চেনা পৃথিবীটা আমাদের চোখের সামনেই বদলে যাচ্ছে দ্রুত। প্রযুক্তির বিকাশ ঘটছে অবিরাম, অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পেছনে ঢালা হচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার। রাজনীতিতে লোকরঞ্জনবাদের (পপুলিস্ট) উত্থান দেশে দেশে অর্থনীতির ধরন ও কর্মখাতকে প্রভাবিত করে চলেছে। আবার মহামারি কোভিড মোকাবিলায় গৃহীত নানা পদক্ষেপও পরিবর্তন এনে দিয়েছে কাজকর্মের এতদিনের অভ্যাসে। সব মিলিয়ে বড় ধরনের ধাক্কা লাগছে কাজের বাজারে। ব্যবসায়, চাকরি বা দৈহিক শ্রম, পেশা যেমনই হোক, তা কিছুই আর আগের মতো থাকছে না। ‘ফিউচারিস্ট’ তথা ভবিষ্যতবিদরা বলছেন, আগামী ১৫ বছরের মধ্যেই আসবে আমূল পরিবর্তন। সামনের দিকে দেখা যাবে এবং কদর পাবে, এমন কিছু পেশার ওপর আলোকপাত করেছেন আনিস রায়হান
অরূপ ঘরামির (৪২) বাড়ি পিরোজপুর জেলায়। আগে তাদের অঞ্চলের মানুষের ঘরবাড়ির ছাউনি দেওয়ার কাজটি বংশানুক্রমে ঘরামিরা করত। অল্প বয়সে বাবা তাকে এই কাজ শিখিয়েছিলেন। কিন্তু নব্বই সালের পর থেকেই টিনের ছাউনি বাড়তে থাকে। ঘরামির কাজের চাহিদাও কমে যায়। নতুন যেসব কাজ এসেছে, সেগুলোও তিনি কিছু শিখেননি। ২০০৩ সালে ঢাকায় এসে দোকানে দোকানে চাকরি শুরু করেন। ঢাকার মতিঝিলে তিনি একটি খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন এখন। তিনি জানান, নামে ঘরামি হলেও পিতার পর আর এই পেশায় তাদের পরিবারের কেউ থাকতে পারেনি।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, সবচেয়ে বেশি সংকটের মুখে পড়বেন শ্রমিক, কৃষকসহ দৈনন্দিন শ্রমের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা। কৃষিতে আগের মতো লোকবল লাগছে না। তাছাড়া তারা শুধু কৃষিকাজ করে টিকতে পারছেন না। বড় বড় উদ্যোক্তারা শিল্পের আওতায় কৃষিকে নিয়ে আসছেন। এর ফলে দেখা যাচ্ছে কৃষি পরিবারের সন্তানেরা অন্য পেশার দিকে যাচ্ছেন। পোশাক শিল্প, নির্মাণ, পরিবহন, গৃহশ্রম, দোকান কর্মচারীসহ নানা ধরনের শহুরে শ্রমের পেশায় যুক্ত হচ্ছেন গ্রাম থেকে আসা লোকজন। কিন্তু এসব শ্রমখাতও অচিরেই নানা ধরনের পরিবর্তনের মুখে পড়বে। পোশাক শ্রমিকের চাহিদা এরকম থাকবে না। অটোমেশনের ফলে ঘুরে যেতে পারে অন্যান্য খাতও। সেই পরিবর্তনের এখনও অনেক বাকি, তবে সেই লক্ষণ ইতোমধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে। ফলে সমাজের ওপর মহলে তৈরি হচ্ছে নতুন অনেক কিছু। সেরকম কিছু পেশা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
ডিজিটাল ময়নাতদন্ত
ডাক্তার যেমন রোগীর ওপর অপারেশন চালিয়ে ময়নাতদন্ত করেন, তেমনি কম্পিউটার ফরেনসিক ইনভেস্টিগেটর চালাবেন ডিজিটাল ময়নাতদন্ত। একজন তার মোবাইলের সব তথ্য মুছে ফেলেছেন, অথচ সেখানেই থাকতে পারে অপরাধের আলামত। কিংবা একজন ফেসবুক বা কোনো সাইটে এমন কোনো ছবি দিয়েছেন বলা হয়েছে, আসলে তিনি তা দিয়েছেন কিনা, এসব বিষয় গবেষণা করে বের করে আনবেন এই পেশার মানুষেরা। দৈনন্দিন জীবনে মোবাইল, কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এ ধরনের পেশা সামনে জনপ্রিয় হবে।
নিরাপত্তা স্থপতি (সেফটি আর্কিটেক্ট)
বাড়িঘরের নকশার মতো একটি প্রতিষ্ঠান বা এলাকার নিরাপত্তার নকশাও দরকার পড়বে সামনের দিকে। কীভাবে লোকজন আসবে, বের হবে, কোথায় কী থাকলে প্রত্যেকের গতিবিধি ধরা পড়বে, কীভাবে অগ্নিকাণ্ড বা ভূমিকম্পের মতো বিপর্যয় মোকাবিলা করা যাবে, চোর বা সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা কীভাবে ঠেকানো যাবে, এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাড়ি বা এলাকার নিরাপত্তা নকশা করে দেবেন এই পেশায় নিযুক্তরা। যেভাবে সন্ত্রাসবাদ বাড়ছে এবং ক্রমাগত সব কিছুর বেসরকারিকরণ হচ্ছে, তাতে করে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেদেরই করে নিতে হবে।
খাদ্য বিশারদ
একদিকে পরিবেশ দূষণ, অন্যদিকে আছে মুটিয়ে যাওয়ার সমস্যা। খাদ্য নিয়ে তাই মানুষের আশঙ্কা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। কোন ধরনের খাবার কখন খাওয়া সমীচীন, কার কী খাওয়া উচিত-অনুচিত, ক্রমাগত এগুলো রোবোটের হাতে চলে যাবে। মানুষের হাতে থাকবে ফুড জার্নালিজম অর্থাৎ কোথায় কোন খাবার পাওয়া যায়; ফুড রিভিউ অর্থাৎ কার খাবার কেমন সে বিষয়ে রেটিং দেওয়া বা মান পর্যালোচনা করা এবং ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অর্থাৎ নতুন খাদ্য তৈরি করা এবং তা ছড়িয়ে দেওয়ার মতো কাজ। খাদ্য বিশারদ হয়ে উঠতে পারলে তাই কাজ এবং খাবারের অভাব হবে না, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
গাছের ডাক্তার
শহরে ছাদ বাগান, অল্প একটু জায়গা থাকলে নিজের প্রয়োজনীয় কিছু সবজি উৎপাদন করে নেওয়া, এটা ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। তাছাড়া সামনের দিকে নতুন ধরনের বাড়ি হবে, যেগুলো বেশ খানিকটা সবুজ তথা গাছ-গাছালিপূর্ণ হবে। তাই গাছপালা রক্ষণাবেক্ষণকারীর দরকার পড়বে সামনের দিকে। আগে যেমন মালি থাকত ঠিক তেমন নয়, এরা হবেন কিছুটা কৃষি বিশেষজ্ঞ এবং কিছুটা সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা বিশেষজ্ঞ। এরা যেমন গাছগাছালি বাঁচিয়ে রাখবেন, তেমনি কীভাবে সেগুলোকে স্থাপন করলে নান্দনিক হবে সেটাও দেখিয়ে দেবেন।
ডিজিটাল দর্জি
সামনের দিনে অনলাইনে মানুষ শুধু তৈরি পোশাকই কিনবে না, বরং তার পোশাক সে মনমত গড়েও নেবে। সেজন্য দরকার হবে ডিজিটাল দর্জির। যিনি গ্রাহকের ছবি নেবেন, তার দেওয়া কিছু মাপ নেবেন এবং শুরুতে তাকে একটি ডিজিটাল নমুনা পাঠাবেন। গ্রাহক সেটি অনুমোদন করলে সেই অনুযায়ী তৈরি হবে পোশাক। অর্থাৎ ডিজিটাল দর্জির কাজ হবে ক্রেতাদের থেকে অনলাইনে অর্ডার নিয়ে তার অনলাইন ভার্সন তৈরি করে দেওয়া। ডিজিটাল দর্জিকে এজন্য ফ্যাশন, স্টাইল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে এবং গ্রাফিকসের কাজে দক্ষ হতে হবে। বিভিন্ন অনলাইন শপের মালিকরা এ ধরনের দর্জি নিয়োগ দেবেন। এই ডিজিটাল দর্জির দেওয়া নমুনা থেকে সরাসরি পোশাক বানাবে সেলাই মেশিনের দর্জিরা।
স্মার্ট মেকানিক
স্মার্টফোন, স্মার্ট টিভি ও আরও অনেক স্মার্টি ডিভাইস এখন হাতে হাতে। অচিরেই ভয়েস কন্ট্রোল অটোমেটিক অডিও সিস্টেম, অটোমেটিক গার্ডেন ওয়াটারিং সিস্টেম, হোম নেটওয়ার্কিং সিস্টেম এবং রোবোটিক ভ্যাকুম ক্লিনারের মতো যন্ত্র ছড়িয়ে পড়বে ঘরে ঘরে। গৃহস্থালির নানা কাজে ব্যবহৃত এসব স্মার্ট যন্ত্রের সঠিক ব্যবহার, মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণে দরকার পড়বে স্মার্ট মেকানিকের। ধারণা করা হচ্ছে গৃহস্থালির কাজের এসব যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে এসব যন্ত্রের সমস্যা সমাধান করাও হয়ে উঠতে পারে একটি চাহিদাসম্পন্ন পেশা।
ড্রোন রাইডার
ধারণা করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে নানা ধরনের পণ্য পরিবহন তথা কুরিয়ারের কাজে ড্রোনের ব্যবহার শুরু হবে। কিন্তু সেটা হওয়ার আগেই এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যাবে ভূমি জরিপ, নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ, গণমাধ্যমের জন্য ছবি তোলা, চলচ্চিত্র ও নাটকের শ্যুটিং, ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও সন্ত্রাস দমন অভিযানের কাজে। তাই ড্রোন চালনা ও ব্যবস্থাপনায় এখন থেকেই যারা মনোযোগ দেবে, তারা ভবিষ্যতে থাকবে পাইওনিয়ারের কাতারে। এটি হবে অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় একটি পেশা।
সময় এগিয়ে যায়, এর সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে থাকে বস্তুজগতও। এর সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে ঝরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না। মানুষের বিশেষ গুণ এটাই যে, সে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে এবং এগিয়ে চলেছে। ভবিষ্যতবিদরা বলছেন, আসন্ন সময়েও সেটা ধরে রাখতে হবে। প্রত্যেককে নতুন প্রবণতাগুলো খেয়াল করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজাতে হবে। নিজেকে বদলে নিতে হবে। প্রস্তুত করতে হবে আগামীর জন্য।