ইউনিয়নবাসীকে গ্রেপ্তারের হুমকি দেয়া ইউএনওকে প্রত্যাহারের দাবি
স্থানীয় জনমতকে উপেক্ষা করে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার বলাইশিমুলে শতবর্ষী একটি মাঠ রীতিমত দখল করে আশ্রয়ণ কেন্দ্রের ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। এবার আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজনে পুরো ইউনিয়নবাসীকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে হুমকি দিয়েছেন সেখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এদিকে মাঠের শ্রেণি পরিবর্তন করে কান্দা দেখিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে বলে মন্তব্য করেছেন উচ্চ আদালত।
এর আগে, ১২ আগস্ট, শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে চারটার দিকে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার বলাইশিমুল আশ্রয়ণ প্রকল্পের নির্মাণাধীন সাত ও আট নং ঘরে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এর প্রেক্ষিতে পরদিন বিকেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ হুমকি দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদা বেগম।
উল্লেখ্য যে, নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার বলাইশিমুল এলাকার শত বছরের পুরোনো একটি খেলার মাঠে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় প্রথমে মাঠ জুড়ে ১০০ টি ঘর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরে এলাকাবাসী এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার দাবি জানান। এলাকাবাসীর সম্পূর্ণ দাবি না মেনে স্থানীয় প্রশাসন সেখানে ২৩টি ঘর নির্মাণ কাজ শুরু করে। এতে এলাকাবাসী নির্মাণকাজে বাঁধা দেয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। সেসময় নির্মাণ কাজ বন্ধ না হওয়ায় স্থানীয় হাবিবুর রহমান মণ্ডলসহ আটজন বাদী হয়ে ৩০ মে জেলা প্রশাসক, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউএনও, সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) আসামি করে আদালতে একটি মামলা করেন।
মাঠ দখল করে নির্মানাধীন আশ্রয়ণ প্রকল্প; ছবি: আবুল কালাম আজাদ
মাঠ রক্ষার দাবিতে এই মামলাটি বিচারাধীন অবস্থায় থাকলেও স্থানীয় প্রশাসন পুলিশি পাহাড়ায় নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখে। পরবর্তীতে ২ জুন রাতের আঁধারে দুটি নির্মাণাধীন ঘরের গাঁথুনি অজ্ঞাতনাম ব্যক্তিরা ভেঙে দেন। পরদিন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী কাজী মাজহারুল ইসলাম বাদী হয়ে ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় বলাইশিমুল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবর তালুকদার ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য হায়দার আলী তালুকদারকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে তারা জামিনে আছেন।
এলাকাবাসীর দাবি, বলাইশিমুল মাঠটি ওই এলাকার একমাত্র খেলার মাঠ। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে এলাকার মানুষ মাঠটিকে খেলা ও বিভিন্ন সামাজিক–সাংস্কৃতিক আয়োজনের স্থান হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। মাঠের ভেতর আশ্রয়ণ প্রকল্পের কারণে এলাকার তরুণদের খেলাধুলার পরিবেশ ও সাংস্কৃতির পরিবেশ হুমকির মুখে পড়বে।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘর নির্মাণ হলেও মাঠের কোন ক্ষতি হবে না বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। সংবাদ সম্মেলনে বলাইশিমুল খেলার মাঠের ৭৬ শতাংশ ভূমি উদ্ধারের দাবি করে মাহমুদা বেগম জানান, বর্তমানে ঘর সংখ্যা কমিয়ে এখানে ১২টি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। বাকি ১১টি ঘর অন্য জায়গায় করা হবে। সরকারের এই উদ্যোগকে যারা নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম চলছে বলে যোগ করেন তিনি।
উল্লেখ্য যে, এই্ ঘটনায় বলাইশিমুল মাঠরক্ষা গণকমিটির আহ্বায়ক আবুল কালাম আল আজাদ, আবদুল আওয়াল মাস্টার, মামুনুর কবীর খান হলি সহ ৬২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এদিকে অনুমতি ছাড়া সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য ফেসবুকে প্রচার করার কারণে মো: হুমায়ুন কবির নামে স্থানীয় এক সাংবাদিকের নামে মামলার হুমকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে মাহমুদা বেগমের বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ইউএনও মাহমুদা বেগম দৃকনিউজকে জানান, সেই সাংবাদিক শুরু থেকে তাকে বিব্রত করার চেষ্টা করে আসছেন এবং আংশিকভাবে তার বক্তব্য ফেসবুকে উপস্থাপন করেছেন। বিব্রত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখলে সেই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলেও দৃক নিউজকে জানিয়েছেন তিনি।
কেন্দুয়া প্রেসক্লাবের সদস্য ও সংবাদ পত্রিকার কেন্দুয়া প্রতিনিধি হুমায়ুন কবির জানান, পেশাগত দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সম্পূর্ণ বক্তব্যই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছেড়েছেন। পরে সন্ধ্যায় তার মুঠোফোনে কল দিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার হুমকি দেন মাহমুদা বেগম। এ বিষয়ে কেন্দুয়া প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে নিন্দা জানানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
মাঠ দখল করে নির্মানাধীন আশ্রয়ণ প্রকল্প; ছবি: আবুল কালাম আজাদ
এদিকে ১৪ আগস্ট পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বলাইশিমূল মাঠে নির্মাণকাজের ওপর তিনমাসের নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলেছেন, মাঠে কোন আশ্রয়ণ প্রকল্প করা যাবে না। আদালত মাঠের জায়গা শ্রেণি পরিবর্তন কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা ৬০ দিনের মধ্যে বাহক মারফত আদালতকে অবহিত করতে জেলা প্রশাসকের প্রতি নির্দেশ জারি করেছেন। আদালত মন্তব্য করে বলেন যে, নিন্ম আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় মাঠের শ্রেণি পরিবর্তন ক্ষমতার অপব্যবহার।
মাঠের শ্রেণি পরিবর্তনের প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দৃকনিউজকে বলেন, ‘মামলা চলাকালীন রায়কে নিজের পক্ষে নেয়া যায় এমন কোন পরিবর্তন মামলার বিষয়বস্তুতে আনা যাবে না। বলাইশিমুলের মামলার রায়কে নিজেদের পক্ষে আনার জন্য শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে এবং সেটা জেলা জজ আদালতের রায়ে স্পষ্ট। আলাদাতের বক্তব্য অনুযায়ীই এলাকাবাসীর দাবি স্বীকৃত সত্য কিন্তু মামলা দায়ের করার পরে এটিকে কান্দায় পরিণত করা হয়েছে। এই শ্রেণি পরিবর্তন করাটা বেআইনি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার’।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে মামলা দেয়া এবং সাংবাদিককে হুমকি দেয়ার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হচ্ছে যে, মাঠ রক্ষার আন্দোলনকে ধামাচাপা দিয়ে মাঠের মধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্প বিরোধিতা করার কারণে এলাকাবাসীর আন্দোলনকে দমন করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসব মামলা দিয়েছেন বা করিয়েছেন।
এদিকে সাংবাদিককে মামলায় জড়ানোর হুমকি দেয়ার ঘটনায় সামাজিক গণমাধ্যমে তোলপাড় তৈরি হলে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ কেন্দুয়ার ইউএনওকে ডেকে সতর্ক করেছেন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী তিনি বলেছেন, “ইউএনওর এসব কথা বলা ঠিক হয়নি। আর তিনি এ ধরনের কথা বলতেও পারেন না। বিষয়টি এরই মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে”।
এই বিষয়ে আন্দোলনকারীদের সাথে যোগাযোগ করা হলে দৃকনিউজকে তারা জানান, বলেছেন ইউএনও শুরু থেকেই স্বেচ্ছাচারী কায়দায় স্থানীয় জনমতের তোয়াক্কা না করে মাঠের জায়গায় আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘরবাড়ি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সঙ্গতকারণেই এলাকাবাসী এই ঘটনায় ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। কঠোর পাহারায় থাকা নির্মাণাধীন আশ্রয়ণ প্রকল্পে আগুন লাগানো বা অন্য কোন তৎপরতাগুলোকেও তারা ষড়যন্ত্রমূলক আখ্যা দিয়ে বলেছেন, মাঠ রক্ষায় আন্দোলকারীদের বিপদে ফেলবার জন্যই যে এই ঘটনাগুলো ঘটানো হয়েছে, সেটা ইউএনওর হুমকি থেকেই পরিস্কার হয়।
এসব ঘটনায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদা বেগমকে প্রত্যাহার ও বিভাগীয় তদন্ত এবং শাস্তি দাবি করে বলাইশিমুল মাঠরক্ষা গণকমিটির আহ্বায়ক আবুল কালাম আল আজাদ জানান, বিগত কয়েকমাস ধরে বলাইশিমুল ইউনিয়নবাসীর ওপর নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। আমরা এই নিপীড়নের অবসান ও নিপীড়নকারীর শাস্তি চাই। তিনি আরও বলেন, বলাইশিমূল মাঠটিকে রক্ষা করতে হবে, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে। একই সাথে দেশের সকল মাঠ রক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট আইন করারও দাবি জানান তিনি।