বৃহঃস্পতিবার ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১ Thursday 21st November 2024

বৃহঃস্পতিবার ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

Thursday 21st November 2024

বহুস্বর মতামত

বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তি-বিরূপতার উৎস কী? উপশম কীসে?

২০২২-০৮-০৬

আহমেদ শামীম

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি ও দুবাইভিত্তিক একটি ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে এসেছে বাংলাদেশ জ্ঞানসূচকে বিশ্বের তলানিতে এবং এশিয়ায় সবচেয়ে নিচে। বাংলাদেশের জনগণের ৯৮ শতাংশ বাঙালি। ফলে বৈশ্বিক জ্ঞানসূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের দায় প্রধানত বাঙালির উপর বর্তায়। এই বাঙালি ভাষা বা নৃতত্ত্ব বিচারে বাঙালি নয়, বরং একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী: বাংলাদেশী বাঙালি। বৈশ্বিক জ্ঞানসূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের প্রেক্ষিতে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে, বাংলাদেশের বাঙালি কি বুদ্ধিবৃত্তিবাদের প্রতি বিরূপ?  

 

 

বৈশ্বিক জ্ঞানসূচকে দেশের অবস্থানের সাম্প্রতিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে উপরের ওই প্রশ্নটি তোলার কারণ, জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিবাদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য, সংজ্ঞাগত। আহমদ ছফার প্রবন্ধ “বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস”-এ জ্ঞানের সাপেক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিবাদের সংজ্ঞার একটা ধারণা পাওয়া যায়: আবেগের পরিবর্তে জ্ঞানের আগুন বুকে জ্বালিয়ে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিতে পরিশীলন আনা, চিন্তাবৃত্তির উন্নতি সাধন করার মত ও পন্থা হলো বুদ্ধিবৃত্তিবাদ কিংবা ইন্টেলেকচুয়ালিজম। মানব মনের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুষদ মানুষকে সে পথেই পরিচালিত করে। 

 

 

কিন্তু মানব মনেই আবার এমনসব ভাব ও ভঙ্গি থাকে যা মানুষকে সেই পথে চলতে বাধা দেয়। সমাজে এমন সব স্বার্থান্বেষী মহল আছে যারা মানুষের সেসকল মনোভঙ্গি ও ভাবধারাকে একটি মত ও পন্থায় পরিণত করে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করে। “মার্কিন জীবনে বুদ্ধিবৃত্তি-বিরূপতাবাদ” গ্রন্থের রচয়িতা রিচার্ড হফস্টাডার এই মত ও পন্থাকে বলেছেন “বুদ্ধিবৃত্তি-বিরূপতাবাদ”। সেই পরিভাষায় আমাদের প্রশ্নটির পরিমার্জিত রূপ হচ্ছে বাঙালি কি বুদ্ধিবৃত্তি-বিরূপতাবাদী কিংবা এন্টি-ইন্টেলেকচুয়াল? 

 

 

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নিবিড় গবেষণার প্রয়োজন আছে, তবে আপাত দৃষ্টি ব্যবহার করে যে অনুসিদ্ধান্তে সহজেই আসা যায় তাহলো, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের বাঙালিদের সবচেয়ে বড় অংশ বুদ্ধিবৃত্তি-বিরূপতাবাদী। এখানে বলা প্রয়োজন যে, সমাজ ও রাষ্ট্রে বুদ্ধিমত্তার আদর আছে। প্রশ্ন তা নিয়ে নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, সেখানে বুদ্ধিবৃত্তির আদর আছে কি না? বুদ্ধিমত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তি দুইটা দুই জিনিস।

 

 

হফস্টাডার বুদ্ধিমত্তা আর বুদ্ধিবৃত্তির পার্থক্য করেন এভাবে: ‘বুদ্ধিমত্তা (ইন্টেলিজেন্স) হলো মনের উৎকৃষ্ট নৈপুণ্য যা নিয়োজিত হয় মোটামুটি সংকীর্ণ, আসন্ন এবং অনুমানযোগ্য সীমার ভেতরে। এটা কার্যসিদ্ধিমূলক, সমন্বয়যোগ্য, এবং অব্যর্থভাবে ব্যবহারিক গুণ।’ আর বুদ্ধিবৃত্তি (ইন্টেলেক্ট) হলো, ‘মানব মনের ক্রিটিক্যাল, সৃজনশীল এবং ধ্যানী দিক।’ 

 

 

হফস্টাডার বুদ্ধিমত্তা আর বুদ্ধিবৃত্তির পার্থক্য করেন এভাবে: ‘বুদ্ধিমত্তা (ইন্টেলিজেন্স) হলো মনের উৎকৃষ্ট নৈপুণ্য যা নিয়োজিত হয় মোটামুটি সংকীর্ণ, আসন্ন এবং অনুমানযোগ্য সীমার ভেতরে। এটা কার্যসিদ্ধিমূলক, সমন্বয়যোগ্য, এবং অব্যর্থভাবে ব্যবহারিক গুণ।’ আর বুদ্ধিবৃত্তি (ইন্টেলেক্ট) হলো, ‘মানব মনের ক্রিটিক্যাল, সৃজনশীল এবং ধ্যানী দিক।’  

 

 

মার্কিন জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরূপতার সুলুক সন্ধান করতে গিয়ে বিচারে রিচার্ড হফস্টাডার দেখিয়েছিলেন, বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরূপতা জাতীয় সমস্যা আকারে দেখা যায় পঞ্চাশের দশকে

 

 

মোটাদাগে বলা যায়, বুদ্ধিমত্তার কাজ চৌকসভাবে সুনিপুণ কার্যসাধন আর বুদ্ধিবৃত্তির কাজ মূল্যায়ন ও তত্ত্বসৃজন। বুদ্ধিমত্তা বিদ্যমান আইডিয়াসমূহকে ভিত্তি করে কাজ করে, বুদ্ধিবৃত্তি নতুন সব আইডিয়া নিয়ে আসে। এই পার্থক্য মাথায় রেখে আমাদের অনুসিদ্ধান্তকে বিচার করতে হবে।  

 

 

আমাদের জনমনোভাবে বুদ্ধিবৃত্তি-বিরূপতাবাদের সংজ্ঞা, উপসর্গগুলো ও উৎস বর্ণনার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের অনুসিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্ত যোগাড় করতে পারি।

 

 

বুদ্ধিবৃত্তিবাদ বিরোধিতার একটি সাধারণ প্রকাশ হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে অর্জিত নতুন নতুন জ্ঞান যখন অনুভূতি, বিশ্বাস, সংস্কার ইত্যাদির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তখন বুদ্ধিবৃত্তীয় অনুসন্ধানের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা। বুদ্ধিবৃত্তিবাদ বিরোধিতার আরেকটি প্রকাশ হলো বুদ্ধিজীবী-বিরূপতা বা বুদ্ধিজীবী তথা যারা মানব মনের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানের পথে আলো জ্বেলে যায়, তাদের প্রতি আগাম অবিশ্বাস, অসন্তোষ আর বিরক্তি। এই দুইটি প্রকাশ কোনো জাতিতে প্রকট হয় এবং সর্বজনের উপর আধিপত্য বিস্তার করে, তখন সেই জাতিকে বুদ্ধিবৃত্তি-বিরূপতাবাদী বলা যায়।

 

 

আহমদ ছফা তার বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস গ্রন্থে একভাবে বাঙালিকে বুদ্ধিবৃত্তি-বিরূপতাবাদী বলেই ইঙ্গিত করেছেন।   

 

 

বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরূপতা সমাজের সমান পুরোনো। কিন্তু কখনও-সখনও সেটা জাতীয় সমস্যা আকারে হাজির হয়। এই বিরূপতার মহামারী আকার ধারণ করে জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ সব রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতাদর্শের চাষাবাদ এবং তা থেকে উৎসাহিত নীতি গ্রহণ ও প্রকল্প বাস্তবায়নের ঐতিহাসিক ফল হিসেবে। বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি অনাদর, অবহেলা আর বুদ্ধিবৃত্তিবাদ বিরূপতার বীজ আসলে বিদ্যালয়েই বপিত হয়। বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম খতিয়ে দেখলে দেখা যায় ভক্তিবাদী রচনায় সয়লাব। ধর্ম ও জাতি সংক্রান্ত যতসব গর্বগাঁথা। শিশুদের প্রশ্নে উৎসাহিত করার চেয়ে ভক্তিরসে সিক্ত হবার শিক্ষা দেওয়া হয়। উত্তম নাগরিক হওয়ার প্রশিক্ষণ শুরু হয় সেই শিশুকাল থেকেই।  

 

 

বিদ্যালয় যেন শিশুকে রাষ্ট্রভীরু ধর্মভীরু বানানোর এলাহি আয়োজন। এই যেমন, বৈশ্বিক জ্ঞানসূচকে উপরের দিকে থাকা আমেরিকায়ও রাজ্যস্তরে কিছু সংসদে প্রস্তাব তোলা হয় বিবর্তনবাদ স্কুলের পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেয়ার। আবার জাতীয়স্তরেও দেখা যায় বিজ্ঞান চোখে ঠুলি পড়িয়ে তাকে সোজা পণ্য-প্রযুক্তির উদ্ভাবনে চালিত করার পাঁয়তারা আছে উচ্চ ও উচ্চতর বিদ্যালয়গুলোতে। কিন্তু সে দেশে আবার এই সব বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরোধী প্রকল্পসমূহকে প্রতিরোধ করার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিবাদী তৎপরতারও অভাব নেই।  

 

 

এদিকে বৈশ্বিক জ্ঞানসূচকে তলানিতে পড়ে যাওয়া বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে জ্ঞান অর্জনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহারিক দিকগুলো শিশুদের জন্য বিজ্ঞান প্রকল্পের মাধ্যমে শেখানো হয় কীনা সন্দেহ। বিবর্তনবাদ পড়ানো হবে কী, হবে না এ নিয়ে  টানা হেঁচড়া হয়েছে বহুকাল। বাংলাদেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তভাবনার, গবেষণার, উদ্ভাবনের কতটুকু পরিবেশ আছে তাও একটি গভীর গবেষণার বিষয়। কিন্তু সব চেয়ে পরিতাপের বিষয় এই বিপরীতে বুদ্ধিবৃত্তিবাদী তৎপরতাকে ছত্রভঙ্গ করা হয়েছে জাতীয়ভাবে। ছফার ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ প্রবন্ধটির মূল ফোকাস রাষ্ট্র কর্তৃক বুদ্ধিবৃত্তিবাদী তৎপরতাকে ছত্রভঙ্গের প্রশ্ন নিয়ে। অথচ সেই প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ বাঙালি পাঠকের পাঠে কেবল বুদ্ধিজীবীর সমালোচনার শোরগোলের মধ্যে হারিয়ে যায়।  

 

 

আহমদ ছফা তার বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস গ্রন্থে একভাবে বাঙালিকে বুদ্ধিবৃত্তি-বিরূপতাবাদী বলেই ইঙ্গিত করেছেন

 

 

আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি-বিমুখতার কারণ আহমদ ছফার দুটি বাক্য থেকে অনুমান করা যায়: “বস্তুত আমাদের মন-মানসে বর্তমানে দুই ধরণের অন্ধতা বর্তমান। একটি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কর্তৃক আরোপিত অন্ধতা, অন্যটা স্বেচ্ছা অন্ধতা।” এখন প্রশ্ন, পাকিস্তান-উত্তর বাংলাদেশে এই স্বেচ্ছা অন্ধতার বাম্পার উৎপাদন কী করে হলো? এই বাঙালি শাসকগোষ্ঠীর অবদান কতটুকু? তা জানতে বাংলাদেশের সৃষ্টির শুরু থেকে যে পাবলিক পলিসিগুলো বুদ্ধিবৃত্তির বিরুদ্ধে এর জনগণকে জাগিয়ে তুলেছে তার একটি জরিপের দরকার আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মেনিফেস্টোতে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভাষণগুলোতে কোথায় কোথায় বুদ্ধিবৃত্তি-বিরূপতার উস্কানি আছে তা দাগাতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের পথে প্রতিবন্ধক জাতীয় বাজেটগুলোর পর্যালোচনা আবশ্যক। কোন ভাব কোন আবেগের চাষ করে জাতিকে একদেশদর্শী করা হলো? এসবের অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা প্রয়োজন। কেননা কোনও জাতির জনমানসে উপস্থিত বুদ্ধিবৃত্তি বিরোধিতা জিনগত নয়, বরং সেই জাতিগঠন ও রাষ্ট্রগঠনের বিশেষ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রথিত। বুদ্ধিজীবী-বিরূপতা নামক আগাছার গোড়াও একই জায়গায় গাঁথা। 

 

 

বাঙালির বুদ্ধিজীবী-বিরূপতা অবশ্য বিভিন্ন পথে পুষ্ট হয়েছে। এটা স্বীকার্য যে, এই বিরূপ মনোভাব অংশত বুদ্ধিজীবীরা অর্জন করেন তাদের মোসাহেবী, তাদের নীরবতা এবং তাদের বিচ্ছিন্নতা দিয়ে। তাই নানান মাধ্যমে বুদ্ধিজীবি-বিরূপতা আমরা ব্যক্ত হতে দেখি। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লার কবিতায় দেখি, ‘বুদ্ধিজীবীর রক্তে স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ’।

 

 

সামাজিক মাধ্যমে বুদ্ধিজীবীর বদলে ‘বুদ্ধিবেশ্যা’, ‘বুদ্ধিবীচি’ ইত্যাদি শব্দের বহুল ব্যবহার দেখে বোঝা যায় পেশাটির প্রতি বাঙালি নেটিজেনদের মনোভাব। এই মনোভাবের কারণ, বুদ্ধিজীবীর কাছে সমাজ আশা করে তারা ক্ষমতার মোসাহেব না সমালোচক হবেন, নীরব নয় সোচ্চার থাকবেন, জন-বিচ্ছিন্ন নয় জন-সংলগ্ন থাকবেন। কেননা, বুদ্ধিজীবির কর্তব্য হলো, আহমদ ছফার মতে, সমাজের ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, উচিত-অনুচিতের মধ্যকার প্রভেদ দাগিয়ে যাওয়া।  

 

 

সামাজিক মাধ্যমে বুদ্ধিজীবীর বদলে ‘বুদ্ধিবেশ্যা’, ‘বুদ্ধিবীচি’ ইত্যাদি শব্দের বহুল ব্যবহার দেখে বোঝা যায় পেশাটির প্রতি বাঙালি নেটিজেনদের মনোভাব। এই মনোভাবের কারণ, বুদ্ধিজীবীর কাছে সমাজ আশা করে তারা ক্ষমতার মোসাহেব না সমালোচক হবেন, নীরব নয় সোচ্চার থাকবেন, জন-বিচ্ছিন্ন নয় জন-সংলগ্ন থাকবেন। কেননা, বুদ্ধিজীবির কর্তব্য হলো, আহমদ ছফার মতে, সমাজের ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, উচিত-অনুচিতের মধ্যকার প্রভেদ দাগিয়ে যাওয়া।  

 

 

এখন বাংলার বুদ্ধিজীবীদের বেশির ভাগই যদি সেই কর্তব্য কিছুদূর পালন করে, জনমনে একটা আস্থার অবস্থান করে নিয়ে, পরে ক্ষমতাবলয় থেকে সুবিধা নিয়ে জনগণকে দিশা দেওয়ার নামে ধোঁকা দিতে থাকেন, তাহলে জনমনে বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীটির প্রতি বিরূপতা তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ছফার একটি কথায় আবারো জোর দিতে চাই, বুদ্ধিজীবী-বিরূপতার মূল উৎস এখানে নয়। সমাজের ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, উচিত-অনুচিতের মধ্যকার প্রভেদ দাগানোর কাজটা বুদ্ধিজীবিদের জন্য তৎকালীন পাকিস্তান এবং সমকালীন বাংলাদেশ কত কঠিন করে তুলেছে তার বয়ানও ছফা রেখেছেন। সাম-দান-দণ্ড-ভেদ প্রমুখ সকল কৌশল অবলম্বন করে বুদ্ধিজীবীদের একদিকে জনবিচ্ছিন্ন করা হয়েছে এবং অন্যদিকে জনগণের অশিক্ষা কুশিক্ষাকে কেবল আশকারা দেওয়া নয়, প্রাতিষ্ঠানিক করার দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশে এখনও তা চলছে।   

 

 

 ২. 

বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে অনুপম কোনও উদাহরণ না। খুঁজলে সকল রাষ্ট্রেই এই সমস্ত প্রকল্পসমূহের সন্ধান পাওয়া যাবে। এই লেখায় আমরা আমেরিকার উদাহরণ দেব দুটি কারণে: এক, আমেরিকান সমাজে বুদ্ধিবৃত্তি-বিরূপতাবাদ যেমন সক্রিয়, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিবাদের প্রতিরোধও তেমন প্রবল। আমেরিকান অভিজ্ঞতা অনুধাবন করলে বুদ্ধিবৃত্তি-বিরূপতাবাদের চরম উদাহরণটি পাওয়া যায়, আবার এর বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামের একটা চিত্রও পাওয়া যায় সে সঙ্গে। ‘আমেরিকান সমাজ বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরূপ’- এমন দাবি গত পাঁচ-ছয় দশক ধরে উচ্চারিত হয়ে আসছে। বর্তমানে সেই বিরূপতা ঐতিহাসিক এক উচ্চতায় পৌঁছেছে। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলের প্রেক্ষিতে কতগুলো প্রশ্ন আলোচনার টেবিলে ঘুরছে।  

 

 

একটি প্রশ্ন যেমন, আমেরিকার সমাজে এই রকম বুদ্ধিজীবী-বিরূপতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরূপতা কী করে অর্জিত হলো? আমেরিকায় সুবিধা না নেওয়া কর্তব্যনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী এবং তাদের গ্রাউন্ড-ব্রেকিং কাজের তো অভাব নেই। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বুদ্ধি উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় হলেও এর স্থানীয় লোকেরা এ বিপুল সংখ্যায় কেন বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরূপ? মার্কিন জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরূপতার সুলুক সন্ধান করতে গিয়ে বিচারে রিচার্ড হফস্টাডার দেখিয়েছিলেন, বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরূপতা জাতীয় সমস্যা আকারে দেখা যায় পঞ্চাশের দশকে।  

 

 

মার্কিন ডানপন্থী সিনেটর ম্যাকার্থি-র নেতৃত্বে পরিচালিত বুদ্ধিজীবী বিরোধী অভিযান ইতিহাসে ম্যাকার্থিবাদ নামে পরিচিতি পেয়েছে

 

পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে আমেরিকান সরকার রাষ্ট্রের সমালোচক বুদ্ধিজীবীদের চরিত্রহননে নামে, যা ইতিহাসে ‘ম্যাকার্থিবাদ’ নামে পরিচিত। এই প্রকল্পের কাজ ছিল জনগণকে ক্রমাগত ভয় দেখানো এই বলে যে, বুদ্ধিজীবীরা তাদের বুদ্ধিভ্রষ্ট করবে। পারিবারিক, ধর্মীয় ও জাতীয় মূল্যবোধ সব চুলায় যাবে সেই বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি নিলে। শাসকশ্রেণী তাদের অধিগত রাষ্ট্রের সকল মাধ্যম ব্যবহার করে উসকে দিলো মানুষের অন্তর্গত ভীতি এবং বিদ্বেষ। তৈরি করল মোসাহেব বুদ্ধিজীবীর দল, যারা শাসক শ্রেণীর পলিসিকেই প্রকারান্তরে জায়েজ করার কাজে তাদের বুদ্ধিকে ব্যবহার করল। এসব মিলিয়ে বুদ্ধিজীবী বর্গটিই পড়ল সন্দেহ আর বিরক্তির যাঁতাকলে। সেই যাঁতাকল আজ অব্দি সচল। বিষয়টা আবার এমনও নয় যে, সকলই সরকার সৃষ্ট। তবে জনগণের ঐতিহাসিক বিশ্বাস, সংস্কার, বিচার ইত্যাদিকে বিভাজনের হাতিয়ার করতে এবং সেই হাতিয়ার ধারালো করতে শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা বরাবরই বিরাজমান। হফস্টাডারের বিশ্লেষণে আমরা পাই, আমেরিকার বুদ্ধিবাদ-বিরূপতা রাষ্ট্র-প্রযোজিত। এই বিষবৃক্ষের চাষাবাদ হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক প্রতিনিধিত্ববাদী রাজনীতির মধ্যে।    

 

 

৩.  

পঞ্চাশের দশক না হয় অনেক আগের কথা। আমেরিকা না হয় অনেক দূর। আমাদের পাশের দেশ আজকের ভারতের কথাই ধরা যাক। রামচন্দ্র গুহ ২০১৭ সনে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় মার্কিন ও ভারতীয় জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরূপতা নামের একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি মার্কিন জীবনের বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরূপতার সঙ্গে ভারতের সাম্প্রতিক বুদ্ধিজীবী-বিরূপতাকে তুলনা করেন এবং হিন্দুত্ববাদকে ম্যাকার্থিবাদের সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মোদী যদি আজকের ট্রাম্প হয়, তাহলে ভারতের আইজেনহাওয়ার-নিক্সন কারা, যারা বুদ্ধিবৃত্তি-বিরূপতার বীজ বপন করেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর বুদ্ধিজীবীদের প্রতি হিন্দুত্ববাদের আক্রমণের ভাষা থেকেও অনেকখানি আঁচ করা যায়। যেমন বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে sickular (সেকুলার যেন অসুস্থ) তথা এন্টি-হিন্দুধর্ম এবং এন্টি-ন্যাশনাল এই দুইটি গালি হিন্দুত্ববাদীদের খুব প্রিয়।  

 

 

এর মাধ্যমে তারা একটি অপ্রিয় সত্যকে তুলে আনেন। সেটা হলো, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ মূলত হিন্দু জাতীয়তাবাদ। এই হিন্দু জাতীয়তাবাদের দুটি প্রধান মুখ আছে – একটি হলো হিন্দু-সংস্কৃতির জাতীয়বাদ অন্যটি হিন্দু-ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ। এই দুই ধরণের জাতীয়তাবাদ কখনো কখনো পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও- আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তারা উভয়ের ভারতীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদের ছাতার তোলে এসে এক হয়। আমেরিকার রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটরা যেমন আমেরিকান এক্সেপশনালিজমের টেবিলে এসে একসঙ্গে পার্টি করে। যে ভাব আর আবেগ দিয়ে ভারতীয়দের পারস্পারিক বৈষম্য ভুলিয়ে ভারতকে সাম্রাজ্য আর সম্প্রসারণবাদী করে তোলা হয়েছে সেই সাতচল্লিশ থেকে, সেই ভাব-আবেগে আপ্লুত জাতিতে করিৎকর্মাদের কদর বজায় থাকলেও ক্রিটিক্যাল থিংকারদের প্রতি ঘৃণা বাড়বে- এটা তো অঘটন নয়, বরং যৌক্তিক পরিণতি।  

 

 

৪. 

আমেরিকার জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের পরতে পরতে সহিংসতা। তবু গৃহযুদ্ধের পর সাদাদের মধ্যে একটা ঐক্য প্রক্রিয়া দেখা গিয়েছিলো। সেই ঐক্য আসলে মতাদর্শের ঐক্য নয়, বিভাজন থেকেই গেছে। থেকে থেকে সেই বিভাজন সহিংস হয়ে ওঠে। বিভাজনকে সহিংস করে তোলায় রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থ আছে। তাতে অনুসারীর আর কোনও যাওয়ার জায়গা থাকে না। সমর্থক কার্যত ক্রীতদাসে পর্যবসিত হয়। আমেরিকায় ধর্ম একটি বিভাজনের হাতিয়ার এবং তা খুব চাতুর্যের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়। ধর্মীয় স্বাধীনতা আমেরিকানদের অবিচ্ছেদ্য অধিকারের শীর্ষস্থান দখল করে আছে। ধর্ম যেখানে চিন্তার স্বাধীনতা খর্ব করে, সেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতার অপব্যবহার ধার্মিককে চিন্তা বা বুদ্ধির বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেবে বৈকি। সে কারণে অনেকে মনে করেন চিন্তাবৃত্তির আদি বিরুদ্ধবাদীরা হলো ধর্মের আক্ষরিক অনুসারীবৃন্দ। আমেরিকায় বিজ্ঞানের বহু প্রস্তাব প্রতিহত হয় ধর্মীয় বিশ্বাসের প্ররোচনায়। ফলে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ মাত্রই মনে করেন, ধর্মকে ব্যক্তিগত স্তরে রাখাই সমীচীন। সংগঠনে, প্রতিষ্ঠানে তথা যাবতীয় জনপরিসরে পলিসি তৈরির ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যবহার আবশ্যিকভাবে পরিহার্য। কিন্তু এই কথায় ফল হয় উল্টো, বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরূপতার চাষাবাদ আরও চড়িয়ে দেওয়া হয়। আমেরিকান রাজনীতিতে সেই চর্চা খুব প্রকটভাবেই আছে।   

 

 

বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরূপতার আরেক পৃষ্ঠপোষক হলো প্রায়োগিকতাবাদ যা রাষ্ট্রেরও খুব পছন্দ। পরিশ্রমী শ্রমিক, বাধ্যগত নাগরিক, ব্যবহারিকতায় বন্দি অনুসারীদেরকে আদর্শ উদাহরণে পরিণত করা প্রায়োগিকতাবাদের প্রথম কথা। সমাজে যা কাজ বলে পরিচিত তা মূলত পয়সা-প্রদায়ী পেশাগত কাজ: হয় চাকুরী, নয় ব্যবসা। চরিত্রের বড়গুণ হিসেবে দেখানো হয়, স্পার্টান সামরিক মতবাদ ‘কথা নয় কাজ।’ এই মন্ত্রে মোহিত পিতামাতাও চান তাদের সন্তান ‘কাজে বড় হোক’, এথেনীয় পাড়াগাঁওয়ের ভাঁড় না হোক। কিন্তু এই আপাত সদিচ্ছার পেছনে আছে সবাইকে লাইনে রাখার পাঁয়তারা- প্রোডাকশন লাইন চালু রাখার চাতুরী। 

 

 

আজকের আমেরিকার আমাজনের ওয়্যারহাউজের কর্মীর কথাই ভাবুন, প্রস্রাব করার সময় যে পায় না ঠিকঠাক, আবার চিন্তা করার সময়! এই চিন্তার অভাব নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় যখন সেই কর্মীই আমাজনকে ভাঙতে চাওয়া রাজনীতিকের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। ঘরে বসে দুই দিনে পণ্য হাতে পাওয়ার একরৈখিক  চিন্তাওয়ালা শ্রেণিও সেই বিরোধিতায় যোগ দেয়। তাইতো আমেরিকার অনেক বুদ্ধিজীবী বিগ কর্পোরেশন ভেঙে দেওয়ার কথা বলে জনতার একটা বড় অংশের বিরূপতার সামনে পড়ে।

 

 

অন্যদিকে অবসর হলো চিন্তার আঁতুড়ঘর। অবসর কেড়ে নেওয়ার মানে মানুষের চিন্তাশক্তি কেড়ে নেয়া। আজকের আমেরিকার আমাজনের ওয়্যারহাউজের কর্মীর কথাই ভাবুন, প্রস্রাব করার সময় যে পায় না ঠিকঠাক, আবার চিন্তা করার সময়! এই চিন্তার অভাব নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় যখন সেই কর্মীই আমাজনকে ভাঙতে চাওয়া রাজনীতিকের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। ঘরে বসে দুই দিনে পণ্য হাতে পাওয়ার একরৈখিক  চিন্তাওয়ালা শ্রেণিও সেই বিরোধিতায় যোগ দেয়। তাইতো আমেরিকার অনেক বুদ্ধিজীবী বিগ কর্পোরেশন ভেঙে দেওয়ার কথা বলে জনতার একটা বড় অংশের বিরূপতার সামনে পড়ে।

 

 

সেই সঙ্গে মালিক ও শাসকশ্রেণি এই বুদ্ধিজীবীদের চরিত্রহননে সর্বশক্তি নিয়োগ করে সেই বিরূপতাকে সহিংস করে তুলতে।  

 

  

৫. 

আমেরিকায় বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরূপতার ব্যক্তি পর্যায়ে আরেকটি ভ্রান্তিবিলাসের পেছনে লুকিয়ে থাকে, সেটা হলো ব্যক্তি স্বাধীনতার বোধ। গড়-আমেরিকানের ধারণা তার যাবতীয় কিছু বাছাইয়ের স্বাধীনতা আছে। আসলেই কি আছে? তা যাচাইয়ের জন্য অবসর তার নাই, উদ্দীপনাও নাই। এই উদ্দীপনা জোগানোর কাজটা বুদ্ধিজীবীর। যার চিন্তার অবসর নাই তাকে চিন্তা করতে উদ্দীপ্ত করা প্রকারন্তরে তাকে বিরক্ত করাই। তাছাড়া বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে দশকের পর দশক ধরে ‘রুটি আর সার্কাস’-এর ভোক্তা জনগণের চিন্তাবুদ্ধির ফারাকটাও একটা বাস্তবতা। বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরূপ জনতা বুদ্ধি-সম্পদের এই বৈষম্য সম্পর্কে ওয়াকেফহাল। আর এই জানাটাও বুদ্ধিজীবী-বিদ্বেষে উৎসাহ দেয়। অন্যদিকে এও সত্য যে, বুদ্ধিজীবীর সবচেয়ে বড় শত্রু তার বুদ্ধিমান বন্ধু। বুদ্ধিজীবী সচারচর মধ্যবিত্ত থেকে আসে।

 

 

একজন মধ্যবিত্ত সফল চাকুরীজীবী কিংবা সফল ব্যবসায়ী অর্থনৈতিক শ্রেণি বিচারে অভিজাতদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না; কারণ সেও সে রকম অভিজাত হতে চায়, বা হবার পথে আছে। বুদ্ধিবৃত্তিক অভিজাতদের প্রতি তার যত বিদ্বেষ। তার বৈষয়িক অর্জন বুদ্ধিবৃত্তিক অভিজাতদের কাছে উদযাপনযোগ্য নয় এটা তাকে পোড়ায়। এ জন্য বুদ্ধিজীবী-বিরূপতা সচ্ছল মধ্যবিত্তেই সবচেয়ে উচ্চকিত।    

 

 

একজন মধ্যবিত্ত সফল চাকুরীজীবী কিংবা সফল ব্যবসায়ী অর্থনৈতিক শ্রেণি বিচারে অভিজাতদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না; কারণ সেও সে রকম অভিজাত হতে চায়, বা হবার পথে আছে। বুদ্ধিবৃত্তিক অভিজাতদের প্রতি তার যত বিদ্বেষ। তার বৈষয়িক অর্জন বুদ্ধিবৃত্তিক অভিজাতদের কাছে উদযাপনযোগ্য নয় এটা তাকে পোড়ায়। এ জন্য বুদ্ধিজীবী-বিরূপতা সচ্ছল মধ্যবিত্তেই সবচেয়ে উচ্চকিত।    

 

 

আবার, গণতন্ত্রও এক নাম যার রকম ফের আছে। আমেরিকার গণতন্ত্রে একটি ছোট অঙ্গরাজ্যের ভোটারের দাম বড় অঙ্গরাজ্যের এক ভোটারের ষোলোগুণ। এটা ইলেক্টোরাল কলেজ সিস্টেমের একটা বাজে ফল। ছোট অঙ্গরাজ্যগুলো যাতে বড় অঙ্গরাজ্যের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের একতরফা চাপে না পড়ে, তাই ইলেক্টর সিস্টেম দিয়ে ভারসাম্য তৈরি করতে চেয়েছিলেন আমেরিকার আদি রাজনীতিবিদেরা। সেকারণেই ট্রাম্প পপুলার ভোটে না জিতেও, ঐ ইলেক্টোরাল কলেজ সিস্টেমের বদৌলতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছিলেন। বড় অঙ্গরাজ্যের ১৫ জন বুদ্ধিবৃত্তিবাদী ভোটারের চেয়ে ছোট অঙ্গরাজ্যের একজন বুদ্ধিবৃত্তিবাদী-বিরোধী ভোটার জাতীয় সরকার গঠনে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন এই বন্দোবস্তে। এই সমস্যা সমাধানের আলাপ তেমন জোরালো নয়, কেননা এই ব্যবস্থা দেশটির জাতির পিতারা করে গেছেন। প্রত্যেক জাতিই তার পিতা বা পিতাদের ব্যাপারে বিহ্বল থাকে। জাতির পিতাদের যুক্তি-বুদ্ধি যেন অকাট্য। আমেরিকার রাজনৈতিক আলাপে এটা প্রবাদতূল্য। পিতারা বলে গেছেন ধর্মের স্বাধীনতার কথা,  বন্দুক রাখার স্বাধীনতার কথা। কোন প্রেক্ষিতে বলে গেছেন তার বিচার করার মতো বুদ্ধি যাতে না হয় আজকের পিতৃব্যরা সেই ব্যবস্থাই করেন। আধুনিক বিশ্বে এসব পিতৃ প্রদত্ত বাক্য কতটা অযৌক্তিক এবং সর্বজনীন স্বার্থ বিরোধী, তা জানার বুদ্ধিবৃত্তি আমেরিকান সমাজে অপ্রতুল।  

 

 

আদিবাসী থেকে দেশ লুটের জন্য বন্দুক দরকার হয়েছিল, নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ির জন্য বন্দুক দরকার হয়েছিলো। তাছাড়া, সরকার একনায়ক হলে তার বিরুদ্ধে বন্দুক তোলার বিপ্লবী মন্ত্র তখনই কার্যকর ছিল যখন দুই পক্ষের হাতেই ছিল গাদা বন্দুক আর গাব্দা কামান। এখন ব্যক্তিগত বন্দুক হচ্ছে অন্যপক্ষকে ভয় দেখানোর আর দাবিয়ে রাখার হাতিয়ার। সেখানে সাদারা যেভাবে ‘ওপেন ক্যারি’ অধিকার ফলায়, তা অন্য বর্ণের লোক করলে নির্ঘাত মারা পড়বে পুলিশের হাতে।

 

 

অস্ত্র রাখার অধিকারের পক্ষে মার্কিন বিধায়করা কথার তুবড়ি ফুটিয়ে চাপা দেন যে, আদিবাসী থেকে দেশ লুটের জন্য বন্দুক দরকার হয়েছিল, নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ির জন্য বন্দুক দরকার হয়েছিলো। তাছাড়া, সরকার একনায়ক হলে তার বিরুদ্ধে বন্দুক তোলার বিপ্লবী মন্ত্র তখনই কার্যকর ছিল যখন দুই পক্ষের হাতেই ছিল গাদা বন্দুক আর গাব্দা কামান। এখন ব্যক্তিগত বন্দুক হচ্ছে অন্যপক্ষকে ভয় দেখানোর আর দাবিয়ে রাখার হাতিয়ার। সেখানে সাদারা যেভাবে ‘ওপেন ক্যারি’ অধিকার ফলায়, তা অন্য বর্ণের লোক করলে নির্ঘাত মারা পড়বে পুলিশের হাতে।

 

 

আবার, ইউরোপের ধর্মীয় নিপীড়নের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমেরিকাকে ধর্ম পালনের ইউটোপিয়া করার জন্য ধর্ম বিষয়ক আইন সবার উপরে লিখিত হয়েছিলো। খ্রিষ্টান ধর্ম পালনের যে স্বাধীনতা এখানে আছে, তা ইসলাম ধর্মের ভাগ্যে জুটবে না। এসব আলোচনা চাপা দেয়ার জন্য আজকের ইভাঞ্জেলিস্টরা, ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়নিস্টরা এবং তাদের পকেটে যাওয়া জনপ্রতিনিধিরা যে বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরোধিতার চাষাবাদ করবে সে কথা বলাই বাহুল্য। 

 

 

৬. 

আমেরিকার বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরোধিতার মধ্যে বামপন্থা-বিরোধিতার একটা ছাপ আছে ঐতিহাসিক কারণে। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটা বড় অংশ বামপন্থার সঙ্গে জড়িত, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। কিন্তু বামপন্থীদের মধ্যেও বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরূপতা অলক্ষণীয় নয়। আসলে, এক বইয়ের ভিতর সবকিছুর সমাধান খুঁজে পাওয়া যেকোনো গোষ্ঠীর মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরোধিতা জেগে উঠতে বাধ্য, সেই বই বাইবেলই হোক আর কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টোই হোক। কি বামপন্থী কি ডানপন্থী, যে গোষ্ঠী বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরোধিতার ধারক হয়ে ওঠে তাদের ব্যবচ্ছেদ করলে পাওয়া যায় আপন আপন মসিহার বুদ্ধিবৃত্তি সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ। শ্রেষ্ঠ বললেও না হয় এ যাবতকাল পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ বলে মানা যায়, না মানলে শ্রেষ্ঠতার লড়াইয়ে অন্তত নামা যায়, কিন্তু সর্বশেষ বললে তো আর আলোচনার পথই থাকে না।  

 

 

এরা নিজেরা বুদ্ধিজীবী– অভিধা বঞ্চিত বুদ্ধিজীবী। এদের মধ্যে সুবিধাবাদ নেই, বরং এরা সাধারণত দ্বিধা বা দুই বিধায় থাকেন, তারপর এই দ্বিধাকে অতিক্রম করতে গিয়ে বুদ্ধিবাদকেই আক্রমণের লক্ষ্য করেন। হফস্টাডার কথা ধার করে তাদের দাগানো যায় এভাবে, এরা ‘না অশিক্ষিত, না অ-বুদ্ধিজীবী, বরং তারা প্রান্তিক বুদ্ধিজীবী, হবু-বুদ্ধিজীবী, স্বীকৃতি-বঞ্চিত বুদ্ধিজীবী, অর্ধ-শিক্ষিতদের শিক্ষিত নেতা,…।’ এরা এদের চিন্তার বিষয়ে খুবই প্যাশনেট। এই প্যাশন জনতাকে ছুঁয়ে যায়। সেই ছোঁয়ায় বন্ধ হয়ে যায় জনতার সহজাত চিন্তাবৃত্তি। 

 

 

আরো একটি পক্ষ বুদ্ধিজীবী-বিরোধিতা প্রচার করেন। এরা নিজেরা বুদ্ধিজীবী– অভিধা বঞ্চিত বুদ্ধিজীবী। এদের মধ্যে সুবিধাবাদ নেই, বরং এরা সাধারণত দ্বিধা বা দুই বিধায় থাকেন, তারপর এই দ্বিধাকে অতিক্রম করতে গিয়ে বুদ্ধিবাদকেই আক্রমণের লক্ষ্য করেন। হফস্টাডার কথা ধার করে তাদের দাগানো যায় এভাবে, এরা ‘না অশিক্ষিত, না অ-বুদ্ধিজীবী, বরং তারা প্রান্তিক বুদ্ধিজীবী, হবু-বুদ্ধিজীবী, স্বীকৃতি-বঞ্চিত বুদ্ধিজীবী, অর্ধ-শিক্ষিতদের শিক্ষিত নেতা,…।’ এরা এদের চিন্তার বিষয়ে খুবই প্যাশনেট। এই প্যাশন জনতাকে ছুঁয়ে যায়। সেই ছোঁয়ায় বন্ধ হয়ে যায় জনতার সহজাত চিন্তাবৃত্তি। 

 

 

৭. 

আমেরিকার বুদ্ধিবাদ-বিরূপতার যত পথে এসে জড়ো হয়েছে, আমাদের দেশে হয়তো অতো পথে আসেনি। কিন্তু উপসর্গগুলো সাদৃশ্যপূর্ণ। আমেরিকার এক্সেপশনালিজম বৈশ্বিক, বাঙালি জাতীয়তাবাদের, বাঙালি মুসলিমের ধর্মীয় চেতনার এক্সেপশনালিজম অভ্যন্তরীণ এবং আঞ্চলিক। দুটো দেশেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিনিধিত্ববাদী রাজনৈতিক চর্চা  বুদ্ধিবাদ-বিরূপতার জ্বালানি সংগ্রহ করে নানা রকম গোঁড়ামি থেকে, তা হোক ধর্মীয়, ভাষিক, জাতিক, লৈঙ্গিক ইত্যাদি। বিষয়টি এখন বৈশ্বিক। তবে একটা পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। আমেরিকায় বুদ্ধিজীবীদের সরকারি বাহিনী দ্বারা কিংবা রাজনৈতিক পাণ্ডা দ্বারা দৈহিক আক্রমণের শিকার হতে হয় না। তাদের জেল খাটার, জেলে গিয়ে পুলিশের মার খাওয়ার ঘটনা তেমন শোনা যায় না; গুম হতেও শোনা যায় না।  

 

 

অন্যদিকে বাংলাদেশে, ছফার উপজীব্য সেই বুদ্ধিজীবীদের রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে আর আজকের বুদ্ধিজীবীরা যে রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে জীবনধারণ করছেন তা কিছু বদলায়নি। জেল জরিমানা শারীরিক অত্যাচার, এমনকি গুম খুনের ভয় আদৌ দূর হয়নি। ছফার তার কথাগুলো বলেছেন ১৯৭২ সনে, আর এখন ২০২২ সাল। মাঝে বাংলাদেশের বয়সের সবটা। সমস্যা সেই একই রয়ে গেছে। বুদ্ধিজীবীরা এখন উভয় সংকটে, নানান পক্ষ থেকে তাদের জন্য হুমকি আছে, আবার জনগণের পক্ষ থেকে তাদের জন্য আছে বিতৃষ্ণা। আবার, বুদ্ধিজীবীদের সংঘর্ষে জড়াতে হয় দলীয়-বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে। বর্গের ভেতরেও তারা প্রতিকূল পরিস্থিতি থাকেন।

 

 

বুদ্ধিজীবীদের তাই আগের চেয়েও দায়িত্ব এবং ঝুঁকি এখন বেশি। এরপর যখন শিক্ষিত সচেতন সমাজের কাছেও যখন বুদ্ধিজীবীরা উপেক্ষা ও উপহাসের পাত্র হয়ে দাঁড়ায় তখন রাষ্ট্রের নিপীড়নের চরিত্র তুলে ধরার মত আর কেউ থাকে না। 

 

 

বুদ্ধিজীবীদের তাই আগের চেয়েও দায়িত্ব এবং ঝুঁকি এখন বেশি। এরপর যখন শিক্ষিত সচেতন সমাজের কাছেও যখন বুদ্ধিজীবীরা উপেক্ষা ও উপহাসের পাত্র হয়ে দাঁড়ায় তখন রাষ্ট্রের নিপীড়নের চরিত্র তুলে ধরার মত আর কেউ থাকে না। 

 

 

বাংলাদেশের শিক্ষিত সচেতন সমাজকে এই অবস্থার সিদ্ধান্ত নিতে হবে বুদ্ধিজীবীর বিকল্প আছে কিনা? রাষ্ট্র ব্যবস্থাটাই এমন যে, কায়েমি বা শ্রেণীস্বার্থগত কারণেতো বটেই, এর পরিচালনা পদ্ধতির কারণেও নাগরিককে বিপদে ফেলে। শুধু তাই নয়, এই বিপদের দায় আবার নাগরিকের ঘাড়েই তুলে দেয়। এটা জোচ্চুরি, এটা অন্যায়। বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্রের জোচ্চুরি ধরিয়ে দেন একইসঙ্গে  নাগরিককে বুদ্ধি দেন রাষ্ট্রপ্রদত্ত বিপদ থেকে বের হবার জন্য। 

 

 

এই জোচ্চুরি ধরা এবং ওই সমস্যা থেকে বের করার জন্য, সমস্যার সঠিক বিশ্লেষণের প্রয়োজন। অনেক সময় প্রয়োজন নতুন পথ উদ্ভাবন। বুদ্ধিজীবীরা তাই করেন। বুদ্ধিজীবীরা পেশাগত এবং-অথবা শ্রেণিগত কারণে বিপদের কেন্দ্র থেকে একটু দূরে থাকেন। তাদের বৃত্তি ও মনোবৃত্তির বশে তারা রাষ্ট্রজাত সমস্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন, চিন্তা করেন, উপায় খোঁজেন, ইতিহাসের আলোকে। তারা ব্যস্ত নাগরিককে সুযোগ করে দেন তাদের বিপদ সম্পর্কে ভাববার, স্বচ্ছদৃষ্টি দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ঘটমান অন্যায়কে বোঝার। অন্যায়কে সঠিকভাবে বোঝার মধ্যে দিয়ে একে প্রতিহত করার পথ উন্মোচিত হয়। এই উন্মোচনেও বুদ্ধিজীবী সহায়তা করেন। নাগরিক তার চিন্তায় ও কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াই করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার কাজে বুদ্ধিজীবীর বিশেষায়িত বুদ্ধি ব্যবহার করার অবকাশ পায়। এতে নাগরিকদের সময় বাঁচে।  

 

 

বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরূপতা বুদ্ধিজীবীর উপর্যুক্ত তৎপরতা এবং কর্মকাণ্ডে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এতে ক্ষতিটা হয় পুরো জাতির। শিক্ষিত সচেতন সমাজ যত তাড়াতাড়ি এটা বুঝতে পারবে ততই মঙ্গল। বলছি না বুদ্ধিজীবীর দায় নেই বুদ্ধিজীবী-বিরূপতার পেছনে। বলছি শিক্ষিত সচেতন সমাজের উচিত এই দায়কে দাগানো বুদ্ধিজীবীর নাম ধরে তার কাজ ধরে, গোটা বর্গ ধরে নয়। বর্গ ধরে বলাটা উলটো বুদ্ধিজীবী-বিরূপতায়ই অবদান রাখে। ফলে, বুদ্ধিজীবী ব্যাশিং-এ ছফার উদ্ধৃতির ভুলভাল ব্যবহার বেড়ে যায়। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর পঙক্তি ‘বুদ্ধিজীবীর রক্তে স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ’ বহুল প্রচলিত উদ্ধৃতি হয়ে যায়। এ ধরণের উদ্ধৃতি নির্বিচার সার্বিকায়ন। এতে উদ্দেশ্য হাসিল হয় বলে মনে হয় না। উদ্দেশ্য হাসিলের অন্য উপায় আছে। দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের কাজের ক্রিটিকাল মূল্যায়ন দরকার। যেমন কাব্য সমালোচনা হয়, চলচ্চিত্র সমালোচনা হয়, নাট্য সমালোচনা হয়, ক্রিটিকাল রচনারও পর্যালোচনা দরকার। সেসব মূল্যায়নের বেরিয়ে আসবে কে ভুষিমাল, কে দালাল আর কে পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল। এই পথ নিলে বুদ্ধিজীবী-বিরূপতায় চির ধরার সম্ভাবনা জাগবে।  

 

 

বুদ্ধিজীবী-বিরূপতায় আরো বড় চিড় ধরানো সম্ভব হবে বুদ্ধিবৃত্তিবাদ-বিরূপতার মধ্যে চিড় ধরিয়ে। এই কাজের শলা ছফার গ্রন্থেই ছিল, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার নিদান দিয়েছিলেন তিনি, তার বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই জ্ঞান হতে হবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে অর্জন করা জ্ঞান। এই পদ্ধতি অবলম্বন করার একটা গণতান্ত্রিক দিকও আছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সর্বজনে রপ্ত করতে পারে এমন একটি বিষয়, এটা অব্যাখ্যেয় কোনও প্রতিভা নয়। একে সর্বস্তরে নিয়ে যাওয়া যায়। এই নিয়ে যাওয়ার কাজ করতে হবে নিরবিচ্ছিন্নভাবে। জ্ঞান বিজ্ঞানের বৈষম্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি মানুষকে সন্দেহবাদী করে তোলে সেই ব্যাপারে সচেতনতা দরকার।  

 

 

 

আহমেদ শামীম  

সহকারী অধ্যাপক (প্রশিক্ষণ)  

এশিয় অধ্যয়ন বিভাগ  

ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস (অস্টিন) 

 

 

 

Your Comment