বৃহঃস্পতিবার ৫ই বৈশাখ ১৪৩১ Thursday 18th April 2024

বৃহঃস্পতিবার ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

Thursday 18th April 2024

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

মিনিকেট নিয়ে আলোড়ন: ক্রেতাদের স্বার্থ রক্ষিত হোক 

২০২২-১০-০৬

আবু রায়হান খান

মিনিকেট চাল নিয়ে সাম্প্রতিক আলোড়নের শুরুটা যেভাবে হয়েছে- 

এবছরের ৪ মে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কাটাসুর এলাকার রিটেইল চেইনশপ ‘স্বপ্ন’ থেকে পাঁচ কেজি ওজনের ‘এসিআই পিওর প্রিমিয়াম মিনিকেট’ নামে মোড়কজাত চাল ক্রয় করেন স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দ সাইফুল আলম। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, পণ্য বা দ্রব্যের মোড়কে পণ্যের জাত বা উৎপাদন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকার কথা। কিন্তু এসিআই কোম্পানির সেই মিনিকেট চালের মোড়কে এ সম্পর্কিত কোন তথ্য উল্লেখ করা ছিল না। এটা বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ক্রেতার সাথে প্রতারণার সামিল। বহু বড় বড় কোম্পানিই এভাবে নিজেদের দামি ব্রান্ডের সুযোগে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আড়াল করে ক্রেতাদের প্রতারিত করেন। মিনিকেট নিয়ে বহুদিন ধরেই আলোচনা ও সমালোচনা হতে থাকলেও সাম্প্রতিক আলোড়নের শুরুটা সেখানে।  

  

অধিকাংশ মানুষই মিনিকেটের প্রতারণার ঘটনাটা জানলেও কেউই ব্যবস্থা নেন না। কিন্তু সৈয়দ সাইফুল আলম ব্যবস্থা নিলেন। ঘটনার তিনদিন পর ৭ই মে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে রিটেইল চেইনশপ স্বপ্নের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ দায়ের করেন তিনি। উল্লেখ্য, সৈয়দ সাইফুল আলম দৃকনিউজে প্রধান গবেষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।  

 

 

  

সৈয়দ সাইফুল আলমের দেয়া অভিযোগ

 

 

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশে বা বিশ্বের কোথাও মিনিকেট নামে কোন ধান চাষ না হলেও বাজারে দেদারসে মিনিকেট নামে চাল বিক্রি করে আসছে বিভিন্ন কোম্পানি। অথচ পণ্য সামগ্রী মোড়কজাতকরণ বিধিমালার দুই নং পরিচ্ছেদ অনুযায়ী মোড়কজাত পণ্য বিক্রয় করতে চাইলে মোড়কে পণ্যের জাতের নাম উল্লেখ থাকতে হবে।  

 

 বাংলাদেশে বা বিশ্বের কোথাও মিনিকেট নামে কোন ধান চাষ না হলেও বাজারে দেদারসে মিনিকেট নামে চাল বিক্রি করে আসছে বিভিন্ন কোম্পানি। অথচ পণ্য সামগ্রী মোড়কজাতকরণ বিধিমালার দুই নং পরিচ্ছেদ অনুযায়ী মোড়কজাত পণ্য বিক্রয় করতে চাইলে মোড়কে পণ্যের জাতের নাম উল্লেখ থাকতে হবে

 

এই আইনটি করা হয়েছে যেন ক্রেতা জানতে পারেন ঠিক কোন উৎস থেকে আসা পণ্য তিনি কিনছেন, এতে তার ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা আছে কি না, কিংবা তিনি এটা চান কি না। এমনকি বহুক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষে নির্দিষ্ট পণ্য খাওয়া কিংবা পরিধান করা ক্ষতিকর হতে পারে, বা সংস্কৃতিতে নিষিদ্ধ থাকতে পারে। এছাড়া কম দামী পণ্যকে দামী মোড়কের আড়ালে বেশি দামে বিক্রি করার সমস্যাও থাকতে পারে। ভোক্তাদের এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ঠেকাতেই এই আইনটি করা হয়েছে। মিনিকেট নামে কোন ধানের জাত না থাকালেও এই নামে চাল বিক্রি করে কয়েকভাবে ক্রেতাদের প্রতারিত করছে কোম্পানিগুলো।  

   

সৈয়দ সাইফুল আলমের অভিযোগের প্রেক্ষিতে, বিগত ২৫ আগস্ট, বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। পরে ২০ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বারের মতো শুনানি হয়। পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য না হলেও এতে দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো নড়েচড়ে উঠতে বাধ্য হয়।  

 

 

রিটেইল চেইনশপ স্বপ্ন থেকে মিনিকেট চাল কেনার রশিদ

 

 

জানতে চাইলে সৈয়দ সাইফুল আলম জানান, এই উৎপাদক ও বিক্রেতারা মানুষের সাথে প্রতারণা করছে এবং মানুষকে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে ফেলছে। একই সাথে চালের আকার পরিবর্তনের কারণে চালের পুষ্টিগুণও নষ্ট হচ্ছে। চিকিৎসকরা সাবধান করেছেন, মিনিকেট চালের ফাইবার অংশটুকু ফেলে দেয়ার কারণে ডায়াবেটিসের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। সব চাইতে বড় কথা, এভাবে কম দামি মোটা চালকে কেটে বাড়তি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ৩৭ নং ধারা অনুযায়ী পণ্যের উৎস ক্রেতাকে জানাবার কথা, সেটা গোপন করা হচ্ছে। এটা পরিস্কার প্রতারণা।  

 

 এই উৎপাদক ও বিক্রেতারা মানুষের সাথে প্রতারণা করছে এবং মানুষকে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে ফেলছে। একই সাথে চালের আকার পরিবর্তনের কারণে চালের পুষ্টিগুণও নষ্ট হচ্ছে। চিকিৎসকরা সাবধান করেছেন, মিনিকেট চালের ফাইবার অংশটুকু ফেলে দেয়ার কারণে ডায়াবেটিসের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। সব চাইতে বড় কথা, এভাবে কম দামি মোটা চালকে কেটে বাড়তি দামে বিক্রি করা হচ্ছে

 

বিশেষ করে জনস্বাস্থ্যের কথা ভেবেই তিনি এই অভিযোগটি দায়ের করেছেন বলে জানান সৈয়দ সাইফুল আলম। তিনি বলেন, এই গুরুতর প্রতারণামূলক কাজের ফলে শুধু যে ক্রেতাদের বাড়তি ব্যয় হয় তাই না, এতে করে বিভিন্ন রোগ বালাই থেকে এমনকী ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে বলেও বিভিন্ন সময়ে গবেষকরা জানিয়েছেন। মিনিকেট নিয়ে বহু আগেই উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিল বলেও মনে করেন তিনি।  

 

সাইফুল আলমের অভিযোগের পর ভোক্তা অধিকারের তৎপরতা 

এসিআই ও স্বপ্নের বিরুদ্ধে সৈয়দ সাইফুল আলমের অভিযোগের পর মামলার চূড়ান্ত রায় না দিলেও বেশ কিছু তৎপরতা দেখিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সম্প্রতি গণমাধ্যমে দেয়া বিভিন্ন বক্তব্যে মিনিকেট চাল বিক্রি নিষিদ্ধ করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মিনিকেট বিক্রি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। এছাড়া বিক্রি ঠেকাতে আইন করা হবেও জানিয়েছেন তিনি।  

 

 

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের দেয়া শুনানির নোটিশ

 

 

কিন্তু মিনিকেট চাল ঠেকাবার নামে যেন চালের দাম বৃদ্ধিসহ নতুন কোন ব্যবসার ফাঁদে ক্রেতাদের না ফেলা হয়, সেটা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সৈয়দ সাইফুল আলম। তার আশঙ্কা রাতারাতি নিষিদ্ধ করার খবর প্রচার করতে থাকলে মিল মালিকরা এবং সুপারমার্কটেগুলো চালের দাম বৃদ্ধির একটা অজুহাত পাবেন। মুদ্রাস্ফীতির বাজারে তা ক্রেতাদের আরও একধাপ পকেট কাটার সুযোগ তৈরি করতে পারে। বরং একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এটা বন্ধ করা হলে অপচয়ের সম্ভাবনা থাকবে না বা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে দাম বৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে একে ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু মিনিকেট নামের একইসাথে অপচয় ও প্রতারণামূলক এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এই চালের ব্যবসা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। 

 

মিনিকেট চাল ঠেকাবার নামে যেন চালের দাম বৃদ্ধিসহ নতুন কোন ব্যবসার ফাঁদে ক্রেতাদের না ফেলা হয়, সেটা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সৈয়দ সাইফুল আলম। তার আশঙ্কা রাতারাতি নিষিদ্ধ করার খবর প্রচার করতে থাকলে মিল মালিকরা এবং সুপারমার্কটেগুলো চালের দাম বৃদ্ধির একটা অজুহাত পাবেন। মুদ্রাস্ফীতির বাজারে তা ক্রেতাদের আরও একধাপ পকেট কাটার সুযোগ তৈরি করতে পারে। বরং একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এটা বন্ধ করা হলে অপচয়ের সম্ভাবনা থাকবে না বা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে দাম বৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে একে ব্যবহার করা যাবে না

 

মিনিকেট মানেই  প্রতারণা, অভিমত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের 

মিনিকেট নামে ধানের কোন জাত নেই বলে দৃকনিউজকে নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের ফলিত গবেষণা বিভাগের প্রধান গবেষক ড. মো. হুমায়ূন কবীর। ভারতে ছোট প্যাকেটে মিনিকেট নামে ছোট বীজের প্যাকেট বিতরণ করা হতো। সেখান থেকেই এই মিনিকেট নামের ব্র্যান্ডের ধারণা এসেছে বলে জানান তিনি। আমাদের দেশের ব্রি ধান-২৮ সহ কয়েকপদের ধানকে পলিশ করে চিকন করে ছেঁটে মিনিকেট ব্র্যান্ড তৈরি করেন বাংলাদেশের কারখানা মালিকরা; যা একধরনের প্রতারণা। বাজারে বেশি দাম পাওয়ার জন্য তারা এ কাজটি করেন বলে যোগ করেন তিনি। 

 

মিনিকেট চাল ভোক্তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায় 

মিনিকেট চাল খাওয়ার কারণে ভোক্তারা ভাতের স্বাভাবিক পুষ্টিগুণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ বিষয়ে ধান গবেষক ড. হুমায়ূন কবীর জানান, চালের উপরিভাগের লেয়ারে জিংক, আয়রনসহ অনেক ধরনের পুষ্টি থাকে। চালটাকে যখন তারা পলিশ করে তখন উপরের লেয়ারগুলো ছাটাই করে তারা। ফলে শুধুমাত্র কার্বোহাইড্রেট ছাড়া আর কিছুই থাকে না। এভাবে চালের চালের সুষম পুষ্টি উপাদান থেকে বঞ্চিত হন ভোক্তারা। 

 

মিনিকেট চাল খাওয়ার কারণে ভোক্তারা ভাতের স্বাভাবিক পুষ্টিগুণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ বিষয়ে ধান গবেষক ড. হুমায়ূন কবীর জানান, চালের উপরিভাগের লেয়ারে জিংক, আয়রনসহ অনেক ধরনের পুষ্টি থাকে। চালটাকে যখন তারা পলিশ করে তখন উপরের লেয়ারগুলো ছাটাই করে তারা। ফলে শুধুমাত্র কার্বোহাইড্রেট ছাড়া আর কিছুই থাকে না। এভাবে চালের চালের সুষম পুষ্টি উপাদান থেকে বঞ্চিত হন ভোক্তারা

 

ড. হুমায়ূন কবীর জানান, পুষ্টি কম হলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকবে। চালটা ছাটাই না করলে যেহেতু সকল পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্য থাকে তাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। ফলে রোগ বালাইয়ের ঝুঁকি কমে যায়। এছাড়া মিনিকেট চাল বাজারজাত করার কারণে ক্ষতির পাশাপাশি ছাঁটাই করার কারণে কখনো কখনো মোট উৎপাদনে প্রায় ২০-৩০ শতাংশ কমে যায়। এতে চালের সার্বিক উৎপাদনের পরিমাণও কমে যায় বলেও যোগ করেন তিনি। 

 

 

মিনিকেট চালের মোড়ক

 

 

চালের মোড়কে তার পুষ্টিগুণ ও বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ থাকার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে দৃকনিউজকে ড. হুমায়ূন কবীর বলেন, চালের জাতের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য থাকে। চালের মোড়কে যদি চালের বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ থাকে তাহলে ভোক্তা তার প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী চাল ক্রয় করতে পারবে। এতে তার প্রতারিত হওয়ার সুযোগ থাকবে না। কিন্তু চালের প্যাকেটে যদি এর পুষ্টিগুণ ও উপাদান না লেখা থাকে তাহলে ভোক্তা বিভ্রান্ত হতে পারে যা প্রতারণার সামিল।

Your Comment