ডিইউজে একাংশ (সরকারপন্থী) ২০২২ নির্বাচনে সংবাদকর্মীদের ভিড়। ছবি: দৃকনিউজ
শেষ পর্ব
- সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সংবাদমাধ্যম
- মালিকানা, বিজ্ঞাপন ও রাজনৈতিক প্রভাবে বদলে যাচ্ছে সংবাদ
- সংবাদ নয়, প্রাধান্য পাচ্ছে বিজ্ঞাপন
- জনগণের আস্থা হারিয়েছে সংবাদমাধ্যম
- শ্রম অধিকারের বালাই নেই, হতাশাগ্রস্ত সাংবাদিকরা
সামাজিক, রাজনৈতিক নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অর্ধশত বছর পার করেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র। দীর্ঘ এই যাত্রাপথে রাষ্ট্রের ও সমাজের বিভিন্ন অংশের ভুল-ত্রুটি বিশ্লেষণ করে ভিন্নমত প্রকাশে পথ পরিসরের দায়িত্ব ছিল সংবাদমাধ্যমের কাঁধে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমগুলো কি পেরেছে তাদের দায়িত্ব পালন করতে? কী ধরনের বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে তাদের? স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আজ কোথায় এসে দাঁড়াল? বর্তমানে সংবাদমাধ্যমের যে পরিস্থিতি সেখানে কার কী ভূমিকা? এসব প্রশ্ন অনুসন্ধানে দৃকনিউজ কথা বলেছে গণমানুষ, বিশ্লেষক, সংবাদকর্মী ও রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। সংবাদমাধ্যমের সংকটকে ঘিরে দৃকনিউজ-এর বিশ্লেষণী প্রতিবেদনের শেষ পর্ব।
অসাধু-স্বার্থসংশ্লিষ্ট সাংবাদিকতা
বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মীর অভিযোগ, নির্বাচনী প্রচারণা থেকে শুরু করে দলীয় এবং ব্যবসায়িক নানা আয়োজনের কাভারেজকে ঘিরে ঊর্ধ্বতন সংবাদকর্মীরা কোটি কোটি অংকের ব্যবসায়িক কাজে লিপ্ত আছেন। প্রতিবেদক সংবাদ সংগ্রহে গেলেই তা টের পান। যেসকল সংবাদকর্মী এসব কাজে যুক্ত হতে চান তারা সহায়ক ভূমিকা রাখেন। আর যারা এভাবে সাংবাদিকতা করতে চান না, তারা নানা উপায়ে নিপীড়নের শিকার হন। একটি প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি চ্যানেলের একজন প্রতিবেদক জানান, “অ্যাসাইনমেন্ট ডেস্ক, বার্তা সম্পাদক থেকে মালিকপক্ষ সকলেই অনিয়ম-অন্যায়ের সাথে জড়িত। এ যেন এক বিশাল সিন্ডিকেট। ফলে কাজের প্রত্যেক স্তরেই প্রভাব পড়ছে প্রতিনিয়ত। যেসকল প্রতিবেদক ঊর্ধ্বতনদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে সহায়ক ভূমিকা রাখছেন, এরা নানা ক্ষেত্রে সুবিধা পান। সংবাদ পরিবেশনের মানদণ্ড রক্ষা না করে, ব্যক্তি বিশেষে ছবি দেখিয়েই অনৈতিক কাজে লিপ্ত তারা। আর এর বাইরে থাকা সংবাদকর্মীদের সাথে বেতনসহ সকল ক্ষেত্রেই অন্যায্য আচরণ ঘটতেই থাকে।”
অধিকাংশ সংবাদকর্মীরই সাংবাদিক সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিয়ে বেশ ক্ষোভ রয়েছে। অন্যদিকে এসব সংগঠনকে ঘিরে সংবাদকর্মীদের একাংশের আগ্রহেরও শেষ নেই। বছর ঘুরতেই সংগঠনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থীদের মাঝে উত্তেজনা দেখা দেয়। সাংবাদিক সংগঠনগুলোর বছরব্যাপী কার্যক্রম থেকে দেখা যায়, বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন, মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন, শিশু-কিশোর সাংস্কৃতিক উৎসব, ক্রীড়ানুষ্ঠান, ‘পিকনিক বা ফ্যামিলি ডে’ ছিল প্রধান আগ্রহের বিষয়। এছাড়াও রয়েছে, ‘ডিআরইউ বেস্ট রিপোর্টিং’ পুরস্কার। করোনা পরিস্থিতিতে, নমুনা সংগ্রহ ও সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণসহ নানা উদ্যোগ নেয় ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটি-ডিআরইউ। এর বাইরে প্রায় ১০ বছর ধরে সাংবাদিক সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সমাবেশের আয়োজন করে থাকে বিভিন্ন সংগঠন। আর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বড় ধরনের কোনো অনিয়ম এবং জোরপূর্বক কর্মী ছাঁটাইয়ের তথ্য চাউর হলে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েই দায় সারে এসব নামধারী সাংবাদিক সংগঠন। এর বাইরে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে নানা অজুহাত। সাংগঠনিক ক্ষমতা নেই বলেও দাবি করেন বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।
তারা বড় বড় ইট ছুড়ছিল, গজারি কাঠও দেখেছি। দুঃখ লাগে মালিকপক্ষের হয়ে এই ঘটনায় আমাদের সহকর্মীরাও জড়িত ছিল। পরে পুলিশ আমাদের রক্ষা করেছে। সেদিন অন্তত ১০ জন সহকর্মী রক্তাক্ত হয়েছেন। এর বিচার তো দূরের কথা, কোনো সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতা আহতদের দেখতেও যান নি। উল্টো আমাদেরকে বলেছে, কে যাইতে বলেছে ওখানে?
জনকণ্ঠ-এর সাবেক সংবাদকর্মী শাহীন রহমান বলেন, “১২ বছর যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি, সেখানে নিয়মিত বেতন আসছে সম্ভবত ৩ বছর। টার্মিনেশনের পর বকেয়ার দাবিতে ২০২১-এর এপ্রিলে একদিন ইউনিয়নের সহযোগিতায় জনকণ্ঠের নিচে অবস্থান করি। বিকেলে প্রায় ২ শতাধিক ক্যাডার ও প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী আমাদের ওপর হামলা চালায়। তারা বড় বড় ইট ছুড়ছিল, গজারি কাঠও দেখেছি। দুঃখ লাগে মালিকপক্ষের হয়ে এই ঘটনায় আমাদের সহকর্মীরাও জড়িত ছিল। পরে পুলিশ আমাদের রক্ষা করেছে। সেদিন অন্তত ১০ জন সহকর্মী রক্তাক্ত হয়েছেন। এর বিচার তো দূরের কথা, কোনো সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতা আহতদের দেখতেও যান নি। উল্টো আমাদেরকে বলেছে, কে যাইতে বলেছে ওখানে?”
জনকণ্ঠের সংবাদকর্মীদের ওপর হামলার দিন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) ও বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব)-এর বেশ কয়েকজন উপস্থিত হয়ে আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন। তবে হামলার শিকার সংবাদকর্মীদের অভিযোগ, সংহতি জানানোর পর এবং হামলার আগেই সাংবাদিক নেতারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
জনকণ্ঠের একাংশ সংবাদকর্মীদের সাথে মালিকপক্ষ ও রাষ্ট্রের এমন অন্যায়ের ঘটনার পর নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ডিআরইউ। তবে শুধু নিন্দা জানিয়েই সাংবাদিক সংগঠন দায় সারতে পারে কিনা, এই প্রশ্নে চাকরি হারানো সংবাদকর্মী রাজন ভট্টাচার্যের উত্তর, “না, আমি তা মনে করি না। কিছু করার সদিচ্ছা থাকতে হবে। বিএফইউজেকে দিয়ে আমরা বিবৃতি দিয়েছিলাম। জাতীয় প্রেস ক্লাব সেইভাবে পাশে দাঁড়ায়নি। জনকণ্ঠ কর্তৃপক্ষ সংগঠনগুলোতে চাপ তৈরি করেছে, যাতে আমাদের পক্ষে না দাঁড়ায়। মালিকপক্ষের আগ্রাসী ভূমিকা ও রাজনৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে আন্দোলনের ডাকে আর কেউ আসে না।”
“আমি যে ভোটটা দিচ্ছি, প্রায়ই সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করি, আপনি কি জানেন এদের দায়িত্ব কী? আসলে বেশিরভাগ সাংবাদিকই জানেন না সাংবাদিক সংগঠনগুলোর আইনে কী বলা আছে। ডিইউজের ২০২০-এর নির্বাচনে জনকণ্ঠের প্রয়াত মালিক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ সারাদিন খবর নিচ্ছিলেন, কারা নির্বাচিত হচ্ছে। যখন শুনলেন আগের দুইজন পরাজিত হয়েছেন, শুনলাম খুব খুশি হয়েছেন। মিষ্টি খেয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছেন,” জানান সংবাদকর্মী শাহীন রহমান।
সাংবাদিক নাজমুল আশরাফ বলেন, “সংবাদ ও সংবাদমাধ্যমের মান, সাংবাদিকদের অধিকার এসব কোনো দেশেই কোনো সরকার করবে না। পৃথিবীর সব সরকারের জন্য সংবাদমাধ্যম বিরোধী পক্ষ। জাতীয় প্রেস ক্লাব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)সহ, ক্র্যাব, ফটো জার্নালিস্ট– এর বাইরে আছে শিক্ষা, অর্থনীতি, আবার ফরেন বিট– এরকম আরও অনেক সংগঠন আছে। এসব সংগঠন সাংবাদিকতার মান উন্নয়ন ও সাংবাদিকের অধিকার রক্ষায় তো কিছুই করে না, মূলত বাটপারদের জায়গা। এখানে মন্দের ভালো ডিআরইউ।”
“যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন তখন তাদের পক্ষে কাজ করে ‘জাতীয় প্রেস ক্লাব’। তাদের মূল কাজ কী আমি জানি না। একটা পত্রিকা যখন বন্ধ হয়ে যায়, সেখানে যদি প্রায় ৩০০ সংবাদকর্মী থাকেন এবং পরিবারে যদি ৪ থেকে ৫ জন সদস্য থাকে তাহলে তো দুর্বিষহ পরিস্থিতি তৈরি হয়। কয়টা টেলিভিশনে নিয়মিত বেতন হয়? কয়টা পত্রিকা বন্ধ হল? কতজন সংবাদকর্মী বেকার হয়েছে এবং তাদের সংসার কিভাবে চলছে? তো আমাদের প্রেস ক্লাবকে কি এমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখি?” সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজার এ বক্তব্যে এসবই শুধু প্রশ্ন থেকে যায়!
সাংবাদিকদের ঐক্যটা প্রথমে ৯১-এ ক্ষমতায় এসে ভেঙেছে বিএনপি। এরপর ক্ষমতার ধারাবাহিকতায় সংগঠনগুলো দু’ভাগ হয়ে যায় বিএনপিপন্থী ও আওয়ামীপন্থী।বিশিষ্ট সাংবাদিকদের মতে, টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার প্রভাব এই বিভেদকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে এখন সবাই ক্ষমতার অংশ, বাকিদের অস্তিত্ব নেই।
এই সংকটময় পরিস্থিতিতে যত সংগঠন আছে সবই আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন উল্লেখ করে সাংবাদিক নাজমুল আশরাফ বলেন, “মালিকদের সংগঠন আছে, সম্পাদক পরিষদ আছে, এত এত সংগঠন এরা যদি সত্যিকার অর্থে চায়, তাহলে ভালো কিছু সম্ভব। তখন সরকার কিছুই করতে পারে না। কিন্তু এদের সবার স্বার্থ আর উদ্দেশ্য তো এক না। এই যে ঢাকঢোল পিটিয়ে সাংবাদিক সংগঠনগুলো নির্বাচন করে, এর ফায়দা একটাই, আমি ওমুক সংগঠনের সভাপতি, সেক্রেটারি– এসব।”
অথচ একমসয় দেশের জ্যেষ্ঠ ও পেশাদার সাংবাদিকদের বুদ্ধিচর্চার কেন্দ্র ছিল ‘জাতীয় প্রেস ক্লাব’। ঠিকানা ১৮ নম্বর, তোপখানা রোডের ‘লাল ইটের দালান’ উল্লেখ করে জাতীয় প্রেস ক্লাবের স্মৃতিচারণ করেছেন সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, নির্মল সেন, এ বি এম মূসাসহ সাংবাদিকতার কিংবদন্তিরা। তাদের লেখা থেকে জানা যায় গণমাধ্যমে সরকারের হস্তক্ষেপ, স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস। রাজনীতির উত্তাল দিনগুলোতেও এই ক্লাব সাংবাদিক ও রাজনীতিকদের আশ্রয়কেন্দ্র ছিল। বাংলাদেশে সাংবাদিকতা ও সংবাদকর্মীদের অধিকার আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে জাতীয় প্রেস ক্লাব।
আশি এবং নব্বইয়ের শুরুর দিকে আমরা যখন সাংবাদিকতা করেছি, তখন কোনো একটি পত্রিকায় যখন অনিয়ম হয়েছে, এর প্রতিবাদে ৩ দিনে ঢাকা শহর অচল হয়ে গেছে। সব পত্রিকায় কর্মবিরতি দিয়ে সাংবাদিকরা রাস্তায় ছিল। মালিকরা তখন নেতাদের পেছনে বাধ্য হয়ে দৌড়েছে। অর্থাৎ ইউনিয়ন শক্তিশালী এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল যে, কোনো সংবাদকর্মীর কোনো ক্ষতি মালিক বা সরকার করলে খবর আছে! এখন কোনো মালিক যদি সকাল-বিকাল লাথি মেরে বের করে দেয়, নির্যাতন করে, কোনো সাংবাদিক সংগঠনের নেতার কিছু যায় আসে না।
সাংবাদিক নাজমুল আশরাফের মতে, “এখন জাতীয় প্রেস ক্লাব আবর্জনায় পরিণত হয়েছে। আর ইউনিয়ন হয়েছে তৃতীয় শ্রেণির লোকজনের ধান্দাবাজির জায়গা।” তিনি বলেন, “আশি এবং নব্বইয়ের শুরুর দিকে আমরা যখন সাংবাদিকতা করেছি, তখন কোনো একটি পত্রিকায় যখন অনিয়ম হয়েছে, এর প্রতিবাদে ৩ দিনে ঢাকা শহর অচল হয়ে গেছে। সব পত্রিকায় কর্মবিরতি দিয়ে সাংবাদিকরা রাস্তায় ছিল। মালিকরা তখন নেতাদের পেছনে বাধ্য হয়ে দৌড়েছে। অর্থাৎ ইউনিয়ন শক্তিশালী এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল যে, কোনো সংবাদকর্মীর কোনো ক্ষতি মালিক বা সরকার করলে খবর আছে! এখন কোনো মালিক যদি সকাল-বিকাল লাথি মেরে বের করে দেয়, নির্যাতন করে, কোনো সাংবাদিক সংগঠনের নেতার কিছু যায় আসে না।”
“আরেকটা বিশাল চ্যালেঞ্জ সাংবাদিকরা নিজেরাই তৈরি করেছেন। বিশেষত সাংবাদিক নেতারা। এদের নিজেদের মোসাহেবি করার খাসলত! সবসময় শুনি এদের নির্বাচন হচ্ছে, পিকনিক হচ্ছে। প্রায়ই বিভিন্ন দূতাবাসের পার্টির ছবি ফেইসবুকে প্রচার করতে থাকেন। এদের মূল লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিদেশ সফর। করোনাকালে দুর্নীতির দায়ে যাদের ধরা হয়েছে, তাদের সাথেও সাংবাদিকদের হাসিমুখে ছবি। যেসব ছবি বড়াই করে তারা নিজেদের ফেইসবুকে দেন। অথচ তাদের দায়িত্ব ছিল এদের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করা। এমবেডেড সাংবাদিক বলে একটা শব্দ চালু হয়েছিল উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়, এরা হচ্ছেন আমাদের এমবেডেড সাংবাদিক।” এমন প্রতিক্রিয়া ড. গীতি আরার।
সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা সংকট ও অধিকারহীনতা
বাস্তবতা এই যে, ক্ষমতাসীনদের সান্নিধ্যের বাইরে থেকে সংবাদমাধ্যমে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। পর্যবেক্ষণ বলছে, সংবাদমাধ্যমগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতামুখী চর্চার ফলে সংবাদ বিশ্লেষণের বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থানের বিসর্জন ঘটেছে অনেক আগেই। সংবাদমাধ্যমগুলোতে সংবাদকর্মীদেরই অধিকার রক্ষা হচ্ছে না।
এরপর সরকারের বিভিন্ন এজেন্সিতে বলা হয়, এরা জামাত-শিবির, আওয়ামী লীগবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী। তখন থেকেই আমাদের ওপর বিভিন্ন জায়গা থেকে হুমকিসহ অত্যাচার-নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসল। আমার পরিবারকেও হত্যার হুমকি দেয়া হল। নিরাপত্তার স্বার্থে নাম বলতে পারছি না। ২৬ দিন ২৬ জায়গায় পলাতক ছিলাম।
জনকণ্ঠ থেকে চাকরি হারানো সংবাদকর্মী রাজন ভট্টাচার্য বলেন, “২০১৮ সালে বকেয়া বেতনের দাবির প্রেক্ষিতে মালিকপক্ষ একদিন হঠাৎ করেই বেতন আর দেয়া সম্ভব না বলে দৃঢ় অবস্থান জানায়। সেসময় অভাবী সাংবাদিকরা খুব কষ্টের জায়গা থেকে কাজ বন্ধ করে জনকণ্ঠের নিচে অবস্থান নেয়। এরপর সরকারের বিভিন্ন এজেন্সিতে বলা হয়, এরা জামাত-শিবির, আওয়ামী লীগবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী। তখন থেকেই আমাদের ওপর বিভিন্ন জায়গা থেকে হুমকিসহ অত্যাচার-নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসল। আমার পরিবারকেও হত্যার হুমকি দেয়া হল। নিরাপত্তার স্বার্থে নাম বলতে পারছি না। ২৬ দিন ২৬ জায়গায় পলাতক ছিলাম।” এসব কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন রাজন ভট্টাচার্য।
সংবাদমাধ্যমের সকল স্তরে দুর্নীতি, অন্যায়-অনিয়ম ছড়িয়ে যাওয়ায় সংবাদকর্মীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। একই সাথে এই প্রভাব নবীন সংবাদকর্মীদেরও বিপর্যস্ত করে তুলছে।
মানসিক পীড়ায় ভুগছি প্রতিনিয়ত। চাটুকারিতা জানি না, কারো পারপার্স সার্ভ (সুবিধা দেয়া) করতে পারি না যারা তাদের আর্থিক উন্নতি ঘটে না। আবার সেখানে ভালো প্রতিবেদক না হয়েও, অনেক কম কাজ করেই বেতন বাড়ে অনেকের। এছাড়া কর্মস্থলে ক্ষমতার আশ্রয়ে থাকা সহকর্মীদের আচরণের মাধ্যমেও প্রতিনিয়ত হেনস্তার শিকার হই। আজেবাজে অ্যাসাইনমেন্ট (সংবাদমূল্যহীন) ছাড়াও নানা উপায়ে হয়রানি চালিয়ে যান ঊর্ধ্বতনরা। এই পরিস্থিতি আত্মবিশ্বাস অনেক কমিয়ে দেয়।
“কী বলব, মাসের শেষে অফিসে আসার ভাড়াটাও তো থাকে না। শুরুতে একটি পত্রিকায় ইন্টার্ন করি, এরপর ২ বছর রেডিওতে কাজ করে এখন আরেকটি টেলিভিশনে আছি ৪ বছর। এখনও লজ্জায় কাউকে বেতন বলতে পারি না! মানসিক পীড়ায় ভুগছি প্রতিনিয়ত। চাটুকারিতা জানি না, কারো পারপার্স সার্ভ (সুবিধা দেয়া) করতে পারি না যারা তাদের আর্থিক উন্নতি ঘটে না। আবার সেখানে ভালো প্রতিবেদক না হয়েও, অনেক কম কাজ করেই বেতন বাড়ে অনেকের। এছাড়া কর্মস্থলে ক্ষমতার আশ্রয়ে থাকা সহকর্মীদের আচরণের মাধ্যমেও প্রতিনিয়ত হেনস্তার শিকার হই। আজেবাজে অ্যাসাইনমেন্ট (সংবাদমূল্যহীন) ছাড়াও নানা উপায়ে হয়রানি চালিয়ে যান ঊর্ধ্বতনরা। এই পরিস্থিতি আত্মবিশ্বাস অনেক কমিয়ে দেয়,” এভাবেই পেশাগত নির্মম বাস্তবতা তুলে ধরেন এই সংবাদকর্মী।
সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন মহল কিংবা উন্মুক্ত স্থানে সভা-সমাবেশসহ নানা ধরনের আয়োজনেই সংবাদ সংগ্রহের কাজে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংবাদকর্মীরা একত্রিত হন। অ্যাসাইনমেন্টের অবসর সময়ে নিজ নিজ কর্মস্থলের হতাশা নিয়ে প্রায়ই আলাপ করেন সংবাদকর্মীরা। একটি সংবাদ সম্মেলন থেকে খবর সংগ্রহের পর একটি প্রতিষ্ঠিত টেলিভিশন চ্যানেলের একজন প্রতিবেদক জানান, সাংবাদিকতায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে এই পেশা বেছে নিয়েছিলেন। পড়াশোনার সময়ে বেশ কয়েকটি জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক হিসেবেও কাজ করেছেন। তিনি বলেন, “সাংবাদিকতায় বেতন কম জানতাম, তবে এত করুণ পরিণতি হবে ভাবিনি। ৬ বছরে দুটি টেলিভিশন বদলেছি। এখনও যে বেতন পাই তা দিয়ে নিজের খরচ চালাতে পারি না। সঞ্চয় তো সম্ভবই হয় না। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ভবিষ্যৎ নিয়ে চাপ আছে। নানা উপায়ে আয়ের উৎস তো খুঁজছি, হচ্ছে না। এ পর্যন্ত কাজের অভিজ্ঞতা তো এখানেই, আমার অনেক সময় চলে যাচ্ছে। যেখানে নিজেই চলতে পারি না সেখানে একটি ভালো প্রতিবেদন তৈরির আগ্রহও আর পাই না।”
তরুণ সাংবাদিকদের হতাশা, আর্থিক অসচ্ছলতা, সংবাদমাধ্যমেই নিপীড়ন-নির্যাতনের অসংখ্য উদাহরণে পরিস্থিতির ভয়াবহতা প্রকাশ হয়। সংবাদমাধ্যম ঘিরে এমন সংকটময় পরিস্থিতিতিতে প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকদের কি কিছুই করার নেই? এই প্রশ্নের প্রতিক্রিয়ায় সংবাদ সাময়িকী ‘সাপ্তাহিক’-এর সাবেক সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা বলেন, “আমি তো একজন ব্যক্তি সাংবাদিক। এই সংকটে ভূমিকা রাখার দায়িত্ব সাংবাদিক সংগঠনগুলোর। তবে সংবাদমাধ্যমের যে রুগ্ণ পরিস্থিতির কথা বলছি এর নেতৃত্বে আছেন সংগঠনের নেতারা। সাংবাদিকতা ছাড়া অন্য অনেক কিছু নিয়েই তারা ব্যস্ত থাকেন। কিভাবে প্লট পাওয়া যায়, বাড়ি-গাড়ি করা যায়। কিভাবে বিদেশ সফর করা যায় এসবই তাদের কর্ম। সংবাদকর্মীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা নেই, কোনো কাজ দেখবেন না।
সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা তার পুরনো কর্মস্থলের সহকর্মীদের নিয়মিত বেতন দিয়েছেন কিনা এই প্রশ্নের জবাবে বলেন, “হ্যাঁ, অনেকের বেতন বন্ধ হয়েছে। আবার আমরা যে খুব ভালো বেতন দিতে পেরেছি তা নয়। কারণ প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছি। তাদের কাছে যে সেভাবে খুব দুঃখ প্রকাশ করেছি সেটা নয়। তবে ভেতরে ভেতরে আমি যন্ত্রণা পেয়েছি, ব্যথিত হয়েছি। এই চিত্রটা সহ্য করা কঠিন, দীর্ঘ সময় মেনে নিয়ে কাজ করা কঠিন ছিল।”
সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে আওয়ামী লীগ যে রাস্তা দেখিয়েছে, ভবিষ্যতে যারা আসবে তারাও সেই চেষ্টাই করবে বলে মনে করেন ‘টিবিএন টোয়েন্টি ফোর’-এর প্রধান সম্পাদক নাজমুল আশরাফ। “রাজনীতি খুব সচেতনভাবেই এটা করেছে যে, এদের মাঝে যত বিভেদ তৈরি করা যাবে, যত দলবাজ তৈরি করা যাবে ততই এই সংবাদমাধ্যম নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। বিএনপি করেছে, আওয়ামী লীগ করছে। এই বাজে রাজনীতির বিপরীতে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে পারলে আজকে সংবাদমাধ্যমে ও সংবাদকর্মীদের এই পরিণতি তো হত না। স্বৈরাচারী এরশাদকে তো কাঁপায় ফেলা হইছিল, একটি পত্রিকা বন্ধ করার প্রতিবাদে ২৬ দিন বাংলাদেশে কোনো পত্রিকা বের হয় নাই। এখন চিন্তা করা যায়?”
“বাংলাদেশে অনেকে সাংবাদিকতার নামে দলবাজি করে বড়লোক হয়েছে। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা দলীয় তোষণের মাধ্যমে ধনী হয়েছে, নবীনরা কী কারণে স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাইবে? আবার যারা সত্যিকার অর্থে সাংবাদিকতা করতে চায়, তারা এই ব্যবস্থায় কিভাবে টিকে থাকবে?” এই প্রশ্ন রাখেন অধ্যাপক ও গবেষক ড. ফাহমিদুল হক।
এমন পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজার মূল্যায়ন: “এসকল সংবাদমাধ্যমে মেধাবীদের জায়গা নেই। তারা অন্যান্য পেশায় চলে যাচ্ছে। অথচ ১৫ বছর আগেও নবীনরা দলে দলে সাংবাদিকতায় এসেছিল। যারা এই সময়ের মাঝে এসেছে, তারা ভুল করেছি ভেবে পেশা পরিবর্তন করছে। যারা অন্য পেশায় যেতে পারছে না তারা হতাশায় আছে। এরকম একটা চিত্র আমার ধারণা আরও দীর্ঘ সময় যাবে। হুট করে এই সংকটের উত্তরণ সম্ভব নয়।”
সংবাদমাধ্যমের এই সংকট সমাজে কী প্রভাব ফেলছে?
গত প্রায় ১ যুগে বাংলাদেশে ৩৬টি (২০০৯-২০১৮) বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল অনুমোদন পেয়েছে, বেশ কয়েকটি সম্প্রচারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সব মিলিয়ে রয়েছে প্রায় ৪৫টি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের হিসেবে সারাদেশে ৩ হাজার ১শ-এর বেশি পত্রিকা নিবন্ধিত রয়েছে। আর অনলাইন নিউজ পোর্টাল রয়েছে শতাধিক। বিশ্লেষকদের মতে, সংবাদমাধ্যমের সংখ্যা বাড়লেও জনগণের সাথে এর বিচ্ছিন্নতা আড়াল করা যায় না।
অধ্যাপক ও গবেষক ড. গীতি আরা নাসরীন বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে সারা দুনিয়ায় পত্রপত্রিকা কমছে। অথচ এখানে আমরা দেখি এর মধ্যেও নতুন সংবাদমাধ্যম আসছে। এর মানে কী? মানুষের কাছে দায়বদ্ধতা নাই। দায়বদ্ধতা আছে যে টাকা দিচ্ছে তার প্রতি! এই যে সংবাদের চেয়ে বিজ্ঞাপন বা সংবাদমাধ্যম বেশি হয়ে যাওয়া, একটা থেকে আরেকটা আলাদা করার উপায় নাই, এটা বড় সংকট। আপনি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দিকে যদি তাকিয়ে দেখেন, আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যমের সংখ্যা আপনার কাছে টোটালি অ্যাবসার্ড (নিরথর্ক) লাগবে।”
রেডিও প্রসঙ্গে এই অধ্যাপক বলেন, “রেডিও সস্তা ও সহজ মাধ্যম। অথচ আপনি দেখেন বাংলাদেশ দুনিয়ার সেই অল্প কয়টা দেশের একটা যেখানে তেমন রেডিও নাই। আছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ বেতার আর অল্প কয়টা এফএম রেডিও। তো কমিউনিটি রেডিওর কথাই যদি ধরেন, সারা দুনিয়ায় তো বটেই, আমাদের পাশে ভারত ও নেপালেও হাজার হাজার আছে। অথচ আমাদের এখানে নাই।”
এখন যে চিত্রটা দেখা যাচ্ছে, এটা রুগ্ণ সংবাদমাধ্যমের চিত্র জানিয়ে সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা বলেন, “সামগ্রিকভাবে সংবাদমাধ্যমগুলোর যে অবক্ষয় এবং গণমানুষের থেকে যে বিচ্ছিন্নতা, এটা একটা বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। গণমাধ্যমকে যদি রুগ্ণ করে দেয়া যায়, যেখানে ৫টা চলার কথা সেখানে ৫০টার অনুমোদন দিলে এরা নিজেরা নিজেরা যুদ্ধ করে সবাই রুগ্ণে পরিণত হবে। পরিস্থিতি এরকম, যে ওপরে বসে আছে সে চায়, আমি তার কথামত চলি। সরকারি বিজ্ঞাপন দিয়ে চলতে পারবেন তবে কথা না শুনলে বিজ্ঞাপন পাবেন না। যারা সরকারি বিজ্ঞাপনে নির্ভর করতে চায় না, তাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ওপরের মহল থেকে নানা প্রক্রিয়ায় আদেশ-নির্দেশ দিয়ে বেসরকারি বিজ্ঞাপনও বন্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ টিকে থাকার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।”
চাকরি হারানো সংবাদকর্মী শাহীন রহমান বলেন, “সত্যি কথা বলতে কি, আমরা তো সরকার সমর্থিত একটি পত্রিকাতেই কাজ করতাম। নানাভাবেই সরকার যেখানে সাহায্য করছে। সেই পত্রিকা ‘জনকণ্ঠ’তেই যদি সংবাদকর্মীরা এত নিপীড়নের শিকার হন, তাহলে অন্য সংবাদমাধ্যমে কী ঘটবে?”
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা গত বছর ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শিরোনামে বাংলাদেশ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর দ্য ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম একটি লেখায় দেশের সংবাদমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা হিসেবে আমরা কী পারি না তা তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, “আমরা যদি আরও ভালো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে মানুষকে জানাতে পারতাম তাদের থেকে কী গোপন করা হয়, তখনই অন্যদের সমালোচনা আমরা করতে পারতাম। কিন্তু আমরা কি ক্ষমতার কাছে জবাবদিহিতা চাই? আমরা কি ক্ষমতায় থাকা মানুষগুলোকে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ করি? আমরা কি নীতিনির্ধারকদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করি? কেন প্রকল্পগুলোর সময় বাড়ানো হয় আর সেগুলোর ব্যয় আসল ব্যয়ের তিন-চার গুণ বৃদ্ধি পায়, সেটার কারণ কি আমরা গভীরভাবে খতিয়ে দেখি? আমরা কি খুঁজেছি কারা বাইরে অর্থ পাচার করে? এমনকি পানামা পেপার যখন কয়েকজন স্থানীয়র সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত দিল, আমরা কি সেটার ধারাবাহিক অনুসন্ধান করেছি? আমরা কি অবৈধ টাকার মালিকদের খোঁজ পেয়েছি, যারা বছরের পর বছর কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তা সাদা করার অনুমতি পায়? আমরা কি জানতে পেরেছি কেন আমরা ঋণখেলাপিদের সময়সীমা বাড়িয়েই চলেছি, আর প্রতিবার সময় বাড়াবার সাথে সাথে সুদের হার আর কিস্তির পরিমাণ নামিয়ে আনছি? টরেন্টোর বেগমপাড়া বা মালয়েশিয়ার বেআইনি সেকেন্ড হোমের মালিকদের নিয়ে আমরা কী করেছি?”
একদিকে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব ক্ষমতার নজরদারি বা পর্যালোচনা, অন্যদিকে ক্ষমতায় টিকে থাকার মাধ্যম হিসেবেও পরিণত হয়েছে সংবাদমাধ্যম। সংবাদমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে আর ধরা যায় না জানিয়ে অধ্যাপক ও গবেষক ড. ফাহমিদুল হক বলেন, “পনের-বিশ বছর আগেও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমকে জাতির বিবেক হিসেবে দেখা যেত, এখন আর সেটা নেই। অতিমাত্রায় দলীয় তোষণের ফলে সংবাদমাধ্যমগুলোর পরিবেশ নষ্ট হয়েছে এবং সংবাদমাধ্যমকে ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রচারের মাধ্যমে পরিণত করা হয়েছে।”
এমন পরিস্থিতিতে সমাজে অনিশ্চয়তা, অন্যায়, নৈরাজ্য, অনাস্থা বেড়েই চলছে বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তার মতে, “কিছু সত্য, কিছু গুজব, আর কিছু ভুল তথ্যের মধ্যে মানুষ জীবনযাপন করছে। ফলে সার্বিক এই পরিস্থিতিতে সাংবাদিক মহল সঙ্গীর ভূমিকা রাখছে। এছাড়াও সরকার যখন কোনো এজেন্ডা পুশ করতে চায় তখন মিডিয়া ব্যবহার করেই সেট করে। আবার কোনো কিছুকে হাওয়া করে দিতে চাইলে তার জন্যও রয়েছে এসব তথাকথিত সংবাদমাধ্যম।”
এই সংকটময় পরিস্থিতি সংবাদমাধ্যমের ফিরে আসার চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি বিকল্প ধারার স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধান করে। প্রতিদিন মূলধারার সংবাদমাধ্যম যা তুলে ধরে না, সেসব সংবাদ তুলে ধরা ও পর্যালোচনা বিকল্প মাধ্যমের কাজ। বাংলাদেশে এখনও এ ধরনের মাধ্যমের খুব নিদর্শন না থাকলেও পাশ্চাত্যে, এবং নিকট প্রতিবেশী ভারতেও বিকল্প মাধ্যমগুলো বেশ শক্তিশালী।
অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন বলেন, “আমি মনে করি সংবাদমাধ্যমে যারা কাজ করেন সবাই তো আর সুবিধাভোগী মানুষ না। তাদেরকেও একই সাথে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। মানসিক দাসত্বের সেই জায়গাটা ভাঙতে না পারলে তো কথা বলে লাভ নেই। ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া কোনো উপায় নাই।”