শুক্রবার ৫ই বৈশাখ ১৪৩১ Friday 19th April 2024

শুক্রবার ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

Friday 19th April 2024

বহুস্বর মতামত

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী-হয়রানি কি শিক্ষার্থী নিয়ন্ত্রণের তরিকা?

২০২২-০৭-৩১

গীতি আরা নাসরীন

সম্প্রতি একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী  আন্দোলনের সূত্রপাতই হয়েছে ছাত্রীদের মৌখিক ও দৈহিক নিপীড়ন এবং তার যথাযথ বিচার না হওয়া থেকে

 

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় ফটো-সেশান করার জন্য একজন নারী ও সংশ্লিষ্ট আলোকচিত্রীকে হেনস্থা করা হয়েছে এরকম একটি পোস্ট  ফেইসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে, ছবির নারী  “স্লিভলেস ব্লাউজ” পরে ছিলেন বলেই, দু’জন শিক্ষক (নারী ও পুরুষ) তাদের সাথে অযাচিত আচরণ করেন, “ন্যুড” ছবি তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ এবং ঘৃণাসূচক উক্তি করেন।  গণমাধ্যম থেকে যোগাযোগ করা হলে সংশ্লিষ্ট একজন শিক্ষক পুরো ঘটনা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের মন্তব্য এবং প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায় পাঠকরা প্রায় সবাই এ কথা  বিশ্বাস করেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নারীর পোশাক নিয়ে এহেন মন্তব্য করে থাকেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে নারীর আবরণ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণে অশিক্ষকসুলভ ব্যবহারেও পিছপা হন না।

 

 

সম্প্রতি একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী  আন্দোলনের সূত্রপাতই হয়েছে ছাত্রীদের মৌখিক ও দৈহিক নিপীড়ন এবং তার যথাযথ বিচার না হওয়া থেকে। ছাত্রীদের চলাফেরার ওপরে অধিকতর নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং সে বিষয়ে প্রতিকার চাওয়া হলে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুধু উদাসীনতাই দেখান না, অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবাদকারীদের সম্পর্ক নানাবিধ মন্তব্য করেন বা তাদের চরিত্র সম্পর্ক নানাবিধ ইংগিতপূর্ণ কথা বলেন। নারী শিক্ষার্থীরা নিয়মিত যে মৌখিক নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকেন, দুঃখজনকভাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই কটুকাটব্য করেন শিক্ষকরাই।

 

 

সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষাপ্রদানকারীদের সম্পর্কে এ ধরণের ভাবনা কী করে জন্মালো, তার কারণ খতিয়ে দেখলে আরও দেখতে পাই, সম্প্রতি একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী  আন্দোলনের সূত্রপাতই হয়েছে ছাত্রীদের মৌখিক ও দৈহিক নিপীড়ন এবং তার যথাযথ বিচার না হওয়া থেকে। ছাত্রীদের চলাফেরার ওপরে অধিকতর নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং সে বিষয়ে প্রতিকার চাওয়া হলে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুধু উদাসীনতাই দেখান না, অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবাদকারীদের সম্পর্ক নানাবিধ মন্তব্য করেন বা তাদের চরিত্র সম্পর্ক নানাবিধ ইংগিতপূর্ণ কথা বলেন। নারী শিক্ষার্থীরা নিয়মিত যে মৌখিক নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকেন, দুঃখজনকভাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই কটুকাটব্য করেন শিক্ষকরাই।

 

 

অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে যারা নিপীড়নে অংশ নেয়, তাদের সিংহভাগ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের জড়িত। যথাযথ বিচারের আওতায় না এনে দলীয় রাজনীতিতে জড়িত এ ধরণের ছাত্রদের বরঞ্চ আরও আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হয়ে থাকে। এর ফলে নিপীড়ন অব্যহত থাকে।



গত ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন নারী শিক্ষার্থীকে পাঁচজন ছাত্র হেনস্তা করে ভিডিও করা ও ধর্ষণ চেষ্টা করলে ছাত্রী অভিযোগ দাখিল করেন। ঘটনার দু’দিন পর তার লিখিত অভিযোগ গ্রহণ করা হয়। এ বিষয়ে কর্তপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বিক্ষোভে  উত্তাল হয়ে ওঠে। গণমাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আরও অভিযোগ করেন, এ ধরণের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আগেও ঘটেছে, তবে, শিক্ষক-কর্তপক্ষ অভিযোগ আমলে নেন না। এর আগে এমনকি নিপীড়কদের চিহ্নিত করা হলেও তাদের কোনো শাস্তি হয়নি। বস্তুত, নিপীড়নকারীরা ক্ষমতাসীন দল এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ছত্রছায়াতেই থাকে।

 

 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর শহীদুল আলম বলেন, মেয়েটি যেখানে আক্রান্ত হয়েছে, সে জায়গাটি “নির্জন” ছিল। সেখানে বরঞ্চ আলোচনার উপস্থাপক মনে করিয়ে দেন, এই জায়গাটির কাছেই জামাল নজরুল ইসলাম বিজ্ঞানাগার, সুতরাং সেখানে একজন ছাত্রী যেতে পারবেন না কেন? যিনি প্ররক্ষক তিনিই যদি ছাত্রীদের জন্য পৃথক নিয়ম জারি করেন এবং  ভুক্তভোগীর ওপর দায় চাপিয়ে দেন, তবে প্রতিকার পাবার আশা সুদূরপরাহত হয়ে যায়।

 

 

কর্তৃপক্ষের মনোভাব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড আয়োজিত একটি অনলাইন আলোচনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর শহীদুল আলম বলেন, মেয়েটি যেখানে আক্রান্ত হয়েছে, সে জায়গাটি “নির্জন” ছিল। সেখানে বরঞ্চ আলোচনার উপস্থাপক মনে করিয়ে দেন, এই জায়গাটির কাছেই জামাল নজরুল ইসলাম বিজ্ঞানাগার, সুতরাং সেখানে একজন ছাত্রী যেতে পারবেন না কেন? যিনি প্ররক্ষক তিনিই যদি ছাত্রীদের জন্য পৃথক নিয়ম জারি করেন এবং  ভুক্তভোগীর ওপর দায় চাপিয়ে দেন, তবে প্রতিকার পাবার আশা সুদূরপরাহত হয়ে যায়।

 

 

উপরন্তু তদন্ত কমিটির সদস্যরাই এধরণের প্রশ্ন/মন্তব্য করেছিলেন বলে জানা যায়,  “এধরণের পোশাক পরলে ছবি তো তুলবেই”, বা “তুমি এত রাতে বেরিয়েছো কেন”!

 


বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে উল্টো ভিকটিম ব্লেইমিং করা আমরা বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বারবার দেখতে পাই। বেশিরভাগ সময়ে ছাত্রীদের ওপরই এ অন্যায্য দায়ভার বর্তালেও ছাত্ররাও কখনো কখনো এর শিকার হয়ে থাকেন।

 

 

যেমন, এই পঁচিশে জুলাই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বুলবুল আহমেদ নামে একজন ছাত্র ছুরিকাহত হয়ে নিহত হন। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ ও বিক্ষোভের মধ্যেই নিহত শিক্ষার্থী বুলবুল আহমেদের জন্য আয়োজিত এক দোয়া মাহফিলে উপাচার্য বলেন, “ইদানীং আমাদের ক্যাম্পাসে কোনো শৃঙ্খলা নেই। রাতে-দিনে যে যেভাবে পারে- সেভাবে অবাধ বিচরণ করছে; যা দেখলে আমরা নিজেরাও লজ্জিত বোধ করি।”

 



বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের বিচরণেরই  জায়গা। সেখানে তাদের জন্য অবাধ বিচরণের পরিবেশ  তৈরী না হলেই বরঞ্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের লজ্জা বোধ করার কথা। পক্ষান্তরে আমরা দেখতে পাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের রক্ষা নয়, তাদের জন্য সীমারেখা নির্ধারণ করে  ভয়ের ভূগোল অংকন করাই দায়িত্বরত শিক্ষকদের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।


 

পাঠক নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, এ বছরের শুরুতেই শাবিপ্রবির একজন ছাত্রী তার হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ করেন। ছাত্রীবান্ধব আবাসনের দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলনে দমনের উদ্দেশ্যে পুলিশ ডাকা হয় ক্যাম্পাসে। আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠি-গুলি-টিয়ারশেল চলে, ফলে আন্দোলন উপাচার্য পদত্যাগের দাবিতে মোড় নেয়। প্রায় দুসপ্তাহের এই আন্দোলনের পরও শিক্ষার্থীদের দাবি মানা হয় নি। বরঞ্চ, ছাত্রীদের ন্যায্য দাবি কে যে উপাচার্য অন্যায় সুযোগ গ্রহণ বলে মনে করেন, এবং গণ্ডীবদ্ধ চলাফেরা না করার কারণে জাহাঙগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বিবাহযোগ্যতা নেই, উপাচার্য মহোদয়ের এই বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

 

 

নারীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার একমাত্র লক্ষ্য বিয়ে করতে পারা, একজন উপাচার্য যখন এভাবে চিন্তা করেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয় শব্দের অর্থ নিয়েই সন্দিহান হতে হয়।

 

 

ছাত্রীদের আলাদা করে চিহ্নিত করা, তাদের গতিবিধির সীমা নিয়ন্ত্রণ করা, কটুক্তি করা, ইত্যাদির মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের ছাত্রী-বান্ধব নয়, পক্ষান্তরে নির্যাতক-বান্ধব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। যৌন-হয়রানীমুক্ত শিক্ষা ও কর্মপরিবেশ তৈরিতে মাননীয় হাইকোর্ট প্রদত্ত নীতিমালা (২০০৯) বাস্তবায়নের অনীহার মধ্যে দিয়ে এই মনোভাব পরিস্ফুট হয়।
 


নীতিমালার ৪ ধারায় যৌন হয়রানীর সংজ্ঞাসমূহ পড়ে দেখলে আমরা বুঝতে পারি, নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে শিক্ষকরাও অনেক সময় এমন কথা বলেন, বা আচরণ করে থাকেন, যা সুস্পষ্টভাবে যৌন হয়রানী। যেমন,

 

ছ) অশালীন ভাষা বা মন্তব্যের মাধ্যমে উক্তত্য করা, .....যৌন-ইঙ্গিতমূলক ভাষা ব্যবহার করে ঠাট্টা বা উপহাস করা;
ঞ) যৌন হয়রানির কারণে খেলা-ধুলা, সাংস্কৃতিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং ‍শিক্ষাগত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হওয়া।

অর্থাৎ অভিভাবকত্বের ছলে শিক্ষক সংবিধান ও নীতিমালাপন্থী কাজ করে বৈষম্য বলবত রাখছেন।

 


প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে অভিযোগগ্রহণকারী কমিটি তৈরী হবে, তার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনাও নীতমালায়  দেওয়া আছে। অথচ, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কমিটি গঠিত হয়নি। কমিটি থাকলেও তা নির্দশিত পদ্ধতি অনুসারে হয়নি।

 

সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সদস্য যাতে এই নীতিমালা সম্পর্ক অবহিত থাকেন তার ব্যবস্থা নিতে হবে। অথচ, যৌন-নিপীড়নের কী-কীভাবে সম্পর্কে অবহিত থাকা তো দূরের কথা, যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করুন, নিপীড়নের শিকার হলে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে কোথায়, কার কাছে অভিযোগ জানাতে হবে সে বিষয়ে তিনি জানেন কী না, প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে “না”-বাচক উত্তর পাবেন।

 

 

সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সদস্য যাতে এই নীতিমালা সম্পর্ক অবহিত থাকেন তার ব্যবস্থা নিতে হবে। অথচ, যৌন-নিপীড়নের কী-কীভাবে সম্পর্কে অবহিত থাকা তো দূরের কথা, যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করুন, নিপীড়নের শিকার হলে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে কোথায়, কার কাছে অভিযোগ জানাতে হবে সে বিষয়ে তিনি জানেন কী না, প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে “না”-বাচক উত্তর পাবেন।

 

 

যৌন-নিপীড়ণ সংক্রান্ত প্রশ্ন উঠলেই আমরা কর্তপক্ষকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নিয়ে ভাবিত হতে দেখি। অথচ, যে সম্মিলিত স্মৃতির মধ্য দিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি তৈরী হয়, সেখানে নিপীড়ন-লাঞ্চছনার ইতিহাসও প্রত্যেকটি আর্বতনের মধ্য দিয়েই আবর্তিত হতে থাকে। কাগুজে ইতিহাসের পাশাপাশি বাহিত সেই মৌখিক ইতিহাস জ্ঞান-পীঠে সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও প্রজ্ঞার অভাবকেই প্রকট করে।
মনে করুন, এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে শিক্ষার্থীরা  নিরাপদে চলাফেরা করেন, যৌন-নিপীড়নের বিচার হয়, এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি কী আরও সমুন্নত হবে না?

 

 

শেষ বিচারে মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চিন্তার মুক্তিক্ষেত্র নয়, চিন্তার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই কাজ করছে। পেটোয়া-বাহিনী দিয়ে, সহিংসতা দিয়ে যেখানে  শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাষ্টিক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ জারি রাখা হয়। যৌন-নিপীড়ন বন্ধে অনীহা এই নিয়ন্ত্রণেরই একটি রূপ।
 


তবুও আশা করি, আমি ভুল প্রমাণিত হবো।

 

 

গীতি আরা নাসরীন

গণমাধ্যম বিশ্লেষক;

অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Your Comment