কোনো অপরাধ করেননি, কিন্তু হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছেন অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। গলায় তাঁর জুতার মালা, যেন বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজের মূর্ত চিত্র।
উত্তেজিত ছাত্র-জনতা কলেজ অধ্যক্ষের গলায় পরিয়ে দিচ্ছে জুতার মালা, আর সেই শিক্ষক হাত উঁচিয়ে সবার কাছে ক্ষমা চাইছেন। তাকে যখন এভাবে অপমান করা হচ্ছিল, তখন তার ইচ্ছে হয়েছে আত্মহত্যা করতে। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের কী হবে, এই ভেবে, এই অপমান সয়েছেন। দেশে তখন পদ্মা সেতু উদ্বোধন-উৎসবের সাজ-সাজ রব,উদ্বোধনের আগ দিয়ে এই ঘটনা ঘটে নড়াইলে।
সেই উৎসবময়তার ভেতরেই নিহত হয়ে গেছে এই দেশ, দেশের মানুষ, ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর থাকা অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের আজীবনের বিশ্বাস। আর সেতু উদ্বোধনের দিন ছাত্রের প্রহারে গুরুতর আহত হন আশুলিয়ার শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার। পরদিন হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিহতই হলেন।
এই দুই শিক্ষকের অপরাধ কী? আমরা জানছি তারা কেবল তাদের দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু এদেশে এখন দায়িত্ব পালনই বিরাট বৈপ্লবিক কাজ। তাতেই সমস্যা হয়ে যায় অনেকের। তাতেই আক্রমণের শিকার হন দায়িত্বপালনকারী। হয় তাকে অপমান করা হয়, নয়তো আহত-নিহত করা হয়। শিক্ষক এখন ক্লাসে গিয়ে স্বাভাবিক আলাপ-বিশ্লেষণ করতে শঙ্কা বোধ করেন। কে কোন ফাঁকে আলাপ রেকর্ড করে অনলাইনে ছেড়ে দেয়! কার কোন অনুভূতিতে আঘাত লাগার কারণে অধ্যক্ষ বা উপচার্যের কাছে চিঠি দিয়ে দেয়! হাজারটা পদ্মা সেতু নির্মাণ করে কী লাভ, যদি মানুষে-মানুষে সম্পর্কের যে সেতু, তা ক্রমাগত ভেঙ্গে পড়তে থাকে?
যারা দৃশ্যমান সব উন্নয়ন প্রকল্প বানাতে মগ্ন, তারা কি খেয়াল করেন যে সমাজের সব মানবীয় স্থাপনা ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক এক আস্থা-শ্রদ্ধা-ভালবাসার সম্পর্ক। তা যে কীরকম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে তার খবর তাদের কাছে আছে বটে! কারণ তাদের প্রশাসন-পুলিশ-রাজনীতিবিদদের উপস্থিতিতেই এসব ঘটনা ঘটে।
মহানবীর বিরুদ্ধে ভারতীয় রাজনীতিবিদ নূপুর শর্মার বিদ্বেষপ্রসূত সাম্প্রতিক এক মন্তব্যকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরী হয় ভারতে, যার ঢেউ বাংলাদেশেও লাগে। নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক ছাত্র নূপুর শর্মার সমর্থনে ফেসবুকে পোস্ট দেয়। তাতে ওই কলেজের কিছু শিক্ষার্থী উত্তেজিত হয়ে অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের কাছে ছাত্র রাহুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানায়। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন পরিস্থিতি বুঝে অভিযুক্ত ছাত্রকে পুলিশের হাতে তুলে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু রটে যায় যে তিনি ছাত্রের পক্ষে কাজ করছেন।
কলেজের আশপাশের স্থানীয় অধিবাসীরা জড়ো হয় এবং পুলিশের সাথে কিছু সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে থাকে, এবং সিদ্ধান্ত হয় অধ্যক্ষ ও ছাত্র উভয়কেই জুতার মালা পরানো হবে এবং তারা হাতজোড় করে ক্ষমা চাইবেন। ১৮ জুন পুলিশের উপস্থিতিতে ছাত্র ও শিক্ষক উভয়ে এভাবেই অপমানিত হন। ছাত্র এখন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মামলায় কারাগারে আর অধ্যক্ষ নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রকাশ্যে আসতে পারছেন না, এ-বাড়ি ও-বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে রক্ষা করছেন। এও জানা যাচ্ছে তার পদচ্যুত করে আরেকজন শিক্ষককে দায়িত্ব দেবার প্রস্তুতি চলছে।
কিন্তু আঘাতকারী ছাত্র জিতুকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিয়েছিল। পদ্মা সেতুর ডামাডোল শেষ হলে, মানুষ এই ঘটনার প্রতিবাদ জানানো শুরু করলে, তাকে গ্রেফতার করা হয়, ঘটনার চারদিন পরে।
অধ্যক্ষ স্বপন কুমারের আচরণটি শিক্ষক বা নাগরিকসুলভই ছিল। তিনি ছাত্রকে জনতার হাতে ছেড়ে না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। আমিও তাই করতাম। যদি সে কোনো অপরাধ করে থাকে প্রচলিত আইনে বিচার হবার কথা। কিন্তু তিনি ছাত্রর পক্ষ নিয়েছেন, এই রটনার কারণে তাকে এমন অপমানিত হতে হলো।
প্রভাষক উৎপল কুমার স্কুল ও কলেজের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি ছিলেন, দায়িত্বের অংশ হিসেবেই উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রদের তার শাসন করতে হতো, তাদের অন্যায়-অপকর্মের জন্য বিচারের মুখোমুখি করতে হতো। আক্রমণকারী ছাত্রটির বিরুদ্ধে শিক্ষক উৎপল কুমারের শৃঙ্খলাজনিত কোনো পদক্ষেপ নেবার কারণেই বিক্ষুব্ধ ছিল। জানা গেছে সে ছিল কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। স্কুল ও কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি হলেন তার নানা।
প্রভাষক উৎপল কুমার স্কুল ও কলেজের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি ছিলেন, দায়িত্বের অংশ হিসেবেই উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রদের তার শাসন করতে হতো, তাদের অন্যায়-অপকর্মের জন্য বিচারের মুখোমুখি করতে হতো। আক্রমণকারী ছাত্রটির বিরুদ্ধে শিক্ষক উৎপল কুমারের শৃঙ্খলাজনিত কোনো পদক্ষেপ নেবার কারণেই বিক্ষুব্ধ ছিল। জানা গেছে সে ছিল কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। স্কুল ও কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি হলেন তার নানা।
দেখা যাচ্ছে শিক্ষকরা তাদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনো উচ্ছৃঙ্খল জনতার বা কখনো বিক্ষুব্ধ ছাত্র দ্বারা আক্রান্ত-অপমানিত হচ্ছেন, মৃত্যুবরণও করছেন। শিক্ষকদের যে সম্মান এই সমাজ দিত একসময়, আজকাল তা যেন দিতে নারাজ তারা। তাতে শিক্ষকসমাজেরও কিছু দায় হয়তো আছে। কিন্তু আজ এমন এক সমাজ-রাষ্ট্র দেখা দিয়েছে, শিক্ষাব্যবস্থাকে যেনতেন রকমে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ দক্ষিণ এশিয়া সর্বনিম্ন, শিক্ষার মানের সূচকেও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন অবস্থানে আছে। এই শিক্ষা দিয়ে কেরানি-আমলা হবে, কিন্তু শিক্ষার যে মূল লক্ষ্য, জ্ঞানচর্চা ও মানবিক মূল্যবোধের লালন সেসব হবার সুযোগ কম। তা হচ্ছেও না। তাই ঘটছে এসব ঘটনা।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, আক্রান্ত শিক্ষকরা হিন্দু সম্প্রদায়ের। অন্তঃত প্রথম ঘটনাটিকে আক্রমণকারী সংখ্যাগরিষ্ঠরা দেখেছে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে। এর আগে এবছরের এপ্রিল মাসে মুন্সীগেঞ্জের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের ক্লাসের আলোচনাকে গোপনে ধারণ করে অনলাইনে ছড়িয়ে দিয়েছিল তারই ছাত্র। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তিনি ক্লাসে ইসলাম অবমাননা করেছেন। ফলে ওই শিক্ষককে কারাবাস করতে হয়। তারও আগে ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জের এক স্কুলের প্রধান শিক্ষককে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে সবার সামনে কান ধরে ওঠবস করান স্থানীয় সংসদ সদস্য। স্পষ্টভাবে বলা ভালো, সারা দেশেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অনুভূতি খুব নাজুক হয়ে উঠেছে আজকাল। অল্পতেই তাদের অনেকের অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত ভিন্ন ধর্ম-মতের মানুষদের ওপর আক্রমণ চালাতে অবশ্য তারা খুবই আগ্রাসী। হয়। অনেক সময়েই এমনকি নিরাপরাধ মানুষের ওপরও হামলা চালাতে এই “অনুভূতি” দ্বিধা করে না। প্রতি পূজায় এবং সারা বছর ধরে নানান সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে বাংলাদেশে। সামান্য এক ব্যক্তির ফেসবুকের কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় একটি পুরো এলাকায় সাম্প্রদায়িক হামলা করা হয়ে থাকে। ’সংখ্যাগুরু’র দাপটে ’সংখ্যালঘু’ জনগোষ্ঠী স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছে না। তারা যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে। দেশের সংবিধান-আইন-কানুনে যাই লেখা থাক, প্রশাসন ও রাজনীতিবিদরা সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষেই কাজ করে চলেছে।
অধ্যক্ষ স্বপন কুমারকে যেভাবে অপমান করা হয়েছে, তার কোনো উপশম নেই। তাকে সসম্মানে স্বপদে ফিরিয়ে আনা এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হতে পারে ভগ্নহৃদয় এই মানুষটির জন্য সামান্য প্রায়শ্চিত্ত। আর যারা দু’দিন ধরে তার নামে গুজব রটালো, ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়ালো, তাদের চিহ্নিত করা ও গ্রেফতার করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক। অন্যদিকে প্রভাষক উৎপল কুমার এ পৃথিবীতে নেই, তার অপমানবোধের কোনো অস্তিত্ব নেই। তার পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। জানা যাচ্ছে আক্রমণকারীর বয়স ১৬ বছর প্রচার হলেও তার প্রকৃত বয়স ১৯। ফলে প্রচলিত আইনেই তাকে বিচার করা যাবে। আর সারাদেশে ঝুঁকির মুখে থাকা ’সংখ্যালঘু’ নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আইনকে নিজের গতিতে চলতে দিতে হবে। সরকার-প্রশাসন ও রাজনীতিবিদদের সংখ্যাগরিষ্ঠের দাবিকে শিরোধার্য না করে প্রচলিত আইনের ওপর আস্থা রাখতে হবে এবং দেশে উদারপন্থী এক পরিবেশ তৈরীতে ভূমিকা রাখতে হবে।
আমাদের দেশের সংবিধান ও আইন-কানুনের নানান সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। কিন্তু তা মোটের ওপর একটি গণতান্ত্রিক ও উদারনৈতিক মূল্যবোধের ওপরে দাঁড়িয়ে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান বা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির অগণতান্ত্রিক, জাতিবিদ্বেষী এবং ধর্মীয়-রক্ষণশীল দাবি ও দাপটের মুখে নতি শিকার করে কিংবা বা সেসব পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণাকে ব্যবহার করে জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি না করে আমাদের গণতান্ত্রিক চেতনা, সংস্কৃতি ও মনননির্ভর দৃষ্টিভঙ্গিকে শিরোধার্য করতে হবে। ভোটাধিকার যতদিন না ফিরছে, ন্যায়বিচার যতদিন না ফিরছে, শ্রেণিবৈষম্য যতদিন না কমছে, সর্বোপরি সমাজে আইনের শাসন যতদিন না ঠিকঠাক প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে ততদিন এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী পরিবেশ মানুষকে উগ্র-সহিংস করে তোলে। কেউ দল ক্ষমতায় তাই যা-খুশি করতে চাইবে, কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের প্রতিনিধি হয়ে ভিন্ন ধর্ম-মতের মানুষদের আক্রমণের সহজ শিকার ভাবতে চাইবে। জিতু কেন গ্যাং সংস্কৃতিতে নিজেকে যুক্ত করছে, মুন্সিগঞ্জের ছাত্র কেন শিক্ষকের বক্তব্য তার অজান্তে রেকর্ড করে, তার কারণ খুঁজতে আমাদের বিদ্যমান অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী পরিবেশের দিকে নজর দিতে হবে। পদ্মা সেতু দিয়ে জনপদের সংযোগ হবে, তার দরকার আছ। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের মনোজগতের যে বিচ্ছিন্নতা ক্রমশ তৈরী হয়ে চলেছে, তার সংযোগ-সেতুও কি আমাদের গড়ে তুলতে হবে না?
কারণ অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী পরিবেশ মানুষকে উগ্র-সহিংস করে তোলে। কেউ দল ক্ষমতায় তাই যা-খুশি করতে চাইবে, কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের প্রতিনিধি হয়ে ভিন্ন ধর্ম-মতের মানুষদের আক্রমণের সহজ শিকার ভাবতে চাইবে। জিতু কেন গ্যাং সংস্কৃতিতে নিজেকে যুক্ত করছে, মুন্সিগঞ্জের ছাত্র কেন শিক্ষকের বক্তব্য তার অজান্তে রেকর্ড করে, তার কারণ খুঁজতে আমাদের বিদ্যমান অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী পরিবেশের দিকে নজর দিতে হবে। পদ্মা সেতু দিয়ে জনপদের সংযোগ হবে, তার দরকার আছ। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের মনোজগতের যে বিচ্ছিন্নতা ক্রমশ তৈরী হয়ে চলেছে, তার সংযোগ-সেতুও কি আমাদের গড়ে তুলতে হবে না?
ড. ফাহমিদুল হক
আবাসিক অধ্যাপক, বার্ড কলেজ, যুক্তরাষ্ট্র।