শুক্রবার ৬ই বৈশাখ ১৪৩১ Friday 19th April 2024

শুক্রবার ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

Friday 19th April 2024

বহুস্বর মতামত

দৃকের সাক্ষাৎকারে মালালাই জয়া

২০২১-১০-০৬

সায়রাত সালেকিন সাত্বিক

দৃকের সাক্ষাৎকারে মালালাই জয়া

 

মালালাই জয়া একজন আফগানি অ্যাকটিভিস্ট, সমাজকর্মী, লেখিকা ও রাজনীতিবিদ। আফগানিস্তানে নারীদের সার্বিক মুক্তির জন্য প্রায় দুই দশক ধরে নিরন্তর লড়ে আসছেন তিনি। ২০২১ সালে তালেবানরা আফগানিস্তান দখল করার পর মালালা সপরিবারে স্পেনে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। সংগ্রামী এই নারী গণতান্ত্রিক, সহিষ্ণু ও নিরাপদ আফগানিস্তান গড়ে তোলার সংগ্রামের অন্যতম প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।২০১৩ সালের জুলাই মাসে আফগানিস্তানের কাবুল নগরীর উপকন্ঠে একটি গোপন স্থানে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন ড. শহিদুল আলম।

 

শহিদুল আলম 

মালালাই জয়া, আপনাকে আফগানিস্তানের একজন নিপাট ত্যাগী ও নির্ভীক যোদ্ধা ডাকা হয়। আপনি সেই অল্প কয়েকজনেরই একজন, যারা সমরপ্রভুদের এবং তাদের মদতদাতা দখলদার বাহিনীর দিকে আঙুল তুলেছেন, মুখ খুলেছেন। এর জন্য আপনাকে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, মাশুল দিতে হয়েছে। আপনার জীবন হুমকির মুখে। আমাদের এই সাক্ষাৎকারের জন্য নিতে হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কতা। আপনার সন্তান অসুস্থ, তবুও আপনি তাকে দেখতে যেতে পারছেন না। এই জায়গায় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা কিংবা অন্তত ন্যূনতম সহযোগিতা আপনার প্রাপ্য। একজন মা হিসেবে, একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে, এবং এই দেশের একজন নাগরিক হিসেবে। কেন এই বেহাল দশা? 

 

মালালাই জয়া 

কারণ আমি সত্যিটা বলছি। কারণ আমি দখলের বিরুদ্ধে, তাদের পুতুল, তাদের পোষা সমরপ্রভু এবং তালেবানের বিরুদ্ধে। যারা ক্ষমতায় আছে, তারা সবাই নারীবিদ্বেষী আর জঙ্গি মনোভাবাপন্ন। তো যে তাদের মুখোশ টেনে খুলে দিচ্ছে, তাকে তো তারা এমন অবস্থায় ফেলবেই। 

 

২০০৩ এর ভাষণটার পর থেকে আমার জীবন এক্কেবারেই বদলে গেছে। সেখানে আমি বলেছিলাম, এই জঙ্গিগুলোকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সম্মুখীন হতে হবে। সেই সময়ে দেশে-বিদেশে নানান জায়গা থেকে আমার এই বক্তব্যের প্রশংসা প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। আবার এই কারণেই যে কতবার আমার প্রাণনাশের জন্য হামলা চালানো হলো! সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ছিল গত বছর। তারা আমার বাসা ও কর্মক্ষেত্রে আক্রমণ চালায়। আমার দুজন দেহরক্ষী গুরুতরভাবে জখম হয়। এখন বাসা বদলেছি। আত্মগোপনে থেকে, সর্বক্ষণ বোরখা পরে এবং সঙ্গে দেহরক্ষী থাকা সত্ত্বেও আমি এই রাষ্ট্রে নিরাপদ না। হত্যাচেষ্টা এখনও তারা চালিয়ে যাচ্ছে। 
 

তবে আমার কণ্ঠস্বর এতগুলো মানুষের কণ্ঠ হয়ে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করতে পেরেছে দেখে আমি সত্যিই অভিভূত। তাদের প্রতি বলতে চাই, এই লড়াই আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চালিয়ে যাব। তার ফলে আমার মৃত্যু ঘটলে ঘটবে। যেমনটি আমি আমার শত্রুদের বলেছি, আমি আমাদের ভবিষ্যতের বীজ রোপণ করে দিয়ে যাচ্ছি। তারা বাগানের সব কটা ফুল ছিঁড়ে ফেলতে পারে, তবে আসছে বসন্তকে কোনোভাবেই থামাতে পারবে না। 

 

শহিদুল আলম 

খুবই সুন্দর বলেছেন। আচ্ছা, আপনাকে তো তারা সর্বশেষ সংসদ থেকে বহিষ্কার করে দিয়েছিল, তাই নয় কি? একজন নির্বাচিত সাংসদকে তারা বহিষ্কার করে দিয়েছিল। এখন একটা নতুন সংসদ বসেছে। এই নতুন সংসদ ও তার সদস্যদের কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?   

 

মালালাই জয়া 

দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের সংসদটা একটা মাফিয়া সংসদ, মাফিয়াদের সংসদ। এর দখল হলো সমরপ্রভু, মাদক সম্রাট এবং সব রকমের অপরাধীদের হাতে। দশকের পর দশক তারা নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে একটার পর একটা অপরাধ করে এখন স্যুট-টাই আর গণতন্ত্রের মুখোশ পরে ক্ষমতা দখল করে আছে। সব মিলিয়ে এতই কম সংখ্যক সৎ আর মুক্তিকামী মানুষ এখন সংসদে, আপনি দুই হাতের আঙুল দিয়েই তাদের গুনতে পারবেন। আমাদের শেষ নির্বাচনটি ছিল একটা সম্পূর্ণ প্রহসনের নির্বাচন, যা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও এসেছে।   

 

আফগানিস্তানে একটা জনপ্রিয় উক্তি আছে যে, কে ভোট দিচ্ছে সেটার থেকে বড় বিষয় হচ্ছে কে ভোট গুনছে। এটাই আমাদের সমস্যার মূল। এবং সে কারণেই আজ আমাদের সংসদ একটা অগণতান্ত্রিক মাফিয়া সংসদ। সব কটা আইনই কিতাবে আছে কিন্তু প্রয়োগে নেই। তাদের কাছে যে আইনগুলো সুবিধার, তা বাদে বাকি সব আইনি বিধান তারা ময়লার ঝুড়িতে নিক্ষেপ করে দেয়। এর আগের সংসদও ঠিক তাই ছিল। সেখানে এক বিন্দু বাকস্বাধীনতা নেই। আমি যতবার কথা বলতে গেছি, আমার মাইক্রোফোন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, মৃত্যুর হুমকি দেওয়া হয়েছে, এমনকি ধর্ষণের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। আর কিছু না পেরে শেষমেশ তারা ষড়যন্ত্র করে আমাকে সংসদ থেকে বের করে দিয়েছে– যেটা সম্পূর্ণরূপে একটি বেআইনি সিদ্ধান্ত। কারণ আমি একজন নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি হিসেবেই সংসদে ছিলাম, অন্য দশ জন সাংসদের মতো মনোনীত সদস্য হিসেবে নয়।  

 

এই মাফিয়া সংসদ একটার পর একটা ভয়ঙ্কর, ন্যক্কারজনক আইন বানিয়েই চলেছে। অপরাধীরা এখন চাইলে নিজেদের ক্ষমা করে দিতে পারে। এবং এর ফলে আফগানিস্তানের প্রতিটি কোণ থেকে গণমানুষের যে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হয়, কোনো কিছুই তারা তোয়াক্কা করে না। এই মাফিয়ারা তাদের মৌলবাদী গোঁড়ামিকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ইসলামকেও একটা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দ্বিধা করে না। আমাদের রাষ্ট্রের তিনটা প্রধান অঙ্গ– বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, ও নির্বাহী বিভাগ। প্রত্যেকটাই এখন এদের দ্বারা সংক্রমিত।  

 

শহিদুল আলম 

আপনি আপনার আলোচনায় বোঝাতে চেয়েছেন যে আপনার দেশে সমরপ্রভুদের সঙ্গে দখলদার বাহিনীর একটা আঁতাত আছে। এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে? 

 

মালালাই জয়া 

হ্যাঁ, আমি মনে করি যে তালেবান আর সমরপ্রভু দুপক্ষেরই আশ্রয়দাতা একই– মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই পাকিস্তানের আইএসআই-এর মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধবাজ সমরপ্রভুদের সমর্থন করে আসছে। সে সময়ে সাধারণ মানুষ এদের ব্যাপারে খুব একটা জানত না, আর এরাও নিজেদের ‘মুজাহিদিন’ আখ্যা দিয়ে চলত। মুক্তিকামী যোদ্ধাদের সঙ্গে মিলে এরাও একসাথে রুশ দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েছিল। সাধারণ মানুষ জানত না কে এদের গডফাদার, কে দিচ্ছে অস্ত্র আর অর্থ। কিন্তু যখন রাশিয়া চলে গেল আর পুতুল ব্যবস্থা ভেঙে পড়ল, ঠিক তখনই এই মৌলবাদীরা জনগণের সামনে তাদের মুখোশ খুলে প্রকৃত অপরাধী চেহারাটি উন্মোচিত করল। একটা গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দিল দেশে আটটা মৌলবাদী দল মিলে, যাদের প্রত্যেকেরই ইচ্ছা ছিল ক্ষমতা দখল করা। মাত্র চার বছরে খুন হলো ৬৫ হাজার নিরীহ মানুষ। ধর্ষিত হলো কত শত পৌড়া আর ছোট ছোট শিশু! আমাদের জাদুঘরগুলোকে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হলো। কাবুলের ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যকার ছবিগুলোতে আমরা দেখতে পাই কিভাবে তারা পেরেক ঠুকে, নারীদের স্তন কেটে নানা রকম নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে। এ সবকিছুই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর ওয়েবসাইটে কিংবা সেই সময়টা নিয়ে লেখা নানান উপায়ে লিপিবদ্ধ আছে। আমার বইয়েও এ নিয়ে তথ্য পাবেন।   

 

সেই সময়টাতেই, অর্থাৎ যখন এই সমরপ্রভুরা ক্ষমতায় ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালেবান সৃষ্টি করল। একইভাবে তালেবান যখন প্রথম ক্ষমতায় আসল, সাধারণ মানুষ প্রথমে খুশিই ছিল। তারা ভেবেছিল এরা হয়তোবা আগের সমরপ্রভুদের মতো নিষ্ঠুর হবে না, যারা তালেবানের ভয়ে ভীরু ইঁদুরের মতো তাদের গর্তে ঢুকে পড়ে।

 

কিন্তু আমরা তো এখন জানি যে তারা আসলে ভেড়ার ছদ্মবেশে নেকড়ে ছিল। এর কিছুদিন পরেই ৯/১১ হামলার পর মানবতার ঝাণ্ডা নিয়ে হাজির হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এবং সেই ওয়ার অন টেররের পক্ষে যে কেবল ন্যাটো দাঁড়িয়েছিল তা কিন্তু নয়– সে দলে ছিল বাংলাদেশও। আবারও আমাদের সাধারণ মানুষ ভাবল যে, না এবার হয়তো ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে, যেহেতু এই বিদেশিদের নিজ দেশেই ৯/১১-এর মতো একটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তারা বুঝতে পারল যে মার্কিনরা মূলত আফগানিস্তানে এসেছে এখানকার নিরীহ মানুষকে খুন করে সে ঘটনার বদলা নিতে। কারণ এই এগারো বছর তারা বলে গেল যে তাদের যুদ্ধ হচ্ছে তালেবান আর আল-কায়েদার বিরুদ্ধে। এখন তারাই নির্লজ্জের মতো বলছে যে তালেবান তাদের শত্রু নয়। বটেই! আমি তো অনেক আগেই বলেছি, তালেবান ওদের গডফাদারদের শত্রু নয়। তারা আফগানি জনসাধারণের শত্রু।   

 

শান্তি আর ন্যায়ের নামে তারা এখন এই জঙ্গিদের সঙ্গে আলাপে বসছে। ঠিক এই কারণেই আজ আফগানিস্তান জঙ্গিদের অভয়ারণ্য। নারী কিংবা শিশু হয়ে জীবনযাপন করতে হলে আফগানিস্তান হলো এই পৃথিবীর বুকে সব থেকে অনিরাপদ, নিকৃষ্ট স্থান। তরুণ প্রজন্মকে তারা মাদকের নেশায় বুঁদ করে তাদের মাদকের বাজার রমরমা রেখেছে। আরেক দিকে নেই জীবনের কোনো নিরাপত্তা। আমি মনে করি খাদ্যের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো নিরাপত্তা। যেখানে আমাদের কোনো স্বাধীনতা নেই, সেখানে গণতন্ত্র-মানবাধিকার-ন্যায় ইত্যাদি নিয়ে আলাপ করা কেবল নিরর্থকই নয়, তা একটা বিশ্রী কৌতুক।   

 

শহিদুল আলম  

শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয়, এর মিত্ররা– এমনকি আমার দেশ বাংলাদেশও এই সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। এখন তারা নিজেদেরকে প্রত্যাহারের কথা বলছে, এর পরিণতি কী হবে? 

 

মালালাই জয়া 

শুরুতেই বলে রাখি, আমি বিশ্বাস করি না যে তারা স্বেচ্ছায় আফগানিস্তান ছাড়বে। হ্যাঁ, আমরা নিশ্চয়ই আশা করি তারা বিদায় নেবে। যদি তারা আজ বা কাল চলে যায়, সেটা পরশু দিন যাওয়ার চেয়ে ভালো, অনেক বেশি ভালো। মার্কিনিরা এখানে এসেছিল তার নিজস্ব কৌশলগত, আঞ্চলিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে। তারা এত সহসা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাবে না। এর কারণ হলো, অন্য এশীয় শক্তিগুলোর সঙ্গে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য এ দেশ একটি অন্যতম যায়গা। আফগানিস্তান থেকে মধ্য এশীয় দেশগুলোর তেল-গ্যাস সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোতেও সহজেই প্রবেশাধিকার পাওয়া যায়। তাছাড়া প্রতিবছর তারা তাদের জঘন্য আফিম ব্যবসা থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করছে। এখানে তাদের উপস্থিতি কেবলই নিজেদের অশুভ উদ্দ্যেশ্যগুলো বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে।     

 

আর তাছাড়া, ন্যাটো আফগানিস্তানে নিজেদের স্বার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভুল ও জঘন্য নীতিসমূহ অনুসরণ করছে। এছাড়াও আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল তাদের সামরিক ঘাঁটিগুলো– বিশেষত আফগানিস্তানে যে নয়টি সামরিক ঘাঁটি আছে– সেগুলোকে বৈধতা দেওয়া। আমি বিশ্বাস করি, যেই দেশে বিদেশি সামরিক ঘাঁটি রয়ে যায়, সেটি কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন না। একই সঙ্গে, আরেক দিক থেকে তারা সন্ত্রাসবাদী, নারীবিদ্বেষী, ফ্যাসিবাদী তালেবানদেরকে ক্ষমতায় ডেকে আনছে যাতে দেশে সমরপ্রভুদের, মাদক কারবারের, ও সন্ত্রাসবাদের বৃত্ত পূর্ণ হয়। তখন তাদের পুতুল সরকার আরও শক্তিশালী হবে, আরও ক্ষমতাবান হবে। তারা আমাদের দেশ থেকে কয়েক হাজার সৈন্যকে সরিয়ে ফেলার পরও কিন্তু সামরিক ঘাঁটিগুলো রয়েই যাচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে চলে যাবার আকাশকুসুম গল্প প্রচারের উদ্দেশ্য পরিষ্কার– মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলা।  

 

ওরা বলে, আমরা (যুক্তরাষ্ট্র) যদি চলে যাই তাহলে কিন্তু আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে, তাই তোমাদের দেশে সামরিক ঘাঁটি থাকবে– এটা তোমাদেরকে মেনে নিতে হবে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, ঘুণাক্ষরেও দখলদারিত্ব মেনে না নেয়ার একটা শক্তিশালী উত্তরাধিকার বহন করে আফগানি জনগণ। সেখানে তারা (যুক্তরাষ্ট্র) দাবি করে গৃহযুদ্ধ বেধে যাবে। কোন ধরনের গৃহযুদ্ধ? আমি তো মনে করি আমরা ইতিমধ্যেই একটা গৃহযুদ্ধের ভেতর আছি। ভবিষ্যতের যে গৃহযুদ্ধের জুজু তারা দেখায়, তা চলমান গৃহযুদ্ধের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক হবে না। এই ১১ বছরে আমরা আফগানিরা তিনটি শত্রুর মুখোমুখি অবস্থান ধরে আছি। এরা হলো সমরপ্রভু, তালেবান, আর দখলদার বাহিনী। এই দখলদার বাহিনীগুলো হাজার হাজার মানুষ খুন করেছে, এমনকি সেই হত্যাযজ্ঞে শ্বেত ফসফরাস ব্যবহার করেছে। দুনিয়ার কোথাও সামরিক আগ্রাসন, বোমাবাজি আর গুলি চালিয়ে গণতন্ত্র আসেনি। আমাদের বিদ্যালয়গুলোয়, বিয়ের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালানো হয়েছে। বিয়েতে আসা অগণিত নিরীহ মানুষের সঙ্গে খুন হয়েছে নবদম্পতি। এমন অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে।    

 

আমরা ইনসাফ চাই। কিন্তু তারা শান্তি আনার কথা বলে আনছে তালেবানকে। আমি বিশ্বাস করি এহেন শান্তি যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ, কারণ এই শান্তি হলো আফগান জনগণের শত্রুদের মধ্যকার সমঝোতার শান্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থে তৈরি হয়েছে এই এজেন্ডা। অন্যদিকে জার্মানি ঘোষণা দিয়ে বসেছে, ২০১৪ সালের পরেও আফগানি জনগণকে সাহায্য করার জন্য তাদের সামরিক উপস্থিতি বহাল থাকবে। আমাদের এই ধরনের সাহায্যের কোনো দরকার নেই। এরা একদল খুনি, লুটেরা, নারীবিদ্বেষী, সন্ত্রাসবাদী, সমরপ্রভুকে সাহায্য করছে। এমনকি পরোক্ষভাবে তালেবদেরকেও। কারণ এই ১১ বছর এরা পর্দার অন্তরালে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা-আইএসআইয়ের মাধ্যমে তালেবানদেরকে সমর্থন যুগিয়েছে। আজ অব্দি জারি আছে তাদের সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম। আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে অগণিত বেসামরিক নাগরিকদেরকে তাদের শিকারের জন্তুতে পরিণত করছে।

 
 
পরিশেষে, আপাতদৃষ্টিতে যে কলহটি আমরা প্রত্যক্ষ করছি, সেটা আদতে সমরপ্রভু, তালেবান ও তাদের আশ্রয়দাতা ধর্মপিতার মধ্যে একটা পারিবারিক ঝগড়া মাত্র। দুর্ভাগ্যবশত ন্যাটো এই জঘন্য যুদ্ধাপরাধের নীতিটাই অনুসরণ করছে।   

 

শহিদুল আলম 

আপনার মতে, সমাধানটা কী? এখানে আমরা একটা দখলদার বাহিনী দেখতে পাচ্ছি যারা বলছে তারা চলে যাবে। লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে, যেমনটা আপনি নিজেই বললেন। আফগানরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় নিপতিত। তো কীভাবে এই বিষয়গুলোর মোকাবিলা হবে? আপনারা কীভাবে আপনাদের জনসাধারণকে মুক্ত করবেন?  

 

মালালাই জয়া  

সমাধানটা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বেচ্ছায় ও আন্তরিকভাবে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়া। কিন্তু তারা সেটা করবে না। আচ্ছা, কল্পনা করুন যে তারা সত্যিই তা করবে। তাহলে আমাদের সকল সমস্যার মূল এই দখলদারিত্বটা দূর হবে, তার একটা অবসান ঘটবে। এতে সমরপ্রভু আর তালেবানরা যে তহবিলের ওপর টিকে আছে তাতে টান পড়বে। কিন্তু এরা তো আসলে ছেড়ে যাবে না আফগানিস্তান। তাই, আমাদের জনগণের সামনে দুটি বিপর্যয়কর সমাধান আছে: হয় লড়াই করো, আর না হয় আপস করে চুপ থাকো। আমি যেমনটা এর আগেও বলেছি, আমাদের একটা শক্তিশালী ইতিহাস আছে, আর আফগান জনগণ কোনো দিনই চুপ থাকেনি। যতদিন দখলদার বাহিনী ও তাদের পুতুলরা ওদের ফ্যাসিবাদ আর যুদ্ধাপরাধ চালিয়ে যাবে, ততদিন তাদের প্রতি জনগণের ঘৃণা বৃদ্ধি পাবে। আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের, গণতন্ত্রমনা দলগুলোর ক্ষোভ বাড়বে। এসব দলের চাইতেও সংখ্যায় অনেক বেশি বুদ্ধিজীবী আছে আমাদের। এই গণতন্ত্রমনা মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীগুলো এই সন্ত্রাসবাদী, তহবিলখোর, সমরপ্রভু, আর তালেবানদের সামনে একটা বিশাল বাধা। আর আমাদের দেশের ইতিহাস থেকে এটা পরিষ্কার যে, স্বাধীনতার জন্য শুধু ঘাম ঝরালেই হয় না, রক্তও দিতে হয়।   

 

তারা (দখলদার ও তাদের পুতুলরা) আফগানিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে এবং নিরীহ আফগানদেরকে খুন করছে, হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, ও অব্যাহত রাখছে তাদের রঙবেরঙের ফ্যাসিবাদ। রুশ আগ্রাসনের ক্ষেত্রেও ঠিক এই জিনিসটাই ঘটেছিল। দখলদারের বিরুদ্ধে হাতিয়ার তুলে নিতে সেই সময়ও আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ভয় পাননি। ভয় পাননি পাহাড়ে যেতে, নিজের দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াতে।   

 

আমাদের দেশের মানুষ যত ক্লান্তই হোক, তাদের যত জখমই থাকুক, তারা হাতিয়ার আর যুদ্ধকে যতই ঘৃণা করে থাকুক, স্বাধীনতা-মুক্তির প্রশ্নে যদি তাদের সামনে আর কোনো উপায় না থাকে– যেমনটা আজ নেই– আমি নিশ্চিত যে তারা প্রতিরোধের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করবেন না। এমনকি যদি খালি হাতে লড়তে হয় লড়বে, দখলদারদেরকে একটা উচিত শিক্ষা দিবে। যেমনটা আমরা এর আগে রুশদেরকে দিয়েছিলাম, ব্রিটিশদেরকে দিয়েছিলাম। আমি আমার জনগণের ওপর আস্থা রাখি, আমি আমাদের দেশের ইতিহাসে বিশ্বাস করি। আমরা অনুসরণ করি মুক্তিযোদ্ধাদের দেখানো পথ। আজ না হোক কাল, বেঁচে থাকি বা না থাকি, আমাদের আর দেখা হোক বা না হোক। আমাদের দেশের মানুষের ওপর আমার বেঁচে থাকার বা আমার মরে যাওয়ার কোনো প্রভাব পড়বে না। যেমন সামাদ বেহরাঙ্গি (ইরানি সাহিত্যিক) বলেছেন, মৃত্যু যেকোনো সময়ই আসতে পারে, তবে আমাদের নিজে থেকে সেটি খোঁজা উচিত না। জীবন অথবা মৃত্যু তখনই যথার্থ হয় যখন এটি অন্যদের জীবনে প্রভাব ফেলে।

  
 
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এবং এই কথা বলতে কখনোই ক্লান্ত হব না যে, মুক্তি জিনিসটা একটা জাতি আরেক জাতিকে দান করতে পারে না। গণতন্ত্র, মুক্তি, নারী অধিকার, স্বাধীনতা, মানবাধিকার, শান্তি, ন্যায় এই মূল্যবোধগুলো একটা সুন্দর ফুলের তোড়া নয় যে বিদেশিরা আমাদের উপহার দেবে। ইতিহাসে আমাদের এই অভিজ্ঞতাটা অসংখ্যবার হয়েছে। বিশেষ করে এই ১১ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ন্যাটো আমার দেশবাসীর সঙ্গে, এবং সে সাথে গণতন্ত্র আর নারী অধিকারের মতো মূল্যবোধগুলোর সঙ্গে রীতিমত বেঈমানি করেছে। তারা এগুলোর নামে নিজেদের অপরাধকে বৈধতা দিয়ে গেছে, যুদ্ধাপরাধ অব্যাহত রেখেছে। দিনশেষে এটা আফগান জনগণেরই দায়িত্ব যে তারা তাদের দেশটাকে মুক্ত করবে, নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতে বিদেশিদের নাক গলাতে দেবে না। কারণ এই মূল্যবোধের দোহাই দিয়ে দখলদাররা আপনাকে ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে নিক্ষেপ করবে। যেমনটা তারা (যুক্তরাষ্ট্র) করেছে আফগানিস্তানে, করেছে ইরাকে।   

 

আফগানদের কথা ভুলে যান, তারা ইরাকে যা করেছে, শুধু সেই কারণেই তাদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত ছিল। ক্ষমার অযোগ্য আর বিস্মরণের অযোগ্য সব অপরাধ। আর লিবিয়ায় তারা যা করেছে, স্বৈরাচারী শাসনের অবসান করতে গিয়ে আল কায়েদাকে মদদ দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে। মিশরে কী করেছে তারা! আজকে মিশরে কী চলছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে যেই মৌলবাদী মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় এসেছিল তাদের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। এটা রাজনৈতিক ইসলামের আরেকটি উদাহরণ, যারা নিজ জনগণের বিরুদ্ধে একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের জন্য রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম মেশায়। এটা তাদের বৈদেশিক হস্তক্ষেপ কামনারও উদাহরণ বটে।  

 

আশা করেছিলাম আফগানিস্তানেই শেষ হবে এই খেলা। কিন্তু না, দুর্ভাগ্যবশত তারা এই যুদ্ধের ধারা নিয়ে হাজির হচ্ছে অন্য দেশগুলোতেও, চালাচ্ছে আগ্রাসন। ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় শুধু আফগানিস্তানেই নয়, পৃথিবীর যেকোনো দেশেই; গণতন্ত্র, শান্তি ও ন্যায়ের মতো মূল্যবোধগুলো যুদ্ধ, সামরিক আগ্রাসন কিংবা বৈদেশিক আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে অর্জন করা যায় না। এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে।    

 

আফগানিস্তানকে মুক্ত হতে হবে নিজের জনগণের দ্বারা, বিদেশিদের দ্বারা নয়। সত্যিকারের গণতন্ত্র কেবল গণক্ষমতার মাধ্যমেই আসতে পারে। আর আমি বিশ্বাস করি জনগণের ক্ষমতা খোদার ক্ষমতার মতোই। কিন্তু আজকে আফগানিস্তানের মানুষের পর্যাপ্ত খাবার নেই, জনগণের নিরাপত্তা নেই, আর এই সবকিছুর জন্য দায়ী দখলদার আর তাদের পুতুলরা। আজকে সারাবিশ্ব নারী অধিকারের কথা বলছে, কিন্তু এ দেশে অধিকাংশ নারীদের অধিকার দূরে থাক, ন্যূনতম মানবাধিকারটুকুও নেই। তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যেন এক সর্বগ্রাসী ধ্বংসযজ্ঞ। এই দেশে পাখি হত্যার চেয়েও সহজ নারী হত্যা।  

 

শহিদুল আলম 

আমার মনে হয় আপনি আফগানিদের প্রসঙ্গে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের দিকে আঙ্গুল তুলতে যাচ্ছিলেন… 

 

মালালাই জয়া 

হ্যাঁ, একটা উদাহরণ হিসাবে বলতে চাইছিলাম যে, শুধু আফগানিস্তানেই তারা দিনের পর দিন ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে না। যে যুদ্ধটা তারা চালাচ্ছে সেটার দিকে একটু তাকান। পাকিস্তানেও তারা ড্রোন হামলা চালাচ্ছে; আর লিবিয়ায়, তারপর মিশরে, এখন সিরিয়ায়। এছাড়া তিউনিশিয়ায় আরব বসন্তের মাধ্যমে আর অন্যান্য দেশেও।


 
তারা ঠিক সেই যুদ্ধটাই চালাচ্ছে, যার উদারহণ হিসেবে আমি ইরাক আর পাকিস্তানের নাম উল্লেখ করেছি। ড্রোন হামলায় অগণিত নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। মিশরের মতো দেশে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ চালাচ্ছে। সেখানে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। নতুন সরকার ক্ষমতা নিতে না নিতেই মানুষ রাস্তায় নেমে স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। আর ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে, সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেদের পুতুলদেরকে ক্ষমতায় বসায়। তবে আমি নিশ্চিত, সময়ের সঙ্গে মানুষ এই প্রকার ক্ষমতাগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। 

 

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই জনগণের এই বিস্ফোরণ লাখ লাখ মানুষকে আশা যোগায়। কিন্তু পয়সার অপর পিঠেই আপনি দেখতে পাবেন বিদেশিদের হস্তক্ষেপ, বিশেষ করে আমেরিকার। দেশে দেশে মার্কিন হস্তক্ষেপ দেশগুলোর জনসাধারণকে আগুনের দিকে, ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে; যেমনটা আমার দেশে ঘটেছে।  

 

একটা দেশে বিদেশিরা হস্তক্ষেপ চালালে যে সেই দেশের মানুষের জীবনে সুখ, শান্তি, নারী অধিকার, ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয় না, সেটা জানা ও বোঝার জন্য সারা দুনিয়ার সামনে আফগানিস্তান খুব ভালো একটা উদাহরণ। তারা আমার দেশের মানুষকে কোণঠাসা করে ফেলেছে।  

 

সিরিয়ায় তারা শান্তি, ন্যায়, গণতন্ত্র ইত্যাদির ছায়াতলে যা করছে, তাতে অগণিত বেসামরিক নাগরিকের রক্ত ঝরছে। এই তালিকা দীর্ঘ হবে যদি আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন প্রশাসনের ইতিহাসের দিকে তাকাই। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অসংখ্য দেশে হস্তক্ষেপ করেছে তারা, বসিয়েছে নিজেদের পুতুল সরকার, যা ঠিক আগেরগুলোর মতোই। বস্তুত কোনই পার্থক্য নেই। 

 

দেশগুলোকে অন্ধকার যুগে পাঠানো হচ্ছে। এটা চিরকাল চলতে পারে না।  

 

শহিদুল আলম 

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী? তারা কি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে? 

 

মালালাই জয়া 

দুর্ভাগ্যবশত আফগানিস্তানের যুদ্ধটা নিছকই একটা সামরিক যুদ্ধ নয়, এটা একই সঙ্গে একটা প্রচারণা যুদ্ধও। মূলধারার গণমাধ্যম একটা ভালো হাতিয়ার, যেটা এক্ষেত্রে রয়েছে দখলদারদের হাতে। যুদ্ধবাজ আর তাদের পুতুলরা মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছে। ভালো মানুষেরা, ন্যায়প্রেমীরা এদের কারণে দিশা হারাচ্ছে। শুধু আফগানিদের কথা বলছি না আমি, যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশের জনগণকেও ধোঁকা দিয়েছে।  

 

তবে আমি এটা ভেবে আনন্দিত হই যে, ক্রমশই আফগানিস্তানের এই জঘন্য যুদ্ধটা একটা ওপেন সিক্রেটে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই অনন্ত যুদ্ধের প্রকৃত রূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় ও শান্তিকামী জনগণের সামনে পরিষ্কার হয়ে উঠছে। এই কারণেই মার্কিন সরকার তাদের যুদ্ধবিরোধী ও ন্যায়প্রেমী জনগণের তোপের মুখে আছে। এমনকি এর বিরুদ্ধে খোদ সেনাবাহিনীর ভেতরই প্রশ্ন জাগা শুরু করে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর অতল গহ্বর থেকেই বিবেকের তাড়নায় জেগে উঠছেন এডওয়ার্ড স্নোডেনের মতো ইতিহাসের মহানায়করা, উন্মোচন করছেন নিজ দেশের ক্ষমতার যুদ্ধাপরাধসমূহ। সারা দুনিয়ার ন্যায়প্রেমী জনগণের কাছে সত্যটা পৌঁছে দিচ্ছে। নানান উপায়ে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন এরকম একটি উদাহরণ। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয়, অন্য বহু দেশ থেকেও নজির টানা যেতে পারে। বিশেষ করে যে দেশগুলোর সৈন্য আফগানিস্তানে মোতায়েন করা রয়েছে। তাই আমি মনে করি, এত কিছুর পরে ন্যায়প্রেমী জনগণকে আর ধোঁকা দেওয়া সহজ হবে না গণমাধ্যমের পক্ষে। প্যাট্রিক টাইলারের সঙ্গে এক রকম একমত পোষণ করি আমি, যখন তিনি বলেন, দুনিয়ায় পরাশক্তি দুইটি– মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর বিশ্বজনমত। বিশ্বজনমত নিজে থেকে ধোঁকা খায়নি, প্রচারণা চালিয়ে তাদের ধোঁকা দেওয়া হয়েছিল। আবারও আমি আশা ব্যক্ত করছি, তারা আর ধোঁকা খাবে না।   

 

গণমাধ্যম শুধু প্রচারণাই চালাচ্ছে না, নির্লজ্জের মতো বড় বড় সব মিথ্যাচার করে চলেছে। একদিকে তাদের রাষ্ট্র নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদেরকে খুন করে, অন্যদিকে তারা নির্লজ্জের মতো বেসামরিক নাগরিকের লাশের সংখ্যা কমিয়ে উল্টো তাদেরকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দেয়। এগুলো ভয়াবহ পর্যায়ের মিথ্যাচার। আফগানিস্তানেও আমাদের অনেকগুলো টেলিভিশন সংবাদপত্র রয়েছে। এগুলোর পেছনে আমরা মিলিয়ন ডলার ব্যয় করি। কিন্তু প্রতিটা টিভি চ্যানেলের মালিক মৌলবাদী গোষ্ঠী ও এসব বিদেশি শক্তিদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলে। এমনকি ইরান আর পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোরও নিজস্ব পুতুল (আফগানিস্তানে) রয়েছে। আমাদের দেশটাকে রোগাক্রান্ত রাষ্ট্র হিসেবে দেখায় তারা (সংবাদমাধ্যমগুলো)। সংবাদমাধ্যম হলো তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার যা দিয়ে মানুষকে সহজেই বোকা বানানো যায়। এখানে প্রচুর সেন্সরশিপের ঘটনাও ঘটে। এমন বহু প্রতিবেদন এসেছে আমাদের কাছে।     

 

গত বছরটা খুব রক্তাক্ত ছিল সাংবাদিকদের জন্য। যে সাংবাদিকরা সত্য বলেন তাদেরকে খুনের হুমকি দেওয়া হয়। এমনকি যখন আমাদের সংবিধানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা লেখা ছিল, তখনও খোদ সংসদের ভেতরে চারবার সাংবাদিক পেটানোর ঘটনা ঘটেছে। আফগানিস্তানে ঠিক কোন ধরনের আইনের শাসন বিদ্যমান, এটা তারই উদাহরণ। এমনকি সংসদের ভেতরেও তারা আইনের তোয়াক্কা করে না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই উদাহরণ দেই। আমার দেওয়া বক্তব্যের সত্যতা নিশ্চিত হওয়ায় যখন সাধারণ মানুষ আমাকে অনুসরণ করা শুরু করে, ঠিক সে মুহূর্তেই আমাকে গণমাধ্যম থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। শুধু যে নিষিদ্ধ করে তাই নয়, আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রচারণা চালায় যে, এই নারী তো আফগানিস্তানে থাকে না। কিন্তু আমি বুক টানটান করে নিজ দেশেই বাস করছি। দেশের মানুষের চেয়ে আমি ভালো নেই। তাদের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যোগাযোগ হয়। আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবেই লড়ে যাচ্ছি।   

 

শুধু আমার ক্ষেত্রেই না, দেশে এমন অনেক মুক্তিকামী সাহসী মানুষ আছেন যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করছেন। এই গণমাধ্যমে তাদের কথা কখনো আসে না। আফগানিস্তানের সলিডারিটি পার্টির কথাই ধরুন, এটা একটা গণতন্ত্রমনা পার্টি যা তরুণরা চালায়। এই তরুণরা দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে, মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করে। তাদের শেষ প্রতিবাদ মিছিলে হাজার হাজার মানুষ অংশ নিয়েছে। কিন্তু আফগানিস্তানের গণমাধ্যমের মাফিয়ারা এটি নিয়ে টুঁ শব্দটাও করেনি। আর যদি কালেভদ্রে প্রতিবেদন করেও থাকে, কোণাকাঞ্চিতে দায়সারা গোছের প্রতিবেদন হয় সেগুলো।  

 

গণমাধ্যম স্বাধীন নয় এবং এর হাতিয়ারগুলো রয়েছে দখলদার ও তার পুতুলদের হাতে। যারা জনগণকে ধোঁকা দিচ্ছে, সারা দুনিয়ার ন্যায়প্রেমী জনগণের চোখে ধুলো দিচ্ছে। তবুও আমার প্রত্যাশা, জনগণ সে ফাঁদে পা দেবেন না। দয়া করে এই গণমাধ্যমগুলোর একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না। তাদের প্রচারণা আর মিথ্যাচারগুলো বিশ্বাস করবেন না। যদি সত্য জানতে চান, তাহলে শুধু কাবুলের ত্রিসীমানায় আঁটকে না থেকে দূরবর্তী প্রদেশগুলোতে যান। লাখ লাখ আফগান নারী ও পুরুষের জন্য প্রতিটি মুহূর্ত নরকের মতো। শান্তির বার্তা নিয়ে হাজির দাবি করা এই সহস্র সৈন্যের উপস্থিতি তাদেরকে শুধু অন্যায্যতা, নিরাপত্তাহীনতা, দুর্নীতি, বেকারত্ব আর দারিদ্র্যতাই উপহার দিয়েছে। এই সময়েও লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। দিনে মাত্র দুই ডলার খরচ করতে পারে তারা। বহু মা তাদের নবজাতককে মাত্র ১০ ডলারের বিনিময়ে বেঁচে দিতে প্রস্তুত। গণমাধ্যম কখনো এই সত্যগুলো সামনে আনে না। যদি আনত, আমি হলফ করে বলতে পারি, আপনারা– দুনিয়ার লাখ লাখ মানুষ আঁতকে উঠত। সেসব দেশের করদাতাদের যে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আমার দেশে পাঠাচ্ছে তা এই মাফিয়াদের পকেটে ঢুকে যাচ্ছে। এই সমরপ্রভুদের সরকারের পকেটে ঢুকে যাচ্ছে। তারা এই টাকা জমাচ্ছে বিদেশি সব ব্যাংকে, নিজ দেশে যাপন করছে বিলাসবহুল জীবন। আপনি দেখতে পাবেন এখানে দামি দামি সব বিপণিবিতান, হোটেল গড়ে উঠেছে। আর মেয়েদের জন্য তারা কিছু স্কুল বানিয়েছে, গুটিকয়েক নারী পড়াশোনা ও চাকরি করার সুযোগ পেয়েছে। এটা দখলদারদের জন্য সমুদ্রে একফোঁটা বিন্দুর মতো। কিন্তু দূরবর্তী প্রদেশগুলোতে যান, দেখবেন সাধারণ মানুষ কিছুই পায়নি।   

 

শহিদুল আলম 

বলাই বাহুল্য, এই মুহূর্তে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই জটিল। দেশটির আয়ের একটি প্রধান উৎস মাদক, আরেকটি বৈদেশিক সহযোগিতা। ধরে নিন, বিদেশিরা সব গাট্টিবোঁচকা নিয়ে চলে গেল। হুট করে, কোনো বিকল্প ব্যবস্থা দাঁড় না করিয়ে মাদক বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেলে কীভাবে চলবে আফগানিস্তান? 

 

মালালাই জয়া 

যদি খুনরাঙা হাতে আঁকা এই ক্যারিকেচার গণতন্ত্রের জায়গায় অন্তত আধখেঁচড়া একটা গণতন্ত্রও আমাদের থাকত, যদি দখলদারদের দেশে যেমন গণতান্ত্রিক সরকার আছে তেমন সরকার থাকত, তাহলে আজ আফগানিস্তান বেহেশত হয়ে যেত। আন্তর্জাতিক তহবিলের থেকে যে টাকা তারা আফগান বিধবা ও এতিমদের কথা বলে, শিক্ষা ও পুনর্গঠনের কথা বলে সারা দুনিয়া থেকে আনে, তার বড় অংশটাই ক্ষমতায় থাকা দুর্নীতিবাজরা লুটেপুটে খায়। এই লুটপাটে পরোক্ষভাবে হলেও তালেবানও অংশ নিয়েছে। তো আমাদের এখানে ধনী মানুষের অভাব নেই। এমনকি আমাদের এই পুতুল রাষ্ট্রপতি নিজেও একবার বলেছিলেন যে, আফগানিস্তানের মানুষের খাওয়া-পরার জন্য যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ এখানেই আছে। আপনারা জানেন আমাদের দেশে কপার, ইউরেনিয়াম, লিথিয়ামের বিশাল মজুদ আছে। মাইলের পর মাইল উর্বর জমি আছে, আছে লোকবল। কিন্তু তাও কেন আমাদের এত খারাপ রকমের চাকরির সংকট? কেন দখলদারদের এই পুতুল সরকার বেকারত্ব ঘুচাতে ব্যর্থ? এর উত্তর আমরা জানি। এর কারণ হলো তারা চায় না আফগানিস্তানের মানুষের সার্বিক বিকাশ হোক। তারা এমনকি আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতিকেও দখল করে ফেলেছে। 

 

আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বন্ধ করতে তারা তাদের পুতুল আর গোঁড়া জঙ্গিদের ব্যবহার করেই যাচ্ছে। ঠিক এই কারণেই আমরা চাই তারা আফগানিস্তান ত্যাগ করুক। 

 

শহিদুল আলম 

অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনি আমাদেরকে একটা জটিল অবস্থার বেশ নিখুঁত একটা বোঝাপড়া দিয়েছেন। আর কিছু কি যোগ করতে চান? 

 

মালালাই জয়া 

আসলে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি বুঝতে গেলে কেবল একটা বই পড়া অথবা একটা ওয়েবসাইট ঘাঁটা যথেষ্ট নয়। এই তিন দশকের দখল আর যুদ্ধ নিয়ে কেউ লিখতে চায় না। বরং তালেবানকে নিয়ে লেখাটাই অনেকের জন্য আকর্ষণীয়। আপনারা তো জানেন উইকিলিকস-এর এক প্রতিবেদনে বের হয়ে এসেছে দখলদারদের পক্ষের আফগানিরা কীভাবে দেশে ও দেশের বাইরে রাজার হালে চলে। আপনারা দয়া করে এদের কথায় কান দেবেন না। আপনারা সলিডারিটি পার্টি অফ আফগানিস্তানের দিকে তাকান। এরাই এই দেশের ভবিষ্যৎ। আমার মতো মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান, আমার চারপাশে তরুণেরা আছে, যারা আরেকটা আফগানিস্তানের স্বপ্ন দেখে, যে আফগানিস্তানের প্রতিটা অন্ধকার কোণায় স্কুল থাকবে। এদেশটাকে পুনর্গঠন করার দায়িত্ব ওদের কাঁধেই, তাদের প্রয়োজন মুক্তিকামী সহযোদ্ধা। তাই এই লড়াইয়ে আপনাদেরকে প্রয়োজন। দুই রকমের সহযোগিতাই আমাদের দরকার, নৈতিক ও আর্থিক।  
 
শহিদুল আলম 

মালালাই জয়া, আমাদের এই আলাপটির জন্য বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

Your Comment