শনিবার ৬ই বৈশাখ ১৪৩১ Saturday 20th April 2024

শনিবার ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

Saturday 20th April 2024

বহুস্বর মতামত

পুলিশ জীবনের স্মৃতি: চাষার হাতে হাতকড়া

২০২২-০৮-২৬

কামরুল ইসলাম

১.

 আমাকে সেবার ‘মফস্বল করা’র নির্দেশ দেওয়া হলো। নির্ধারণ করা হলো বরিশাল কোতোয়ালি থানার সবচেয়ে দূরবর্তী ও নদীপথের ইউনিয়ন। ইউনিয়নের নামটা আমার আজও মনে আছে - চন্দ্রমোহন । 

 

 

 পুলিশের পরিভাষায় ‘মফস্বল করা’ কথাটার বিশেষ অর্থ আছে। আর বরিশাল এলাকায় এই কথার অর্থ আরও বিশেষ। থানা সদর থেকে কয়েক দিনের জন্য গাট্টিবোঁচকা বেঁধে ফোর্স ও অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট এলাকার জন্য বেরিয়ে পড়ে সেই এলাকা চৌকিদার দফাদার, মেম্বার, চেয়ারম্যান নিয়ে মামলা তদন্ত করা, এলাকার মুলতবী ওয়ারেন্ট তামিল করা, এলাকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা ইত্যাদিকে পুলিশের ভাষায় ‘মফস্বল করা’ বুঝায়।

 

 

 আমি তখন দ্বিতীয় দফায় বরিশাল কোতোয়ালি থানায় শেষ ৬ মাসের জন্য শিক্ষানবীশ হিসেবে কর্মরত। ওসি ছিলেন জনাব নূরুল আলম সাহেব। সেকেন্ড অফিসার জনাব রুহুল ইসলাম সাহেব। যার বাড়ি ছিল আমার ডুমুরিয়া থানায়। তারই ব্যাচমেট জনাব হেলাল উদ্দিন ছিলেন একই থানায়। তার বাড়ি ফুলতলা থানায়। হেলাল সাহেব ও রুহুল সাহেব আমাকে ভীষণ আদর করতেন। বিশেষ করে হেলাল সাহেব ছিলেন আমার আত্মার সাথে যুক্ত। তিনি তখনও বিয়ে করেননি। আমরা একসাথে পুলিশ ক্লাবে থাকতাম। 

 

 

 তো জীবনে প্রথমবার মফস্বল করতে গাট্টিবোঁচকা বেঁধে ফোর্স ও অস্ত্র গোলাবারুদসহ প্রস্তুত হলাম। দুর্গম নদীমাতৃক এলাকা বলে ফোর্সের সংখ্যা বেশি নেওয়া প্রয়োজন। তার ওপর তখন ছিল সর্বহারা পার্টির চরম দৌরাত্ম। বাবুগঞ্জ ও উজিরপুর থানা এলাকায় আনসার বাহিনীর অস্ত্র লুট হয়েছিল কয়েক দিন আগে। এলাকায় থমথমে অবস্থা। এর বেশ কিছু আগে গোঁসাইরহাট থানায় পুলিশের অস্ত্র লুট হয়। সব কিছু মিলে বরিশাল জেলা তখন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। 

 

 

 যাত্রাপথও বেশ জটিল। বিকালবেলায় লঞ্চে করে প্রায় অর্ধেক পথ যাওয়া যাবে। সেখান থেকে ইঞ্জিন বোটে চন্দ্রমোহন ইউনিয়নের কাছে গিয়ে তারপর কয়েক মাইল পায়ে হেঁটে চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি। সেই বাড়িতে গিয়ে আস্তানা গেড়ে তারপর চলবে অভিযান। পুলিশের নিরাপত্তার জন্য চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা।

 

 

 ২.

জীবনের প্রথম মফস্বলে যাবার সময় সমাগত। আমার সাথে তিনজন কনস্টেবল প্রস্তুত। এমন সময় একজন বয়স্ক কনস্টেবল আমার কানে কানে বললেন, 

“স্যার, আমাকে নিয়ে চলেন। আমি ঐ এলাকা চিনি। আপনি নতুন মানুষ। বিপদ-আপদ হলে আমি সামলে নিবো।”

 

 

এই কনস্টেবল সাহেবের কথা না বললেই নয়। তার চেহারা আমার চোখে আজও ভাসে। তার কনস্টেবল নং ১১৪। নাম- তোফাজ উদ্দীন। তখন তার চাকরি জীবন শেষের পর্যায়ে। থানায় যত লাশ আসতো তার প্রত্যেকটির পোস্টমর্টেম করাতেন এই তোফাজ উদ্দীন। মরা পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত লাশ টানাটানিতে তিনি কখনও আপত্তি করতেন না। যেকোনো লাশ দেখে তিনি বলে দিতে পারতেন, কোনটা ‘হত্যা’ আর কোনটা ‘আত্মহত্যা’। লাশের সুরতহাল রিপোর্ট কীভাবে তৈরি করতে হয় তা তিনি আমাকে নিজের হাতে শিখিয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, “সব মানুষের একদিন মরতে হবে। তাই সকল লাশের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। লাশের যত্ন নিতে হবে।”

 

 

তিনি সকল বেওয়ারিশ লাশ যত্ন সহকারে সৎকার ও দাফন করতেন। তিনি আমাকে সন্তানের মতো স্নেহ করে আগলে রাখতেন। আমার প্রথম মফস্বল অভিযানে সেকেন্ড অফিসার রুহুল ইসলাম সাহেবের বদান্যতায় এই কনস্টেবল তোফাজ উদ্দীন সঙ্গী হয়েছিলেন। চন্দ্রমোহন ইউনিয়নের মুলতবী সকল ওয়ারেন্ট ও মামলার কাগজপত্র আমাকে থানার মুন্সি সাহেব বুঝিয়ে দিলেন। 

 

 

 বিকাল, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলো। লঞ্চ ও ইঞ্জিন নৌকা ভ্রমণ শেষ করে শুরু হলো পায়ে হাঁটা। উদ্দেশ্য চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি। আমার সাথে থাকা অভিজ্ঞ কনস্টেবল তোফাজ উদ্দীন আগে থেকেই চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি চিনতেন। বয়স বেশি হলেও তার হাঁটায় মোটেই ভাটা পড়েনি। আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে যতবার জিজ্ঞেস করছি, “চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি আর কত দূর?”

 

 

তিনি বলেছিলেন, “এইতো শুনকি স্যার।”

 

 

তার উপর আস্থা হারিয়ে মাঝে দুই একজন পথচারীদের জিজ্ঞেস করলে তারাও বলেছিলেন, “এইতো শুনকি . . .”

 

 

 সেই থেকে ‘শুনকি’  শব্দটি আমার কানে গেঁথে গিয়েছিল। অবশেষে পদযাত্রার অবসান হলো। পৌঁছে গেলাম কাঙ্খিত চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি। তখন রাত প্রায় দশটা। অভিজ্ঞ কনস্টেবল তোফাজ উদ্দীনের গলার স্বর শুনে চেয়ারম্যান সাহেব হন্তদন্ত হয়ে উঠে আসলেন। এত রাতে তাকে না জানিয়ে এত পুলিশ তার বাড়িতে যাওয়ায় তিনি একটুও বিরক্ত হলেন না। বরং তার চোখে মুখে আনন্দের ভাব ফুটে উঠল। আমাকে দেখে তিনি আরো খুশি হলেন। ইতোপূর্বে এই চেয়ারম্যান সাহেবকে আমি দুই একবার থানায় দেখেছিলাম, কিন্তু পরিচয় হয়নি।

 

 

বরিশাল এলাকায় কোনো বাড়িতে মেহমান হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার ইতোমধ্যে হয়েছে। ঐ এলাকার মানুষ অত্যন্ত অতিথি পরায়ণ। বিশেষ করে পুলিশের কদর অনেক বেশি। তাই ঐ রাতে চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নের হিড়িক পড়ে গেল। সামান্য সময়ের মধ্যে নানাবিধ খাবার দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করা হলো। 

 

 

 খাওয়ার শেষে চেয়ারম্যান সাহেবের কাঠের দোতলা বাড়ির একটি রুমে সুসজ্জিত বিছানায় আমার ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হলো। আমার সাথে থাকা চারজন কনস্টেবল আজ রাতে শুধু  ওয়ারেন্ট তামিলের জন্য বাহিরে যেতে অনুমতি চাইলো। আমি তাতে সম্মত না হয়ে নিজেও তাদের সাথে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। সকল কনস্টেবল এক প্রকার অবাক হলো। চেয়ারম্যান সাহেব নিজেও অবাক হলেন। তিনি বললেন, 

“এ কেমন কথা স্যার! আমি চৌকিদার দফাদার ডেকে এনেছি। ওরা সারারাত বড় মিয়াদের সাথে সব ওয়ারেন্টের আসামি ধরে আনবে। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান।”  

 

 

 কিন্তু আমার মন সায় দিলো না। রাতে যদি ফোর্সের কোনো সমস্যা হয় বা কোনো মানুষের সাথে যদি কোনো খারাপ ব্যবহার করে তাহলে দায়দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে। তাই চেয়ারম্যান সাহেব ও ফোর্সের প্রবল আপত্তি স্বত্ত্বেও আমি নিজেই ওয়ারেন্ট তামিলে ফোর্সের সাথে গেলাম। 

 

 

 সারারাত ওয়ারেন্ট তামিল করে ভোরবেলায় ৬ জন ওয়ারেন্টের আসামি ধরে আবার চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি হাজির হলাম। চেয়ারম্যান সাহেব রীতিমতো অবাক হতে লাগলেন। তিনি বললেন,

 

 

“স্যার, এরা সবাই আমার নিজের লোক। আমি ডাকলেই তারা হাজির হতো। এর আগে কয়েকবার থানার দারোগা স্যারেরা এসে তাদের আমার বাড়িতে ডেকেছেন। তারা সবাই দারোগা স্যারদের খুশি করে বাড়িতে ঘুমায়। আপনি যখন কষ্ট করে ধরেই এনেছেন তখন আমার কাছে দিয়ে যান। আপনাকে একটু বেশি খুশি করব।”

 

 

“স্যার, এরা সবাই আমার নিজের লোক। আমি ডাকলেই তারা হাজির হতো। এর আগে কয়েকবার থানার দারোগা স্যারেরা এসে তাদের আমার বাড়িতে ডেকেছেন।তারা সবাই দারোগা স্যারদের খুশি করে বাড়িতে ঘুমায়। আপনি যখন কষ্ট করে ধরেই এনেছেন তখন আমার কাছে দিয়ে যান। আপনাকে একটু বেশি খুশি করবো।"

 

 

 আমার সাথে থাকা কনস্টেবলরা চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে একমত পোষণ করল। আমি অবাক হয়ে থমকে গেলাম। প্রতিমাসে ওয়ারেন্ট তামিল নিয়ে ওসি সাহেব-এসপি সাহেব সকল অফিসারকে কত বকাবকি করেন, তা আমি ইতোমধ্যে জেনে গেছি। বিশেষ করে দীর্ঘদিনের লাল কালির ওয়ারেন্ট নিয়ে বেশি বকাবকি করেন। ঐ দিন যেসব ওয়ারেন্টের আসামি ধরা পড়েছিল, তারা সবাই ছিল লাল কালির ওয়ারেন্ট। তাই চেয়ারম্যান সাহেব ও কনস্টেবলদের সকল অনুরোধ আমি অগ্রাহ্য করে আসামিদের নিয়ে তখনই বরিশাল ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। 

 

 

 চেয়ারম্যান সাহেবের চোখে মুখে বিরক্তির ভাব দেখলাম। কনস্টেবল সাহেবরাও একই ভাব প্রকাশ করলেন। কিন্তু গ্রেফতারকৃত ওয়ারেন্টের আসামিদের মধ্যে কোনো বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। কারণ তারা এর আগে বহুবার চেয়ারম্যান সাহেবের মাধ্যমে কিছু নগদের বিনিময়ে ছাড়া পেয়ে বাড়িতে গিয়ে নাক ডেকে ঘুমিয়েছে। 

 

 

 অবস্থা বেগতিক দেখে আমি দেরি না করে আসামিদের নিয়ে নদীর ঘাটের দিকে রওয়ানা হতে কনস্টেবলদের নির্দেশ দিলাম। মনে মনে ভীষণ অসম্মানিত হলেও চেয়ারম্যান সাহেব নাস্তা খাইয়ে ছাড়লেন। আমিও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ও চেয়ারম্যান সাহেবের অনুরোধে নাস্তা খেয়ে আসামি ও ফোর্সসহ নদীর দিকে হাঁটতে থাকলাম। 

 

 

 রাতের সেই ‘শুনকি’র পথ ধরে পায়ে হেঁটে নদীর পাড়ে হাজির হয়ে এক হৃদয় বিদারক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম। আসামিদের নিয়ে নৌকায় উঠতে গিয়ে দেখলাম তাদের আত্মীয়-স্বজনরা নদীর পাড়ে ভীড় করে কান্নাকাটি করছে। আমি বিবেকের কাছে দংশিত হতে লাগলাম। তবুও আসামিসহ নৌকা ছেড়ে দিয়ে তীর থেকে একটু দূরে যেতেই দেখলাম সেই চেয়ারম্যান সাহেবও নদীর পাড়ে হাজির। তিনি একটি কথাও বললেন না। তার জীবনে দেখা ব্যাতিক্রমী ঘটনা নিয়ে হয়তো তিনি হিসাব মিলাতে চেষ্টা করছিলেন। 

 

 

 ৩.

নৌকা নদীর মাঝখানে গেলে আমি কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়ে আসামিদের কাছে জিজ্ঞেস করলাম তাদের বিরুদ্ধে কী কী মামলা? তারা কেন দীর্ঘদিন কোর্টে হাজির হয় না? ইত্যাদি। তারা সবাই জানাল, তাদের বিরুদ্ধে কৃষিঋণের মামলা। কৃষিঋণ নিয়ে শোধ দিতে না পারায় ওয়ারেন্ট হয়েছে। আমি ফাইল থেকে ওয়ারেন্টগুলো বের করে দেখি ওরা সত্য কথা বলেছে। আমার মনে ভেসে উঠল এদেশের শত শত ঋণ খেলাপিদের ছবি। তারা দেশের কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে রীতিমতো বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ সামান্য কয় টাকা কৃষিঋণ নিয়ে অভাবের তাড়নায় শোধ করতে না পারায় তাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট হয়েছে, আর সেই ওয়ারেন্ট তামিল করে আমি বাহবা কুড়াব। নিকুচি করি এমন বাহবার। পরে যা হবার তাই হবে। আমি আপাতত সব আসামি ছেড়ে দিয়ে যাব তাতে যা হবার তাই হবে। ওদিকে স্বজনদের হাতে হাতকড়া দেখে নদীর ধারে অপেক্ষমান মানুষের মৃদু দীর্ঘশ্বাসে সকালের মৃদুমন্দ বাতাস ভারি হতে লাগল। আমি তাদের দিকে এক নজর দেখি আর নৌকার ভিতরে থাকা হাতকড়া পরা মানুষদের দিকে তাকাই। আমার মনে নানা প্রশ্ন ভীড় করে। আমার পুলিশি পোশাকের ভিতরের মানুষটির কাছে সেগুলোর উত্তর জানতে চাই। এক পর্যায়ে নৌকা ফিরিয়ে আবার ঘাটে ভিড়াতে বললাম।

 

 

তারা সবাই জানাল, তাদের বিরুদ্ধে কৃষিঋণের মামলা। কৃষিঋণ নিয়ে শোধ দিতে না পারায় ওয়ারেন্ট হয়েছে। আমি ফাইল থেকে ওয়ারেন্টগুলো বের করে দেখি ওরা সত্য কথা বলেছে। আমার মনে ভেসে উঠল এদেশের শত শত ঋণ খেলাপিদের ছবি। তারা দেশের কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে রীতিমতো বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ সামান্য কয় টাকা কৃষিঋণ নিয়ে অভাবের তাড়নায় শোধ করতে না পারায় তাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট হয়েছে

 

 

 উপস্থিত চেয়ারম্যান সাহেব ও ধৃত আসামির আত্মীয় স্বজনদের ডেকে একসাথে করে তাদের কথা শুনলাম। তারা প্রত্যেকে অত্যন্ত গরিব। চেয়ারম্যান সাহেব ও আসামিদের আত্মীয় স্বজনদের একসাথে নিয়ে বললাম, 

 

 

“আমি এক শর্তে সব আসামি ছেড়ে দিতে পারি। চেয়ারম্যান সাহেব আগামী দুই তিন দিনের মধ্যে সকল আসামিকে বরিশাল পুলিশ ক্লাবে আমার কাছে হাজির করবেন। আমি তাদের জামিনের ব্যবস্থা করব। উকিলের খরচ আমি বহন করব।”

 

 

 চেয়ারম্যান সাহেবসহ সকলে অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমার সাথে থাকা কনস্টেবলরা বিরক্ত হতে লাগল। সকালবেলায় এই কথাগুলো বললে তাদের পকেটে কিছু নগদ নারায়ণ আসতো সেটা আর হলো না। আসামির আত্মীয় স্বজনরা আমাকে বিশ্বাস করতে সাহস করছিল না। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব অনেক অভিজ্ঞ মানুষ। তিনি পুলিশের মতিগতি জানেন। তাই তিনি সকল আসামি পুলিশ ক্লাবে আমার কাছে হাজির করতে সম্মত হলেন। আমি কোনো প্রকার কাগজ কলম ছাড়া সকল আসামি চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে ছেড়ে দিয়ে আমার জীবনের প্রথম মফস্বল অভিযানের অকাল সমাপ্তি টেনে বরিশাল শহরের দিকে রওয়ানা হলাম। সারা নদীপথে আমার সাথে থাকা কনস্টেবলদের মুখে বিরক্তির ছায়া দেখতে পেলাম। তাদের এবারের মফস্বল অভিযান বিফলে গেল।

 

 

চেয়ারম্যান সাহেব অনেক অভিজ্ঞ মানুষ। তিনি পুলিশের মতিগতি জানেন। তাই তিনি সকল আসামি পুলিশ ক্লাবে আমার কাছে হাজির করতে সম্মত হলেন। আমি কোনো প্রকার কাগজ কলম ছাড়া সকল আসামি চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে ছেড়ে দিয়ে আমার জীবনের প্রথম মফস্বল অভিযানের অকাল সমাপ্তি টেনে বরিশাল শহরের দিকে রওয়ানা হলাম। সারা নদীপথে আমার সাথে থাকা কনস্টেবলদের মুখে বিরক্তির ছায়া দেখতে পেলাম। তাদের এবারের মফস্বল অভিযান বিফলে গেল।

 

 

 বিকালবেলা থানায় না গিয়ে সোজা পুলিশ ক্লাবে গিয়ে ঘুম দিলাম। রাতে থানায় যাবার সাথে সাথে ওসি সাহেব তলব করলেন। ইতোমধ্যে তিনি সকল ওয়ারেন্টের আসামি ছেড়ে দেবার সব খবর পেয়ে গেছেন। আমার সাথে থাকা কনস্টেবলদের মধ্যে কেউ হয়তো সব কথা ওসি সাহেবকে বলে দিয়েছে। আমার সাথে মফস্বলে গিয়ে সবাই অহেতুক কষ্ট পেয়ে নগদ নারায়ণ বঞ্চিত হয়ে ওসি সাহেবের কাছে হয়তো কিছু বাড়িয়ে বলে প্রিয়পাত্র হবার চেষ্টা করেছে। 

 

 

 ওসি সাহেব আমাকে সকল ছেড়ে দেওয়া ওয়ারেন্টের আসামিদের নাম ধরে ধরে বললেন, 

“তুমি গত রাতে মফস্বলে গিয়ে অমুক অমুক আসামি ধরে ছেড়ে দিয়েছ। এজন্য তোমার বিরুদ্ধে এসপি সাহেবের কাছে ও কোর্টে রিপোর্ট দেওয়া হবে। তাতে তোমার চাকরিও চলে যেতে পারে।”

 

 

আমিও এ ব্যাপারে আইনের বিধান জানি। আইনের দৃষ্টিতে আমি মারাত্মক অপরাধ করেছিলাম। ভয়ে শরীর আড়ষ্ঠ হয়ে আসছিল। তবুও সাহস করে বললাম, 

“স্যার, সকল আসামি যদি কোর্টে হাজির হয় তাহলে কী হবে?”

 

 

ওসি সাহেব রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, “আসামিরা তোমার দুলাভাই লাগে না-কি? তুমি বরিশালের মানুষ চিনো? সারা জীবনে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখন যাও সাসপেন্ড হওয়ার জন্য রেডি হও।”

 

 

আমি ওসি সাহেবের রুম থেকে বের হবার আগেই অন্যান্য অফিসাররা আমার গত রাতের কাহিনী শুনে হাসাহাসি শুরু করেছিলেন। আমি তাদের কাছাকাছি যেতেই তারা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলেন। আমি মনের কষ্টে সোজা পুলিশ ক্লাবে চলে গেলাম।

 

 

 রাতে কোনো মতে খেয়ে দেয়ে বিছানায় গিয়ে সারারাত নির্ঘুম কাটালাম। মনে মনে ভাবলাম, সারদায় ট্রেনিংয়ে থাকায় তখন বিসিএস পরীক্ষা দিতে পারিনি। এখন যদি চাকরি চলে যায় তাহলে পড়াশোনা করে বিসিএস পরীক্ষা দিব। আল্লাহ সহায় থাকলে এর চেয়ে ভালো কিছু হবে।

 

 

 নির্ঘুম রাত কাটিয়ে সকালে অফিসে যেতে মন চাচ্ছিল না। অফিসে গেলে ওসি সাহেবের রক্তচক্ষু দেখতে হবে। তার চেয়েও খারাপ অন্যান্য অফিসারদের উপহাস সহ্য করতে হবে। এসব ভেবে বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিজের ভবিষ্যতের চিন্তা করতে থাকলাম। এমন সময় পুলিশ ক্লাবের বাবুর্চি কালু এসে বলল, 

 

 

 “স্যার, চন্দ্রমোহন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাব আর কয়জন মানু আপনার লগে দেহা হরতে আইছে।”

 

 

আমি লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে ক্লাবের বারান্দায় গিয়ে সকলকে দেখে এক প্রকার কেঁদে ফেললাম। ওরা আমার বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়ে কালবিলম্ব না করে নির্ধারিত দিনের আগেই আমার কাছে হাজির হওয়ায় আমি ওসি সাহেবের সেই কথা মিথ্যা প্রমাণ করলাম। সেই যে ওসি সাহেব বলেছিলেন, “তুমি বরিশালের মানুষ চিনো না। ওরা জীবনেও হাজির হবে না।” 

 

 

আমি লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে ক্লাবের বারান্দায় গিয়ে সকলকে দেখে এক প্রকার কেঁদে ফেললাম। ওরা আমার বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়ে কালবিলম্ব না করে নির্ধারিত দিনের আগেই আমার কাছে হাজির হওয়ায় আমি ওসি সাহেবের সেই কথা মিথ্যা প্রমাণ করলাম। সেই যে ওসি সাহেব বলেছিলেন, “তুমি বরিশালের মানুষ চিনো না। ওরা জীবনেও হাজির হবে না।” 

 

 

 সেদিন আমার মনে হয়েছিল, বিশ্বাস অনেক বড়। মানুষকে সত্যিকার বিশ্বাস করে বিনা স্বার্থে মর্যাদা দিলে তারা বিশ্বাস ভঙ্গ করেনা। সেখানে নির্দিষ্ট কোনো এলাকা বা নির্দিষ্ট দেশ কোনো বিষয় নয়। পৃথিবীর মানুষ বিশ্বাস ভঙ্গ করে আস্থার অভাবে। একবার কারও মনে আস্থা অর্জন করতে পারলে মানুষ তার মর্যাদা দেবেই। 

 

 

 আমি বেশ ভয়ে ভয়ে ছিলাম। থানার অফিসার যদি জানে পুলিশ ক্লাবে হাতের নাগালে ছয়জন লাল কালির ওয়ারেন্টের আসামি ঘোরাঘুরি করছে তাহলে এখনই ধরে নিয়ে কৃতিত্ব নেবে। তাই দ্রুত গোসল নাস্তা সেরে আসামি ও চেয়ারম্যান সাহেবকে সাথে করে সোজা কোর্টে গেলাম। আমার পরিচিত এডভোকেট দিলীপ বাবুকে সব ঘটনা খুলে বললাম। তিনি বিনা টাকায় জামিন মুভ করতে রাজি হলেন। তবে জামিনের বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারলেন না। সুতরাং ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব সালেহ হাসান সাহেবের কাছে হাজির হয়ে তাকেও সব খুলে বললাম। আমার চাকরির ক্ষতি হতে পারে শুনে তিনিও আসামিদের জামিন দিতে সম্মত হলেন। সকল আসামি একযোগে হাজির হয়ে জামিন পেয়ে গেল। 

 

 

 আহ্, কী যে শান্তি! আমার চোখের সামনে স্বর্গ নেমে এলো। আমি কোর্ট থেকে রিকল নিয়ে থানায় হাজির হলাম। এ যাত্রায় আমার চাকরি বেঁচে গেল। কিন্তু ওসি সাহেবের আস্থা ফিরে পাওয়া গেল না। তিনি সবার কাছে বললেন,  “এসব অফিসার দিয়ে থানা চালানো কঠিন। এরা কোনো কাজের না।”

 

 

 আহ্, কী যে শান্তি! আমার চোখের সামনে স্বর্গ নেমে এলো। আমি কোর্ট থেকে রিকল নিয়ে থানায় হাজির হলাম। এ যাত্রায় আমার চাকরি বেঁচে গেল। কিন্তু ওসি সাহেবের আস্থা ফিরে পাওয়া গেল না। তিনি সবার কাছে বললেন,  “এসব অফিসার দিয়ে থানা চালানো কঠিন। এরা কোনো কাজের না।”

 

 

এরপর ঐ আসামিদের সাথে আমার আর কোনো দিন দেখা হয়নি। তবে চেয়ারম্যান সাহেব থানায় এলে মাঝে মাঝে আমাকে খুঁজতেন। 

 

 

 ৪.

আইন ও মানবতা কখনও কখনও পরস্পরের বিরোধী। গরিব অসহায় জেনেও ধৃত ওয়ারেন্টর আসামিদের ছেড়ে দেবার অধিকার আইন আমাকে দেয়নি। পুলিশের জন্যে এই ধরনের মানবিক কাজ করা রীতিমত আইনবিরোধী। আসামিরা যদি ঐদিন আমার কাছে হাজির না হয়ে পালিয়ে থাকত, বা কয়েকদিন পরে হাজির হতো, সেটা আমার জন্য বড় ধরনের বিভাগীয় শাস্তি ডেকে আনতে পারত। চাকরি জীবনের একদম শুরুতে একসাথে ছয়জন লাল কালির ওয়ারেন্টের আসামিকে কোর্টে হাজির করানোর কৃতিত্বের চাইতে ঝুঁকির মাত্রাটা একটু বেশিই ছিল। ভাগ্যগুনেই সেবার বেঁচে গিয়েছিলাম। 

 

 

 এই ঘটনার পর থেকে ঐ ওসি সাহেব আমাকে আর কোনো দিন সুনজরে দেখেননি। কিন্তু ওপরকর্তার চক্ষুশূল হয়েও অনেকগুলো অসহায় গরিব মানুষের মুখের হাসি ফোটানোর তৃপ্তি আজও আমি অনুভব করি। 

 

 

কামরুল ইসলাম, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা

 

 

Your Comment