শুক্রবার ১৯শে আশ্বিন ১৪৩১ Friday 4th October 2024

শুক্রবার ১৯শে আশ্বিন ১৪৩১

Friday 4th October 2024

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

দেশসেরা স্বরলিকা এখন বাল্যবধূ: কোথায় হারালো বাঁশজানি গ্রামের নারী ফুটবলাররা

২০২২-০৯-২২

নাহিদ হাসান

২০১৭ সালে স্বরলিকাকে দেশসেরার পুরষ্কার হাতে তুলে দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সদ্য ভারত-বাংলাদেশ বিলুপ্ত ছিটমহলের বাংলাদেশীদের কাছে পাওয়া প্রথম উপহার হচ্ছে, স্বরলিকা পারভীন
 

 

ভূরুঙ্গামারী: ইতিহাসের প্রান্তরে

ভূরুঙ্গামারী উপজেলা সদরের বাগভাণ্ডার বিজিবি ক্যাম্প থেকে উত্তরদিকে পাথরডুবি। তারপর দুধকুমার নদী ধরে ধরে মাত্র ৩ কিলোমিটার গেলেই বাঁশজানি গ্রাম ও তার প্রাইমারি স্কুল। মোড়ে মোড়ে লোকজনকে বলতেই তারা দেখিয়ে দিচ্ছেন পথ। বোঝা গেল, সবাই গ্রামটির খবর জানেন। বোঝা গেলো, এক ধরনের গর্বও আছে তাদের।
 

আমার সহযাত্রী হামিদুল ইসলাম ও আমি যখন স্কুলে পৌঁছুলাম, তখন পৌঁনে চারটা। পাশাপাশি দুটি স্কুল। একটি প্রাইমারি, আরেকটি হাই স্কুল। প্রাইমারির মেয়েরা খেলছে। রেফারির ভূমিকায় আছেন শিক্ষক বায়েজিদ হোসেন। শিক্ষকরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

যখন তারা ২০১৭ সালে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপে জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয় হয়, সে সময় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন খালেদা খাতুন। ম্যানেজার ছিলেন সহকারি শিক্ষক বায়েজিদ স্যার। বর্তমান প্রধান শিক্ষক বাদরে জাহান। এ বছরও তার স্কুল জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তাঁদের কাছে শুনলাম পেছনের গল্প। ২০১৭ সালের বিস্ময়কর ফলাফল।

বিদ্যালয়টি ১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত। একসময় কোচবিহার রাজ্যের অংশ ছিল। সম্ভবত, কোচ রাজারা স্কুলটি নির্মাণ করেছেন। স্কুলটির কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে মওলানা ভাসানীর বাড়ি। স্কুলটি ফুলকুমার নদ আর জননেতা মওলানার বাড়ি দুধকুমারের পাশে। দুই নদের মাঝখানে স্কুল ও বাড়ি। ভাসানি হুজুরের স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িতে এখন শুধু বছরে একবার ওরস হয়। তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া দুধকুমার নদ যেখানে ব্রহ্মপুত্রে মিলেছে, তার ওপারেই ধুবড়ি শহর, যেখানে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর ১৭৬৩ সালে লেফটেন্যান্ট মরিসনের সাথে রমানন্দ গোসাঁঈয়ের বাহিনীর যুদ্ধ হয় এবং কোম্পানির বাহিনী পরাজিত হয়। তারও আগে এই এলাকায় ইসলাম খাঁর মুঘল বাহিনীর সাথে স্থানীয় কৃষক নেতা সনাতনের যুদ্ধ হয়। দিনের শাসক মুঘল বাহিনী আর রাতের শাসক সনাতন বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধেরও অনেকগুলো প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়েছিল ভুরুঙ্গামারী জনপদে। নিয়মিত যুদ্ধের পাশাপাশি গণমানুষের অংশগ্রহণে গেরিলা যুদ্ধের এটা ছিল অন্যতম একটা ক্ষেত্র।

 

 

বাঁশজানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েদের অর্জন সাজানো রয়েছে শোকেসে

 

 

ইতিহাসের এতগুলো গ্রন্থির উজান পেরিয়ে সেই বাঁশজানির মেয়েরা ২০১৭ সালে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপে তৃতীয় হয়েছে, তাদেরই একটা মেয়ে স্বরলিকা পেয়েছিল দেশসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। এত অসাধারণ সব সাফল্যের পরও সেই দলের বড় অংশই কাদের অবহেলায় যেন হারিয়ে গেলো, মাঠে যারা যারা টিকে আছে, তাদেরও কত রকম যুদ্ধ করে ফুটবল দলটাকে ধরে রাখতে হচ্ছে!

 

 

বাঁশজানির মেয়েরা…
ভুরুঙ্গামারী উপজেলার বাঁশজানি গ্রাম। খালেদা খাতুন স্কুলে আছেন ২০১২ সাল থেকে। তিনি শোনালেন, পেছনের ঘটনা। প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম সেবার ছাত্রীদের নিয়ে টিম গঠন করার উদ্যোগ নেন। প্রশিক্ষকের দায়িত্ব দেন সহকারী শিক্ষক বায়েজিদ ইসলামকে। তাঁরা সবাই মিলে ছাত্রীদের স্কুলে রান্না বান্না করেন, সেখানেই আবাসিক রেখে প্রশিক্ষণ দেন। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন এলাকাবাসীসহ শিক্ষা কর্মকর্তারা। ওই সময়ের উপজেলা নির্বাহী অফিসার উপজেলার সকল শিক্ষকের প্রতি সহযোগিতার আহ্বান জানান। উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার মুকুল স্যার সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখেন।
তৎকালীন প্রধান শিক্ষক খালেদা খাতুন জানান, অফিস সহকারী আতিকুর, জেলা থেকে মতিন ও সহকারী শিক্ষক পুরো প্রশিক্ষণে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই উপজেলার প্রত্যেক শিক্ষকের, এলাকাবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থনে ২০১৭ সালে জাতীয় স্তরে সাফল্য আসে।

 

 

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট ২০১৭ তে তৃতীয় হয় বাঁশজানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েরা
 

 

বায়েজিদ হোসেন জানান, “আমি ২০০৮ সালে যোগদান করি। নিজেও একজন খেলোয়াড় ছিলাম। খেলোয়াড়দের পেছনে একজন অভিভাবক লাগে। বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের বিয়ে হওয়ার কারণ হল, জাতীয়ভাবে সেরা হওয়ার পর তারা কোথায় যাবে? এটা তো তারা জানে না। খেলোয়াড় হিসেবে যে ক্যারিয়ার গড়া যায়, তাদেরকে যেন জাতীয় টিমে তাদের খেলানোর সুযোগ আছে, এই স্বপ্নটাকে বাস্তব করার কেউ না থাকলে অভিভাবকরা কী করবে?”
 

জেলা ক্রীড়া সংস্থা আব্দুল মতিন নামে একজনকে কোচ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। তিনি এক বছর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন কুড়িগ্রাম থেকে গিয়ে। সেটাও এই সাফল্যের পেছনে ভূমিকা রেখেছিল।

কিন্তু ওই টিমের সেরা খেলোয়াড়সহ ৭ জনের বিয়ে হয়ে গেল কেন? এ সম্পর্কে বর্তমান প্রধান শিক্ষক বাদরে জাহান বলেন, করোনার আগে ঢাকায় একটি টিমে স্বরলিকা খেলতে যায়। হঠাৎ করোনায় সবকিছু থেমে গেলে স্বরলিকার বাবা তাকে বাড়ি নিয়ে আসেন। তারপর তাকে বিয়ে দেন। একই ঘটনা ঘটেছে বাকি দলের ৭ জন খেলোয়াড়ের বেলায়ও। সবগুলো বিয়েই ছিল বাল্যবিবাহ, ফলে কাউকে না জানিয়ে গোপনেই সেগুলো হয়েছে।

 

কিন্তু ওই টিমের সেরা খেলোয়াড়সহ ৭ জনের বিয়ে হয়ে গেল কেন? এ সম্পর্কে বর্তমান প্রধান শিক্ষক বাদরে জাহান বলেন, করোনার আগে ঢাকায় একটি টিমে স্বরলিকা খেলতে যায়। হঠাৎ করোনায় সবকিছু থেমে গেলে স্বরলিকার বাবা তাকে বাড়ি নিয়ে আসেন। তারপর তাকে বিয়ে দেন। একই ঘটনা ঘটেছে বাকি দলের ৭ জন খেলোয়াড়ের বেলায়ও। সবগুলো বিয়েই ছিল বাল্যবিবাহ, ফলে কাউকে না জানিয়ে গোপনেই সেগুলো হয়েছে।


এ সম্পর্কে ফুটবলার ও সংগঠক নোমি নোমান জানান, খেলোয়ার, কোচ ও সংগঠকদের মাঝে সমন্বয়হীনতারই মূল অভাব ছিল স্থানীয় পর্যায়ে। এতে অনুশীলন বন্ধ হয়ে গেলে মেয়েরা মাঠমুখী না থাকায় বাল্যবিবাহের শিকার হতে শুরু করে।
 


টেলিফোনে কাঁদছিলো স্বরলিকা
২০১৭ সালে যারা জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয় হয়েছিল, তারা এখন পাশের হাইস্কুলে ক্লাস টেনে পড়ে। জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হওয়া বাঁশজানি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের  ১৭ জনের দলের মাঝে ৭ জনেরই ইতিমধ্যে বাল্য বিবাহ হয়েছে। মাঠে মাতানো ১০ নম্বর জার্সিধারী স্বরলিকা পারভীনসহ এই খেলোয়াড়রা আর মাঠে নেই। তাদের মাঝে ২ জন ইতিমধ্যেই মা হয়েছেন। অবশিষ্ট খেলোয়াড়রা একে একে বলে গেলো তাদের জার্সি নাম্বার আর পজিশন। স্বপ্নের মতই লাগে এই শিশুদের কণ্ঠে সেগুলো শুনতে: জান্নাতুল জার্সি-৭, তানজিলা তিথি জার্সি ৬, সুমাইয়া খাতুন জার্সি-৫, লাইজু জার্সি-১২, জামিয়া জুই জার্সি-৫, বিজলী জার্সি-৪, লাইজু জার্সি-১২, শিল্পী জার্সি-১৩ সহ মোট ৯ জন খেলোয়াড় এখনো অবশিষ্ট আছেন। 

 

জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হওয়া বাঁশজানি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের  ১৭ জনের দলের মাঝে ৭ জনেরই ইতিমধ্যে বাল্য বিবাহ হয়েছে। মাঠে মাতানো ১০ নম্বর জার্সিধারী স্বরলিকা পারভীনসহ এই খেলোয়াড়রা আর মাঠে নেই। তাদের মাঝে ২ জন ইতিমধ্যেই মা হয়েছেন। অবশিষ্ট খেলোয়াড়রা একে একে বলে গেলো তাদের জার্সি নাম্বার আর পজিশন। স্বপ্নের মতই লাগে এই শিশুদের কণ্ঠে সেগুলো শুনতে: জান্নাতুল জার্সি-৭, তানজিলা তিথি জার্সি ৬, সুমাইয়া খাতুন জার্সি-৫, লাইজু জার্সি-১২, জামিয়া জুই জার্সি-৫, বিজলী জার্সি-৪, লাইজু জার্সি-১২, শিল্পী জার্সি-১৩ সহ মোট ৯ জন খেলোয়াড় এখনো অবশিষ্ট আছেন


প্রধানমন্ত্রী তাদের হাতে জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা করে পুরষ্কার দেন। আর পুরস্কার হিসেবে তারা পান ৫০ হাজার টাকা। এলাকায় ফেরার পর, আর কোনও রাষ্ট্রীয় আনুকল্য পাননি। কেউ খোঁজ রাখেনি। জেলা ক্রীড়া সংস্থা, মহিলা ক্রীড়া সংস্থা তাদের কোনও খোঁজ নেয়নি। সমর্থনের অভাবে, ভবিষ্যতের কোন আশা-ভরসার অভাবে একে একে তাদের বড় অংশ হারিয়ে যান।

যারা আছে, এখনও তারা খেলছে। যখন খেলার প্রতিযোগিতা থাকে তখনই কেবল তারা খেলে। খেলতে যতই আনন্দ লাগুক, সারা বছর খেলার বন্দোবস্ত তাদের নাই।  কলকলিয়ে তারা বললো, তারা সারা বছর খেলতে চায়, উপযুক্ত প্রশিক্ষক চায়। তারা খেলাধুলাকেই ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চায়।

জাতীয় পর্যায়ে চোখ ধাঁধানো ফুটবল খেলা স্বরলিকার সাথে কথা হলো টেলিফোনে। নিজের কণ্ঠেই কিশোরী স্বরলিকা জানাল, তার বিয়ে হয়ে গেছে। বাচ্চাও হয়েছে। এখন আর খেলার সুযোগ তার নেই। ফোনের এপাশে বুঝতে পাচ্ছিলাম, স্বরলিকা কাঁদছে। বিয়ে না হলে এখন সে কোন শ্রেণিতে পড়তো? দশম শ্রেণি? হয়তো। 

 

 

জাতীয় পর্যায়ে চোখ ধাঁধানো ফুটবল খেলা স্বরলিকার সাথে কথা হলো টেলিফোনে। নিজের কণ্ঠেই কিশোরী স্বরলিকা জানাল, তার বিয়ে হয়ে গেছে। বাচ্চাও হয়েছে। এখন আর খেলার সুযোগ তার নেই। ফোনের এপাশে বুঝতে পাচ্ছিলাম, স্বরলিকা কাঁদছে। বিয়ে না হলে এখন সে কোন শ্রেণিতে পড়তো? দশম শ্রেণি? হয়তো।

 

কুড়িগ্রামের সন্তান, জাতীয় দলের সাবেক কৃতি ফুটবলার ও কোচ রেহেনা পারভীন জানান, বিভিন্ন বয়স ভিত্তিক দলগুলোকে জেলায় সক্রিয় করা গেলে এই মেয়েগুলোকে যুক্ত করা যেত। প্রত্যেক গ্রুপের জন্য কোচ ও বেতন-ভাতা দেওয়া গেলে এই ঝরে পড়ার ঘটতো না।

ডিসি, এসপি, ইউএনও সহ নানান সরকারী কর্মকর্তাদের চোখ ধাঁধানো গাড়ি ও অন্যান্য বিলাসের তুলনায় সেখান থেকে বরং কমই নগদ সাহায্য মিলেছে। অন্যদিকে বাড়ি বাড়ি থেকে মানুষ সাহয্য করেছেন, সেই  সাহায্যটুকুই ছিল খেলোয়ারদের অতদূর যাবার পাথেয়। সাফল্য লাভ করার পর এগিয়ে এসেছিল শুধু কুড়িগ্রাম সমিতিও। যৎসামান্য হলেও তাতে চেষ্টাটা ছিল, সহৃদয়তাটুকুও ছিল। “বছর দুয়েক আগে ঢাকাস্থ কুড়িগ্রাম সমিতির অর্থায়নে ২০ জন নারী ফুটবলারদের মাঝে ১টি করে ছাগল ও ৫টি করে গাছের চারা বিতরণ করা হয়েছিল। কেমন আছেন সেখানকার ফুটবলাররা, জানতে ছুটে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখা হল স্বরলিকা পারভীনের বাবার সঙ্গে। ছাগলটির ছানা হয়েছে, ৫টি গাছের ১টি বেঁচে আছে। কিছু ছবিও তুললাম। ঘরের ভেতর স্বরলিকার সাফল্যের মেডেল৷ ক্রেস্ট ও কাপগুলো। স্বরলিকার কথা জিজ্ঞেস করতেই প্রতি উত্তরে সবকিছু জানা হলে মাথার ভেতরে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। একটা প্রতিভা এইভাবে শেষ হয়ে গেল! সবকিছু দেখে নীরবে প্রস্থান করলাম।“ - কথাগুলো সাইদুল আবেদীন ডলার ফেসবুকে লিখেছিলেন ১৪ মার্চ ২০২১ সালে।

নাগেশ্বরী কলেজ মাঠে মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধের দাবিতে একবার মিছিল হয়। এই মিছিল প্রসঙ্গে জানতে চাই কয়েকজনের কাছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয়রা জানান, ঘটনা আসলে ছিল এরকম: মেয়ে ফুটবলারদের খেলা উপলক্ষে বেশ কিছু বখাটে লোক মাঠের পাশে জুয়া বসিয়েছিল। মূলত সেই জুয়া বন্ধ করাটাই প্রকৃত লক্ষ। তাই জুয়া যে ফুটবল খেলার উছিলায় বসেছিল, সেই ফুটবল খেলা বন্ধের দাবিতে স্থানীয় মুসল্লিরা রাস্তায় নেমেছিলেন। আর ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলন সুযোগ বুঝে নিজেদের ব্যানার সামনে নিয়ে আসে। মূল উদ্দেশ্য খেলা বন্ধ করা ছিল না। কিন্তু দেশবাসীর কাছে ভুল বার্তা চলে গেছে। স্থানীয়রা প্রশ্ন রাখেন, খেলার বিপক্ষে থাকলে এতগুলো নারী ফুটবলার তৈরি হয় কী করে!

 

মেয়ে ফুটবলারদের খেলা উপলক্ষে বেশ কিছু বখাটে লোক মাঠের পাশে জুয়া বসিয়েছিল। মূলত সেই জুয়া বন্ধ করাটাই প্রকৃত লক্ষ। তাই জুয়া যে ফুটবল খেলার উছিলায় বসেছিল, সেই ফুটবল খেলা বন্ধের দাবিতে স্থানীয় মুসল্লিরা রাস্তায় নেমেছিলেন। আর ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলন সুযোগ বুঝে নিজেদের ব্যানার সামনে নিয়ে আসে। মূল উদ্দেশ্য খেলা বন্ধ করা ছিল না। কিন্তু দেশবাসীর কাছে ভুল বার্তা চলে গেছে। স্থানীয়রা প্রশ্ন রাখেন, খেলার বিপক্ষে থাকলে এতগুলো নারী ফুটবলার তৈরি হয় কী করে!

 


ফুটবলাররা যেভাবে হয়ে যায় ভলিবলার

২০১৭ সালে স্বরলিকাকে দেশসেরার পুরষ্কার হাতে তুলে দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সদ্য ভারত-বাংলাদেশ বিলুপ্ত ছিটমহলের বাংলাদেশীদের কাছে পাওয়া প্রথম উপহার হচ্ছে, স্বরলিকা পারভীন।

সাফ জেতা স্বপ্নার গ্রামের নাম মিঠাপুকুরের পালিচড়া। এরাও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফসল। গত এপ্রিল মাসেই এই গাঁয়ের চার ফুটবলারকে প্রশিক্ষণের জন্য পর্তুগাল পাঠিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রীড়া সংস্থা। তাদের ক্লাবের নাম ছিল সদ্যপুষ্করিণী যুব স্পোর্টিং ক্লাব। এই গ্রামে নির্মাণ করা হয়েছে একটি মিনি স্টেডিয়ামও। কিন্তু কুড়িগ্রামের ফুটবলারদের ক্রীড়া সংস্থা হ্যাণ্ডবল ও ভলিবলের খেলোয়ারে পরিণত করেছে। জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পদকের মুখেও শুনলাম সেই কাহিনী।

ফুটবলের সেই উপহারদের নিয়ে কী  করেছে জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, এটা জানতে চাই সাধারণ সম্পাদক রোকসানা বেগমের কাছে। তিনি জানান, করোনার কারণে তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আমরা মূলত হ্যাণ্ডবল ও ভলিবল নিয়ে কাজ করি। এই দুটো নিয়ে যতটা মাতামাতি করি, মেয়েদের ফুটবল ও ক্রিকেট নিয়ে কাজ করা হচ্ছে না। ফুটবল-ক্রিকেটের মেয়েরাই কিন্তু ভলিবল-হ্যাণ্ডবল খেলছে। আমরা মেয়েদের সাথে আছি।

একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ, লা লীগা ও বুন্দেসলীগের আদলে বিধিবদ্ধ ক্রীড়া ক্যালেণ্ডার নেই? কেন নেই সেই প্রশ্নটা করেন।  আগামি দিনের স্বপ্না, রূপনা চাকমারা কিভাবে তৈরি হবে, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। আর যারা ক্রীড়া সংগঠনগুলোর শীর্ষ পদগুলো দখল করে আছেন, তারাও তো কম দায়ী নয়।

 

একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ, লা লীগা ও বুন্দেসলীগের আদলে বিধিবদ্ধ ক্রীড়া ক্যালেণ্ডার নেই? কেন নেই সেই প্রশ্নটা করেন।  আগামি দিনের স্বপ্না, রূপনা চাকমারা কিভাবে তৈরি হবে, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। আর যারা ক্রীড়া সংগঠনগুলোর শীর্ষ পদগুলো দখল করে আছেন, তারাও তো কম দায়ী নয়।

 


নতুন মাঠ নেই, পুরাতনগুলো দখলের পথে

বলাইশিমুল মাঠ দখলের ঘটনা শুধু ময়মনসিংহেই নয়, সারা দেশেরই একই চিত্র। বলাই শিমুলে মাঠরক্ষা গণকমিটি ছিল তাই রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু কুড়িগ্রামে দিনকে দিন খেলার মাঠ কমে যাচ্ছে। স্কুলের প্রাচীর ধরে দোকান গড়ে ওঠা ও হাটে পরিণত হওয়া স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠ আবাদী জমি, কোনটি মেলা আর কোনটি হাটে পরিণত হয়েছে। কোথাও অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণের জন্য। স্কুল-কলেজগুলোতে বছর বছর শিক্ষার্থী বাড়ে, মাঠ ছোট হয়ে আসে।

সমাজ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ফেসবুকের ফাটল দিয়ে নিস্পৃহ দর্শকের মত বাইরের জগতের দিকে তাকিয়ে থাকার যুগে আছি। শারীরিক যোগাযোগহীন কিন্তু ফেসবুকের সাগরে ভাসমান। ঢেউ আমাদের সম্পর্কিত করেছে। ভয় ও নিঃসঙ্গতা বলছে, ঢেউয়ে গা ভাসাও। এখনও গ্রামে পুঁজির দাপট ততটা পৌঁছেনি, যতটা শহরে। এখনও নৌকার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে মানুষ পরষ্পরের নিঃশ্বাসের শব্দ টের পায়। যে গাঁয়ে এখনও বই আর মোবাইল নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেনি, সেই গাঁ-ই ভরসা। কিন্তু শহরের স্টেডিয়াম যদি সবগুলো গাঁয়ের মাঠকে নিজের সাথে জুড়ে নিতে পারে, তাহলে কলসিন্দুরের পর পালিচড়ার সাথে বাঁশজানি গ্রামের নামও বাংলাদেশ জানবে।

 


লেখক: লেখক ও সংগঠক।
nahidknowledge@gmail.com 

Your Comment