১২ আগস্ট বিশ্ব হাতি দিবস। ২০১২ সাল থেকে বিশ্বের হাতি সংরক্ষণ, তাদের নিরাপত্তা এবং মুক্ত চলাচল নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
হাতিরা বিশ্ব জুড়েই বিপন্ন প্রাণি। গত শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত আফ্রিকার অন্তহীন গৃহযুদ্ধ, চোরা শিকার আর হাতির দাঁতের ব্যবসার কারণে আফ্রিকার হাতিরা বিলুপ্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল।
গত তিরিশ বছরে ধীরে ধীরে হলেও আফ্রিকার হাতির উপপ্রজাতিটির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে ধারাবাহিকভাবেই আশঙ্কাজনক হারে কমছে এশীয় হাতির বাসস্থান ও সংখ্যা।
কিন্তু গত তিরিশ বছরে ধীরে ধীরে হলেও আফ্রিকার হাতির উপপ্রজাতিটির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে ধারাবাহিকভাবেই আশঙ্কাজনক হারে কমছে এশীয় হাতির বাসস্থান ও সংখ্যা।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন ন্যাচার (আইইউসিএন) এর গত নভেম্বরের তথ্য মাফিক, বিশ্বের মহাবিপন্ন ঘোষিত প্রজাতি এশীয় হাতির দুই তৃতীয়াংশের বাস বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে। এর বাইরে কিছু আছে থাইল্যান্ড, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের বন বিভাগ ও আইইউসিএন – এর এক যৌথ জরিপে জানা যায়, সে সময় বাংলাদেশে হাতি ছিল ২৬৮টি। স্থায়ীভাবে এ অঞ্চলের বাসিন্দা এমন হাতি ছাড়া পরিব্রাজক হাতির গড় সংখ্যা ছিল ৯৩। বন্দি দশায় আছে নিবন্ধিত এমন ৯৬টি হাতি ছিল সে সময়।
বাংলাদেশের বিশাল অঞ্চল জুড়ে একদা হাতির চলাচল ছিল। বর্তমানের আসাম, মায়ানমার, ত্রিপুরা, মেঘালয় সন্নিহিত বাংলাদেশের এলাকাগুলোতে “খেদা” দিয়ে হাতি ধরে তাদের পোষ মানানো হতো। প্রশিক্ষিত রনহস্তীদেরকে পাঠানো হতো ভারত জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মোঘল দুর্গ ও সেনানিবাসগুলোতে। এমনকি মৌর্য আমলে সুদূর সিরিয়াতে গ্রিক সেলুসিড রাজারা ভারত থেকে রফতানি হওয়া হাতিকে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রিক ও রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন।
ফ্রান্সিস বুখানন তার দিনপঞ্জিতে উল্লেখ করেছেন ১৭৮৮ সালের দিকে মহেশখালী দ্বীপে হাতিদের বিলুপ্ত হবার কথা। এই ঘটনার বছর দশেক পর বুখানন দ্বীপটিতে পা দিয়েছিলেন। কুমীর, বাঘসহ আর সব বুনো প্রাণিদের নিশ্চিহ্ন হওয়াতে বুখানন অবশ্য আনন্দিতই ছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তার করা সফরের কাহিনী “জার্নি টু সাইথ ইস্ট বেঙ্গল-১৭৯৮” পরিপূর্ণ হয়ে আছে তার ভাষায় “ক্ষতিকর” পশু-পাখি ও ঝোপঝাড় থেকে অঞ্চলটিকে মুক্ত করে অর্থকরী আবাদ ও খাজনার পরিমান বৃদ্ধির নানান পরিকল্পনায়।
মোঘল আমলে পূর্ব বাংলায় কৃষিকাজের বিস্তারের সাথে সাথে হাতির চলাচলের এলাকা ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হতে থাকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শুরুর দিকে ফ্রান্সিস বুখানন তার দিনপঞ্জিতে উল্লেখ করেছেন ১৭৮৮ সালের দিকে মহেশখালী দ্বীপে হাতিদের বিলুপ্ত হবার কথা। এই ঘটনার বছর দশেক পর বুখানন দ্বীপটিতে পা দিয়েছিলেন। কুমীর, বাঘসহ আর সব বুনো প্রাণিদের নিশ্চিহ্ন হওয়াতে বুখানন অবশ্য আনন্দিতই ছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তার করা সফরের কাহিনী “জার্নি টু সাইথ ইস্ট বেঙ্গল-১৭৯৮” পরিপূর্ণ হয়ে আছে তার ভাষায় “ক্ষতিকর” পশু-পাখি ও ঝোপঝাড় থেকে অঞ্চলটিকে মুক্ত করে অর্থকরী আবাদ ও খাজনার পরিমান বৃদ্ধির নানান পরিকল্পনায়।
ঢাকার রাস্তায় মাহুত ও হাতি। এশীয় হাতিদের একটা বড় অংশই এমন পায়ে শেকল নিয়ে বেঁচে আছে। আলোকচিত্র: শহিদুল আলম
বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে ফ্রান্সিস বুখাননের এই প্রকৃতি বিধ্বংসী পরিকল্পনা অনেকদূরই বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশ আমলে এর আনুষ্ঠানিক শবযাত্রার আয়োজন চলছে। বাংলাদেশের বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সাল থেকে গত ১৭ বছরে মানুষের হাতে হত্যার শিকার হয়েছে ১১৮টি হাতি। ২০১৫ সাল থেকে বিগত ছয় বছরেই মারা গেছে ৬৯ টি হাতি। তবে দেশের প্রাণি বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। গত দুই বছরেই মারা গেছে ৩৮টি হাতি। ২০২০ ও ২০২১ সালে যথাক্রমে ২২টি ও ১৬টি হাতি মারা পড়েছে মানুষের হাতে। এর মধ্যে কক্সবাজার অঞ্চলেই অন্তত ১৩টি বুনো হাতি হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
নিছক হত্যা ছাড়াও বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা হ্রাসের কারণ এর বিচরণক্ষেত্র রাতারাতি ধ্বংস করা হয়েছে বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণের ফলে। রামুতে সেনানিবাস নির্মাণ, কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী বনাঞ্চলে রেললাইন (যার কারণে বাধাগ্রস্ত হবে হাতি চলাচলের ৬টি করিডোর), মায়ানমারে গণহত্যার কারণে বিপুল পরিমান রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্বাস্তু হওয়া, বিভিন্ন প্রকল্প, অবৈধ জবরদখলসহ বিভিন্ন কারণে হাতির নিরাপদ আবাসস্থল ধ্বংস, পর্যাপ্ত খাদ্যাভাব, চলাচলের করিডোর চরমভাবে বাধাগ্রস্থ হওয়া হাতিকে বিপন্নু করেছে। হাতিরা খাদ্যের সন্ধানে মানুষের জনপদে পা ফেলেছে, বিষয়টা এমন নয়। মানুষই তাদের আবাসস্থলে নির্বিচার দখলদারি চালিয়েছে।
এশীয় হাতিরা খুন হয়েছে নানাভাবে। কোথাও গুলি করে, কোথাও ইলেকট্রিক তার পেঁচিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে। এর মাঝে মর্মান্তিকতম একটি ঘটনা সামাজিক গণমাধ্যমে আলোড়ন তৈরি করে ২০২০ সালে। সে বছরের ২৭ মে পাশের ভারতের কেরালার মলপ্পুরমে একটি দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা হাতিকে আনারসের ভেতর বিস্ফোরক ঢুকিয়ে খাওয়ানো হয়।
আলঙ্কারিক হলেও হাতিদের রক্ষার বিষয়ে কিছু অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। গত বছর ২০২১ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে এক ভার্চুয়াল বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত হাতি সংরক্ষণ বিষয়ে প্রটোকল সম্পর্কিত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
দুই রাষ্ট্রের শীষ পর্যায়ে এ নিয়ে ঐক্যমত সত্ত্বেও বাস্তবে হাতি সংরক্ষণে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এখনো বলবার মত নয়। এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং এশিয়ান এলিফেন্ট স্পেশালিষ্ট গ্রুপের সদস্য ড. মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ দৃকনিউজ'কে বলেন, “রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যোগ দেখছি। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। আইন হচ্ছে। পলিটিক্যাল উইল আছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে হাতি সংরক্ষণে কার্যকর উদ্যোগ দেখছি না।”
হাতির চলাচলের রাস্তা মুক্ত করার উদ্যোগ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ এলিফেন্ট কনজারভেশন অ্যাকশন প্ল্যানের অন্যতম প্রণেতা তৎকালীন আইইউসিএন বাংলাদেশে কর্মরত আশরাফুল হক দৃক নিউজকে বলেন, “বিপন্ন হাতি বাঁচাতে এটি ছিল একটি শুভ উদ্যোগ। এর প্রাথমিক কাজটি শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে। আইইউসিএন বাংলাদেশ ও বনবিভাগের যৌথ গবেষণার মাধ্যমে প্ল্যানটি সূচিত হয়েছিল। আমরা সেখানে কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলাম। বন্য হাতি কোনো সীমানা মানে না। তারা যেখানে খাদ্য সেখানে বিচরণ করে। আমরা প্রস্তাবনায় উল্লেখ করি, নির্দিষ্ট কোনো দেশের পক্ষে আন্তঃসীমান্ত হাতি সংরক্ষণ সম্ভব নয়। এর জন্য বাংলাদেশ, ভারত দুই দেশকেই কাজ করতে হবে। ২০১৭ সালে আমরা গবেষণা করে হাতির সীমান্ত পেরোনোর প্রায় ১০/১৫ টি স্থান শনাক্ত করি। এরপর তা অনুযায়ী ২০১৮ সালে একটি খসড়া প্রণয়ণ করা হয়। সেখানে বেশ কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দুই দেশের মধ্যে হাতি বিষয়ক তথ্য বিনিময়ের দিকে আমরা জোর দিই। কারণ, বন্য প্রাণি শনাক্তে ভারত প্রযুক্তিগতভাবে আমাদের চেয়ে এগিয়ে। আমরা ‘এলিফেন্ট করিডোর’ নামে হাতি বিচরণ করে এমন কিছু এলাকা বের করি।“
আশরাফুল হক আরও বলেন, “কাজটি সহজ ছিল না। কারণ, বুনো হাতি দীর্ঘ এলাকা জুড়ে বিচরণ করে। শীতে তারা এক জায়গায় থাকতে পছন্দ করে, গ্রীষ্মে আবার আরেক এলাকা। তাদের খাদ্য চাহিদাও অন্য প্রাণি অপেক্ষা বেশি। এদিকে তাদের বাসস্থলে মানুষের হানা। ফলে বাধ্য হয়ে তাদের লোকালয়ে আসতে হয়। লোকালয়ের মানুষও স্বাভাবিক কারণে হাতির ফসল নষ্ট কাণ্ডে ক্ষিপ্ত থাকে। তাই সংঘাত অনিবার্য। আমরা হাতির নিরাপদ অভায়ারণ্যের প্রস্তাব তৈরি করি। যার প্রভাবেই বাংলাদেশ ভারতের এই সমঝোতা স্মারক।”
এ বিষয়ে বনসংরক্ষক ইমরান আহমেদ দৃকনিউজ’কে বলেন, এটি একটি সময় সাপেক্ষ বিষয়। আমরা ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ে কমিটি গঠন করেছি। সীমান্ত এলাকায় নজর বাড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। তবে আগেও বলেছি, এটি সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। কোভিডের কারণে দেরি হয়েছে বেশ কিছুটা। তবে কাজ থেমে নেই।