বৃহঃস্পতিবার ১৪ই চৈত্র ১৪৩০ Thursday 28th March 2024

বৃহঃস্পতিবার ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

Thursday 28th March 2024

বহুস্বর মতামত

চা শ্রমিক আন্দোলনে গোয়েন্দা তৎপরতা কেন?

২০২২-০৮-২৫

মিখা পিরেগু

দেশব্যাপী চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন চলছে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেশের সকল চা বাগানের শ্রমিকেরা গত ৯ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে রয়েছেন। এই সময়ে সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ অবরুদ্ধ করে শ্রমিকেরা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। 

 

৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আজকেও ধর্মঘট করছেন শ্রমিকরা। আলোকচিত্র: সুমন পাল

 

 

চা শ্রমিক তথা চা জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণে চলমান আন্দোলনে উঠে এসেছে চা শ্রমিকদের উপর অব্যাহত শোষণ নিপীড়নের বিরাজমান রূপ। যার ফলে দেশের আপামর জনগণের সমর্থনে চা শ্রমিকদের মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবিটি যৌক্তিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। কিন্তু যেকোনো সংগঠিত আন্দোলনে ভীতসন্ত্রস্ত বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিকা এই আন্দোলনের ক্ষেত্রেও পৃথক কিছু নয়। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলন থেকে কৃষক কিংবা শ্রমিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় আন্দোলন দমাতে বা ক্ষোভ প্রশমিত করতে প্রশাসনিক কাঠামো, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ব্যাবহার করা হয়েছে। চা শ্রমিকদের চলমান আন্দোলন দমাতেও সেই একই নিবর্তনমূলক চরিত্র ধরে রেখেছে ক্ষমতাসীন সরকার।

 

 

দেখা গেছে, দীর্ঘ দুই সপ্তাহ ধরে চলা চা শ্রমিক ধর্মঘটের বিভিন্ন সময়ে বাগান মালিক ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সাথে চা শ্রমিকদের দফায় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গত ১৬ আগস্ট চা শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল শ্রম অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়ে মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন। এর পরদিন ১৭ আগস্ট ঢাকার শ্রম অধিদপ্তরে চা শ্রমিক ইউনিয়ন, চা বাগান মালিক ও শ্রম অধিদপ্তরের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

 

 

আবার ২০ আগস্ট শ্রম অধিদপ্তরের মৌলভীবাজারে শ্রীমঙ্গল বিভাগীয় কার্যালয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ, শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন চা শ্রমিকদের প্রতিনিধিদল। এর আগে বিভিন্ন সময় মালিকপক্ষের সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ ২১ আগস্ট রাতে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে মালিকপক্ষ, শ্রমিক ইউনিয়ন, শ্রম অধিদপ্তরের প্রতিনধিসহ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। 

 

 

উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, এসকল দ্বিপক্ষীয় কিংবা ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়াও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার উপস্থিতি প্রতীয়মান হয়েছে। উল্লিখিত সবগুলো বৈঠকে “প্রধানমন্ত্রীর উপর আস্থা রেখে চা শ্রমিকদের আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়েছে” এই মর্মে লিখিত ও সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

 

 

এসকল দ্বিপক্ষীয় কিংবা ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়াও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার উপস্থিতি প্রতীয়মান হয়েছে। উল্লিখিত সবগুলো বৈঠকে “প্রধানমন্ত্রীর উপর আস্থা রেখে চা শ্রমিকদের আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়েছে” এই মর্মে লিখিত ও সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

 

 

গত ২০ আগস্ট শ্রম অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয় শ্রীমঙ্গলে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন জৈষ্ঠ সচিব, স্থানীয় সাংসদ আব্দুস শহীদ, শ্রম অধিদপ্তরের পরিচালক,  চা শ্রমিক ও বাগান মালিকদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে নাতিদীর্ঘ সভা শেষে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ সংবাদমাধ্যমকে জানান “প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়েছে। নতুন মজুরি ১৪৫ টাকা নির্ধারিত হয়েছে”। চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ কাজে ফেরার ঘোষণা দিলেও বাগানে বাগানে চা শ্রমিকেরা এই সিদ্ধান্ত মেনে নেননি। বরং আরও ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়। ফলে পরদিন চা শ্রমিকেরা ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে অবস্থান নেয়। দিনব্যাপী অবরোধে সিলেটের সাথে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়।

 

 

বিভিন্ন পয়েন্টে প্রশাসন ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিরা নানামুখী তৎপরতা করলেও রাজপথ থেকে চা শ্রমিকেরা ফিরে যাননি। এর মাঝে রাত ১০টার পর মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সকলপক্ষকে নিয়ে বৈঠক শুরু হয়। পরে রাত ২ টায় চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা গণমাধ্যমকে জানান “শ্রমিক ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে কাল থেকে শ্রমিকেরা কাজে যোগ দিবে আগের মজুরিতেই”। পুনরায় এ ব্যাপারে লিখিত দেন চা শ্রমিক ইউনিয়িনের নেতৃবৃন্দ। বৈঠকের পর মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সকলপক্ষের সাক্ষর করা একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়। সেখানে মালিক, শ্রমিক ও সরকারের প্রতিনিধি ছাড়াও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। অভিযোগ আছে সর্বশেষ দুটি সভায় চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় সভাস্থলে নিয়ে আসা হয়। রাতের আঁধারে করা বৈঠকের পর চা শ্রমিক ইউনিয়নের সেই ঘোষণার পরেও চা শ্রমিকেরা কাজে যোগ দেননি। বিভিন্ন বাগানে বাগানে পঞ্চায়েতরা চা শ্রমিক ইউনিয়নের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছে।

 

 

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনিক কাঠামো ব্যবহার করে বর্তমান সরকার বিভিন্ন সময় চা শ্রমিকদের বিক্ষোভ প্রশমিত করলেও এখন আর সেটা কাজ করছে না। ফলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা চলমান চা শ্রমিক আন্দোলন ঘিরে পরিলক্ষিত হচ্ছে। নিরীহ চা শ্রমিকদের ভীত সন্ত্রস্ত রেখে অমানবিক মজুরি মেনে নিয়ে কাজে ফেরানোই যেন এদের মূল কাজ। 

 

 

 

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনিক কাঠামো ব্যবহার করে বর্তমান সরকার বিভিন্ন সময় চা শ্রমিকদের বিক্ষোভ প্রশমিত করলেও এখন আর সেটা কাজ করছে না। ফলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা চলমান চা শ্রমিক আন্দোলন ঘিরে পরিলক্ষিত হচ্ছে। নিরীহ চা শ্রমিকদের ভীত সন্ত্রস্ত রেখে অমানবিক মজুরি মেনে নিয়ে কাজে ফেরানোই যেন এদের মূল কাজ। 

 

 

গোয়েন্দা তৎপরতা দিয়ে বৈষম্য চাপা দেয়া যাবে না

খোদ শ্রম আইনেও বৈষম্যের শিকার চা শ্রমিকেরা। শ্রম আইনের ১১৫ নম্বর ধারায় উল্লেখ আছে কেবল মাত্র চা শ্রমিক ছাড়া সকল শ্রমিক ১০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি প্রাপ্য হবেন কিংবা শ্রম আইনের ১১৭ ধারায় উল্লেখ থাকা সকল শ্রমিক প্রতি ১৮ দিন কাজের জন্য একদিন অর্জিত ছুটি প্রাপ্য হবেন আর চা শ্রমিকেরা প্রতি ২২ দিনে এক দিন ছুটি প্রাপ্য হবেন। শ্রম আইনের ৪৫ ধারায় উল্লিখিত প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা নারী চা শ্রমিকেরা অদ্যাবধি পায়নি। বরং মাতৃত্বকালীন ছুটির বিষয়ে সবাই উদাসীন। ৪৫ ধারায় বলা আছে তবে শর্ত থাকে যে, চা-বাগান শ্রমিকের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট চা-বাগানের চিকিৎসক কর্তৃক যতদিন পর্যন্ত সক্ষমতার সার্টিফিকেট পাওয়া যাইবে ততদিন পর্যন্ত উক্ত শ্রমিক হালকা ধরনের কাজ করিতে পারিবে। এমন বৈষম্য খোদ শ্রম আইনে বিদ্যমান থাকায় চা শ্রমিকদের অন্যান্য সুবিধাদি যেমন বাধ্যতামূলক গ্র্যাচুয়িটি ও গ্রুপবীমার ব্যাপারে এখনও কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই।

 

 

শ্রম আইনের ৯৫ ধারায় চা-বাগানে বিনোদন ও শিক্ষার সুবিধা সম্পর্কে সরকারকে বলা হয়েছে –“(ক) বিধি প্রণয়ন করিয়া উহার প্রত্যেক মালিককে সেখানে নিযুক্ত শ্রমিকগণ এবং তাহাদের শিশু সন্তানগণের জন্য বিধিতে উল্লিখিত বিনোদনমূলক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার জন্য নির্দেশ দিতে পারিবে; (খ) যে ক্ষেত্রে কোন চা-বাগানের শ্রমিকগণের ছয় হইতে বারো বছর বয়সী শিশু সন্তানগণের সংখ্যা পঁচিশ এর উপরে হয় সে ক্ষেত্রে, বিধি প্রণয়ন করিয়া উহার মালিককে, বিধিতে উল্লিখিত প্রকারে এবং মানের শিশুদের শিক্ষার সুযোগ এর ব্যবস্থা করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারিবে; (গ) প্রতিটি চা বাগানে শ্রমিকদের এবং তাহাদের সন্তানদের জন্য বিধি দ্বারা নির্ধারিত পন্থায় উপযুক্ত চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।”

 

 

শ্রম আইনের ৫৯ ধারা মতে, প্রত্যেক কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষের জন্য পৃথক ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ও ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করা মালিকের দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রতিটি চা বাগানে আছে নামমাত্র চিকিৎসা কেন্দ্র যেখানে সকল রোগের ওষুধ প্যারাসিটামল। নেই কোনও পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা। চা বাগানের শিশুদের সুস্থ বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা যেমন নেই তেমন নেই পর্যাপ্ত শিক্ষার সুযোগ। প্রতিটি চা বাগানে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও, বর্তমান শিক্ষা কাঠামোর বিচারে এগুলোকে অপূর্ণাঙ্গই বলা চলে। শ্রম আইনের ৯৬ ধারায় বাগান মালিকদের বলা হয়েছে, “প্রত্যেক চা বাগানের মালিক চা বাগানে বসবাসরত প্রত্যেক শ্রমিক এবং তাহার পরিবারের জন্য গৃহায়নের সুবিধার ব্যবস্থা করিবেন।” কিন্তু পরিবার প্রতি ৭৫০ বর্গফুটের একটি আধা কাঁচা বাসস্থানই ইঙ্গিত করে সরকারের মতো বাগান মালিকেরাও এক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করে শোষণ জারি রেখেছে।

 

 

বাস্তবতা হচ্ছে প্রতিটি চা বাগানে আছে নামমাত্র চিকিৎসা কেন্দ্র যেখানে সকল রোগের ওষুধ প্যারাসিটামল। নেই কোনও পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা। চা বাগানের শিশুদের সুস্থ বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা যেমন নেই তেমন নেই পর্যাপ্ত শিক্ষার সুযোগ। প্রতিটি চা বাগানে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও, বর্তমান শিক্ষা কাঠামোর বিচারে এগুলোকে অপূর্ণাঙ্গই বলা চলে। শ্রম আইনের ৯৬ ধারায় বাগান মালিকদের বলা হয়েছে, “প্রত্যেক চা বাগানের মালিক চা বাগানে বসবাসরত প্রত্যেক শ্রমিক এবং তাহার পরিবারের জন্য গৃহায়নের সুবিধার ব্যবস্থা করিবেন।” কিন্তু পরিবার প্রতি ৭৫০ বর্গফুটের একটি আধা কাঁচা বাসস্থানই ইঙ্গিত করে সরকারের মতো বাগান মালিকেরাও এক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করে শোষণ জারি রেখেছে।

 

 

এমনকি ১৯৬২ সালের টিপ্ল্যান্টেশন লেবার অর্ডিন্যান্স এবং ১৯৭৭ সালের প্ল্যান্টেশন রুলস-এ চা শ্রমিকদের শিক্ষা, বসবাস ও স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য বাগান মালিকদের প্রতি সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও এর ন্যুনতমও বাস্তবায়ন হয়নি।

 

 

আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, চা শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। ওয়ান পার্টি স্টেটের ন্যায় চা শিল্পেও কেবল একটি মাত্র ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে। অবাস্তব বিধি বিধান দ্বারা চা শ্রমিকদের বিকল্প শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করার সুযোগকে সীমিত করা হয়েছে। সরকারের লেজুরবৃত্তিক সংগঠন হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নই মূলত চা শ্রমিকদের অদ্বিতীয় ট্রেড ইউনিয়ন। বিকল্প ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে প্রতি চা বাগান, প্রতি ভ্যালি ও মোট চা বাগানে ৩০ ভাগ শ্রমিকের অংশগ্রহণ থাকতে হবে, যা একটি অবাস্তব শর্ত কেননা বর্তমান সকল চা শ্রমিকই চা শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য এবং চা বাগানে দীর্ঘকাল স্থায়ী শ্রমিকের নতুন নিয়োগ নেই। যার ফলে বাধ্য হয়েই চা শ্রমিক ইউনিয়ন ব্যাতিত ভিন্ন কোনো ট্রেড ইউনিয়ন চা শ্রমিকেরা করতে পারছে না। যা আইএলও কনভেনশন বিরোধী ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আরও অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে চা বাগানের ইজারাদারদের চা বাগান মালিক হিসেবে মূলধারায় প্রচলিত করে চা জনগোষ্ঠীর প্রতি সরকার ও রাষ্ট্রকাঠামো দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে। কেননা চা বাগানের মালিকানা রাষ্ট্রের। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ইজারাদাররা চা চাষের জন্য বিভিন্ন শর্তে ইজারা নিয়ে থাকেন। ইজারাদারেরা আইন ও বিধি মেনে চা বাগান পরিচালনা করে কি না সেটার তদারকি সরকার আর করেনা। ফলে বাগান ইজারাদারেরা বাগান মালিক হিসেবে পরিচিত হয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভোগ করে। কারণ বাগান ইজারাদারদের সাথে সরকারের নিবিড় সংযোগ।

 

 

চা শ্রমিক আন্দোলনে গোয়েন্দা তৎপরতার বদলে সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের নিয়ে সমগ্র চা শিল্প সেক্টরে অনুসন্ধান করলে বেরিয়ে আসবে চা শ্রমিকদের উপর ক্রমাগতভাবে ঘটে যাওয়া নির্মম, অমানবিক শোষণের লুকায়িত গল্প। কেবল মজুরি বৈষম্যই নয়, প্রায় দুশো বছর বসবাস করেও ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া ছাড়াও রয়েছে চা শ্রমিক হিসেবে চিহ্নিত করে পেশাগত পরিচয়ের আড়ালে জাতিসত্ত্বার পরিচয়কে মুছে ফেলার চেষ্টা।

 

 

চা জনগোষ্ঠীর অর্ধশতাধিক জাতিসত্ত্বাকে স্বীকৃতি না দেয়া ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ভাষা সংস্কৃতিকে সংরক্ষণে উদাসীনতা। গোয়েন্দার চোখ দিয়ে তাদের বঞ্চনার তল খুঁজে পাওয়া যাবেনা, গোয়েন্দা সংস্থার জোর খাটিয়ে তাদেরকে দমন করাও আর যাবে না। যতবার পুরুষ চা ইউনিয়ন নেতাদের জোর করে কিংবা ভয় বা লোভ দেখিয়ে স্বাক্ষর করানো হয়েছে, আন্দোলন থামাবার ঘোষণা দেয়া হয়েছে, ততবার ঠিকই সাধারণ শ্রমিকরা মাঠে বের হয়ে এসেছেন। এখানে জোর খাটবে না। তাই চা শ্রমিকের কথা শুনতে হবে, সেটা শুনবার মতো চোখ আর কান যাদের আছে, তাদেরকে দিয়েই এই অনুসন্ধান করতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং পর্যালোচনায় অবশ্যই চা শ্রমিকদের ভূমিকা রাখতে হবে। নারী শ্রমিকরা যেহেতু চা বাগানের মূল শ্রমিক, তাদের প্রতিনিধিত্বও নিশ্চিত করতে হবে।

 

 

চা জনগোষ্ঠীর অর্ধশতাধিক জাতিসত্ত্বাকে স্বীকৃতি না দেয়া ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ভাষা সংস্কৃতিকে সংরক্ষণে উদাসীনতা। গোয়েন্দার চোখ দিয়ে তাদের বঞ্চনার তল খুঁজে পাওয়া যাবেনা, গোয়েন্দা সংস্থার জোর খাটিয়ে তাদেরকে দমন করাও আর যাবে না। যতবার পুরুষ চা ইউনিয়ন নেতাদের জোর করে কিংবা ভয় বা লোভ দেখিয়ে স্বাক্ষর করানো হয়েছে, আন্দোলন থামাবার ঘোষণা দেয়া হয়েছে, ততবার ঠিকই সাধারণ শ্রমিকরা মাঠে বের হয়ে এসেছেন। এখানে জোর খাটবে না। তাই চা শ্রমিকের কথা শুনতে হবে, সেটা শুনবার মতো চোখ আর কান যাদের আছে, তাদেরকে দিয়েই এই অনুসন্ধান করতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং পর্যালোচনায় অবশ্যই চা শ্রমিকদের ভূমিকা রাখতে হবে। নারী শ্রমিকরা যেহেতু চা বাগানের মূল শ্রমিক, তাদের প্রতিনিধিত্বও নিশ্চিত করতে হবে।

 

 

চা শ্রমিকদের চলমান আন্দোলনে সরকারও আর ভিন্ন কোনো পক্ষ নয়, বরং বাগান মালিকদেরই তারা মুখপাত্র। যারা আন্দোলন দমাতে শ্রমিকদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে বিক্ষোভকে বাধাগ্রস্থ করতে প্রশাসনিক কাঠামো থেকে অনির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের ব্যবহার করছেন। কিন্তু তাদের সেই প্রয়াস সফল হবে না চা শ্রমিকদের নিজভূমে পরবাসী করে রাখার দিন শেষ। সকল ষড়যন্ত্র, প্রলোভন, ভয়-ভীতি, হুমকি, ক্ষমতার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চা শ্রমিকদের মুক্তির সংগ্রাম চলছে। চা শ্রমিক নাকি শ্রমদাস এই প্রশ্নের উত্তর আজ রাষ্ট্রকে দিতে হবে। নতুবা অব্যাহত সংগ্রামের মাধ্যমেই চা শ্রমিকেরা দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির পথ খুঁজে নিবে।

 

 

মিখা পিরেগু

চা শ্রমিক সন্তান ও সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।