শুক্রবার ১৯শে আশ্বিন ১৪৩১ Friday 4th October 2024

শুক্রবার ১৯শে আশ্বিন ১৪৩১

Friday 4th October 2024

দেশজুড়ে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ

সুন্দরবন ঘিরে কী এই ‘এসইএ’, বিশেষজ্ঞরা কেন উদ্বিগ্ন?

২০২২-০৫-২৬

আনিস রায়হান

সুন্দরবন ঘিরে কী এই ‘এসইএ’, বিশেষজ্ঞরা কেন উদ্বিগ্ন?

 

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা- ইউনেস্কোর দাবির ভিত্তিতে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ ঘোষিত সুন্দরবনকে ঘিরে নতুন একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ সরকার। এর নাম দেয়া হয়েছে, ‘সুন্দরবনের অসামান্য সার্বজনীন মূল্য সংরক্ষণের জন্য দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৌশলগত পরিবেশগত সমীক্ষা (স্ট্র্যাটেজিক এনভায়রনমেন্টাল অ্যাসেসমেন্ট) বা এসইএ প্রকল্প’। ইতোমধ্যে এই সমীক্ষার খসড়া ও এর ভিত্তিতে ওই অঞ্চলের ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনারও খসড়া তৈরি হয়ে গেছে। 

 


তবে বিশেষজ্ঞরা এই সমীক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাদের মতে, ‘এসইএ’ জিনিসটা কী, সেটা ঠিকঠাক না বুঝে কিংবা জেনেশুনেই এসইএ’র মাপকাঠি লঙ্ঘন করে তৈরি হয়ে গেছে এই খসড়া। সে কারণে এর যে উদ্দেশ্য সুন্দরবনকে রক্ষা করা, সেটা তো অর্জন হবেই না, বরং এ থেকে আরো নতুন সংকটের জন্ম হতে পারে। ‘এসইএ’ ও এর খসড়ার ভিত্তিতে এই অঞ্চল ব্যবস্থাপনার যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সেই খসড়া মূল্যায়ন করে বিশেষজ্ঞরা কোনো অগ্রগতির দিশা পাননি। তারা বলছেন, এসইএ’র মানদণ্ড অনুসরণ না করেই যদি এভাবে এগুলো চূড়ান্ত করে ফেলা হয় তবে তা সুন্দরবন রক্ষায় কাজে লাগবে না।  

 

কী এই এসইএ


বিশ্বজুড়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিবেশের সুরক্ষার বিষয়টিকে ইদানীং বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিবেশগত সুরক্ষার নানা মানদণ্ড তৈরি করছে। যার ভিত্তিতে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যক্রম শুরুর আগেই পরখ করে নেয়া হয় যে, ওই প্রকল্পের ফলে পরিবেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। এতদিন দাতা সংস্থাগুলো কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হলে শর্ত আরোপ করত যে, প্রকল্প শুরুর আগে তার পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) বা ইআইএ করতে হবে। এর সঙ্গে সম্প্রতি যোগ করা হচ্ছে ‘কৌশলগত পরিবেশগত সমীক্ষা’ বা এসইএ করার দাবিও।

 


বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এসইএ একেবারেই নতুন একটি বিষয়। কেবল জাতীয় পরিবেশ নীতি ২০১৮ তে এসইএ’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে বা পরে বাংলাদেশের আর কোনো আইনগত দলিলে এসই’র কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। পরিবেশ আইনবিদ ব্যারিস্টার আবু রায়হান মুহম্মদ খালিদের মতে, পরিবেশ নীতিতে বিষয়টি এসেছে, যার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে এটি আইনী কাঠামোতেও উঠে আসার কথা। তবে এটার কোনো সংজ্ঞা বা কিভাবে করতে হবে তা বিস্তারিত কোথাও বলা নেই। তা সত্ত্বেও পরিবেশ নীতিতে যতটুকু এসেছে, তা এসইএ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। বরং বলা হয়েছে বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থায় এসইএ’র কোনো উল্লেখ নেই।

 


পরিবেশ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে সংযোজিত জাতীয় পরিবেশ নীতি ২০১৮ ঘেঁটে দেখা যায়, এর ৫.৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “মন্ত্রণালয়/বিভাগসমূহপ্রযোজ্য ক্ষেত্রে নীতি, পরিকল্পনা, এবং কর্মসূচির উপর স্ট্র্যাটেজিক এনভায়রনমেন্টাল অ্যাসেসমেন্ট (এসইএ) সম্পাদন করিবে।”

 


ব্যারিস্টার রায়হান খালিদ জানান, ২০০১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এসইএ’র ক্ষেত্রে প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা দিয়ে একটি আইন প্রণয়ন করে, যা তাদের সদস্যভুক্ত দেশগুলো অনুসরণ করতে বাধ্য। এখন তো বিশ্বব্যাংকের এ সংক্রান্ত একটা দিকনির্দেশনা (গাইডলাইন) আছে, বিশ্বের ৩৬টি দেশের অর্থনৈতিক জোটভিত্তিক সংস্থা ওইসিডি’রও একটা গাইডলাইন আছে। এসব ক্ষেত্রে এসইএ’র কাজ কী তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। মোটাদাগে বিষয়টি হলো, যদি কোথাও কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হয় তবে সেক্ষেত্রে প্রণয়ন করতে হবে ইআইএ। আর একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের এসইএ বলতে বুঝানো হয়, ওই অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ তথা শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সমস্ত আইন, বিধি, নীতি ও নির্দেশনার ওপর পরিবেশগত সমীক্ষা পরিচালনা।

 


আমরা যদি সরলভাবে বুঝি তাহলে এই যে এলাকা, সুন্দরবন এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল তথা সমগ্র খুলনা অঞ্চল পরিচালিত করে যে আইনগুলো- মৎস্য আইন, পানি আইন, বন আইন, জাহাজ চলাচল আইন, সাধারণ ফৌজদারি আইন, খাজনার আইন, কর আইন, এরকম যত আইনকানুন আছে, সেই আইনগুলোতে এমন কোনো ধারা আছে কিনা যাতে বনের ক্ষতি হয়, সেগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। এরপর সেগুলোকে উৎপাটন করতে হবে, সেগুলো বদলে ফেলতে হবে, যাতে বনের ক্ষতি না হয়, বলেন রায়হান খালিদ।

 


সুতরাং, এটা একেবারেই পরিস্কার যে, পরিবেশের ওপর নির্দিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পের, যেমন রাস্তাঘাট, কল কারখানা, বাঁধ ও সেতু ইত্যাদির প্রভাব নিরূপণ করা হয় ইআইএ দ্বারা। আর উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয় যেসব নীতি ও আইন দ্বারা, পরিবেশের ওপর সেগুলোর প্রভাব নিরূপণের জন্য করা হয় এসইএ। দুটো বিষয় পরিস্কারভাবেই আলাদা।

ইউনেস্কো এখানে ভুল করেছে। তারা সবগুলো দাবি একত্রে করেছে এবং বলেছে যে, আমরা অনুরোধ করি এসইএ করতে হবে এবং বৃহৎ প্রকল্পগুলোর ইআইএ করতে হবে ওই এসইএ প্রকল্পের অধীনেই। এটা তাদের ভুল। তাদের স্পষ্ট বলা উচিৎ ছিল যে, যেগুলো প্রকল্প সেগুলোর ইআইএ, আর যেগুলো আইন বা নীতি, সেগুলোর এসইএ করতে হবে। এটা না বলে তারা বলেছে, এসইএর মধ্যেই ইআইএগুলো যোগ করে দিতে। এখানে তারা এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।

এসইএ যেভাবে এলো


জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ তথা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষণা এবং সেই স্থানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি দেখভাল করে থাকে। বাংলাদেশের সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি পায়। তবে এই বনের আশেপাশে সাম্প্রতিক নানা ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম ও বেশ কিছু দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের নিকট কিছু দাবি উত্থাপন করে। 

 


২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ৩৮তম সম্মেলনে ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারকে জানায়, ২০১৪ সালে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত পশুর নদীতে তেলবাহী জাহাজডুবি হয়ে অনেক তেল ছড়িয়ে পড়ায় তারা উদ্বিগ্ন। এ থেকে তাদের মনে হয়েছে যে, সুন্দরবন একটা ঝুঁকির মধ্যে আছে। তাই তারা দবি করে, নদীতে যে খনন হচ্ছে, জাহাজ চলছে, এবং যে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে- এগুলোর ইআইএ করতে হবে। ওই প্রতিবেদনগুলো তারা আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন)-এর মাধ্যমে যাচাই বাছাই করে নেবে। পাশাপাশি তারা আরো দাবি করে, সামগ্রিকভাবে সুন্দরবনের জন্য একটি এসইএ করতে হবে।

 


ব্যারিস্টার রায়হান খালিদ দৃকনিউজকে বলেন, ইউনেস্কো এখানে ভুল করেছে। তারা সবগুলো দাবি একত্রে করেছে এবং বলেছে যে, আমরা অনুরোধ করি এসইএ করতে হবে এবং বৃহৎ প্রকল্পগুলোর ইআইএ করতে হবে ওই এসইএ প্রকল্পের অধীনেই। এটা তাদের ভুল। তাদের স্পষ্ট বলা উচিৎ ছিল যে, যেগুলো প্রকল্প সেগুলোর ইআইএ, আর যেগুলো আইন বা নীতি, সেগুলোর এসইএ করতে হবে। এটা না বলে তারা বলেছে, এসইএর মধ্যেই ইআইএগুলো যোগ করে দিতে। এখানে তারা এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। দ্বিতীয়ত এসইএ জিনিসটা ঠিক কী, সেটা তারা স্পষ্ট করেনি। তাদের দায়িত্ব ছিল, সুষ্পষ্টভাবে বাংলাদেশের কোন আইনের অধীনে এটা হবে কিংবা তা না থাকলে জাতিসংঘের যে দিকনির্দেশনা রয়েছে তার উল্লেখ করে বলা যে, এর আলোকে এসইএ করতে হবে। কিন্তু সেটা তারা করেনি।

 


বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি আমলে নিয়ে এসইএ প্রকল্পটা কিভাবে হবে, তার একটি টার্মস অফ রেফারেন্স তথা কার্যপরিচালনার শর্তাবলি তৈরি করে ইউনেস্কোকে পাঠিয়ে দেয়। এতে সরকার ঘোষণা করে যে, এসইএ’র ক্ষেত্রে তারা ওইসিডি’র যে গাইডলাইনটি রয়েছে, সেটি অনুসরণ করবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় পরিবেশগত বিষয়াদি আমলে নেয়া হচ্ছে কিনা যাচাই করে দেখবে। ইউনেস্কো নিজে কোনো মানদণ্ড দেয়নি, বাংলাদেশ যখন নিজেই ওইসিডি’র মানদণ্ডে এসই করার কথা জানায়, তারা সেটি গ্রহণ করে। 

 


এরপর ২০১৭ সালের ৪১তম সম্মেলনে ইউনেস্কো যোগ করে যে, এসইএ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সুন্দরবনে যেন নতুন কোনো প্রকার অবকাঠমোগত উন্নয়নের অনুমোদন না দেয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের ৪৩তম সম্মেলনে তারা বলে, এসইএ সম্পন্ন হলে সেটি তাদের পাঠাতে, যা কিনা তারা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা যাচাই করবে এবং এসইএ’র ভিত্তিতে উঠে আসা করণীয়গুলো চলমান ও আসন্ন প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হবে। ২০২১ সালের সম্মেলন থেকে তারা আবার বলে যে, এসইএ ও এর ভিত্তিতে তৈরি ওই অঞ্চলের ব্যবস্থাপনাগত পরিকল্পনা তথা এসইএমপি প্রতিবেদনটি জমা দিতে হবে। সেই সঙ্গে দাবি করে যে, ভবিষ্যতে উন্নয়ন কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এসইএ থেকে প্রাপ্ত করণীয়গুলো প্রয়োগ করতে হবে। এর সঙ্গে তারা আবারও যোগ করে যে, আমরা আবারও উদ্বেগের সঙ্গে জানাচ্ছি যেন এসইএ শেষ হওয়ার আগে ওই এলাকায় নতুন কোনো প্রকল্প অনুমোদন না দেয়া হয়।

 

 

এসইএ নিয়ে উদ্বেগ কেন


সরকারের পদক্ষেপ মোতাবেক ইতোমধ্যে একটি বিশেষজ্ঞ দল এসইএ ও এসইএমপির খসড়া প্রস্তুত করে ফেলেছে। সেই খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। ইন্টেগ্রা কনসাল্টিং নামক একটি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি সহযোগিতায় এই এসইএ প্রকল্প সম্পাদন করছে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস (সিইজিআইএস)। প্রকল্পের নাম দেয়া হয়েছে, ‘সুন্দরবনের অসামান্য সর্বজনীন মূল্য সংরক্ষণের জন্য দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৌশলগত পরিবেশগত সমীক্ষা প্রকল্প’। এর সঙ্গে এসইএ প্রণয়ন প্রকল্পের অধীনে তৈরি করা হয়েছে, একটি কৌশলগত পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা তথা স্ট্র্যাটেজিক এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট প্লান (এসইএমপি)।

 


এই দুই প্রতিবেদনের চূড়ান্ত খসড়া পড়ে বিশেষজ্ঞরা হতবাক। প্রথম আপত্তির জায়গা হলো, সুন্দরবন ঘিরে প্রয়োগকৃত আইনগুলোর পরিবেশগত সমীক্ষা হবে, অথচ এটা করা হচ্ছে আইনবিদ ছাড়াই। দ্বিতীয়ত, এই খসড়ায় দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশে এসইএ’র কোনো আইনগত কাঠামো নেই। অথচ সরাসরি সংবিধানের ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ অধ্যায়ভুক্ত ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ যার অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্র যেকোনো নীতি বা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও পরিবেশের নিরাপত্তা বিধান করতে বাধ্য, এটা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির মধ্যেই বলা হয়েছে। এছাড়া পরিবেশ নীতি ২০১৮-তেও সুস্পষ্টভাবে এসইএ’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

 


ব্যারিস্টার রায়হান খালিদ জানান, যেকোনো আইন ও প্রশাসনিক দলিল, যেমন আইন, নীতি, পরিকল্পনা ইত্যাদি, সংবিধানে ঘোষিত মৌলিক মানবাধিকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার মুল নীতিসমূহের সঙ্গতিপূর্ণ কিনা যাচাই করে দেখার পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা বাংলাদেশের সংবিধানেই রয়েছে। এক্ষেত্রে সংবিধানের ৭(২), ৮(২) অনুচ্ছেদসহ দ্বিতীয় ভাগ এবং তৃতীয় ভাগ, সেইসঙ্গে ১০২ অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য। এছাড়া সাধারণ প্রকরণ আইন ১৮৯৭ (১৮৯৭ এর ১০ নং আইন), সচিবালয় নির্দেশমালা ২০১৪-তেও যেকোনো আইন, পরিকল্পনা ও কর্মসূচী প্রণয়নের আগে ও পরে তা জাতীয় সংবিধানের আলোকে যাচাই করে নেয়ার বিস্তারিত ব্যবস্থা রয়েছে। এর কোনো উল্লেখ আলোচ্য এসইএ তে করা হয়নি এবং সে সকল বিদ্যমান ব্যবস্থা এড়িয়ে নতুন একটি দুর্বল বিকল্প তৈরির অপচেষ্টা চলছে। এছাড়াও বন সংশ্লিষ্ট আরও অনেক আইনকানুন আলোচ্য এসইএতে বিবেচনা করা হয়নি।

 


এই আইনবিদ দাবি করেন, সরাসরি সংবিধানের আদেশ, দেশের সংবিধান ও সংশ্লিষ্ট আইনকানুন এবং পরিবেশ নীতির ঘোষণা অমান্য করে ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা ভুল করেই হোক এসইএ প্রণয়ন ও প্রয়োগের আগেই তার ভেতরে সংকট উৎপাদনের উপাদান স্থাপন করা হয়েছে। আইন লুকানোর এই কাজটিকে আইন দ্বারা বাধ্য না থাকার চেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

 


রায়হান খালিদ বলেন, দেশের বন সম্পদের ব্যবস্থাপনায় ইতোমধ্যেই আমরা অনেক আইন ও নির্দেশনা তৈরি করেছি। তিনি বলেন, সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদ, এবং ১৯৯৬ সালের ড. মহিউদ্দিন ফারুক বনাম বাংলাদেশ মামলায় মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে ঘোষিত নাগরিকদের জীবনের মৌলিক অধিকার পরিবেশ সংরক্ষণের অধিকার ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যের অধিকার অন্তর্ভুক্ত করে। এর পাশাপাশি জাতীয় বন নীতি ১৯৯৪, বাংলাদেশ বন মহা-পরিকল্পনা ২০১৫, বাংলাদেশ খসড়া বন মহাপরিকল্পনা ২০১৭-২০৩৬, বাংলাদেশ খসড়া বন নীতি ২০১৬, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রণীত বাংলাদেশ ন্যাশনাল কনজারভেশন স্ট্র্যাটেজি ২০১৬-২০৩১, বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-৪১, খসড়া বাংলাদেশ ন্যাশনাল রেড প্লাস স্ট্র্যাটেজি (বিএনআরএস) ২০১৬-৩০, খসড়া বন বিনিয়োগ পরিকল্পনা ২০১৭, ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০২০-২০২৫, বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান ২১০০, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা (বিসিসিএসএপি) ২০০৮, জাতীয় অভিযোজন কর্মসূচী (এনএপি) ২০০৯, পরিবেশ অধিদফতর প্রণীত বাংলাদেশ ন্যাশনাল একশন প্রোগ্রাম ফর ডেজারটিফিকেশন, ল্যান্ড ডিগ্রেডেশন অ্যান্ড ড্রাউট ২০১৫-২০২৪, বাংলাদেশ ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন মাস্টার প্ল্যান ২০১৫-৩৫, বাংলাদেশ টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান ২০১৮-২০২৭ প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়াও ১৫টি আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সংস্থার সদস্য হয়েছে বাংলাদেশ, যেখানে বন ও পরিবেশ রক্ষার ঘোষণা রয়েছে।

 


এই আইন বিশেষজ্ঞের মতে, এত আইন, এত পরিকল্পনা থাকতেও সুন্দরবনের জন্য নতুন আরেকটি পরিকল্পনা প্রণয়ন শুধু মানুষের চোখে ধুলো দেয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। বিদ্যমান আইন ও পরিকল্পনার কথাই মানুষ জানে না, কেননা এরই মধ্যে অনেক অপ্রয়োজনীয় পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। বিদ্যমান বনজ সম্পদ পরিকল্পনাসমূহ উপেক্ষা করে শুধু সুন্দরবনের জন্য পৃথক একটি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করলে তা প্রশাসনিক জটিলতা ও বিভিন্ন সমজাতীয় পরিকল্পনার মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করবে মাত্র। বরং সুন্দরবন সম্পর্কিত কোনো বিশেষ পরিকল্পনা থাকলে তা বিদ্যমান সামগ্রিক বন মহাপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

 


এই পরিবেশ আইনবিদ জানান, খসড়া প্রতিবেদন প্রণয়নকারী দলের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি তার মতামত জানালে এবং তাদের স্বেচ্ছাসেবায় সহযোগিতার প্রস্তাব দিলেও তারা তা নিতে অস্বীকার করেন। এমনকি দলটির প্রধান তাকে এক ইমেইলের জবাবে জানান যে, ‘এখানে আইনবিদের প্রয়োজন নেই, এটা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের কাজ’। তবে রায়হান খালিদ মনে করেন, এটা বরং উল্টো। আইন বিশ্লেষণের জন্য আইনবিদ প্রয়োজন। যারা এটি করেছেন তারা এখতিয়ার বহির্ভূত কাজ করেছেন এবং এর ফলে এরকম মারাত্মক সব ভুল তৈরি হয়েছে, যা কিনা এর উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।

 

কী বলছে এসইএ’র খসড়া


এসইএ খসড়া প্রতিবেদনটি ৪০০ পৃষ্ঠা দীর্ঘ। নিয়মমাফিক এখানে বিভিন্ন আইন ও নীতির ধারাসমূহ বিশ্লেষণ করে দেখার কথা যে, সেগুলো ব্যবহার করে বনের জন্য ক্ষতিকর কোনো উন্নয়ন কার্যক্রম গৃহীত হওয়ার সুযোগ রয়েছে কিনা। এসই খসড়া সে বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। খসড়াটির মার্চ-এপ্রিল ২০২০-এর ‘স্ক্রিনিং পর্যায়’ অংশে বলা হয়েছে, ‘২৮টি খাত ও প্রধান ইস্যুগুলোর সাথে সম্পৃক্ত ৮৯টি নীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচির পর্যালোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের আইনি ও বিধিনিষেধ বিষয়ক তত্ত্বকাঠামোর পর্যালোচনা’র কথা বলা হয়েছে। তবে কী এই আইনি পর্যালোচনা এবং সেই পর্যালোচনা থেকে কী মিলল, কোন নীতি বা আইনের কোন ধারাগুলো বনরক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তা এই প্রতিবেদনে নেই। 

 


খসড়াটির যে কার্যকরী সারসংক্ষেপ বা এক্সিকিউটিভ সামারি, তার প্রথম লাইন বলছে, এই এসইএ’র লক্ষ্য হচ্ছে উন্নয়নের প্রভাব নিরূপণ করা (এইমস টু অ্যাসেস দ্যা ইমপ্যাক্টস অফ ডেভেলপমেন্ট) । অথচ উন্নয়নের কোনো এসই হয় না, ওটার জন্য হয় ইআইএ, আর আইনের ক্ষেত্রে হয় এসইএ। কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এ ধরনের প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপটুকুই সাধারণত অনুসৃত হয়। 

 


প্রতিবেদনটি গবেষণাধর্মী নয়, বরং অনেকক্ষেত্রেই অনুমানভিত্তিক বলে মত বিশ্লেষকদের। এবং সেই অনুমানও এই বন নিয়ে যেসব উদ্বেগ রয়েছে, সেগুলোর বিপক্ষে। যেমন, বায়ু ও পানি দূষণ কমে যাওয়ার অনুমান করা হয়েছে সুনির্দিষ্ট কোনো উপাত্ত ছাড়াই। এর সপ্তম অধ্যায়ে ৯টি মূল খাতের গভীরতর বিশ্লেষণ করা হলেও তাতে আইন, বিধিবিধান বা নীতিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এর অধ্যায় ৫ বলছে যে, ‘এসইএ পিপিপি’র প্রভাব নিরূপণ করতে চায়।’ অথচ এসইএ’র কাজ হওয়ার কথা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি নীতির কোন অংশটি পরিবেশবান্ধব নয় বা পরিবেশের পক্ষে হুমকি কিনা তা খুঁজে বের করা। এটা আবারও দেখিয়ে দেয় যে, খসড়া প্রণেতারা উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে ছিলেন।

সবচেয়ে বড় কথা, এসইএ যেটা করা হয়েছে সেটা যে কতখানি গ্রহণযোগ্য সেটা নিয়ে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে, আমরা আশা করব যে সরকার ‘এসইএ করেছি’- এই কথাটা বলে একটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে সুন্দরবনের সর্বনাশ ডেকে আনতে কোনরকম অসৎ কর্মকাণ্ডের মধ্য নিজেকে জড়িত করবে না। কারণ সুন্দরবন হচ্ছে একটা বিশ্ব ঐতিহ্যের ব্যাপার। আমরা তার হেফাজতকারী।


বিভিন্ন আইন নিয়ে আলোচনা হয়েছে প্রচুর। কিন্তু কোথাও কোনো সংশোধনীর প্রস্তাবনা নেই। এই এসইএ’র অধীনে সুন্দরবন অঞ্চলের যে ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা তথা এসইএমপি করা হয়েছে, ১০০ পৃষ্ঠার সেই প্রতিবেদনে কোনো আইন বা নীতি পরিবর্তনের ব্যবস্থা নেয়ার কথা কোথাও বলা হয়নি। এর মধ্যে নীতি বা আইন নিয়ে মাত্র দুটি বাক্য রয়েছে, সেখানেও সুনির্দিষ্ট কিছু বলা নেই। পুরো প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিরাজমান বিধিনিষেধ আর নির্দেশনাগুলো (রেগুলেশনস অ্যান্ড গাইডলাইনস) মেনে চলাকেই পরিবেশগত ও সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে যথেষ্ট বলে ধরে নেয়া হয়েছে। এসব বিধিনিষেধ আর নির্দেশনাগুলো ত্রুটিপূর্ণ কিনা, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য আদৌ যথেষ্ট কিনা, সেই প্রসঙ্গ সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

 


ক্ষতি প্রশমন ও ঝুঁকি নিরূপণের মানদণ্ডগুলো তৈরি করা হয়েছে এটা স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়ে যে, চলমান বিধিনিষেধ আর নির্দেশনাগুলোই যথেষ্ট, সরকার এগুলো মেনে চললেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা যাবে। যদিও এর চতুর্থ অধ্যায়ে একবার স্বীকার করে নেয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশে যেসব পরিবেশগত ও সামাজিক সুরক্ষা রয়েছে, অর্থাৎ বিদ্যমান বিধিনিষেধ ও নির্দেশনাগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত মানের সাপেক্ষে অপ্রতুল হতে পারে এবং এসব কিছুর ‘পর্যালোচনা ও পরিমার্জনা’ প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু সেগুলো কী কী তা উল্লেখ করা হয়নি।

 

পরিবেশবিদ ও সংগঠকরা যা ভাবছেন


সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি আইনজীবী সুলতানা কামাল দৃকনিউজকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই আমরা বলে আসছি যে, এই সমস্ত প্রকল্পে একটা বিজ্ঞানভিত্তিক, তথ্যভিত্তিক এসইএ হওয়া উচিৎ। আমরা জানি যে সরকার দীর্ঘদিন ধরেই এই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেছে। এসইএ করার কোন উদ্যোগ তারা নেয়নি। ইদানীং আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে তারা এসইএ করার একটা উদ্যোগ নিয়েছে কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা জানতে পারি যে সেই এসইএ-টা আসলে সেরকমভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক হয়নি এবং সবচেয়ে বড় কথা, এটা একটা আলাপ-আলোচনা, পরামর্শভিত্তিক হওয়া উচিৎ ছিল, যারা এই সমস্ত ব্যাপারে বিশারদ-বিশেষজ্ঞ, যারা এই বিষয় নিয়ে কাজ করছেন তাদের সঙ্গে এটা আলোচনা করা উচিৎ ছিল - সেরকম কোন কিছুই হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, এসইএ যেটা করা হয়েছে সেটা যে কতখানি গ্রহণযোগ্য সেটা নিয়ে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে, আমরা আশা করব যে সরকার ‘এসইএ করেছি’- এই কথাটা বলে একটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে সুন্দরবনের সর্বনাশ ডেকে আনতে কোনরকম অসৎ কর্মকাণ্ডের মধ্য নিজেকে জড়িত করবে না। কারণ সুন্দরবন হচ্ছে একটা বিশ্ব ঐতিহ্যের ব্যাপার। আমরা তার হেফাজতকারী।’

 


তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা আরো যোগ করেন, ‘সরকার আশা করি এ ব্যাপারে আবার বিবেচনা করবে এবং ‘এসইএ করেছি’ এই কথা বলে আমাদেরকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে সুন্দরবনের সর্বনাশের পথে এগোবে না- এটাই আমরা আশা করব।’

 


এ বিষয়ে সুন্দরবন বাঁচাও আন্দোলনের পদক্ষেপ সম্বন্ধে তিনি বলেন, ‘একটা গণতান্ত্রিক সমাজে তো জনগণ কোনো কথা বললে সেটাই সরকারের শোনার কথা। কিন্তু সেটা আমরা পাচ্ছি না, কারণ এখানে গণতন্ত্র সেভাবে কার্যকর নয়। আমরা একটা অন্য ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে চলছি। সেজন্য আমাদের কাজটা খুবই কঠিন হয়ে গেছে। প্রথম কথা হচ্ছে, আমাদের এ ব্যাপারে আরও সোচ্চার হতে হবে। আমাদের আরও কন্ঠ তুলতে হবে যে আমরা এটা হতে দিতে পারি না। আর আন্তর্জাতিকভাবে যে ঘটনাগুলো ঘটে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেখানেও অনেক ধরনের স্বার্থ খেলা করে। তারা হয়তো অর্থও অনেক বেশী খরচ করতে পারে! যাদের অন্য ধরণের প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে, তারা অনেক সময়ে জিতে যায়। যাই হোক, সেখানেও আমাদের যতটা সম্ভব, তথ্যগুলো পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। বিশ্বাস হারালে তো চলবে না, আমাদেরকে চিন্তা করতেই হবে যে কিভাবে আমরা সুন্দরবন বাঁচাতে পারি এবং আমাদেরও কৌশল আরও দৃঢ়তর করতে হবে।’

 


বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দৃকনিউজকে বলেন, ‘এই এসইএ কোন স্বচ্ছ নিয়ম মেনে করা হয়নি এবং সেখানে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না। যে পদ্ধতিগত বিষয়গুলো মেনে নিরপেক্ষ, এসইএ করা হয়, সেই বাস্তব বিষয়গুলো এখানে একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। এটা এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে করে সরকারের যে বিতর্কিত প্রকল্পগুলো সুন্দরবনের জন্য হুমকির সৃষ্টি করবে, সেগুলোকে যেন বৈধতা দেয়া যায়।’

 


পুরো বিষয়টার মধ্যে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো যতটা না প্রাধান্য পাচ্ছে, তার চেয়ে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ বেশি প্রভাব ফেলছে বলে অভিমত এই পরিবেশ আইনবিদের। তিনি বলেন, ‘ইউনেস্কোর যে বৈজ্ঞানিক দল আছে, কারিগরি পর্যবেক্ষক দল আছে, সেই কারিগরি দল বারবারই কিন্তু রামপালের ব্যাপারে আপত্তি তুলেছে এবং রামপালের ইআইএ’র ব্যাপারেও তারা সন্তুষ্ট ছিল না। ছিল না বলেই এই এসইএ করা। কিন্তু ইউনেস্কোর যে রাজনৈতিক কাঠামোটি আছে, বৈজ্ঞানিক দলটি ওই রাজনৈতিক দলটিকেই সহযোগিতা দেয়। গবেষণা করে দেয়, তারা হ্যাঁ বা না বলে। যখন এই বৈজ্ঞানিক দলটি রাজনৈতিক দলটিকে বলবে, তারা তখন বেশ একটা কৌশলী ভূমিকা নিয়ে নেয়। এখানেও কৌশলী অবস্থান নিয়ে নেওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে কারণ রামপালের এই প্রকল্পের সাথে এবং সুন্দরবনের অভ্যন্তরীণ নৌপথকে কয়লা পরিবহনের জন্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থ আছে, চীনেরও স্বার্থ আছে। সুতরাং ওই রাজনৈতিক কাঠামোটিতে কেবল বাংলাদেশ একা বক্তব্য দেয় না, তার সঙ্গে চীন, রাশিয়া এবং ভারত সকলেই একত্রিত হয়ে বাংলাদেশের পক্ষে বলতে থাকে। ওটা যেহেতু একটা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম, সেজন্য তারা খুব একটা গভীরে না গিয়ে এই একটা এসইএ করে নিয়ে আসো– এরকম সমাধানের দিকে চলে যায়। 

 


সরকার যে ধরনের এসইএ করেছে, ইউনেস্কো এটা মানবে কিনা, সে প্রসঙ্গে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সম্ভাবনা আছে এটা তারা মেনে নিবে, তেমনি এটা ওরা মানবে না, সেই সম্ভাবনাও থাকছে। কারণ অনেক সময়ে আপনি দেখেছেন যে সমস্ত সাইট, ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে চিহ্নিত থাকে, তার মধ্য বেশ কয়েকটাকে কিন্তু তারা ঝুঁকিপূর্ণ সাইটের তালিকায় দিয়ে দেয়। সেক্ষেত্রে এরকমও হতে পারে যে, এই এসইএ-তে তারা সন্তুষ্ট না হয়ে সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় ঢুকিয়ে দিতে পারে। 

 


খসড়া এসইএ তাহলে কিসের ভিত্তিতে করা হলো, সে সম্বন্ধে চূড়ান্ত মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আই উড সে, বুরোক্রেসি অ্যান্ড পলিসি’ (আমি বলব যে, এটা আমলাতন্ত্র ও তাদের নীতির আলোকে করা হয়েছে)।

বিদেশি কোম্পানি বিপজ্জনক প্রকল্পকে বৈধতা দেওয়ার জন্য প্রতারণা করে, ভুল তথ্য দেয়, একটা দেশের সম্পদ দখল করার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বাংলাদেশের সরকার বাংলাদেশ বিনাশী, সুন্দরবন বিনাশী একটা প্রকল্প এবং সেই অঞ্চলের বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকর প্রকল্পকে বৈধতাদানের জন্য নানা রকম প্রতারণা, মিথ্যাচার এবং ভুল তথ্যের আশ্রয় নিচ্ছে এবং সবকিছুই বলা যায় জনগণের কাছ থেকে সম্পূর্ণ আড়ালে রেখে। এই সমীক্ষা, পুরো প্রকল্প এবং সরকারের পুরো তৎপরতাই আমরা প্রত্যাখান করি। এটা গ্রহণ করার কোনো প্রশ্নই আসে না।


তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সাবেক সদস্য সচিব ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ দৃকনিউজকে বলেন, ‘সরকার এ পুরো বিষয়টা নিয়ে প্রথম থেকেই প্রতারণা করছে। প্রতারণা এবং মিথ্যাচারের ওপর ভিত্তি করেই পুরো প্রকল্পটা দাঁড়ানো। ইআইএ করার সময়েই তারা প্রতারণা করেছে। সেটার মধ্যে সুন্দরবনকে গ্রাম হিসেবে দেখানো হয়েছিল। যাতে পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপদগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া যায়। তারপর এ নিয়ে যখন আপত্তি এবং সেটা বাতিলের দাবি উঠতে থাকে, তখন সরকার অন্যদিকে চুক্তি করতে থাকে। ইউনেস্কো যখন পরিষ্কারভাবে তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে যে, রামপাল সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর, রামপাল প্রকল্পটাকে এখান থেকে সরাতে হবে, সরকার তখন তদবির করে অন্য দেশের কাছে যাতে সুন্দরবন বিনাশী এই প্রকল্প বৈধতা পায়। যাতে ইউনেস্কো এই প্রকল্পের পক্ষে থাকে বা ইউনেস্কো এই প্রকল্পের বিপক্ষে শক্তিশালী অবস্থান না নেয়। এই তদবিরের কাজে বাংলাদেশের সহযোগী হচ্ছে ভারত এবং চীন। কারণ এই দুটি দেশই বিভিন্ন কয়লা-ভিত্তিক প্রকল্প বাংলাদেশে করছে।’

 


সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম এই নেতা বলেন, ‘এতসব তদবির করার পরেও ইউনেস্কো শেষ পর্যন্ত একটা শর্ত দিয়েছিল যে, একটা এসইএ করতে এবং এটা করার আগ পর্যন্ত সকল প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখার সুপারিশও করেছিল তারা। কিন্তু কোনো প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখেনি সরকার। সরকার ক্রমাগত মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়ে গেছে ইউনেস্কোর কাছে যে, তারা খুব ভালোভাবে সুন্দরবনের রক্ষণাবেক্ষণ করছে। দেখা গেছে, রামপালে কাজ হচ্ছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ অতি দূষণপ্রবণ অনেকগুলো প্রকল্পকে সবুজ, নিরাপদ বলে অনুমোদন দিয়েছে সরকারের পরিবেশ কমিটি। ফলে যে সমীক্ষাটা হয়েছে, তার মধ্যে যথাযথ তথ্য নেই।

 


বিভিন্ন পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে এটা হওয়ার কথা থাকলেও অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ জানান, সুন্দরবন নিয়ে গত ১০ বছরে সাংগঠনিকভাবে, ব্যক্তিগতভাবে দেশ-বিদেশের যারা কথাবার্তা বলছেন, তাদের কারো সঙ্গেই যোগাযোগ করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এটা বানানো হয়েছে কিছু লোকজন দিয়ে, তারা তাদের মুখস্ত কিছু কথাবার্তা বলেছে। এভাবে যদি চলতে থাকে, এটা যদি চলতেই থাকে, তাহলে সুন্দরবন শেষ হবে, বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। এবং এটা অবধারিত, এতে কোন সন্দেহ নেই। 

 


অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ আরো যোগ করেন, বিদেশি কোম্পানি বিপজ্জনক প্রকল্পকে বৈধতা দেওয়ার জন্য প্রতারণা করে, ভুল তথ্য দেয়, একটা দেশের সম্পদ দখল করার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বাংলাদেশের সরকার বাংলাদেশ বিনাশী, সুন্দরবন বিনাশী একটা প্রকল্প এবং সেই অঞ্চলের বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকর প্রকল্পকে বৈধতাদানের জন্য নানা রকম প্রতারণা, মিথ্যাচার এবং ভুল তথ্যের আশ্রয় নিচ্ছে এবং সবকিছুই বলা যায় জনগণের কাছ থেকে সম্পূর্ণ আড়ালে রেখে। এই সমীক্ষা, পুরো প্রকল্প এবং সরকারের পুরো তৎপরতাই আমরা প্রত্যাখান করি। এটা গ্রহণ করার কোনো প্রশ্নই আসে না। 

 


বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল এ প্রসঙ্গে দৃকনিউজকে বলেন, এসইএ’র খসড়া প্রস্তুত করার পর তারা একটা জাতীয় কর্মশালা করেছিল চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে, সেখানে আমাদেরকে ডেকেছিল। আমরা আমাদের মতো গিয়েছি। লিখিত মতামতও দিয়েছি। আমরা বলেছি যে, সমীক্ষাটা স্বাধীনভাবে হয়নি। এটা করেছে সিইজিআইএস। তারা এটা স্বাধীনভাবে করবে বলে আমরা মনে করি না। কারণ তারা সরকারের প্রভাবে চালিত প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া এটার মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক অনেক ফাঁকি রয়েছে, দুর্বলতা রয়েছে। সমীক্ষা করতে যে বিজ্ঞানের ভিত্তিতে সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করা উচিৎ, সেগুলো করা হয়নি। সর্বোপরি এটা তো বাংলাদেশের মানুষের জন্য হচ্ছে, কিন্তু খসড়াটি বাংলায় করা হয়নি। কাজেই এটা মূলত যে উদ্দ্যেশ্যে করেছিল যে, সুন্দরবনসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ বা ওই এলাকাটাকে সংরক্ষিত রাখার জন্য সুপারিশ করা, সেটা এই এসইএ থেকে আসছে না। বরং যে সমস্ত কাজ এই এলাকার ক্ষতি করবে সেগুলোকে বৈধতা দেওয়ার একটা অবস্থায় যাচ্ছে এটা।

 


পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের এই সংগঠকের মতে, সমস্যার কারণগুলো যদি চিহ্নিত না করা যায়, তাহলে সমস্যা আসতেই থাকবে। তিনি বলেন, ‘যেমন ধরেন রেড-ক্যাটাগরি ইন্ডাস্ট্রিকে (অতিদূষণপ্রবণ শিল্প) গ্রিন-ক্যাটাগরি করে (নিরাপদ শিল্পের তলিকায়) ফেলা হল। সরকারের কাগজ পরিবর্তন করলে তো দূষণ নিয়ন্ত্রণ হয় না। একটি শিল্প যে ধরনের দূষণ করে, তাকে হঠাৎ করে অন্যভাবে চিহ্নিত করা শুরু করে দিলে তো এটা বৈজ্ঞানিক বিশুদ্ধতা হারাল। শরীফ জামিল আরো জানান, সিইজিআইএস-কে দেয়া পর্যবেক্ষণের কোনো জবাব এখনো তারা পাননি। তারা লিখিত জবাব দেয়ার কথা থাকলেও এখনো সেটা তারা দেয়নি।

 

এসই প্রণেতাদের বক্তব্য


এসইএ প্রণয়নের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান সিআইজিএস বরাবর দৃকনিউজ-এর পক্ষ থেকে ইমেইল পাঠিয়ে এ বিষয়ে বক্তব্য চাওয়া হলেও তারা মেইলের কোন জবাব দেননি। পরবর্তীতে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা এ খানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আপনারা কাকে মেইল করেছেন আমি তো জানি না, এটা তো সাধারণত আমাদের যে বিভাগ এটা দেখে, তাদের সঙ্গে কথা বলে আমি জানাচ্ছি।’ এ সময় জিজ্ঞেস করা হয় যে, এসই’র অধীনে আপনারা কোনো আইন বা নীতি সংশোধনের কোনো প্রস্তাব কি এনেছেন? খসড়া এসইএ ও এসইএমপিতে আমরা সেরকম কিছু পাইনি। এমন প্রশ্নের জবাবে মালিক ফিদা এ খান বলেন, ‘যদি তা না লাগে, তাহলে এটা আসবে কেন?’ তিনি আরো মন্তব্য করেন, ‘এসইএটা কী, এটা তো বুঝতে হবে, যাই হোক আমাদের যারা কাজ করেছেন, সেই বিভাগের সঙ্গে কথা বলে আমি আপনাদের প্রশ্নটার উত্তর দিচ্ছি।’

 


এই প্রতিবেদন প্রকাশ অবধি আমরা তাদের দিক থেকে কোনো জবাব আর পাইনি। একই প্রশ্ন পেশ করে আমরা ইমেইল করেছিলাম সিইজিআইএসকে কারিগরি সহায়তা দেয়া দল ইন্টেগ্রা কনসাল্টিংকেও। তাদের দিক থেকেও এ অবধি কোনো জবাব আসেনি। দৃকনিউজ এ বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত রেখেছে এবং আগামীতে তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া গেলে সেটি এখানে সংযুক্ত করা হবে।

 

 

প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সায়রাত সালেকিন সাত্বিক

Your Comment