ভারতে নিষিদ্ধ বিবিসির প্রামাণ্যচিত্র গুজরাটের মুসলিম গণহত্যায় মোদির দায়
২০২৩-০১-৩১
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০২। গুজরাটের আহমেদাবাদ শহরে গণহত্যাকারীরা যানবাহন পুড়িয়ে দিচ্ছে। ছবি: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস
গুজরাট ২০০২ এবং বিবিসির প্রামাণ্যচিত্র
২০০২ সালে গুজরাটের আহমেদাবাদ শহরের গুলবার্গ হাউজিং সোসাইটি। ২৮ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যা। গুজরাট গণহত্যার প্রথম দিন সেদিন। বাড়িতেই ছিলেন সংসদ সদস্য এহসান জাফরি। সেদিনের গণহত্যায় এহসানের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এলাকার বহু মানুষ, যাঁদের মধ্যে একজন ইমতিয়াজ পাঠান। ইমতিয়াজ জানান, এহসান জাফরির বাড়িতে ভিড় করেছিলেন নারী-শিশুসহ আতঙ্কিত বাসিন্দারা। সহিংসতা কমার কোনো লক্ষণ নেই দেখে এহসান জাফরি তাঁর পরিচিত রাজনৈতিক নেতাদের, পুলিশের বড়কর্তাদের ফোন করতে থাকেন। এরপরও কোনো সাহায্য না আসায় সর্বশেষ যে ব্যক্তিকে তিনি ফোন করেন, তাঁর নাম নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। তিনি তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী।
কোনো সাহায্য না আসায় সর্বশেষ যে ব্যক্তিকে তিনি ফোন করেন, তাঁর নাম নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। তিনি তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। এহসান জাফরি তাঁকে ফোন করলে তিনি এহসানের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন ও তাঁকে গালিগালাজ করেন
এহসান জাফরি তাঁকে ফোন করলে তিনি এহসানের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন ও তাঁকে গালিগালাজ করেন। ইমতিয়াজ পাঠানের বর্ণনায়, “জাফরি সাহেব তারপর বললেন, কোনো সাহায্য আসবেন না। তিনি রান্নাঘরে গেলেন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললেন, “আমাকে হত্যা করলে যদি তোমাদের তৃপ্তি হয়, তাহলে আমি বাইরে আসছি। তারপরও এই মহিলা, বাচ্চা আর সবাইকে তোমরা ছেড়ে দাও।” আমরা সবাই যেতে মানা করলাম, কিন্তু জাফরি সাহেব শুনলেন না। তিনি বেরিয়ে গেলে ওরা তাঁর গলা কেটে ফেললো। টুকরো টুকরো করে ফেললো তাঁকে।… আমার মা আর চাচাসহ আমার পরিবারের ১০ জনকে খুন করা হয়েছিলো সেদিন।”
গুজরাট গণহত্যায় নিহত সাংসদ এহসান জাফরির ছবি নিয়ে স্ত্রী জাকিয়া জাফরি। ছবি: অমিত দেব, রয়টার্স
২০০২ সালের গুজরাট গণহত্যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূমিকার বিষয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির প্রামাণ্যচিত্র ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোয়েশ্চেন এর প্রথম পর্ব সম্প্রচারিত হয়েছে গত ১৭ জানুয়ারি। গণহত্যার সময়ে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মোদি। আলোচিত এ প্রামাণ্যচিত্রে দেখা যাচ্ছে, উগ্রবাদী হিন্দু গণহত্যাকারীরা মুসলিমদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে এবং সে সময়ে পুলিশ নিষ্ক্রিয়ভাবে পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
আলোচিত এ প্রামাণ্যচিত্রে দেখা যাচ্ছে, উগ্রবাদী হিন্দু গণহত্যাকারীরা মুসলিমদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে এবং সে সময়ে পুলিশ নিষ্ক্রিয়ভাবে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এরই মধ্যে ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় প্রামাণ্যচিত্রটি বা এর কোনো ক্লিপ শেয়ার করা নিষিদ্ধ করে আদেশ জারি করেছে
এরই মধ্যে ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় প্রামাণ্যচিত্রটি বা এর কোনো ক্লিপ শেয়ার করা নিষিদ্ধ করে আদেশ জারি করেছে। ২০২১ সালের নীতিমালা অনুযায়ী এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে “জরুরি অবস্থায় তথ্য আদান-প্রদান বন্ধ করা যাবে।”
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০২। আগুন জ্বলছে গুজরাটে। ছবি: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস
বলা হয়, ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর গুজরাটের এই গণহত্যাই ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে সহিংস ঘটনা। নরেন্দ্র মোদির এ গণহত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ আজ নতুন নয়। তাহলে বিবিসির এ প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে এতো শোরগোল কেন? ৫৯ মিনিটের এ প্রামাণ্যচিত্রে মোদির সম্পৃক্ততার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মন্তব্যও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু নতুন যে সাক্ষ্য এতে দেখানো হয়েছে, সেগুলো আগে কেউ জানতেন না। বিবিসির এই প্রতিবেদনে এর আগ পর্যন্ত অপ্রকাশিত ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে এ গণহত্যার জন্য মোদিকে ‘সরাসরি দায়ী’ সাব্যস্ত করা হয়েছে।
বিবিসির এই প্রতিবেদনে এর আগ পর্যন্ত অপ্রকাশিত ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে এ গণহত্যার জন্য মোদিকে ‘সরাসরি দায়ী’ সাব্যস্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে মোদি একটি ‘দায়মুক্তির পরিবেশ’ তৈরি করার ফলেই এই গণহত্যা সম্ভব হয়েছে এবং এথনিক ক্লিনজিং বা গণহত্যার এর সব বৈশিষ্ট্যই এখানে দেখা গেছে
বলা হয়েছে মোদি একটি ‘দায়মুক্তির পরিবেশ’ তৈরি করার ফলেই এই গণহত্যা সম্ভব হয়েছে এবং এথনিক ক্লিনজিং বা গণহত্যার এর সব বৈশিষ্ট্যই এখানে দেখা গেছে। বৃটিশ সরকারের পরিচালিত এই তদন্তে জানা যায় অন্তত ২০০০ মানুষ খুন হয়েছিলেন, মুসলিম নারীদের পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ করা হয় এবং ১লক্ষ ৩৮ হাজার মানুষ অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুতে পরিণত হন। এখানে আরও বলা হয় যে এই সহিংসতা ছিল পূর্বপরিকল্পিত, সম্ভবত কয়েকমাস আগেই এই পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। এর লক্ষ ছিল হিন্দু এলাকাগুলো থেকে মুসলিমদের অবলোপন। উগ্র হিন্দুবাদী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা বিএইচপির নেতৃত্বে রাজ্য সরকারের ছত্রছায়ায় এটা ঘটেছিল। মোদী মুখ্যমন্ত্রী থাকলে সমঝোতা অসম্ভব, এটি চিল তদন্তের সিদ্ধান্ত। বিবিসির এই প্রামাণ্যচিত্রে সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব জ্যাক স্ট্র সহ অন্যান্য পশ্চিমা কূটনীতিবিদরা মোদির সম্পৃক্ততার সমালোচনা করেছেন। এ প্রামাণ্যচিত্রটিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও একটি তদন্তের কথা বলা হযেছে, সেখানেও মোদীর অংশগ্রহণ বিষয়ে একই রকম সিদ্ধান্ত ছিল।
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০২। গোধরার সবরমতী কোচে আগুন ধরিয়ে হত্যা করা হয় ৫৯ জনকে। ছবি: এপি
২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি গুজরাটে তিন দিনব্যাপী যে গণহত্যা আরম্ভ হয়, আক্ষরিক অর্থেই তার আগুন জ্বলেছিলো আগের দিন, অর্থাৎ ২৭ ফেব্রুয়ারি। সেদিন অযোধ্যার রাম জন্মভূমি নামক তীর্থস্থান থেকে সবরমতী এক্সপ্রেসের একটি কোচ ফিরে আসছিলো হিন্দু তীর্থযাত্রীদের নিয়ে। গোধরা স্টেশনের কাছাকাছি জায়গাতে ট্রেনটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। অগ্নিকাণ্ডের কারণ সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া না গেলেও ধারণা করা হয়, এর দায় মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষের। এ ঘটনায় নারী ও শিশুসহ মারা যান ৫৯ জন মানুষ, যাঁদের সকলেই ছিলেন হিন্দু তীর্থযাত্রী। এই হত্যাকাণ্ডই পরদিন গুজরাটে গণহত্যা শুরু হওয়ার ইন্ধন হিসেবে কাজ করে। সে সময় ঘটনাটির ওপর প্রতিবেদন করেছিলেন বিবিসির প্রতিবেদক জিল ম্যাকগিভারিং। তাঁর প্রতিবেদনে তিনি বলেন, “ভয়াবহ এই ধ্বংসযজ্ঞ। মানবসৃষ্ট এবং ইচ্ছাকৃত বলে এটা আরো বেশি ভয়ানক। ভারতে ঘটা ধর্মীয় ঘৃণার ভয়াবহতম প্রকাশের ঘটনাগুলোর মাঝে একটি এটি। কোনো কোনো জায়গায় শোক এবং ক্ষোভ এরই মধ্যে সহিংসতার রূপ নিয়েছে। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা যেখানে শিরায় শিরায় মিশে আছে, তেমন একটি রাজ্যে বিষয়টি গুরুতর আশঙ্কার কারণ।” ম্যাকগিভারিংয়ের এই উক্তি থেকে বোঝা যায় যে, গোধরা হত্যাকাণ্ডের পরপরই আসন্ন সহিংসতার বিষয়টি আঁচ করা গেছিলো।
গোধরা স্টেশনের কাছাকাছি জায়গাতে ট্রেনটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। অগ্নিকাণ্ডের কারণ সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া না গেলেও ধারণা করা হয়, এর দায় মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষের। এ ঘটনায় নারী ও শিশুসহ মারা যান ৫৯ জন মানুষ, যাঁদের সকলেই ছিলেন হিন্দু তীর্থযাত্রী। এই হত্যাকাণ্ডই পরদিন গুজরাটে গণহত্যা শুরু হওয়ার ইন্ধন হিসেবে কাজ করে
ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোয়েশ্চেন প্রামাণ্যচিত্রে গোধরা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সাক্ষাৎকার দেন জিল ম্যাকগিভারিং। বিবিসির সাবেক এই প্রতিবেদক বলেন, “ঘটনাটা ঘটেছে এমন একটা রাজ্যে, যেখানে হিন্দু সংখ্যাগুরু আর মুসলিম সংখ্যালঘুর মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েনের স্পষ্ট ইতিহাস আছে। অতীতে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং অত্যন্ত নৃশংস সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। উদ্বেগের বিষয় ছিলো এই যে, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে যদি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ক্রুদ্ধ হয় এবং মনে করে তাদেরকে টার্গেট করা হচ্ছে, তাহলে তার প্রতিক্রিয়া আরো ভয়াবহ হতে পারে। সে সময়ে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি তখন এক উদীয়মান তারকা, দূরদর্শী এবং যে-কোনো কিছু তিনি করিয়ে নিতে পারেন। তিনি অত্যন্ত হিন্দুপ্রেমী, অত্যন্ত ক্ষমতাধর এবং প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি।”
মোদি কি দায়ী?
একটি রাজ্যের সরকারী কর্তাব্যক্তিদের কাছে, বিশেষত মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে এটাই আশা করা স্বাভাবিক যে, তিনি এ ধরনের সহিংসতার কোনোরকম আঁচ পাওয়ামাত্রই তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবেন। তা যদি সম্ভব না হয়, তাহলেও সহিংসতা শুরু হওয়ামাত্র তা নিবারণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন রাজ্যের সরকারপ্রধান- এমনটাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু মোদি যা করেছিলেন সে সময়ে, তা ভারতের ইতিহাসে কোনো মুখ্যমন্ত্রীই এর আগে করেননি।
মোদি ঐ তিন দিন গণহত্যা প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা তো করেনইনি, বরং তাঁর নির্দেশেই পুলিশ সে সময়ে নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। সহিংসতার খবর সরাসরি মোদি পর্যন্ত পৌঁছলেও তিনি তা থামানোর কোনো চেষ্টাই করেননি
বিভিন্ন সূত্র থেকে বরং জানা যায় যে, মোদি ঐ তিন দিন গণহত্যা প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা তো করেনইনি, বরং তাঁর নির্দেশেই পুলিশ সে সময়ে নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। সহিংসতার খবর সরাসরি মোদি পর্যন্ত পৌঁছলেও তিনি তা থামানোর কোনো চেষ্টাই করেননি। বরং অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাস, এ গণহত্যার জন্য মোদি সরাসরি দায়ী।
গুজরাটের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হরেন পণ্ডিয়ার মৃত্যু রহস্য আজও উদ্ঘাটিত হয়নি। ছবি: আহমেদাবাদ মিরর
হরেন পণ্ডিয়ার সাক্ষ্যের বিষয়টিই ধরা যাক। ১৯৯৮ সালে বিজেপি নেতা কেশুভাই প্যাটেল গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর পদে আসীন হলে বিজেপি সমর্থক হরেন পণ্ডিয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এরপর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসলে তিনি প্রদেশের রাজস্ব মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। বিবিসির প্রামাণ্যচিত্রে তাঁর বিষয়ে কথা বলেছেন ইহুদি পাদ্রি ফাদার সেড্রিক প্রকাশ। গুজরাটের মানবাধিকার কর্মীদের গড়ে তোলা সিটিজেনস ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। তিনি জানান, হরেন পণ্ডিয়া গুজরাট গণহত্যার বিষয়ে যা যা জানতেন, নাম গোপন রাখার শর্তে তা ট্রাইব্যুনালকে জানান। গোধরা হত্যাকাণ্ডের রাতে, অর্থাৎ ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতেই আসন্ন গণহত্যার বিষয়ে যে আভাস মিলছিল, সেটা ট্রাইব্যুনালকে তিনি জানান। সে রাতে মোদি এবং সরকারের বড়কর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তিনি।
তিনি জানান। সে রাতে মোদি এবং সরকারের বড়কর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তিনি। মোদি সেই বৈঠকে বলেছিলেন, গোধরা হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় হিন্দুরা যা করবে, তাতে যেন বাধা দেওয়া না হয়
মোদি সেই বৈঠকে বলেছিলেন, গোধরা হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় হিন্দুরা যা করবে, তাতে যেন বাধা দেওয়া না হয়। সেড্রিক প্রকাশ জানান, হরেন পণ্ডিয়া স্পষ্টতই গুজরাটের হত্যাকাণ্ডের জন্য মোদিকে দায়ী করছিলেন। তবে, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় বলছে, তাঁর এসব দাবি সর্বৈব মিথ্যা এবং তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি ঐ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। বিশ্লেষকরা অনেকেই অবশ্য মনে করেন, এ তদন্ত আদতে নির্ভরযোগ্য নয়।
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আর বি শ্রীকুমার। ছবি: টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া
হরেন পণ্ডিয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলেও, তাঁর এই বক্তব্যের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। এর ফলে ২০০২ সালের আগস্ট মাসে তিনি পদত্যাগ করেন। পরের বছর, অর্থাৎ ২০০৩ সালের ২৬ মার্চ গুজরাটের সাবেক এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হরেন পণ্ডিয়াকে নিজের গাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাঁর মৃত্যুকে অত্যন্ত অস্বাভাবিক এবং রহস্যজনক মনে করা হয়, কারণ তাঁর শরীরে গুলি ঢুকেছে যৌনাঙ্গ ও তলপেটের মাঝামাঝি জায়গা দিয়ে। যেখানে যেখানে রক্ত থাকার কথা, সেসব জায়গাতে রক্ত ছিলো না। তাছাড়া, গাড়িতে তিনি যেভাবে বসে ছিলেন সেভাবে থাকা অবস্থায় শরীরের এই অংশে গুলি করা অসম্ভব। অনুসন্ধানী সাংবাদিক হরতোষ সিং বাল মনে করেন, হরেন পণ্ডিয়াকে অন্য কোথাও খুন করে মৃতদেহ তাঁর গাড়িতে রেখে যাওয়া হয়েছে। আউটলুক ইন্ডিয়া এ হত্যাকাণ্ডকে বলছে এ মার্ডার ফোরটোল্ড।
শ্রীকুমারের মতো সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা সঞ্জীব ভাটও এখন কারাগারে। ছবি: দ্য কুইন্ট
মোদি যে গণহত্যায় বাধা দেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন, হরেন পণ্ডিয়াই তার একমাত্র সাক্ষী নন। গুজরাটের পুলিশ ইনটেলিজেন্সের সাবেক প্রধান আর বি শ্রীকুমারের ভাষ্যও একই কথা বলে। তাঁর দাবি, গোধরা ট্রেন অগ্নিকাণ্ডের রাতে মোদি কর্মকর্তাদের বলেছিলেন হিন্দুদের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর সুযোগ দিতে। গুজরাটের পুলিশ চিফ তাঁকে এ তথ্য দিয়েছেন বলে জানান শ্রীকুমার, যদিও সেই পুলিশ চিফ পরে তা অস্বীকার করেন। পরে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম (এসআইটি) তাঁর এই সাক্ষ্যকে গুজব/ অনির্ভরযোগ্য বলে রায় দেয়। শ্রীকুমার এখন কারাগারে রয়েছেন। জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা সঞ্জীব ভাটের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। সঞ্জীব জানান, তিনি ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে মোদির ডাকা বৈঠকে ছিলেন। মোদি সেখানে বলেছিলেন, “হিন্দুরা এখন অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে আছে।
সঞ্জীব জানান, তিনি ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে মোদির ডাকা বৈঠকে ছিলেন। মোদি সেখানে বলেছিলেন, “হিন্দুরা এখন অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে আছে। তাদেরকে অবশ্যই তাদের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর সুযোগ দিতে হবে।” শ্রীকুমারের মতো সঞ্জীব ভাটের বক্তব্যও অনির্ভরযোগ্য বলে বাতিল করে দেওয়া হয়
তাদেরকে অবশ্যই তাদের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর সুযোগ দিতে হবে।” শ্রীকুমারের মতো সঞ্জীব ভাটের বক্তব্যও অনির্ভরযোগ্য বলে বাতিল করে দেওয়া হয়। মোদিসহ অন্যান্যদের দাবি, সঞ্জীব আলোচ্য সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। ২০১৯ সালে সঞ্জীব ভাটকে ৩০ বছর আগের এক পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁর মেয়ে ডাক্তার আকাশি ভাট বলেন, “আমার বাবার কণ্ঠস্বর রোধ করা নিশ্চিত করতে যা যা করা সম্ভব তার সবই করবে সরকার। মোদিকে যারা ২০০২ সালের গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত দাবি করতে পারেন, তাদের মধ্যে শুধু তিনিই জীবিত আছেন।”
গুজরাট গণহত্যায় প্রায় একশো মানুষকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত বাবু বজরঙ্গি। ছবি: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
বৈঠকে উপস্থিত কর্তাব্যক্তি ছাড়াও, ঘটনার সঙ্গে যুক্ত অপরাধীদের কারো কারো সাক্ষ্য থেকেও মোদির সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্পষ্ট। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য কট্টর হিন্দু ডানপন্থী দল বজরঙ্গ দলের সন্ত্রাসী বাবুভাই প্যাটেল বা বাবু বজরঙ্গির ভাষ্য। ১০০ মানুষকে হত্যা করা গণহত্যাকারীদের একটি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। ২০০৭ সালে একজন সাংবাদিক গুজরাটে গিয়ে হিন্দু চরমপন্থীর ছদ্মবেশে বাবু বজরঙ্গিকে জিজ্ঞাসা করেন, গণহত্যার সময়ে কী ঘটেছিলো। গোপন ক্যামেরায় বাবু বজরঙ্গির বক্তব্য ধারণ করেন তিনি। সেই ভিডিওতে দেখা যায় বাবু বজরঙ্গি বলছেন, “কাউকে ছাড়িনি। ছাড়া উচিতও না।
সেই ভিডিওতে দেখা যায় বাবু বজরঙ্গি বলছেন, “কাউকে ছাড়িনি। ছাড়া উচিতও না। আমি তো এখনও বলি… যা খুশি হোক, বাচ্চা হোক, মহিলা হোক, খুন করো। খুন করো, টুকরো টুকরো করো, পুড়িয়ে দাও ওদের।” মুসলিমদের হত্যা করে আনন্দ পান, হত্যা করে রাতে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়েন বলেও জানান বাবু বজরঙ্গি
আমি তো এখনও বলি… যা খুশি হোক, বাচ্চা হোক, মহিলা হোক, খুন করো। খুন করো, টুকরো টুকরো করো, পুড়িয়ে দাও ওদের।” মুসলিমদের হত্যা করে আনন্দ পান, হত্যা করে রাতে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়েন বলেও জানান বাবু বজরঙ্গি। গণহত্যার কয়েক মাস পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বজরঙ্গি ওই গোপনে ধারণ করা ভিডিওতে আরো জানান, বিচার ব্যবস্থায় প্রভাব খাটিয়ে তাকে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেন মোদি। তবে, পরবর্তী সময়ে এই ভিডিও নিয়ে আলোড়ন তৈরি হলে বাবু বজরঙ্গি দাবি করেছেন, এর কোনোকিছুই সত্য নয়। সেই সাংবাদিক তাঁকে একটি স্ক্রিপ্ট পড়তে বলেছিলেন, তিনি সেটিই কেবল পড়েছেন, আর কিছু নয়। তবে একজন বিচারক রায় দিয়েছেন যে, ভিডিওর সত্যতা বিষয়ে সন্দেহ নেই। ২০১২ সালে খুনের দায়ে বাবু বজরঙ্গিকে কারাগারে পাঠানো হয়।
হরেশ ভাট। ছবি: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছিলো স্থানীয় বিজেপি নেতা হরেশ ভাটের বক্তব্যও। এ বক্তব্যে দেখা যায় তিনি বলছেন, “মোদি যা করেছেন তা আগে কোনো মুখ্যমন্ত্রী কখনও করেননি। তিনি আমাদের তিন দিন সময় দিয়েছিলেন। “তিন দিন যা খুশি করো, তিন দিন পর আমি সামলে নেবো।” তিন দিন পর তিনি থামতে বললেন, আর সব থেমে গেলো।” হরেশ ভাট পরে দাবি করেন যে, তিনি বানিয়ে একটি মিথ্যা গল্প বলেছিলেন ঐ সাংবাদিককে। রেকর্ডিংয়ে থাকা অভিযোগ মিথ্যা ও ভুল বলে দাবি করেছেন নরেন্দ্র মোদি।
বিচার…?
গুজরাট গণহত্যায় নিহত সাঈদ দাউদ ও শাকিল দাউদ। ছবি: ক্ল্যারিয়ন ইন্ডিয়া
গুজরাট গণহত্যার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির যুক্ততার এমন অকাট্য প্রমাণ একটি-দুটি নয়। তা সত্ত্বেও ভারতের মাটিতে তাঁর বিচার সম্ভব হয়নি। ২০০৩ সালের আগস্টে মোদি লন্ডন সফরে গিয়েছিলেন। সে সময়ে ঘটনার শিকার ইয়র্কশায়ার প্রবাসী ভারতীয় মুসলিম ইমরান দাউদ তাঁর পারিবারিক আইনজীবী ইমরান খানের সহায়তায় মোদিকে লন্ডনে গ্রেফতার করার চেষ্টা করেন। গুজরাট গণহত্যা থেকে ইমরান দাউদ বেঁচে ফিরতে পারলেও প্রাণ দিতে হয় তাঁর দুই চাচা সাঈদ দাউদ ও শাকিল দাউদ এবং পড়শি মোহাম্মদ আসওয়াতকে।
“মোদি যা করেছেন তা আগে কোনো মুখ্যমন্ত্রী কখনও করেননি। তিনি আমাদের তিন দিন সময় দিয়েছিলেন। “তিন দিন যা খুশি করো, তিন দিন পর আমি সামলে নেবো।” তিন দিন পর তিনি থামতে বললেন, আর সব থেমে গেলো
আইনজীবী ইমরান খান এবং ভুক্তভোগী ইমরান দাউদের পরিকল্পনা ছিলো এই যে, দাউদ পরিবার আদালতে নরেন্দ্র মোদিকে আইনের আওতায় আনার আবেদন জানাবে। হত্যাকাণ্ডটি ভারতের গুজরাটে ঘটলেও ইংল্যান্ডের এর বিচার সম্ভব। নিহত বেশ কয়েকজন ভারতীয় বংশো্দ্ভূত ব্রিটিশ মুসলিমও ছিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনাটি ফাঁস হয়ে যায়। একজন ভারতীয় কূটনীতিক জানান, এ খবর ফাঁস হওয়ার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মোদি একরকম তড়িঘড়ি লন্ডন থেকে পালিয়ে আসেন সে সময়ে। মোদিকে কূটনৈতিকভাবে বর্জন করে যুক্তরাজ্য এবং তার ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ২০০৫ সালে নির্দিষ্ট এক আইন অনুযায়ী নরেন্দ্র মোদির ভিসা আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এ আইন প্রযোজ্য সেসব সরকারী কর্মকর্তার জন্য, যারা ধর্মীয় স্বাধীনতার গুরুতর লঙ্ঘন ঘটান।
বিচারের ওপর ভরসা হারিয়েছেন গুজরাট গণহত্যায় গণধর্ষণের শিকার বিলকিস বানু। ছবি: মণীশ স্বরূপ/ এপি
বিচার পাননি বিলকিস বানুও। ২০০২ সালের মার্চের ৩ তারিখে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাছের এক গ্রামে যাচ্ছিলেন ২১ বছর বয়সী বিলকিস। তিনি তখন পাঁচ মাসের গর্ভবতী। পথে তাদের ওপর লাঠি, তলোয়ার ও কাস্তে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ২০-৩০ জন মানুষের একটি দল। ১১ জন গণধর্ষণ করে বিলকিসকে। তাঁর চোখের সামনে হত্যা করা হয় তাঁর পরিবারের সাত সদস্যকে, যাদের মধ্যে তাঁর তিন বছর বয়সী শিশুকন্যাও ছিলো। গত বছর ভারতের স্বাধীনতা দিবস ১৫ আগস্টে কারামুক্তি পেয়েছে বিলকিস বানুর ১১ ধর্ষক। বিলকিস জানান, বিচারের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন তিনি।
সাংসদ এহসান জাফরির বাড়িতে হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশকে তাদের ভূমিকার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে পুলিশের একজন কর্তা বলেন, তিনি মনে করেন তাঁরা আরো ভালোভাবে কাজ করতে পারতেন, কেননা সবসময়েই আরো ভালোভাবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এভাবে তাদের নিষ্ক্রিয়তার প্রশ্নটি এড়িয়ে যান এই কর্মকর্তা
গুজরাটের গণহত্যার পর দুই দশকেরও বেশি সময় কেটে গেছে। বাবু বজরঙ্গির মতো দুই একজন অপরাধীর সাজা হলেও বিচার পাননি ইমরান দাউদ, ইমতিয়াজ পাঠান, বিলকিস বানুরা। সাংসদ এহসান জাফরির স্ত্রী জাকিয়া জাফরিও তাঁর স্বামী হত্যার বিচার পাননি। বরং অনেকক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর ওপরেই নানা কায়দায় দোষ চাপানো হয়েছে। যেমন, এহসান জাফরির ক্ষেত্রে বিচারক মন্তব্য করেছেন তিনি বন্দুকের গুলি ছুঁড়ে জনতাকে উত্তেজিত করে তুলেছেন। তাঁর ও নরেন্দ্র মোদির ফোন কলের বিষয়টি মোদি অস্বীকার করেছেন এবং দাবি করেছেন তিনি ফোন ধরেননি। অন্য দিকে তদন্ত বলছে, ফোনটি যে করা হয়েছিলো তার আদতে কোনো প্রমাণ নেই। এভাবে সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরেও বারবার আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে গেছেন মোদি। ২০০৯ সালে বিশেষ আদালত কর্তৃক স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম (এসআইটি) গঠিত হয়। সেখানে সঞ্জীব ভাট বা আর বি শ্রীকুমারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাক্ষ্য থাকলেও ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মোদি এবং আরো ৬৩ জনকে নির্দোষ সাব্যস্ত করে এসআইটি।
মোদি কী বলছেন?
ইমরান দাউদ বা ইমতিয়াজ পাঠানের মতো ভুক্তভোগী, সঞ্জীব ভাট বা আর বি শ্রীকুমারের মতো সাক্ষী, কিংবা বাবু বজরঙ্গির মতো অপরাধীর বয়ান আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি। কিন্তু স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি, অথবা তাঁর আজ্ঞাদাস পুলিশ বাহিনীর বক্তব্য কী এ বিষয়ে? প্রথমে পুলিশ বাহিনীর কথা ধরা যাক। জিল ম্যাকগিভারিংয়েরই এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, গুজরাটের বৃহত্তম শহর আহমেদাবাদ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হলেও পুলিশ স্রেফ পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। সাংসদ এহসান জাফরির বাড়িতে হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশকে তাদের ভূমিকার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে পুলিশের একজন কর্তা বলেন, তিনি মনে করেন তাঁরা আরো ভালোভাবে কাজ করতে পারতেন, কেননা সবসময়েই আরো ভালোভাবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এভাবে তাদের নিষ্ক্রিয়তার প্রশ্নটি এড়িয়ে যান এই কর্মকর্তা।
হরেন পণ্ডিয়ার শেষকৃত্যে নরেন্দ্র মোদি। হরেন পণ্ডিয়ার মৃত্যুতে কণ্ঠরোধ হয়ে গেলো মোদির বিরুদ্ধে একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর। ছবি: সিদ্ধার্থ দর্শন কুমার, এপি ফটো
আর মোদি? মোদির ভাষ্য হলো, অত্যন্ত তৎপরভাবে গণহত্যা দমন করার ফলেই মাত্র তিন দিনে এই গণহত্যা রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, “যা ঘটেছে তার জন্য আমি আনন্দিত নই, কিন্তু আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করেছি।” সাংবাদিক জিল ম্যাকগিভারিংয়ের সঙ্গে এক মুখোমুখি সাক্ষাৎকারে গুজরাটের আইন ও বিচার ব্যবস্থার ভগ্নদশা সম্বন্ধে মোদিকে প্রশ্ন করেন জিল। যার উত্তরে মোদি বলেন, “আপনাদেরকে আগে নিজেদের তথ্য শুধরে নিতে হবে। গুজরাটের পরিস্থিতি অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ।… আপনাদের বিশ্লেষণের সঙ্গে আমি একমত নই। আপনাদের তথ্যের সঙ্গে আমি একমত নই।… এগুলো পুরোপুরি বিভ্রান্তিকর তথ্য। এসব আবর্জনা কোত্থেকে তুলে এনেছেন আমি জানি না।” জিল যখন জানান যে, যা তিনি বলছেন তা তিনি নিজের চোখে ঘটতে দেখেছেন, মোদি তার উত্তরে বলেন, মোদির বিরোধী পক্ষের লোকেদের সহিংসতায় যুক্ত থাকতে দেখেছেন জিল। মানবাধিকার প্রশ্নে মোদি বলেন, “দয়া করে আমাদের কাছে মানবাধিকার প্রচার করতে আসবেন না। আমরা জানি মানবাধিকার কী। আপনারা ব্রিটিশরা আমাদেরকে মানবাধিকার শেখাতে আসবেন না।” সবশেষে মোদি বলেন যে, একটিমাত্র জায়গায় তিনি ভুল করেছেন, আর তা হলো আরও কঠোরভাবে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিৎ ছিলো। অর্থাৎ, গণহত্যার সকল দায়, গুজরাটের সহিংস পরিস্থিতি সবকিছুকে তিনি অস্বীকার তো করলেনই, সেইসঙ্গে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ উচিৎ ছিলো বলেও দাবি করলেন।
মোদির উত্থান, মোদির ক্যারিশমা
এ প্রামাণ্যচিত্রে মোদির রাজনৈতিক দল বিজেপির সাবেক রাজনীতিবিদদের সাক্ষাৎকারও রয়েছে, যাঁরা গণহত্যায় মোদির সম্পৃক্ততার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। ২০১৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে এখানে, যাতে বলা হচ্ছে মোদির বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। এছাড়া, এ প্রামাণ্যচিত্রে মোদির আরএসএসের (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়টিও এসেছে। ‘গুজরাট আন্ডার মোদি’ বইয়ের লেখক, কিংস কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ক্রিস্টোফ জাফ্রেলট বলেন, “আরএসএস খুব ছোট ছেলেদের দলে ভিড়িয়ে নেয়, যাদের মন তখনও কাঁচা।… ১৯২০ এর দশকে আরএসএসের উত্থান ঘটে, যখন ইউরোপে এমন এক আন্দোলন দানা বাঁধছে যা ইতালিতে ফ্যাসিবাদ আর জার্মানিতে নাৎসিবাদে রূপ নেবে।… মোদি আরএসএসেরই ফসল। এই সংগঠনের রাজনীতি, এর জীবনধারা শিখে নিয়েছেন তিনি।”
মোদি বলেন যে, একটিমাত্র জায়গায় তিনি ভুল করেছেন, আর তা হলো আরও কঠোরভাবে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিৎ ছিলো। অর্থাৎ, গণহত্যার সকল দায়, গুজরাটের সহিংস পরিস্থিতি সবকিছুকে তিনি অস্বীকার তো করলেনই, সেইসঙ্গে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ উচিৎ ছিলো বলেও দাবি করলেন
সাংবাদিক এবং ‘নরেন্দ্র মোদি: দ্য ম্যান, দ্য টাইমস’ বইয়ের লেখক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেন, “ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদীদের তৈরি জাতির শ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্বে এবং একটা সাধারণ শত্রু তৈরির ধারণায় বিশ্বাসী ছিল আরএসএস। আরএসএসের জন্য সেই সাধারণ শত্রু ছিলো মুসলিমরা।” বিজেপির যুব শাখার সাবেক সহসভাপতি এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডক্টর স্বদেশ সিং অবশ্য মনে করেন, আরএসএস হিন্দুপ্রেমী হলেও মুসলিমবিদ্বেষী নয়। তাঁর মতে, মানুষ যেকোনো উপায়েই প্রার্থনা করতে পারেন, কিন্তু কেউ হিন্দু মূল্যবোধে বিশ্বাসী হলে তিনি ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হন। আরএসএসে একটি শক্তিশালী অবস্থান বিজেপিতেও মোদির আসনকে পাকাপোক্ত করে। মোদির উত্থানের প্রথম ধাপই ছিলো তাঁর আরএসএস সম্পৃক্ততা।
“ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদীদের তৈরি জাতির শ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্বে এবং একটা সাধারণ শত্রু তৈরির ধারণায় বিশ্বাসী ছিল আরএসএস। আরএসএসের জন্য সেই সাধারণ শত্রু ছিলো মুসলিমরা।”
গুজরাটে এই সহিংস গণহত্যার পর মোদি যা করেন, তা অভাবনীয়। নির্বাচনের ঘোষণা দেন তিনি। নির্বাচনের প্রচারণায় তাঁকে দেখা যায় এক ক্যারিশম্যাটিক নেতা হিসেবে, মঞ্চে দাঁড়িয়ে যিনি বলছেন, “আপনারা গ্রামে কোনো দোকান পুড়িয়েছেন? আপনারা কাউকে ছুরি মেরেছেন বা কারো মাথা কেটেছেন? আপনারা কোনো মা-বোনের ইজ্জত নিয়েছেন? তারপরও গুজরাটের শত্রুরা বলে বেড়াচ্ছে, গ্রামের পর গ্রামজুড়ে আগুন জ্বলছে। এভাবে গুজরাটের বদনাম করা হচ্ছে…।” এভাবে শুধু গণমাধ্যমেই নয়, জনমানসেও সত্য বদলে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালান মোদি।
নিষিদ্ধ
নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। ছবি: ইন্ডিয়া টিভি নিউজ
ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোয়েশ্চেন প্রামাণ্যচিত্রের প্রথম পর্ব ভারতে প্রচারিত হওয়ার পরপরই তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ১৬ নম্বর ধারার আওতায় এটিকে ব্লক করা হয় এবং এর কোনো লিঙ্ক অথবা ক্লিপ অনলাইনে শেয়ার করা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা কাঞ্চন গুপ্ত জানান, টুইটার ও ইউটিউবের কয়েক ডজন অ্যাকাউন্ট এই প্রামাণ্যচিত্রের ক্লিপ শেয়ার করায় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম দুটিকে এসব অ্যাকাউন্ট বাতিল করার আদেশ দিয়েছে ভারত সরকার। কাঞ্চন গুপ্তর মতে, এই প্রামাণ্যচিত্র “ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে হেয় করছে” এবং “ভিত্তিহীন অভিযোগ প্রচার করছে।” অন্যদিকে বিবিসি বলছে, এ প্রামাণ্যচিত্র “সর্বোচ্চ সম্পাদকীয় মানদণ্ড অনুসরণ করে কঠোর গবেষণার” মাধ্যমে নির্মিত হয়েছে।
ভারতে যে সময়ে এ প্রামাণ্যচিত্র নিষিদ্ধ করা হলো, তার আগে থেকেই ভারত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিচারে এক দুঃসময় পার করছে। মোদির আমলে বিশ্লেষণী সাংবাদিক এবং গণমাধ্যম আইনের নামে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। গত বছর গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিলো ১৫০ তম, যা দেশটির ইতিহাসে সর্বনিম্ন। বিবিসির এই প্রামাণ্যচিত্র নিষিদ্ধ করা নিশ্চিতভাবেই এক্ষেত্রে ভারতকে আরেক ধাপ পিছিয়ে দিলো।
বিবিসির প্রামাণ্যচিত্র নিষিদ্ধের নিন্দা জানিয়েছেন সাংসদ মহুয়া মৈত্র। ছবি: টুইটার
বিরোধী পক্ষের রাজনীতিবিদরাও ফুঁসে উঠেছেন এই প্রামাণ্যচিত্র নিষিদ্ধের ঘটনায়। তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ মহুয়া মৈত্র এর একটি ক্লিপের লিঙ্ক শেয়ার করে লেখেন, “বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের সম্রাট আর পারিষদেরা এতো নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, বিষয়টি লজ্জাজনক।” এছাড়া কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে), দ্য ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট (আইপিআই) ও ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের (আইএফএফ) মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও ভারতে এই প্রামাণ্যচিত্র নিষিদ্ধ করার সমালোচনা করেছে। তবে, নিষিদ্ধ করা সত্ত্বেও এবং বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ার মতো বাধা-বিপত্তির পরেও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তুমুল আগ্রহ নিয়ে এই প্রামাণ্যচিত্র দেখছেন। এই প্রামাণ্যচিত্র দেখানোর পরিকল্পনা করায় জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ডজনখানেক শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ। এটি দেখার সময়ে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দিকে ইট-পাটকেল ছুঁড়েছে ২০-৩০ জনের একটি দল। প্রতিবাদে থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু এতোকিছুর পরেও ফোনে, ল্যাপটপে কিউআর কোড শেয়ার করে এই প্রামাণ্যচিত্র দেখছেন ভারতের তরুণ প্রজন্ম।
গুজরাটের এই গণহত্যার রক্তের দাগ মোদী মুছতে পারেননি। সম্ভবত পারবেনও না। পৃথিবীর ইতিহাসের পথ ফুলে ঢাকা সুকুমার নয়, ইতিহাস সবসময়ই চলেছে রক্তের বন্যা আর মৃতদেহের স্তূপ ডিঙিয়ে। তারপরও শুধু অন্য ধর্মাবলম্বী পরিবারে জন্ম নেওয়ার অপরাধে সহস্রাধিক নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা ও ধর্ষণের সুযোগ করে দেওয়াকে পাশবিক বলারও অবকাশ নেই, কারণ এ কাজের নজির রয়েছে শুধু মানুষের মধ্যেই। মোদির বিচার ঘটনার পর দুই দশক কেটে গেলেও হয়নি, বরং তিনি ক্রমশ ওপরে উঠেছেন। তিনি জানতেন, তাঁর আসন টলানোর ক্ষমতা কোথাও কারো ছিলো না। ভারতের ইতিহাস তাই গেরুয়া কালিতে নিজের মনমতো লিখে চলেছেন আরএসএসের যোগ্য সন্তান নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি।