সহজে বের হতে পারে না। এসব কারণে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের পরিমান বৃদ্ধি পেলে শহরাঞ্চলে কৃত্রিম বন্যার সৃষ্টি হয়
অন্যদিকে সিলেটসহ অন্যান্য শহর অঞ্চলে মাঝেমধ্যে বন্যা প্রকোপের মূলে রয়েছে ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতায় প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা। অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে জল-জমির কৃত্রিম ও বিরোধপূর্ণ বিভাজন, স্লুইসগেট ও প্রথাগত জল নিষ্কাশন পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা এবং বর্জ্য পদার্থের মাধ্যমে নদী ভরাট, নগরায়ন ও উন্নয়নের নামে নদী ও খাল দখল ইত্যাদি বিষয়গুলো বন্যার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। যার ফলে শহর অঞ্চলে অধিক বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা দেখা যায়। ঔপনিবেশিক শাসনামলে নগর পরিকল্পনার কেন্দ্রে ছিল জল ও জমির বিভাজন। আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনার মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিকভাবে নদী ও ভূমিকে আলাদা করা হয়েছিল। জলের প্রাকৃতিক প্রবাহের উপর যান্ত্রিক হস্তক্ষেপের ফলে ক্রমশ শুষ্ক নগরী ও শুষ্ক ভূমি গড়ে উঠছিল। ঔপনিবেশিক নগরায়নই প্রথম শহরের সাথে পানির বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে।
নদী ও পানি সম্পর্কিত ধারনায় ঔপনিবেশিক জ্ঞানতত্ত্ব এখনও প্রভাবশালী। বর্তমানে শহরাঞ্চলের প্রকৌশল ও স্থাপত্যরীতি এই ধারাবাহিকতাকে অনুসরণ করে আসছে। পানি একটি পণ্যে পরিণত হয়েছে যার কোনো বাস্তুতান্ত্রিক কর্তাসত্ত্বা নেই। একে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় রেখে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। শহরে অঞ্চলে পর্যাপ্ত পুকুর, খাল, মাটি ও গাছপালা না থাকায় পানি শোষণের সহজাত ব্যবস্থাপনা সংকুচিত হয়ে আসছে। সড়ক সম্প্রসারণ ও ড্রেন নির্মাণের কাজ করতে গিয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে ইতিমধ্যে সড়কের পাশের বেশিরভাগ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এই ধরনের কর্মকাণ্ডে মাধ্যমে পানি বাষ্প ও শোষণের পরিসরগুলো ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সব পানি নদীতে পতিত হচ্ছে এবং বৃষ্টিপাত হলেই তার নিকটবর্তী অঞ্চলগুলো প্লাবিত হচ্ছে। অন্যদিকে পানি নিয়ন্ত্রণে বাঁধ নির্মাণের ফলে বৃষ্টির পানি সহজে বের হতে পারে না। এসব কারণে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের পরিমান বৃদ্ধি পেলে শহরাঞ্চলে কৃত্রিম বন্যার সৃষ্টি হয়।
এভাবে প্রাযুক্তিক আধুনিকীকরণ হিসেবে রেলপথ, সড়কপথ, বাঁধ ও সেচপ্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয়গুলো ঔপনিবেশিক ধারাবাহিক সূত্রে এ অঞ্চলের বাস্তুসংস্থানকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাস্তুসংস্থানের অবক্ষয় প্রতিরোধে প্রাযুক্তিক জ্ঞান, দক্ষতা ও চর্চার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। কারিগরি সহায়তার ক্ষেত্রে স্থানীয় জ্ঞান ও পরিবেশকে কেন্দ্রে রাখতে হবে, যার মাধ্যমে প্রাণ-প্রকৃতির স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় থাকবে। প্রাযুক্তিক ব্যবস্থাপনাকে দীর্ঘমেয়াদি বি-উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।