বৃহঃস্পতিবার ১২ই বৈশাখ ১৪৩১ Thursday 25th April 2024

বৃহঃস্পতিবার ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

Thursday 25th April 2024

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ: এক বাবার অভিজ্ঞতা

২০২২-০৩-২৯

ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ:  এক বাবার অভিজ্ঞতা

মাহবুব মমতাজ কাশেম, পেশায় একজন পুর প্রকৌশলী [সিভিল ইঞ্জিনিয়ার]। বাস করেন রাজধানী ঢাকার ধানমণ্ডির কলাবাগানে। সম্প্রতি তার ৭ বছর বয়সি একমাত্র শিশুকন্যা রুশদা মাহভীন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে, লাখো টাকা খরচ করে বহু কষ্টে মেয়েকে বাঁচাতে পারলেও, শিকার হয়েছেন নানা ভোগান্তির। তবে টাকা খরচ করে সেবা পাওয়ার সাধ্যই বা আছে ক’জন নাগরিকের। ঢাকায় সম্প্রতি করোনা মহামারির মধ্যেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির শিকার এই বাবা দৃকনিউজ-এর কাছে প্রকাশ করেছেন তার দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা। গ্রন্থনা করেছেন ফাইয়াজ আহমেদ

 

গোটা ধানমন্ডির তুলনায় কলাবাগান এলাকা ঘিঞ্জি বেশি। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার অনেক আগে থেকে আমি পাশের বাসার লোকজনকে বলেছি, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করতে। তারা দুই বাড়ির মাঝের সীমানার ভেতরে ঘর করেছে। ওই ঘরের উপর সিগারেটের প্যাকেট, বোতল হাবিজাবি ফেলা হয়েছে। সেখানে এসির পানি জমে সয়লাব, এটা ৩৬৫ দিনের ঘটনা। অর্থাৎ সব সময়ই ময়লার স্তুপ থাকে। তারা কখনোই পরিষ্কার করে না। তাদেরকে অনেক বলেছি, তারা পরিষ্কার করে না। এমনকি দারোয়ানকে বকশিস দেওয়ার কথাও বলেছি, তাও তাদের কোনো সাড়া নেই।

 

আমার বাসা তো ৫৫/৩ নম্বর, এর আগে পরে যে বাসাগুলো আছে তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। আমার ধারণা, এখানকার বাসাগুলো থেকেই ডেঙ্গু মশা হচ্ছে। কেউ নিজে এসে দেখলে বুঝবে বাস্তব অবস্থা কতো ভয়াবহ। বাসার পাশের ৫৫/১ আর ৫৫/২ নম্বর যে বাসা তাদেরকে আমরা কয়েকবার জানালেও লাভ হয়নি। অনেকেই উল্টো বলে আমার বাসার ছাদে গাছ আছে, এখান থেকে মশা হয়েছে। ছাদ বাগান তো থাকবেই, তবে সেখানে পানি জমে কিনা সেটা দেখার বিষয়।

 

এই বিষয়টি নিয়ে আমি সিটি করপোরেশনকে জানিয়েছিলাম, আমার মেয়ের ডেঙ্গু জ্বর হওয়ার আগেই। সিটি করপোরেশনের হটলাইনে ফোন দিলাম, তারা বলল, স্থানীয় যে কমিশনার আছে তাকে জানাতে। তারপর কমিশনার অফিসের ফোন নম্বর যে দেওয়া হলো, তারা ফোন দিলে ধরে না। পরে মেয়ের ডেঙ্গু হওয়ার পরে কমিশনারের অফিসে লিখিত অভিযোগপত্র পাঠিয়েছি। সেটি পাঠানোর পর এক সপ্তাহ গত হলেও তার প্রেক্ষিতে কোনো উদ্যোগ এখনও দেখিনি। তারা বলেছে, ম্যাজিস্ট্রেট এলে বিষয়টি তাকে দেখাবে। তিনি যদি দরকার মনে করেন, তাহলে আসবেন। এটা অনেক লম্বা প্রক্রিয়া। এদিকে ইতোমধ্যে আমার বাসার চার তলায় আরেকজন ভাড়াটিয়া ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। গতকাল তার ডেঙ্গু হয়েছে। আর আশেপাশের বাসার কথা কী বলব! কলাবাগানের বেশ কিছু রোগী আমি সেন্ট্রাল ও স্কয়ার হাসপাতালে দেখেছি।

 

আমাদের এখানে অনেক বড় ডাক্তার আছে, তবে তারা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় কতটা পারদর্শী তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে, বিশেষ করে আমার মেয়ের ঘটনা দেখার পর। সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তির পর যা ঘটেছে, তা অবিশ্বাস্য। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সাধারণ চিকিৎসা হলো, রোগীকে ভর্তির সঙ্গে সঙ্গেই তরল [ফ্লুইড] দিতে হয়। এটি করতেই দেড় ঘণ্টার মতো দেরি হয়। সুঁইনালী [ক্যানোলা] লাগাতেই অনেক বেশি সময় লেগে যায়।

 

অধ্যাপক সাইয়েদা আনোয়ার-এর অধীনে মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। আমি জানতাম তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান। তিনি পরিদর্শনে [রাউন্ড] এসে রোগীকে না ডেকে কর্তব্যরত ডাক্তার যে প্রতিবেদন দিয়েছেন, সেটি দেখেই বলে দেন কোনো সমস্যা নেই। তিনি রোগীকে না দেখেই বিভিন্ন টেস্ট করাতে বললেন। এমন না যে তিনি রোগী দেখতে টাকা নেন না। তিনি প্রতিবার রোগী দেখার জন্য এক হাজার টাকা করে নেন। তিনি টাকা নিচ্ছেন, অথচ রোগীকে দেখছেন না। এমনকি তারা রক্ত পরীক্ষাও করছেন না। হাসপাতালে নেওয়ার পরে তারা কোনো  আল্ট্রাসনো, এক্সরে, সিবিসি, এরকম কোনো পরীক্ষাই করেনি। এটা তো গেল সকালের পরিদর্শন। রাতের পরিদর্শনের সময় যখন রোগী পেট ও বুকে ব্যাথার কথা বলল, তখনও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি পরদিনও তারা রক্ত পরীক্ষা করেনি। অথচ সিবিসি টেস্ট ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর জন্য বাধ্যতামূলক।

 

পরদিন সকালে মেয়ে অচেতন অবস্থায় চলে যায়, মস্তিষ্ক অকার্যকর হয়ে পড়ে। তখন এই বিষয়ে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের কোনো ধারণাই ছিল না। ডিউটি ডাক্তার নাড়ি ও রক্তচাপ পরীক্ষা করে বলে ৮০/৫০, তিনি এই তথ্য লিপিবদ্ধ না করেই চলে যান। এই তথ্য পরে পাওয়াও যায়নি। মেয়ের খালা পেশায় চিকিৎসক। যদি আগের দিন তিনি না আসতেন, তাহলে হয়তো মেয়েকে বাঁচানো যেত না। তিনিই বিষয়টা বুঝতে পারেন রক্তচাপ পরীক্ষা করে। এরপর সব চিকিৎসকদের ডেকে চেঁচামেচি করার পর একজন কর্তব্যরত চিকিৎসককে পাওয়া যায়, নাম তার আকাশ। তিনি বেশ ভালো সেবা দিয়েছেন এবং সহযোগিতা করেন। এছাড়া বাকি যাদের দেখেছি, মনে হয়েছে তারা শুধু নামেই যোগ্যতা সম্পন্ন।

 

এ অবস্থায় মেয়েকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে [আইসিইউ] নেই, কিন্ত তারা রাখবে না। তাদের যে কনসালটেন্ট ডা. সাইয়েদা আনোয়ার তিনি বলেন এই রোগী এখানে ওয়ার্ডেই থাকবে। এখানেই তিনি রোগীকে ভালো করবেন। এমনকি আমি যখন সন্ধ্যার সময়ে রোগীকে অ্যাম্বুলেন্স করে স্কয়ার হাসপাতালে নেই, তখনও তিনি পরিদর্শনে এসে বলেছেন রোগীকে ওয়ার্ডে রেখেই সুস্থ করে তুলবেন। সেন্ট্রাল হাসপাতালের ওয়ার্ডে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টায় ভর্তি করি, পরদিন শুক্রবার সকাল ১০টা পর্যন্ত ছিল। তারপর সেখান থেকে বের করে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয় বিকাল পর্যন্ত। সেন্ট্রাল হাসপাতালে ৬৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়।

 

এরপর মেয়েকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে তাকে জরুরিভিত্তিতে আইসিইউতে নিয়ে কৃত্রিম স্বাস প্রশ্বাসের ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। স্কয়ার হাসপাতালে ছিল শুক্রবার বিকাল থেকে গত শনিবার দুপুর পর্যন্ত। স্কয়ারে আমার সব কিছু মিলিয়ে খরচ হয় ৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে এ যাত্রায় প্রায় পাঁচ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। স্বস্তি এখানেই যে, কন্যাকে নিয়ে ঘরে ফিরতে পেরেছি। কিন্তু আমাদের মতো মধ্যবিত্ত মানুষরা যদি এরকম একটা রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে এভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ি, তাহলে তো প্রশ্ন রাখতেই হয়, আমাদের করের টাকা কোথায় ব্যয় হচ্ছে?

 

এসব নিয়ে সিটি করপোরেশনের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার কথা ভেবেছি। কিন্তু সেটা করা যাবে না। আমাদের দিক থেকে ক্ষতিপূরণ চাইলে পরে দেখা যাবে, বাসা থেকে বর্জ্য অপসারণ বন্ধ হয়ে যাবে, আরো এটা-ওটা বন্ধ হয়ে যাবে। সিটি করপোরেশন তো মশার ওষুধ দিয়ে যায় নামমাত্র, এতে যে আসলে কী দেয় তারাই জানে। শুনেছি দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ তাপস সাহেবও এই এলাকাতেই বসবাস করেন। তা সত্ত্বেও যদি এই এলাকায় এমন ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে, তাহলে দক্ষিণের বাকি রাজধানীবাসী কেমন আছে, তা চিন্তা করাও কঠিন। অভিযোগ জানিয়েও কিন্তু কোনো ফল আমরা পাইনি। এই দুর্ভোগের অবসান চাই।

Your Comment