শুক্রবার ১৫ই চৈত্র ১৪৩০ Friday 29th March 2024

শুক্রবার ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

Friday 29th March 2024

দেশজুড়ে গণমাধ্যম

স্বাধীনতার ৫০ বছর: সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কোথায়?

২০২২-০৪-২৮

সামিয়া রহমান প্রিমা
সিনিয়র রিপোর্টার

প্রথম পর্ব

 

  • সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সংবাদমাধ্যম
  • মালিকানা, বিজ্ঞাপন ও রাজনৈতিক প্রভাবে বদলে যাচ্ছে সংবাদ
  • সংবাদ নয়, প্রাধান্য পাচ্ছে বিজ্ঞাপন
  • জনগণের আস্থা হারিয়েছে সংবাদমাধ্যম
  • শ্রম অধিকারের বালাই নেই, হতাশাগ্রস্ত সাংবাদিকরা

 

স্বাধীনতার ৫০ বছর: সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কোথায়?

 

সামাজিক, রাজনৈতিক নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অর্ধশত বছর পার করেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র। দীর্ঘ এই যাত্রাপথে রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন অংশের ভুল-ত্রুটি বিশ্লেষণ করে ভিন্নমত প্রকাশে পথ পরিসরের দায়িত্ব ছিল সংবাদমাধ্যমের কাঁধে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমগুলো কি পেরেছে তাদের দায়িত্ব পালন করতে? কী ধরনের বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে তাদের? স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আজ কোথায় এসে দাঁড়াল? বর্তমানে সংবাদমাধ্যমের যে পরিস্থিতি, সেখানে কার কী ভূমিকা? এসব প্রশ্ন অনুসন্ধানে দৃকনিউজ কথা বলেছে গণমানুষ, বিশ্লেষক, সংবাদকর্মী ও রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। সংবাদমাধ্যম সংকটকে ঘিরে দৃকনিউজ- এর বিশ্লেষণী প্রতিবেদন

 

স্বাধীন গণমাধ্যম কী

 

গণমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব গণস্বার্থ সংশ্লিষ্ট খবর জনগণের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা। সে সংবাদ তৈরির ক্ষেত্রে ক্ষমতা, প্রশাসন, মালিকপক্ষ ও বিজ্ঞাপনের প্রভাবসহ নানা দিক থেকে বাধা আসলেও তা অতিক্রম করে যতখানি সত্য প্রকাশ করে ততখানি স্বাধীন একটি দেশের গণমাধ্যম। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো বৈশ্বিক গণমাধ্যমের তুলনায় আলাদা কিছু নয়। তবে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের ওপর সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণ, সংবাদ নির্বাচন, সংবাদ পরিবেশনার মান, সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা সংকট ও অধিকারহীনতা ব্যাপকভাবে আলোচিত। 

 

 

বাংলাদেশের গণমাধ্যম কখনোই গণমানুষের কণ্ঠস্বর ছিল না বলে মনে করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন। বাংলাদেশের সংবাদ জগতের অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে এই গণমাধ্যম বিশ্লেষক বলেন, “সংবাদমাধ্যমে প্রান্তিক নারীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম নারী তো দূরের কথা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরই কোনও সংবাদ আসে না তথাকথিত মূলধারায়। গবেষণামতে প্রান্তিক অঞ্চলের (গ্রাম, মফস্বল) খবর থাকে মাত্র ৮ ভাগ। অথচ দেশের ৯০ ভাগ অঞ্চলই প্রান্তিক। এবং শহর বলতেও দেখি শুধু ঢাকা। এভাবেই আমাদের সংবাদমাধ্যম চলছে।”

 

 

গণমানুষের সঙ্গে কথা বলেও মিলেছে একই মত। কারওয়ানবাজারের ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ আলী বলেন, “মিডিয়া তো প্রায়ই আসে, দাম কম না বেশি বক্তব্য তুলে ধরে, তাদের লাভের জন্য, গরিবের জন্য না। কৃষকের খবর তো খুবই কম আসে। এই যে ধান, ডাল, গম যারা চাষ করতেছে তারা কিন্তু লসে (লোকসান) আছে। মনে করেন, এই আমি এবার দুই বিঘা ইরি ধান বুনছি, মাত্র ৬ মণ ধান পাইছি আর সব নষ্ট হইয়া গেছে, এই খবরটা তো কেউ নেয় না। একজন কৃষক যে কত কষ্ট করে ফসল ফলায় কিন্তু তারা তো দাম পাচ্ছে না।”

 

 

দুনিয়ায় সেই অর্থে কোনও স্বাধীন গণমাধ্যম নেই এবং কথিত গণমাধ্যম আসলে বাণিজ্যের জন্যই তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন ড. গীতি আরা। তারপরও আপেক্ষিক অর্থে স্বাধীন গণমাধ্যম ছিল এবং আছে বলেই সারা দুনিয়ায় প্রেস ফ্রিডমের ইনডেক্স তৈরি হয় বলে জানান তিনি।

 

 

দেশের সংবাদমাধ্যমের ৫০ বছর

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে সংবাদমাধ্যমের রয়েছে তাৎপর্যময় অবদান। পুরো পাকিস্তান আমল জুড়ে বাঙালির লড়াই-সংগ্রাম তুলে ধরাসহ জনমত গঠনে সেসময়ের সংবাদমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

 

সংবাদমাধ্যমের দীর্ঘ পথ পরিক্রমার অন্যতম সাক্ষী সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের পরপর স্বাধীন বাংলাদেশেও অনেক প্রতিকূলতা ছিল। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ কীভাবে চলবে এক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছিল। এর অংশ হিসেবে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের একটা ব্যবস্থা করা হয়। সেই ব্যবস্থা হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত ৪টি পত্রিকা ছাড়া বাকি সব বন্ধ করে দেয়া হয়।”

 

রাতের বেলা প্রেস রিলিজ আসত কোন সংবাদ কীভাবে ছাপতে হবে। তবে নানা কৌশল

অবলম্বন করে তা ঠেকানোর চেষ্টা ছিল। পাঠানো বার্তা

ছাপাতে বাধ্য হলে, এর পাশেই এক কলাম সাদা রাখা হত যেটা ছিল প্রতিবাদ!

 

১৯৭৫ সালের পর থেকে পত্রিকাগুলো আবার প্রকাশিত হয়। এরপর সামরিক শাসনকালে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতা দেখা দিলেও জোরালো প্রতিবাদ জারি ছিল। সেসময়কার সংবাদমাধ্যমগুলো সামরিক শাসনের বিপক্ষে জনগণের পক্ষ নিয়ে শক্তি প্রকাশ করেছিল। “রাতের বেলা প্রেস রিলিজ আসত কোন সংবাদ কীভাবে ছাপতে হবে। তবে নানা কৌশল অবলম্বন করে তা ঠেকানোর চেষ্টা ছিল। পাঠানো বার্তা ছাপাতে বাধ্য হলে, এর পাশেই এক কলাম সাদা রাখা হত যেটা ছিল প্রতিবাদ!” অর্থাৎ গণমাধ্যমের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের একটি বড় অংশ গণমানুষের সঙ্গে ছিলেন বলে জানান গোলাম মোর্তোজা।

 

 

আশির দশকের শেষভাগে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের বাইরে স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিবাদে  বিচিন্তা, প্রিয় প্রজন্ম, খবরের কাগজসহ বিশেষ ধারার বেশ কয়েকটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল। সেসময় ‘দুর্নীতিপরায়ণদের উল্লাসনৃত্য’ শিরোনামে লেখা প্রকাশ করে বন্ধ হয়ে যায় খবরের কাগজ। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের ঐতিহাসিক রায়ে পত্রিকাটি ফিরে আসে। জেনারেল এরশাদের পতনের পর সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৬, ১৭, এবং ১৮ ধারা উঠিয়ে নিলে পত্রিকাগুলোর স্বাধীনতা খানিক বিস্তৃত হয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ-এর আমলে কিছুটা সীমাবদ্ধতার মাঝেও সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গা ছিল গণমাধ্যম। তবে ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের চাপের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের পক্ষ নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোকে সে ধরনের ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি।

 

 

সবশেষ ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত এই ১৪ বছরের শাসনামলে পর্যায়ক্রমে গণমাধ্যমের ওপর যেভাবে চাপ বেড়েছে তা এর আগে কখনও দেখা যায়নি বলেই জানান সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা। এই বিশ্লেষকদের মতে, অতীতে সংবাদমাধ্যমের যে বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল, গত কয়েক বছরে সেটা তারা পুরোপুরি খুইয়েছে! ফলে সংবাদমাধ্যম যে সব সময় সত্যি বলে না, এটি এরই মধ্যে জনগণের কাছে প্রতিষ্ঠিত। এমন পরিস্থিতিতে দেশের গণমাধ্যমকে, গণমাধ্যম বলতে নারাজ অধ্যাপক ও গবেষক ড. গীতি আরা নাসরীন। তিনি বরং এদের ‘তথাকথিত সংবাদমাধ্যম’ হিসেবে আখ্যায়িত করতেই পছন্দ করেন।

 

 

গণমাধ্যমের ওপর চাপবৃদ্ধির চিত্র মিলছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা থেকে। দৃক- এর ‘গবেষণা ও পাবলিক ক্যাম্পেইন’ বিভাগের হিসাবমতে, ২০২০ ও ২০২১ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কমপক্ষে ১৬৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ৯৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ২০২০ সালে ২৫০ জনের বেশি সাংবাদিক ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালীদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন, তিনটি অনলাইন পোর্টাল বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি নানা উপায়ে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে সংবাদমাধ্যমের ওপর– এমন তথ্য দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন (বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া শাখা) এর সর্বশেষ প্রতিবেদন।  

 

 

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার মানদণ্ডের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস, আরএসএফ-এর হিসেব বলছে, ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫২তম অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। সংস্থাটির মাপকাঠিতে ‘নিয়ন্ত্রণকারী’ হিসেবে ভারত, চীন, মিয়ানমার, রাশিয়া, সৌদি আরব, উত্তর কোরিয়াসহ বিশ্বের ৩৭ জন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের নাম এসেছে, যেখানে বাংলাদেশও রয়েছে। এই তালিকা প্রকাশের পর থেকে বাংলাদেশে আরএসএফ-এর ওয়েবসাইটটি আর দেখা যাচ্ছে না।

 

 

দীর্ঘদিন সরকারি চাকরি করে গত ৫ বছর ধরে অবসরে রয়েছেন চিত্তরঞ্জন রায়। রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় একটি চায়ের দোকানে নিয়মিত আসেন তিনি। সেখানেই আলাপচারিতায় দেশের সংবাদমাধ্যম নিয়ে আক্ষেপ করেন জনাব চিত্তরঞ্জন। এমন ক্ষোভের কারণ জানতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, “পত্রিকা কী পড়ব? আর রুচি নাই! খুললেই দেখি ঘটনা একটা, আর দেখায় আরেকটা। মিডিয়া সত্য বলবে কীভাবে? যদি সত্য বলতে যায়, সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে যায়, তাইলে তো ওই চ্যানলে, পত্র-পত্রিকাই বন্ধ হয়ে যাবে। মিডিয়াকে সন্ত্রাসী আর উল্টাপাল্টা বইলা দেয় বন্ধ কইরা।”

 

সমাজের কোন অংশটা ২০ বছর আগের মত আছে? আমাদের সকল ক্ষেত্রেই যখন অবক্ষয় নেমে এসেছে, তখন সংবাদমাধ্যম তো রাষ্ট্রের বাইরে নয়! ষাট, সত্তুর, আশি ও নব্বইয়ের দশক একেক সময়ে সংবাদমাধ্যমের একেক ধরনের সংকট ছিল। এখন হয়ত রাস্তাঘাট উন্নত হচ্ছে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে, তথ্য-প্রযুক্তি বাড়ছে। তবে গণমাধ্যম, গণতন্ত্র, আর রাজনীতির বিসর্জনের সময় পার করছি আমরা। সংবাদমাধ্যমের যে হাল, এককভাবে সেই দায় ক্ষমতার রাজনীতির। একটা দল টানা ১৪ বছর ক্ষমতায়, এরা সংবাদমাধ্যমকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে এর ফলেই অবনতির মাত্রাটা বেশি।

 

বাংলাদেশের সংবাদজগৎ সামরিক আমলের চেয়েও বাজে পরিস্থিতিতে আছে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম টিবিএন টোয়েন্টি ফোর-এর প্রধান সম্পাদক নাজমুল আশরাফ বলেন, “সমাজের কোন অংশটা ২০ বছর আগের মত আছে? আমাদের সকল ক্ষেত্রেই যখন অবক্ষয় নেমে এসেছে, তখন সংবাদমাধ্যম তো রাষ্ট্রের বাইরে নয়! ষাট, সত্তুর, আশি ও নব্বইয়ের দশক একেক সময়ে সংবাদমাধ্যমের একেক ধরনের সংকট ছিল। এখন হয়ত রাস্তাঘাট উন্নত হচ্ছে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে, তথ্য-প্রযুক্তি বাড়ছে। তবে গণমাধ্যম, গণতন্ত্র, আর রাজনীতির বিসর্জনের সময় পার করছি আমরা। সংবাদমাধ্যমের যে হাল, এককভাবে সেই দায় ক্ষমতার রাজনীতির। একটা দল টানা ১৪ বছর ক্ষমতায়, এরা সংবাদমাধ্যমকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে এর ফলেই অবনতির মাত্রাটা বেশি।”

 

 

অতীত ও বর্তমানের পার্থক্য নির্দেশ করে সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা বলেন, “সেসময় সংবাদমাধ্যম ঘিরে যে দালালিপনা, সেন্সরশিপ– এসব ছিল সরকারি মিডিয়ায়। অন্য মিডিয়াগুলোর চক্ষুলজ্জা ছিল। এখন সাধারণ মানুষের কাছে সংবাদমাধ্যমের নির্লজ্জতা ও দালালি দৃশ্যমান।”

 

 

২০২১ সালে উদযাপিত হয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী তথা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর। এই ৫০ বছরে নির্বাচিত বা সামরিক, সকল সরকারই ক্ষমতায় থাকাকালীন সংবাদমাধ্যমগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সকল বাহিনী, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তর, সংস্থা, এমনকি টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, বাদ পড়েনি কেউই। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলছেন, দেশে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলো হলো রাষ্ট্র, মালিকপক্ষ, সাংবাদিকদের নানা সংকট ও সমাজের পশ্চাৎপদতা।

 

 

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের ভূমিকা

 

স্বাধীন সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের নানামুখী দায় দেখা যায়। ‘নিপীড়নমূলক’ হিসেবে আখ্যায়িত বিভিন্ন আইন, রাষ্ট্রীয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়সারা কর্মকাণ্ড, প্রশাসনের অসহযোগিতা ও পেশিচর্চা। এছাড়া সরকারি দলের রাজনীতিকদের প্রত্যক্ষ চাপ ও সরকারি বিভিন্ন কার্যালয়ের হস্তক্ষেপের কথাও উঠে আসছে সাংবাদিকদের বয়ানে।

 

 

সম্প্রতি প্রস্তাবিত গণমাধ্যমকর্মী আইন পাস হলে স্বাধীন সাংবাদিকতার বিকাশ ও সংবাদকর্মীদের অধিকার বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন, সংবাদমাধ্যম বিশ্লেষকরা। আইনগত সীমাবদ্ধতার ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পূর্বসূরি ছিল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন ২০০৬। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ২০১৪-কে পশ্চাৎপদ নীতি উল্লেখ করেও সমালোচনা রয়েছে সাংবাদিক মহলে। ভিন্নমত দমনের লক্ষ্যে প্রণীত আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় শাস্তি বাড়িয়ে ২০১৩ সালের সংশোধনীর পর এর প্রয়োগ বাড়তে থাকে। এরপর ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন– ডিএসএ’ চালু করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এই আইনে সংবাদকর্মী, লেখক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট থেকে শুরু করে যে কাউকে যেকোনো সময়ে গ্রেফতার করে হয়রানি চলমান আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি রয়েছে সংবাদমাধ্যমসহ রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন মহলে। সংবাদমাধ্যম ও বিভিন্ন গবেষণার হিসেবে বিভিন্ন জেলা ও প্রান্তিক পর্যায়ের সংবাদকর্মীরা এই আইনে বেশি মামলার শিকার হচ্ছেন।

 

 

বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের অনিয়ম ও দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করে এলাকার ক্ষমতাসীন মহলের রোষানলে পড়েন ঠাকুরগাঁওয়ের সাংবাদিক আল মামুন জীবন। করোনা পরিস্থিতিতে ‘ত্রাণ বিতরণে অব্যবস্থাপনা’ নিয়ে ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেয়ায় তার বিরুদ্ধে ডিএসএ মামলা দেয় বালিয়াডাঙ্গী থানা পুলিশ। পুলিশি হয়রানি ঠেকাতে জীবন আত্মগোপনে ছিলেন ৬ মাস। উচ্চ ও নিম্ন আদালত থেকে স্থায়ী জামিন পেলেও প্রতিমাসে মামলার হাজিরা তো রয়েছেই। তবে এত কষ্টের পরেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে চুপ থাকতে রাজি নন তিনি। জোরগলায় সাংবাদিক জীবন বলেন, “এই মামলায় আমরা যারা শিকার হচ্ছি, হয়রানির কষ্টটা শুধু তারা আর তাদের পরিবারই বুঝেন। ঢাকার বড় বড় সাংবাদিক মহল তো শুধু বাতিলের দাবি জানিয়েই শেষ! এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে যা যথেষ্ট নয়। সারাদেশে এ পর্যন্ত যতজন এই মামলায় নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তাদের সকলের মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। ডিএসএ বাতিল করতে হবে।”

 

 

দৃকনিউজকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজ- এর সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, “জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সরকারি দল ও প্রশাসনের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার কিংবা আর্থিক দুর্নীতির খবর ছাপা হওয়া মাত্রই সংশ্লিষ্ট সংবাদকর্মীর ওপর দলীয় পেশিবাজ কর্মীদের ঝাঁপিয়ে পড়ার অজস্র উদাহরণ রয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার দলীয়করণের কারণে এই সব হামলার শিকার সংবাদকর্মীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন।”

 

 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় দিনের পর দিন জামিন না পেয়ে প্রায় ১ বছর পর কারাগারেই মারা গেছেন লেখক মুশতাক আহমেদ। ডিএসএ মামলায় গ্রেফতারের পর পুলিশি নির্যাতনে শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। প্রায় ২ মাস নিখোঁজ থাকার পর সীমান্তে ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের খোঁজ মেলে। এরপর ডিএসএ ও ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলাসহ একাধিক মামলায় গ্রেফতার হন এই ফটোসাংবাদিক।  

 

 

মামলার ভিত্তি না থাকায় প্রমাণ হয় না অপরাধ। ফলে ‘ডিএসএ’ মামলায় আদালতের শাস্তির নজির নেই। তাই সাংবাদিকদের সেভাবে বছরের পর বছর কারাগারে থাকতে না হলেও টিকিয়ে রাখা হয়েছে হয়রানি। সক্ষমতা না থাকলেও মামলা টানছেন হাজার হাজার মানুষ।

 

 

তবে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)- এর মহাপরিচালক ও সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ দাবি করেন, “কোনো সংবাদমাধ্যম বা সংবাদ লেখার জন্য কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এমন উদাহরণ দিতে পারবেন না। হয়েছে ফেইসবুকে লেখার কারণে, যেটা অসম্পাদিত মাধ্যম। সেজন্য ডিএসএ। এগুলো হয়েছে আঞ্চলিক পত্রিকায় যেখানে সাংবাদিকতার এথিকস মানা হয়নি। সংবাদ ছাপা হয়েছে এবং যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তার কোনও বক্তব্য নেই। এখন এই ভদ্রলোক আইনের প্রতিকার কোথায় পাবেন?”

 

 

নিপীড়নমূলক ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে বিশ্লেষকদের মত, এই যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা গেছে এটাই ক্ষমতাসীনদের সাফল্য। সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা তার বক্তব্যের উদাহরণ দিয়েই বলেন, “এই যে আমি আপনার সাথে কথা বলছি, আমি ভাবছি আপনার প্রশ্নের উত্তরে কোন কথাটা বলব আর বলব না! কিছু বলে ফেলেছি তা ভারসাম্য করার জন্য আরেকটা শব্দ খুঁজি।”

 

 

যেই দেশে ডিএসএ-র মত আইন থাকে সেখানে কোনও সংবাদমাধ্যম স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারবে না বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক  অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক। এমন পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন জরুরি, তা দৃশ্যমান না হওয়ায় হয়রানি থামছে না বলেও মনে করেন তিনি।

 

 

স্বাধীন সাংবাদিকতা ও জনগুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি নিপীড়নমূলক আইন  অফিসিয়াল সিক্রেক্টস অ্যাক্ট ১৯২৩। এই আইনে গত বছরের ১৭ মে প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হন প্রথম আলো পত্রিকার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম। মামলার আগে প্রায় ৬ ঘণ্টা এই সাংবাদিককে আটক রাখা হয়। সম্পাদক নূরুল কবীর দৃকনিউজকে বলেন, “ব্রিটিশ আমলে প্রণীত এই আইনের ফলে দেশপ্রেমিক সরকারি কর্মকর্তাদের পক্ষেও ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক কর্মীদেরকে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। ঔপনিবেশিক আমলে প্রণীত হলেও এই আইনে, আর যাই হোক, দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিক-আমলা ও ব্যবসায়ী চক্র দ্বারা জনসাধারণের অর্থ লোপাটের ইঙ্গিতপূর্ণ দলিল রাষ্ট্রীয় ‘গোপন তথ্য’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের আমলাদের অসাধু অংশ, একশ্রেণির রাজনীতিকদের অনুমোদন ও প্রশ্রয়ে, এখন প্রায় সকল সরকারি ফাইলের ওপরে ‘গোপনীয়’ কিংবা ‘অতি-গোপনীয়’ ছাপ্পর মেরে রাখে। ফলে অনেক দেশপ্রেমিক সরকারি কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে সরকারী দুর্নীতির তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে ভয় পান।

 

 

জাতীয় দৈনিক পত্রিকা জনকণ্ঠ এর সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতা সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সংবাদমাধ্যমের বিকাশে কী ভূমিকা রাখছে, সেই চিত্র তুলে ধরে। ২০১৮ সালে ২৬ মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে সোচ্চার হন জনকণ্ঠ-এর ২০০-এর বেশি সংবাদকর্মী। এই সংবাদকর্মীরা জানান, জনকন্ঠের সংবাদকর্মীদের মাঝে প্রায় ৬০ শতাংশ ৮ম ওয়েজ বোর্ডের বাইরে ছিল। কেউ বেতন চাইলেই, ‘উইদাউট টার্মিনেশান বেনিফিট’সহ কোনো নিয়ম-নীতির বালাই না করেই ছাঁটাই করত মালিকপক্ষ। এই পরিস্থিতিতে পত্রিকাটিতে সংবাদকর্মীদের ‘ইউনিট’ গঠন হয়। এই ইউনিটের ৩ বছরের লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় অবশেষে ২৬ জন সংবাদকর্মী একযোগে চাকরিচ্যুত ও শারীরিক নিপীড়নের শিকার হন।

 

 

তাদেরই একজন এই পত্রিকার সাবেক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রাজন ভট্টাচার্য বলেন, “আমাদের ওপর হামলা চালানোর পর আমাদেরকেই দুষ্কৃতি-সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে ২টি প্রতিবেদন ছাপা হয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রায় ১২ বছর ধরে যে পত্রিকায় সাংবাদিকরা কাজ করেছে তাদেরই বিরুদ্ধে একটি ‘সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি’ জনকণ্ঠ ছাপিয়েছে যেটা সাংবাদিকতার নীতিমালা, ওয়েজ বোর্ড নীতিমালার পরিপন্থী। অথচ প্রেস কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ, ডিএফপি বা তথ্য মন্ত্রণালয় এই পত্রিকার বিরুদ্ধে একটি জবাব চায়নি কিংবা একটি নোটিশ পর্যন্ত করেনি যে কেন আপনারা এই ধরনের নোটিশ সাংবাদিকদের নাম উল্লেখ করে প্রথম পাতায় ছাপিয়েছেন? তাহলে আমরা ধরে নিব যে, রাষ্ট্র এই ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত ছিল? যদি এই স্বেচ্ছাচারিতা হয়, আগামী দিনের সংবাদকর্মীদের জন্যে খুব সুখকর হবে না। আজকে আমাদের ক্ষেত্রে হয়েছে, কালকে যে অন্য কারও হবে না কে নিশ্চয়তা দিবে?”

 

 

গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার থেকে একপর্যায়ে চাকরী হারানো সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলারও উদ্যোগ নেয়া হয় বলে জানান এই সংবাদকর্মী।

 

 

সংবাদমাধ্যমে সেলফ সেন্সরশিপ

 

সংবাদমাধ্যমের সংকটময় পরিস্থিতিতে সেলফ সেন্সরশিপ শব্দটি তীব্র আকার ধারণ করেছে। মোটাদাগে কোনও খবর ক্ষমতাধর মহল বা সরকারের জন্য ইতিবাচক না নেতিবাচক– এটা বুঝে খবরটিকে বিবেচনায় নেয়া অর্থাৎ কোনও ঘটনা বা খবর সংগ্রহ হবে কি হবে না কিংবা কিভাবে ভারসাম্য করে সেই সংবাদ প্রকাশ করা হবে, এমন পরিকল্পনাকেই বলা হয় সেলফ সেন্সরশিপ।

 

 

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের খবর সংগ্রহ ও প্রকাশ এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ। সূত্র জানায়, নির্বাচনের খবর কী উপায়ে সংগ্রহ করা হবে ক্ষমতাসীন মহল থেকে সে ধরনের কোনও নির্দেশনা আসেনি। তবে নির্বাচনকে ঘিরে অনিয়ম দেখানো যাবে না, এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কোনও কোনও সংবাদমাধ্যমের নীতি-নির্ধারকরা। ভোট চুরি, অনিয়ম ও বেশ কয়েকটি এলাকার সহিংসতার খবর হাতেগোনা কয়েকটি সংবাদপত্র ছাড়া গোটা সংবাদজগৎ থেকেই উধাও ছিল। সংবাদমাধ্যম বিশ্লেষকরা বলছেন, এর ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব সরেজমিন চিত্র উঠে এসেছে তাও গুজব বলে উড়িয়ে দিতে সমস্যা হয়নি।

 

 

কয়েকটি টেলিভিশন মিডিয়ার সংবাদকর্মীদের বক্তব্যে এই নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের অভিযোগ, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগের দিন কী দেখানো হবে আর হবে না, তা নির্ধারিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে সরকার দলীয় সমর্থক রিপোর্টারদের অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয় এবং অনিয়ম তুলে না ধরে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখানোর নির্দেশনা থাকে। নেটওয়ার্ক না থাকায় কয়েকটি ভোটকেন্দ্র থেকে লাইভ (সরাসরি সম্প্রচার) বন্ধ হয়ে যায়। ‘অ্যাজ লাইভে’র (সরাসরির মত করে গৃহীত কিন্তু সরাসরি নয়, আংশিক সম্পাদিত) কৌশল নেয়া হয়। অর্থাৎ কয়েকটি চ্যানেলের বেশ কয়েকজন রিপোর্টার নির্বাচনের মাঠ থেকে লাইভের মত বক্তব্য রেকর্ড করে অফিসে ফেরেন। এরপর তা প্রচারের আগে রিপোর্টার কোনও অনিয়মের তথ্য তুলে ধরলে বা ক্যামেরায় কোনও কিছু ধরা পড়লে তা সরিয়ে ফেলার জন্য সম্পাদনায় সরাসরি নির্দেশনা দেন বার্তাকক্ষের উচ্চপদস্থ কর্মীরা। এরপর তা জনগণের উদ্দেশ্যে প্রচার করা হয়।

 

 

সেসময় সারাদেশে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের পরিস্থিতি ও অনিয়ম সকাল থেকে সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে তুলে ধরে যমুনা টেলিভিশন। এরপর নির্বাচনের দিন থেকেই প্রায় ৪৮ ঘণ্টা এই চ্যানেলটি দেখা যায়নি। এই টেলিভিশনের সংবাদকর্মীরা জানান, সম্প্রচার বন্ধ না থাকলেও, ক্যাবল অপারেটরদের মাধ্যমে চ্যানেলটির সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। 

 

 

নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের একজন প্রধান বার্তা সম্পাদক জানান, “এই নির্বাচন যে একচেটিয়া হবে তা নির্বাচনের প্রস্তুতি থেকেই ধারণা করা গেছে। এদিকে লাইভ সম্প্রচারের মত নেটওয়ার্ক ছিল না। তাই নানা ধরনের প্রক্রিয়ায় যেতে হয়।” গোটা কর্মজীবনে কোনও নির্বাচনকে ঘিরেই এমন অভিজ্ঞতা নেই বলেও জানান তিনি।   

 

 

জাতীয় নির্বাচন প্রচারে ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্ট ও অনলাইনসহ সকল মাধ্যম যা দেখিয়েছে, তার সাথে বাস্তব চিত্র মেলাতে পারেনি জনগণ। সেসময়ের পরিস্থিতি স্মরণ করে সাধারণ মানুষ জানান, তারা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখেছেন তাদের ভোটটি নেই। যাদের ভোট চুরি হয়ে গেছে, তাদের প্রত্যেকের কাছেই এই খবরটি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এত এত সংবাদমাধ্যমের কোথাও সে খবরটি তারা খুঁজে পায়নি। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রকৃত চিত্র কেন সংবাদমাধ্যমে উঠে আসেনি- এমন প্রশ্নের জবাবে পিআইবি’র মহাপরিচালক বলেন, “সংবাদমাধ্যমগুলো নিজেদের স্বার্থেই করেছে। মালিকরা মনে করে যে এই সরকার আসলে তাদের সুবিধা হবে তো সে সরকারের পক্ষে যাচ্ছে। যেহেতু ব্যবসায়ীরা মিডিয়া করে বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার জন্য, সাংবাদিকতার বিকাশ ঘটানোর জন্য নয়। এবং এ কারণেই ভালো মানের সাংবাদিক পাওয়া যাচ্ছে না। পত্রিকাগুলোর গুণগত মান বাড়ছে না।”

 

এই যে নির্বাচন ব্যবস্থাটাই ভেঙে দেয়া হল, সংবাদমাধ্যমগুলো কোনো ইতিবাচক ভূমিকা না রেখে উল্টো ভেঙে দেয়ার পদ্ধতি সমর্থন করল, এখন এর জন্য কি দেশের জনগণ দায়ী? না, মোটেই না। এর জন্য প্রভাবশালী সাংবাদিক ও মালিকরা দায়ী। আমার মতে এটা গণবিরোধী ঘটনা।

 

এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকারের ভূমিকা ও সেলফ সেন্সরশিপের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে বলে মত সংবাদমাধ্যম বিশ্লেষকদের। এ সকল সংবাদমাধ্যম গণমুখী তো নয়ই, বরং গণবিরোধী বলেই মত দিয়েছেন অধ্যাপক ও গবেষক ড. ফাহমিদুল হক। তিনি বলেন, “এই যে নির্বাচন ব্যবস্থাটাই ভেঙে দেয়া হল, সংবাদমাধ্যমগুলো কোনো ইতিবাচক ভূমিকা না রেখে উল্টো ভেঙে দেয়ার পদ্ধতি সমর্থন করল, এখন এর জন্য কি দেশের জনগণ দায়ী? না, মোটেই না। এর জন্য প্রভাবশালী সাংবাদিক ও মালিকরা দায়ী। আমার মতে এটা গণবিরোধী ঘটনা।”

 

 

আলোচিত সংবাদ সাময়িকী সাপ্তাহিক-এর সাবেক সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা বলেন, “যখন সেলফ সেন্সরশিপ তৈরি করা যায়, তখন সরকার বুক ফুলিয়ে বলতে পারে আমি তো না করি নাই! এখনকার অবস্থানটা আগের যেকোনও সময়ের চাইতে পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর সুনির্দিষ্ট করে কোনও সংস্থা বা বাহিনীকে বলতে হয় না, কী করবেন আর করবেন না। পরিকল্পিতভাবে পরিবেশটাই এমন যে, বোঝা যায় কোন সংবাদ কিভাবে করলে পুরস্কৃত হবেন, মেনে না চললে তিরস্কৃত হবেন, না গুম হবেন।”

 

 

২০১৮ সালে ‘নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন’ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের যে অভিযোগ, সেই চিত্রও সংবাদমাধ্যমে সঠিকভাবে আসেনি বলে অভিযোগ রয়েছে আন্দোলনকারীদের। এর প্রতিবাদে সংবাদকর্মীদের ওপরে ক্ষোভ প্রকাশ করতেও দেখা যায় শিক্ষার্থীদের।

 

 

অতীতে পত্রিকার একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল কার্টুন। যেখানে ‘রাজনৈতিক কার্টুন’ ছিল অন্যতম। রাজনৈতিক কার্টুন প্রতিবাদের একটি ভাষা। পর্যবেক্ষণ বলছে, তথ্য-প্রযুক্তির এসময়ে পত্রিকা ছাড়াও কার্টুন প্রকাশের অনেক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এছাড়াও পত্রিকাগুলো আগে যে রম্য ম্যাগাজিন করত সেখানেও কার্টুনের আধিপত্য ছিল। জাতীয় দৈনিক নিউ এইজ ছাড়া আর কোথাও তেমন ‘রাজনৈতিক কার্টুন’ দেখা যায় না। কার্টুনিস্টরা বলছেন, পত্রিকাগুলোর অর্থনৈতিক কারণে এসব সংখ্যা কমে এসেছে। আর ‘রাজনৈতিক কার্টুন’ কমে আসার কারণ ‘সেলফ সেন্সরশিপ’।

 

 

নিউ এইজ-এর সিনিয়র কার্টুনিস্ট মেহেদি হক বলেন, “রাজনৈতিক ব্যক্তির ছবি আঁকার ক্ষেত্রে বাধা আছে, যেমন সম্পাদকের মতামতের আগেই একজন কার্টুনিস্ট ভাবছেন, আঁকব কিনা, যেটা ভয়াবহ। আর ‘রাজনৈতিক কার্টুন’ মানেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। নির্বাচন ব্যবস্থা, দুর্নীতি নিয়ে নিয়মিত করছি। সবশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর ক্যারিকেচারও করেছি। তবে সীমাবদ্ধতা থাকায় পরিমাণ তো কমেছে। যারা সরকারের বিভিন্ন মহলের সংবাদমাধ্যমে কাজ করেন, তাদের তো কিছুই করার নেই। এছাড়া পাকিস্তান আমলেও কার্টুনিস্টদের মূল্যায়ন ছিল, যা বেশিরভাগ জায়গাতেই নেই।” 

 

 

একসময়ের জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য্য, প্রধানত দৈনিক প্রথম আলোর জন্য আঁকেন। এই বিষয়ে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ২০১৭ সালে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কার্টুনের জন্মই হয়েছে অসঙ্গতি, ভুল-ভ্রান্তিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে। সরকার, বিরোধী দল বা প্রশাসনকে কতখানি প্রশংসাযোগ্য কাজ করল তার ফিরিস্তি দেওয়ার জন্য না। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, “কেন জানি আমার মনে হয়েছে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল (৯৬-২০০১), তখন অনেক সমালোচনা করেছি ভোরের কাগজে এবং প্রথম আলোর শুরুর দিকে। দেখতাম আওয়ামী লীগের ওরা চট করে খুব রেগে যেত এবং ছাত্রলীগকে আমি ভয়ই পেতাম সে সময়। আর বিএনপিকে নিয়ে আমি এমন কার্টুনও করেছি যেটাতে মনে করেছিলাম, প্রকাশ হওয়ার পরদিনই আমাকে ধরে হয়ত মেরে ফেলবে অথবা কিছু একটা করবে। কিন্তু দেখলাম কিছুই হয়নি। তখন আমি মনে করেছিলাম বিএনপি এসব সমালোচনাগুলোকে পাত্তা দিত না।”