বৃহঃস্পতিবার ১৪ই চৈত্র ১৪৩০ Thursday 28th March 2024

বৃহঃস্পতিবার ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

Thursday 28th March 2024

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

২৬ বছরেও কল্পনা চাকমার সন্ধান কিংবা বিচার কোনোটাই মেলেনি

২০২২-০৬-১২

দৃকনিউজ প্রতিবেদন

কল্পনা চাকমা ছিলেন অবিভক্ত হিল উইমেন ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক। আলোকচিত্র: সংগৃহিত 

 

 

বাংলাদেশের আদিবাসী নেতা কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৬ বছর পূর্ণ হয়েছে। কল্পনা আওয়াজ তুলেছিলেন পাহাড়ে জারি থাকা নিপীড়ন এবং পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। সামরিক বাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন কল্পনা চাকমা। তিনি ছিলেন অবিভক্ত হিল উইমেন ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক। তবে প্রতিবাদী আদিবাসী এই নারীর সেই আদর্শ, চিন্তা-চেতনা, প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে চিরতরে রুদ্ধ করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১১ জুন মধ্যরাতে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাইল্যাঘোনার নিজ বাড়ি থেকে অপহৃত হন কল্পনা চাকমা। তৎকালীন  কজইছড়ি আর্মি ক্যাম্পের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস দলবল নিয়ে চোখ বেধে ধরে নিয়ে যান ২৩ বছর বয়সী কল্পনাকে। এমন নির্মমতার ২৬ বছর পেরিয়েছে। এই অপহরণের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদলেছে ৩৯ বার। তবে আজও হদিস মেলেনি কল্পনা চাকমার। কল্পনার খোঁজ করতে গিয়ে জীবন হারিয়েছেন রুপন চাকমা, সমর, সুকেশ, মনোতোষ। কল্পনা চাকমাসহ অধরায় রয়ে গেছে সব বিচার।  

 

 

কল্পনা চাকমা অপহরণের প্রতিবাদে ও অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে প্রতিবছর ১২ জুন বিক্ষোভ সমাবেশ করে থাকে পার্বত্য চট্টগ্রামভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন। কল্পনা চাকমার স্মরণে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে আদিবাসী নারী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন। খাগড়াছড়ি শহরে এই প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নিয়েছেন সংগ্রামী আদিবাসীরা। 

 

 

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতা-কর্মীরা জানান, কল্পনা চাকমা অপহরণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশকে ঘিরে এই আয়োজনের কয়েকদিন আগে থেকেই পাহাড়ি এলাকায় টহল দিয়ে ভয়ের পরিস্থিতি তৈরির পাঁয়তারা চালিয়েছে সেনাবাহিনী। “যেহেতু তারা এই ঘটনায় অপরাধী তাই প্রতিবছরই ১২ জুন এর আগে সেনাবাহিনী এই অঞ্চলে ভয়-ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তৎপর হয়ে ওঠে” বলে জানান এই সংগঠনের সভাপতি নিরূপা চাকমা। 

 

 

কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৬ বছরে, খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ মিছিলের আগে সেনা-পুলিশ টহল। আলোকচিত্র: হিল উইমেন্স ফেডারেশন 

 


হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি বলেন, “১৯৯৬ সালের এই দিনে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৭ ঘন্টা আগে মধ্যরাতে বাঘাইছড়ি কজইছড়ি ক্যাম্পে দায়িত্বরত লে. ফেরদৌস ও তার সহযোগীরা মিলে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করে। ২৬ বছরেও সরকার তার কোনো হদিস দিতে পারেনি। বরং কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারীদের শাস্তি না দিয়ে এ ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে নানা প্রপাগান্ডা ও মিথ্যাচার করা হচ্ছে।”

 

 

“সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সফরকালে ক্ষমতাসীন সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ব্যানার নিউজ নামে এক নিউজ পোর্টালকে দেয়া সাক্ষাতকারে কল্পনা চাকমা অপহরণ নিয়ে অসত্য তথ্য দিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন,” বলেও জানান তিনি। কল্পনা চাকমা অপহরণ নিয়ে তথ্যের বিকৃতি না ঘটাতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে সতর্ক করেছেন নিরূপা চাকমা।

 

 

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেন, রবিবার ১২ জুন, বিক্ষোভ মিছিল শুরু হওয়ার আগে একপ্রকার বাধা দিয়েছে সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনী। সমাবেশ ও মিছিলের আগে মারমুখী ছিল পুলিশ। মিছিলটি প্রদক্ষিণ করতে দিতে চায়নি। একপর্যায়ে নেতা-কর্মীদের প্রতিবাদ ও মিছিলে নারীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় পিছু হটে আইন-শৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনী। 

 

 

কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৬ বছরে, খাগড়াছড়িতে হিল উইমেন্স ফাউন্ডেশনের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের বাধা। আলোকচিত্র: হিল উইমেন্স ফাউন্ডেশন 

 

কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনার বিচারের ক্ষেত্রে সরকার বরাবরই উদাসীনতা দেখিয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন এই সমাবেশে অংশ নেয়া বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা। তারা বলেন, কল্পনা চাকমা অপহরণের পর বাঘাইছড়িতে মামলা হয়। এই মামলা তদন্তে এ পর্যন্ত ৩৯ জন কর্মকর্তা বদল হয়েছেন। প্রশাসন এবং রাষ্ট্রের অনীহা ও ঘটনার সাথে রাষ্ট্রীয় বাহিনী সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে দীর্ঘ ২৬ বছরেও বিচার হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন আদিবাসী নেতারা। 

 

 

আন্দোলন জোরদার করার আহ্বান জানিয়ে সমাবেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভাপতি কণিকা দেওয়ান বলেন, “কল্পনা চাকমার অপহরণের ঘটনা জাতিগত নিপীড়নেরই অংশ। ২৬ বছর অতিবাহিত হলেও সরকার তার বিচার করেনি। একইভাবে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে সোহাগী জাহান তনু হত্যার বিচারও হয়নি।” 

 

 

পুলিশি বাধা ও হয়রানি অতিক্রম করে কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৬ বছর পরেও বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছে হিল উইমেন্স ফেডারেশন। আলোকচিত্র: হিল উইমেন্স ফেডারেশন

 

 

এদেশে ধর্ষক, নিপীড়ক, খুনীরা যদি ক্ষমতাবান হন কিংবা ক্ষমতাবানদের ছত্রছায়ায় থাকে তাহলে তারা রেহাই পেয়ে যান বলে অভিযোগ করেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভাপতি কণিকা দেওয়ান। পাহাড়িদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে অভিযোগ করে অনতিবিলম্বে এই ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করার আহ্বান তাদের। 

 

 

পরিবার, সমাজ তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন কায়েমের লক্ষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে এই সমাবেশ থেকে। আর কালক্ষেপন না করে কল্পনা চাকমা ও মাইকেল চাকমার সন্ধান দেয়ার জোরালো দাবি জানিয়েছেন তারা। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, গুম-খুন, অপহরণ এবং বিনাবিচারে হত্যাবন্ধসহ সকল অন্যায়-অবিচার প্রতিরোধ করার আহ্বান আদিবাসীদের।