বৃহঃস্পতিবার ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১ Thursday 21st November 2024

বৃহঃস্পতিবার ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

Thursday 21st November 2024

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

মুনিয়া ‘ধর্ষণ ও হত্যা’ মামলা: পিবিআই এর তদন্তের ত্রুটি, বাদীর নারাজি

২০২৩-০১-০২

সামিয়া রহমান প্রিমা
সিনিয়র রিপোর্টার

ভিকটিম মুনিয়া ও অভিযুক্ত আসামি আনভীরের বেশ কিছু ছবি জব্দ করেছিলো পুলিশ/ছবি- দৃকনিউজ

 

 

শিক্ষার্থী মুনিয়া ‘ধর্ষণ ও হত্যা’ মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশান- পিবিআই এর চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে নারাজির আবেদন করেছেন ভিকটিমের বড় বোন বাদী নুসরাত জাহান তানিয়া। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল- ৮ এর বিচারক মাফরোজা পারভীন মুলতবি জানিয়ে বাদীর জবানবন্দি রেকর্ড করার জন্য আগামী ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩ দিন ধার্য করেছেন।

 

বাদীর জবানবন্দী গ্রহণ স্বাভাবিক আইনি প্রক্রিয়া উল্লেখ করে আইনজীবীরা জানান, আগামীতে বাদী ও বিবাদী দুই পক্ষের শুনানির ধারাবাহিকতায় নারাজি মঞ্জুর বা নামঞ্জুর করার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের আদেশ জানা যাবে।

 

‘ধর্ষণ ও হত্যা’র অভিযোগের মামলায় গত ১৯ অক্টোবর আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে পিবিআই। চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা গোলাম মুক্তার আশরাফ উদ্দিন উল্লেখ করেন আনভীরসহ অন্যান্য আসামিদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। একইসাথে অভিযুক্ত সকল আসামির অব্যাহতির আবেদন করেন তিনি।   

 

এর ধারাবাহিকতায় পুলিশি আবেদন ও তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতের নির্ধারিত সময়ে রবিবার, পহেলা জানুয়ারি ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল- ৮ এ এই নারাজি দাখিল করেন বাদীপক্ষ। এরপর আংশিক শুনানি শেষে পরবর্তী দিন নির্ধারণ করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল।

 

এই মামলার নারাজি আবেদনের একটি কপি দৃকনিউজ সংগ্রহ করেছে। ভিকটিমের বড় বোনের আবেদনে উল্লেখ করা অভিযোগের কিছু অংশ তুলে ধরা হয়েছে।

 

নারাজি আবেদনের কিছু অংশ:

 

১। ভিকটিম মুনিয়া বাদীর আপন ছোট বোন। মা-বাবা হারা মুনিয়া বড় বোনের আদর-যত্নে বেড়ে ওঠেছেন। ঘটনাচক্রে ভিকটিম ১নং বিবাদীর সায়েম সোবহান আনভীরের চোখে পড়লে তার রুপে মোহিত হয়ে কোটি কোটি টাকা ও বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সম্পর্ক স্থাপন করে।

 

২। একপর্যায়ে ভিকটিম মুনিয়া অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে অভিযুক্ত আসামী আনভীরকে বিয়ের চাপ দেয়। এতে উভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও চরম বিরোধের সৃষ্টি হয়। এই বিষয়টি অপর আসামিদের মধ্যে প্রকাশ পেলে তারা পারিবারিক সুনাম, সুখ্যাতি রক্ষায় মুনিয়াকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

 

একসময় ১নং অভিযুক্ত আসামি ভিকটিমকে বলেন, “তুমি কুমিল্লা চলে যাও। মা (আফরোজা বেগম- ২নং বিবাদী) তোমাকে মেরে ফেলবে।” এসময় ভিকটিম লাইভে এসে সব ঘটনা ফাঁস করে দেবেন বলে ১নং বিবাদী আনভীরকে হুমকি দেন। পাল্টা জবাবে, অভিযুক্ত আসামী ভিকটিমকে বলেন, “এতো সময় আর তুই পাবি না।”

 

৩। ভিকটিম বিপদ আঁচ করতে পেরে ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে চায় এবং ঘটনার দিন ভোরে ফ্ল্যাট মালিকের কাছে গাড়ি চান। ফ্ল্যাট মালিক শারমিন আহমেদ রাখি (৫নং বিবাদী) এবং ইব্রাহিম আহম্মদ রিপন (৮নং বিবাদী) গাড়ি না দিয়ে উল্টো বিষয়টি বসুন্ধরা গ্রুপ মালিক অভিযুক্ত আসামিদের জানিয়ে দেন।

 

এরপর অভিযুক্ত সকলেই পরস্পরের যোগসাজসে কিলিং মিশনের সাহায্যে ‘ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড’ সংঘটিত করে সুকৌশলে ‘আত্মহত্যা’ বলে চালিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ভিকটিমের লাশ ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে রাখেন।

 

৪। ঘটনার দিন ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল সকাল ৯টায় ভিকটিম তার বড় বোন ও মামলার বাদীকে ফোন দিয়ে বলেন, “আনভীর আমাকে ধোঁকা দিয়েছে। সে বিয়ে করবে না, ভোগ করেছে।” বিপদের আশঙ্কা করে আরও বলেন, “তুমি তাড়াতাড়ি ঢাকায় আসো।” ইফতারের জন্য বড় বোনকে আসার সময় কলা নিয়ে আসতে বলেন ভিকটিম। অভিযোগে এই বিষয়টি উল্লেখ আছে যা মৃত্যুকালীন জবানবন্দী হিসেবে গণ্য বটে।

 

৫। তদন্তকারী কর্মকর্তা নির্ধারিত তদন্তসীমা অতিক্রম করে আসামিপক্ষে বাধ্য হয়ে সত্যের বিপরীতে মিথ্যা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। এতে বাদী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। 

 

পিবিআই এর তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ভিকটিম পক্ষের নারাজি প্রতিবেদনের কিছু অংশ/ছবি- দৃকনিউজ

 

 

নারাজি দাখিলের কারণ:

 

১। যেহেতু পিবিআই এর তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন ভিকটিম মুনিয়া অভিযুক্ত আসামি সায়েম সোবহান আনভীরের আর্থিক সহযোগিতায় ঢাকায় বাসা ভাড়া নিয়েছেন এবং তিনি সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। একইসাথে তাদের শারীরিক সম্পর্ক ছিল এবং ভিকটিমের গর্ভের সন্তানের জৈবিক পিতা আনভীর তদন্তে তা প্রমাণিত।

 

২। ভিকটিমের পোশাক ও বেডশীটসহ বিভিন্ন আলামতে আনভীরের ডিএনএ পাওয়া যায় যা পিবিআই এর তদন্তে প্রমাণিত।

 

৩। ভিকটিমের পরনের পোশাক কাটাছেঁড়া ছিলো এবং রক্তের উপস্থিতি ছিলো। 

 

৪। যেহেতু তদন্ত কর্মকর্তা, ঘটনার দিন ও সময়ের আলামত, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, ডিএনএ প্রতিবেদন, ঝুলন্ত মরদেহের ছবি ও পারিপার্শ্বিক স্বাক্ষ্যের ওপর কোনো যৌক্তিক মন্তব্য করেন নাই।

 

পিআরবি (পুলিশ আইন) প্রবিধান ৪৪৪ অনুযায়ী মামলার ব্রিফ নামক একটি কাগজ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল- ৮ এসে পৌঁছেছে। এতে মামলার এজাহারের সারাংশ, ঘটনার দিনের জব্দ আলামতের বিবরণ, তদন্ত প্রতিবেদনের ফল এবং এই তদন্তের ত্রুটি-বিচ্যুতিও তুলে ধরা হয়েছে। পিআরবি অনুযায়ী এই তদন্তের কিছু ত্রুটি তুলে ধরা হলো।

 

 

পিআরবি (পুলিশ আইন) প্রবিধান ৪৪৪ অনুযায়ী মামলার ব্রিফ/ছবি- দৃকনিউজ

 

পুলিশ আইন মোতাবেক পিআইবি’র তদন্তের ত্রুটি:  

 

১। প্রথম খসড়া মানচিত্রে ঘটনাস্থল বনানী এবং দ্বিতীয় খসড়া মানচিত্রে ঘটনাস্থল গুলশানের ফ্ল্যাটটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ নেই এবং ঘটনাস্থলের চৌহদ্দি দেয়া হয় নাই। ঘটনাস্থলের আশেপাশের স্থাপনার উল্লেখ নাই।

 

২। তদন্তে, সাক্ষ্যে ও ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় ১নং এজাহারনামীয় আসামী সায়েম সোবহান আনভীরের সহিত ভিকটিম মোসারাত জাহান মুনিয়ার শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টি সন্দেহতীতভাবে প্রমাণিত হলেও কেন ডিএনএ ক্রসমেচিং (তুলনামূলক ডিএনএ পরীক্ষা) বা ডকুমেন্টারি এভিডেন্স (দালিলিক প্রমাণ) সংগ্রহ করা হয়নি, বিষয়টি বোধগম্য নয়।

 

৩। ভিকটিম মুনিয়া ঘটনার দিন বড় বোনকে ফোন করে বিপদের কথা জানান। “তুমি তাড়াতাড়ি আসো, আমার বড় ধরনের দুর্ঘটনা হয়ে যেতে পারে”- এই বিষয়টি আমলে নেয়া যেত কিন্তু বিষয়টির ব্যাখ্যা তদন্তে প্রকাশিত হয়নি।

 

রাজধানীর গুলশানে ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল মুনিয়ার রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় গুলশান থানার ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনা’র মামলায় আদালত থেকে অভিযুক্ত আসামি বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের অব্যাহতির পর, ২০২১ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর বসুন্ধরা গ্রুপের এই পরিবারসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে ‘ধর্ষণ ও হত্যা’ মামলা করেন ভিকটিম পরিবার।

 

এই মামলায় অভিযুক্ত ৮ জন আসামিদের মধ্যে মুনিয়ার প্রেমিক আনভীরসহ আরও রয়েছেন ওনার স্ত্রী সাবরিনা সোবহান, আনভীরের মা, বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আফরোজা বেগম এবং বাবা, চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান শাহ আলম, ঘটনাস্থল ফ্ল্যাটটির মালিক দম্পতি ইব্রাহিম আহম্মদ রিপন, শারমিন আহমেদ রাখি, অন্যান্য অভিযুক্ত সাইফা রহমান মিম এবং মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা। 

 

এদিকে শিক্ষার্থী মোসারাত জাহান মুনিয়া ‘ধর্ষণ ও হত্যা’ মামলার ন্যায়বিচারের দাবিতে রাজধানীতে ‘জাস্টিস ফ্যর মুনিয়া’র ঝটিকা প্রতিবাদ লক্ষ্য করা গেছে। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, বিত্তশালী আসামিপক্ষের ক্ষমতা ও টাকার প্রভাবে গুরুত্বপূর্ণ আলামত ও প্রশ্ন এড়িয়ে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মূল দাবি, সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্ত অন্যতম আসামি মুনিয়ার প্রেমিক, বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরকে গ্রেফতার করতে হবে। 

Your Comment