বরিশাল থেকে বদলিজনিত কারণে ঝিনাইদহ জেলায় যোগদান করতে হলো। সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় গিয়ে আমি কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। বরিশাল জেলায় গত সাড়ে তিন বছরের অর্জিত সুনাম কোনো কাজে লাগলো না। আমি ভেবেছিলাম এক, হলো তার বিপরীত। পুলিশের চাকরিতে সুনাম বদনামের চেয়ে অন্য কিছুর মূল্যায়ন বেশি, সেটা এবার খানিকটা উপলব্ধি করলাম। আমার এক ব্যাচমেট অবশ্য একদিন আমাকে বলে রেখেছিলেন,
গ্রাম এলাকায় কোনো মানুষ আত্মহত্যা করলে স্থানীয় চেয়ারম্যান মেম্বারের খবরদারী ও পুলিশের ভয়ে আত্মীয় স্বজনের কান্না পর্যন্ত থেমে যেত। কারণ, পুলিশে খবর দিলে জেলা সদরে লাশ মর্গে নেওয়ার খরচ, সেখানে পোস্টমর্টেম করানোর খরচ, আবার বাড়ি আনার খরচ সবই মৃতের আত্মীয় স্বজনদের বহন করতে হতো। তারপর পুলিশের মামলা নিষ্পত্তির ঝামেলা তো আছেই। এসব কারণে আত্মহত্যাকারী নিজে মরে, আত্মীয় স্বজনের বোঝা হয়ে পড়ত।
'পুলিশের চাকরি হচ্ছে ব্যবসার মতো। বুঝেশুনে জায়গামতো বিনিয়োগ করতে পারলে লাভ বেশি হবে'।
আমি তার কথা বুঝতে পারলেও, তার কথা মতো কাজ করতে চাইনি। সুতরাং যা হবার তাই হলো। সময়টা ১৯৮৮ সাল। কয়েক ঘাটের পানি খেয়ে আমার পোস্টিং হলো ঝিনাইদহ জেলার বিশেষ শাখায়। এই শাখার কাজকর্ম আমি কিছুই জানতাম না। তাই মন খারাপ হলেও, বাধ্য হয়েই সেখানে যোগদান করলাম।
আমার পূর্ব পরিচিত জনাব সিরাজুল ইসলাম সাহেব ছিলেন কোর্ট ইন্সপেক্টর। তিনি আমাকে সান্তনা দিয়ে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন এবং জোর করে তার বাসাতেই রেখে দিলেন।
আমি ঝিনাইদহ জেলার বিশেষ শাখায় মাস দুয়েক কর্মরত ছিলাম। দিন কাটছিল না। অবশেষে একদিন মন খারাপ করে কাউকে না জানিয়ে খুলনা গিয়ে ডিআইজি মহোদয়ের সাথে দেখা করলাম। তখন খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি ছিলেন জনাব এ এফ কবির। সারদায় আমার ট্রেনিংয়ের সময় তিনি পুলিশ একাডেমির প্রিন্সিপাল ছিলেন। তিনি আমাকে দারুণ স্নেহ করতেন, সব কথা শুনে একটু রেগে গেলেন এবং আমাকে বললেন, 'তুমি ঝিনাইদহ চলে যাও, আমি এক সপ্তাহের মধ্যে ঐ জেলা পরিদর্শন করব'।
আমি যথারীতি ঝিনাইদহ চলে গেলাম। একদিন ডিআইজি মহোদয় ঝিনাইদহ জেলা পরিদর্শনে গেলেন। ঐ দিনই আমার পোস্টিং হলো ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু থানায়। তখন হরিণাকুন্ডু থানায় কোনো ওসি ছিলেন না। অতএব আমাকে অলিখিত ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্য প্রেরণ করা হলো।
তখন ছিল বর্ষাকাল। হরিণাকুন্ডু থানার যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল চরম বেহাল। তবুও আমার যাবতীয় মালামাল একটি সুটকেসে ভরে হরিণাকুন্ডু থানার উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। যাবার সময় দুই মাসের মায়ায় জড়ানো কোর্ট ইন্সপেক্টর জনাব সিরাজুল ইসলাম, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের রেখে যেতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছিল।
অবিশ্বাস্য কাদার রাস্তা পাড়ি দিয়ে হরিণাকুন্ডু থানায় হাজির হলাম। থানার পরিবেশ ও অফিসার ফোর্সের অবস্থা দেখে মনে হলো, চাকরি ছেড়ে আজই চলে যাই। আমার পূর্বের কর্মস্থল বরিশাল কোতোয়ালি থানার জন্য মনটা কেঁদে উঠলো।
তখন হরিণাকুন্ডু থানায় আমি ছাড়া আর একজন সাব ইন্সপেক্টর ও দুই জন সহকারি সাব ইন্সপেক্টর ছিলেন। তাদের অবস্থা থানার চেহারার মতোই। ঝিনাইদহ জেলার সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত থানা ছিল হরিণাকুন্ডু থানা। বিশেষ করে বৃষ্টির মওসুমে থানায় কোনো লোকজন আসত না, দিনের অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ থাকত না, কোনো টেলিফোনের ব্যবস্থা ছিল না।
দুই/ তিন দিন চলে গেল। আমার কষ্ট বাড়তে লাগলো। হঠাৎ একদিন বৃষ্টিভেজা সকালে একজন চৌকিদার এসে জানালো, থানার প্রত্যন্ত এলাকায় একজন গরিব মহিলা গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তাদের পরিবারের কেউ লাশের দায়িত্ব নিয়ে থানায় খবর দিতে চাচ্ছে না, আবার এলাকার চেয়ারম্যান পুলিশে খবর দেওয়া ছাড়া লাশ দাফন করতে দিচ্ছেন না।
আমি ডিউটি অফিসারকে চৌকিদারের মাধ্যমে একটি অপমৃত্যু মামলা রেকর্ড করতে বললে, ডিউটি অফিসার গড়িমসি শুরু করলেন। থানার অন্য একজন সাব ইন্সপেক্টর অপমৃত্যুর খবর শুনে আগেই ভিন্ন কাজের অজুহাতে থানা থেকে সরে পড়েছিলেন। ডিউটি অফিসার ছিলেন একজন এএসআই। অতএব বাকি রইলো অপর একজন এএসআই। তিনি জানালেন যে, গতমাসে তিনি অনেক অপমৃত্যু মামলা তদন্ত করেছেন, তাই এই মামলাটি যেন তার ঘাড়ে না দেওয়া হয়।
থানার কনস্টেবল থেকে শুরু করে সকলেই চাইলেন, চৌকিদার সাহেবকে কৌশলে বিদায় দিয়ে ঝামেলা এড়াতে। এই থানায় আত্মহত্যার পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ায় এমন ঘটনা নিত্যকার ছিল। তাই পুলিশ ও আত্মহত্যাকারীর আত্মীয় স্বজনের বিড়ম্বনার শেষ ছিল না। গ্রাম এলাকায় কোনো মানুষ আত্মহত্যা করলে স্থানীয় চেয়ারম্যান মেম্বারের খবরদারী ও পুলিশের ভয়ে আত্মীয় স্বজনের কান্না পর্যন্ত থেমে যেত। কারণ, পুলিশে খবর দিলে জেলা সদরে লাশ মর্গে নেওয়ার খরচ, সেখানে পোস্টমর্টেম করানোর খরচ, আবার বাড়ি আনার খরচ সবই মৃতের আত্মীয় স্বজনদের বহন করতে হতো। তারপর পুলিশের মামলা নিষ্পত্তির ঝামেলা তো আছেই। এসব কারণে আত্মহত্যাকারী নিজে মরে, আত্মীয় স্বজনের বোঝা হয়ে পড়ত।
এসব ঘটনায় পুলিশেরও অনেক বক্তব্য শুনেছি। তারা জানান, পুলিশ যদি দায়িত্ব নিয়ে মৃতের বৈধ অভিভাবকদের কাছে বিনা ময়না তদন্তে লাশ দাফনের অনুমতি দেয় তাহলে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী অফিসারের বিপদ হয়। কারণ, অনেক সময় প্রকৃত হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়, আবার প্রকৃত আত্মহত্যাকে হত্যা মামলা সাজানোর চেষ্টা করা হয়। তখন পুলিশের সমস্যা হয়। তাই কোনো পুলিশ অফিসার সহজে অপমৃত্যু মামলা তদন্ত করতে চান না। নিদেনপক্ষে তদন্ত করতে বাধ্য হলে, সহজ সমাধান হিসেবে তদন্তকারী কর্মকর্তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে প্রকৃত আত্মহত্যার ঘটনায়ও সোজা পোস্টমর্টেম করতে মর্গে পাঠিয়ে দেন। সেখানে কে ধনী, কে গরিব, কোন ঘটনা প্রকৃত আত্মহত্যা, কোন ঘটনায় পরবর্তীকালে সমস্যা হতে পারে, আর কোন ঘটনায় সমস্যা হবে না, সে বাছবিচারের অধিকাংশ তদন্তকারী অফিসার আর যান না। বাংলাদেশে বহুক্ষেত্রে যেমন প্রভাবশালীরা খুনের ঘটনাকে আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দিয়ে থাকেন, তেমনি আরও বেশি ক্ষেত্রে নিখাঁদ আত্মহত্যার ঘটনাতেও দরিদ্র পরিবার নানান রকম আইনী ও আর্থিক হয়রানির শিকার হতে থাকেন।
যাহোক, চৌকিদারের মৌখিক ভাষ্যমতে আমি নিজেই অপমৃত্যু মামলা রেকর্ড করে নিজেই তদন্তভার নিলাম এবং একজন কনস্টেবল সাথে নিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ঘটনাস্থলের দিকে রওয়ানা হলাম।
গ্রামের কর্দমাক্ত পথে বৃষ্টিতে ভিজে মোটরসাইকেলে করে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে গিয়ে বহুবার ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়েছিল। কাকভেজা হয়ে এক সময় মৃতদেহের কাছে পৌঁছে গেলাম। একটি মাটির একচালা ঘরের ভাঙাচোরা বারান্দায় মৃতদেহটি পড়েছিল। সারারাতের বৃষ্টি মৃতদেহকে এক প্রকার শেষ গোসল করিয়ে রেখেছিল। যে ঘরটিতে মৃত্যুর আগে মৃত মহিলা সপরিবারে বসবাস করতেন, তার ঘরে বৃষ্টি ঠেকানোর উপযোগী ছাউনি ছিল না। অতএব ঘরে ও বারান্দায় বৃষ্টির পানি অনায়াসে বয়ে চলতো। তাদের নিজেদের কোনো ভিটেমাটিও ছিল না। নদী ভরাটের সুযোগে কোনমতে একটু জায়গা দখল করে ছিল তাদের বসবাস ।
আমি ঐ বাড়িতে পৌঁছে দেখি সমগ্র বাড়ি জনমানবহীন। এমনকী এলাকার কোনো মানুষও তেমন চোখে পড়ল না। মৃত নারীটির বয়স ছিল অনুমান ২৫/৩০ বছর। স্বামী ও দুটি সন্তানও ছিল। পুলিশ আগমনের খবর শুনে স্বামী আগেই পালিয়েছিল, সন্তান দুটি কান্না ভুলে পাশের কোনো নিরাপদ স্থানে গা-ঢাকা দিয়েছিল। এসব ঘটনায় স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বার, চৌকিদার, দফাদারদের কিছু আইনগত দায়িত্ব থাকে। কিন্তু বৃষ্টির অজুহাতে ও মৃতা অত্যন্ত গরিব বলে সবাই দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছিল।
মৃত নারীটির বয়স ছিল অনুমান ২৫/৩০ বছর। স্বামী ও দুটি সন্তানও ছিল। পুলিশ আগমনের খবর শুনে স্বামী আগেই পালিয়েছিল, সন্তান দুটি কান্না ভুলে পাশের কোনো নিরাপদ স্থানে গা-ঢাকা দিয়েছিল। এসব ঘটনায় স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বার, চৌকিদার, দফাদারদের কিছু আইনগত দায়িত্ব থাকে। কিন্তু বৃষ্টির অজুহাতে ও মৃতা অত্যন্ত গরিব বলে সবাই দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছিল।
আমি লাশটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম। যে ঘরের মধ্যে গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল সেই জায়গা দেখলাম। মৃতার গলায় রশির দাগ ও আত্মহত্যার সকল উপসর্গ পর্যবেক্ষণ করলাম। সবকিছু মিলিয়ে আমি মোটামুটি নিশ্চিত হলাম যে, এটা প্রকৃতই আত্মহত্যা। কিন্তু, তার আত্মহত্যার পিছনে কী কারণ ছিল তা জানা আবশ্যক ছিল। তাই আমি সেই কারণ খুঁজতে চেষ্টা করতে থাকলাম। কীভাবে করব? সেখানে কোনো লোকজন সাক্ষ্য দেওয়া দূরের কথা, আমার সাথে সামান্য কথা বলতেও কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। আমি অসহায়ের মতো মৃত্যুর কারণ খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকলাম। কিন্তু কোনো ফল হলো না। মৃতার স্বামী ও সন্তানের কোন হদিস পাওয়া গেল না। আমার সাথে থাকা কনস্টেবলকে দিয়ে আশেপাশের লোকজন খুঁজে আনার চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। শেষ পর্যন্ত কাগজ কলম নিয়ে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করলাম। কোনো নারীর লাশের সুরতহাল করার সময় আইন অনুযায়ী একজন নারীকে দিয়ে লাশ উল্টেপাল্টো করে সমস্ত শরীর দেখার নিয়ম থাকলেও এখানে তেমন কোনো সুযোগ ছিল না।
লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি হলো। এবার সুরতহাল রিপোর্টে কয়েকজন সাক্ষীর সাক্ষর নেওয়ার পালা। কিন্তু আবারও সেই একই সমস্যা। কে দেবে সাক্ষর? আমার সাথে থাকা কনস্টেবলকে সাক্ষর দিতে বলায় সে বাধ্য হয়ে সাক্ষর দিল। ইতোমধ্যে সময় অনেক গড়িয়ে গেল। বৃষ্টি থেমে গেল। পুলিশের ভীতি কাটিয়ে দুই-চারজন মানুষের চলাফেরা লক্ষ্য করা গেল। তাদেরকে সুরতহাল রিপোর্টে সাক্ষর করার জন্য অনুরোধ করলে তারা কৌশলে সরে পড়ার চেষ্টা করতে লাগলো। আমার অসহায়ত্ব বাড়তে লাগলো।
এখানে একটা আইনের কথা বলে রাখি। ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোডের ১৭৪ ধারা অনুযায়ী অপমৃত্যু মামলা তদন্তের সময় কোনো মানুষ পুলিশের অনুরোধে কোনো মৃত ব্যক্তির সুরতহাল রিপোর্টে সাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালে পুলিশ তাকে তাৎক্ষণিক আইনের আওতায় প্রসিকিউট করার ক্ষমতা রাখে। এই আইন আমার জানা ছিল। সন্দেহজনক আত্মহত্যার ঘটনায় মৃতার স্বামী বা সন্দেহজনক কাউকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা পুলিশ হিসেবে আমারও ছিল। কিন্তু কোনো আইনগত ক্ষমতা প্রয়োগ করার মানসিকতা আমার মনে আসেনি। শুধু, ঐ অসহায় মৃতদেহের প্রতি আমার মানসিক কষ্ট বেড়েই চললো। তাই, দুই তিনজন অশিক্ষিত পথচারীর কাছ থেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে টিপসই নিয়ে সুরতহাল রিপোর্ট সম্পন্ন করলাম।
অপমৃত্যু মামলা তদন্তের সময় কোনো মানুষ পুলিশের অনুরোধে কোনো মৃত ব্যক্তির সুরতহাল রিপোর্টে সাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালে পুলিশ তাকে তাৎক্ষণিক আইনের আওতায় প্রসিকিউট করার ক্ষমতা রাখে। এই আইন আমার জানা ছিল। সন্দেহজনক আত্মহত্যার ঘটনায় মৃতার স্বামী বা সন্দেহজনক কাউকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা পুলিশ হিসেবে আমারও ছিল। কিন্তু কোনো আইনগত ক্ষমতা প্রয়োগ করার মানসিকতা আমার মনে আসেনি। শুধু, ঐ অসহায় মৃতদেহের প্রতি আমার মানসিক কষ্ট বেড়েই চললো। তাই, দুই তিনজন অশিক্ষিত পথচারীর কাছ থেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে টিপসই নিয়ে সুরতহাল রিপোর্ট সম্পন্ন করলাম।
সাথে থাকা কনস্টেবল বললো, 'স্যার, এই লাশ কীভাবে বয়ে সদর হাসপতালে নিব? এখানে কোনো ভ্যান বা অন্য কোনো বাহন পাওয়া যাবে না। চেয়ারম্যান, মেম্বাররা কোনো সাহায্য করবে না। আত্মাহত্যার লাশ নেওয়ার কথা শুনে এলাকার সকল ভ্যানওয়ালা এই এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। আমি এখন কী করব? আমার কাছে কোনো টাকা পয়সাও নেই।’
এখানে আরো একটা আইনের কথা বলি। অপমৃত্যু মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি মনে করেন, আত্মহত্যার পিছনে কোনো হত্যাজনিত বা সন্দেহজনক কারণ নেই; অর্থাৎ মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত আত্মহত্যা, তাহলে তদন্তকারী কর্মকর্তা লাশের বৈধ অভিভাবকদের কাছে বিনা ময়নাতদন্তে লাশ দাফনের অনুমতি দিতে পারেন। আবার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিজের ভবিষ্যৎ ঝামেলা এড়াতে, বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মহোদয়ের লিখিত অনুমতি নিতে পারেন। একজন এএসআই থেকে সকল ঊর্ধতন পুলিশ অফিসার অপমৃত্যু মামলা তদন্তের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত।
আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হলো। পোস্টমর্টেমের জন্য লাশ সদর হাসপাতালে পাঠাতে হবে, না হয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে লাশ দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে, নইলে নিজে ঝুঁকি নিয়ে বিনা ময়না তদন্তে লাশ দাফনের অনুমতি দিতে হবে। প্রথমোক্ত দুটি পথ আমার জন্য ঝুঁকিমুক্ত হলেও অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ এবং শেষোক্ত পথটিতে সকল ঝুঁকি আমার নিজের উপর। তবু আমি শেষোক্ত সিদ্ধান্তটিই নিলাম। আমার সিদ্ধান্তে সঙ্গের কনস্টেবলের মুখে স্বস্তি ফিরে এলো, এলাকার লোকজন এগিয়ে আসতে লাগলো। শুধু, মৃতের স্বামী ও সন্তানদের দেখা মিললো না। উপস্থিত লোকজন একে একে বলতে লাগলো মৃতার আত্মহত্যার মূল রহস্য। মৃতার স্বামী বেচারা ছিল দিনমজুর, তবে একটু অলস। মৃতা নিজেও দিনমজুর ছিল। দুজনেই মাটি কাটার কাজ করতো। যখন কাজ থাকত তখন খাবার থাকত। বর্ষাকালে মাটির কাজ কম হয়। তারপর কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে কোনো কাজ ছিল না। তাই তাদের খাবার জোটেনি। দুটো ছেলেমেয়ে ক্ষুধার জ্বালায় কান্নাকাটি করছিল। ছেলেমেয়ের কান্না সহ্য করতে না পেরে মহিলা আত্মহত্যা করেছিল। স্বামী বেচারা পুলিশের ভয়ে কোথায় পালিয়েছিল তা কেউ বলতে পারলো না।
মৃতা নিজেও দিনমজুর ছিল। দুজনেই মাটি কাটার কাজ করতো। যখন কাজ থাকত তখন খাবার থাকত। বর্ষাকালে মাটির কাজ কম হয়। তারপর কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে কোনো কাজ ছিল না। তাই তাদের খাবার জোটেনি। দুটো ছেলেমেয়ে ক্ষুধার জ্বালায় কান্নাকাটি করছিল। ছেলেমেয়ের কান্না সহ্য করতে না পেরে মহিলা আত্মহত্যা করেছিল। স্বামী বেচারা পুলিশের ভয়ে কোথায় পালিয়েছিল তা কেউ বলতে পারলো না।
সব কিছু শুনে আমার পুলিশি মনটা মানুষের রূপ ধারন করল। ওদিকে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আমিও অভুক্ত ছিলাম। ঐ এলাকায় খাবার মতো কোনো জায়গা ছিল না। আশেপাশের কোনো বাড়ি থেকেও খাবার প্রস্তাব এলো না। পকেট থেকে টাকা বের করে খাবার কিনতে কাউকে পাঠাবো এমন ব্যবস্থাও ছিল না।
শেষ পর্যন্ত নিজের টাকায় মৃতার জন্য কাফনের কাপড় আর বাঁশ কিনতে পাঠালাম। স্থানীয় একজনকে দাফন কাফনের দায়িত্ব দিয়ে সন্ধ্যায় থানার উদ্দেশ্য মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা দিলাম।
রাতে থানায় ফিরে ঐ থানায় পোস্টিং দেওয়ার জন্য এসপি মহোদয়কে মনে মনে অভিসম্পাত দিতে থাকলাম এবং ঐ এলাকায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি হওয়ার কারণ খুঁজতে শুরু করলাম। অপমৃত্যু মামলার রেজিস্টার ঘেঁটে দেখলাম সারা দেশের তুলনায় ঝিনাইদহ জেলায় অপমৃত্যু মামলার পরিমাণ অনেক বেশি। পুরনো কয়েকজন কনস্টেবলের কাছে জানলাম, আরো অনেক আত্মহত্যার ঘটনা পুলিশের কাছে রিপোর্ট হয় না। আবার কিছু আত্মহত্যার ঘটনা পুলিশের কাছে রিপোর্ট হলেও ঝামেলা এড়াতে নথিভুক্ত করা হয় না। সবকিছু শুনে মনে মনে স্থির করলাম, এখানে চাকরি করাকালীন আত্মহত্যা প্রতিরোধে কিছু কিছু কাজ করব এবং এই মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট লেখার সময় গতানুগতিক চূড়ান্ত রিপোর্ট না লিখে, আমার অভিজ্ঞতার কথা পুলিশ বিভাগ ও সরকারের উচ্চ মহলে জানানোর চেষ্টা করব।
ঐ এলাকায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি হওয়ার কারণ খুঁজতে শুরু করলাম। অপমৃত্যু মামলার রেজিস্টার ঘেঁটে দেখলাম সারা দেশের তুলনায় ঝিনাইদহ জেলায় অপমৃত্যু মামলার পরিমাণ অনেক বেশি। পুরনো কয়েকজন কনস্টেবলের কাছে জানলাম, আরো অনেক আত্মহত্যার ঘটনা পুলিশের কাছে রিপোর্ট হয় না। আবার কিছু আত্মহত্যার ঘটনা পুলিশের কাছে রিপোর্ট হলেও ঝামেলা এড়াতে নথিভুক্ত করা হয় না।
পরদিন সকালে অপমৃত্যু মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট লিখতে বসলাম। এর আগে বিভিন্ন অফিসারের দাখিলকৃত চূড়ান্ত রিপোর্ট পড়লাম। সবটাই ছিল ছক আকারে একান্তই দায়সারাভাবে লেখা। আমি ছকের বাইরে আমার কিছু কিছু অতিরিক্ত মতামত ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরলাম। ভেবেছিলাম হয়তো কোনোদিন আমার ঐসব মতামত কোনো বড় কর্তার নজরে পড়তে পারে। তবে পুলিশের ঐসব দেখার সময় নেই, তাও আমি জানতাম। আমি ঐ ঘটনায় যা যা করেছিলাম এবং যা যা লিখেছিলাম তা সবই আমার একান্ত নিজের পেশাগত দায়িত্ব পালনের তৃপ্তির জন্যই করা। তবে আজও আমার মনে হয়, আমার সেই লেখা শুধু লেখাই রয়ে গেছে।
ঐ অপমৃত্যু মামলায় ঝুঁকি নিয়ে বিনা ময়না তদন্তে লাশ দাফনের অনুমতি দেওয়ার কারণে আমার কোনো ঝামেলা হয়নি। কিন্তু জীবনে প্রথম আত্মহত্যার ঘটনার তদন্ত করার এই স্মৃতি আমাকে আজও ভারাক্রান্ত করে। আত্মহত্যার মামলাগুলোতে নিকটজনেরা যে ভোগান্তির শিকার আজও হন, সেটা দূর করার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আরও দরকার একটু অনুসন্ধানী মন নিয়ে আত্মহত্যাকারীর পরিবেশ, সমাজ, পরিবার আর ব্যক্তিগত জীবনটাকে উপলব্ধির চেষ্টা। সেই চেষ্টারই খানিকটা উদ্যোগ ছিল আমার সেই প্রতিবেদনটাতে। কিন্তু পুলিশের বর্তমান কাঠামোগত বাস্তবতায় এই কাজ কয়েকজন মানুষ করতে পারবে না, প্রয়োজন একটা সামগ্রিক ঐকান্তিক প্রচেষ্টা।
কামরুল ইসলাম, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা