হাসেম ফুডসে ঝলসানো প্রাণ দৃকের ৩২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আলোকচিত্রে প্রতিবাদ
২০২১-০৯-০৪
দৃকের ৩২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ঘিরে কোনো আনন্দোৎসব নয়, কারখানায় নির্মম হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে দেয়ালে ঝুলছে ফ্রেমবন্দি প্রতিবাদ। দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন, আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী, কোথাও উঁড়ছে ছাই, উদ্ধার কার্যক্রমে ছোটাছুটি, স্বজনদের আহাজারি এবং আহত শ্রমিকদের ক্ষত-বিক্ষত শরীরের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে প্রদর্শনীর দেয়ালে। গত ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডসে অগ্নিকাণ্ড নিয়ে আয়োজন করা হয় এই আলোকচিত্র প্রদর্শনীর।
‘হাসেম ফুডসে ঝলসানো প্রাণ’ শিরোনামে দৃক পিকচার লাইব্রেরি আয়োজিত প্রদর্শনীটি ৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পান্থপথের দৃকপাঠ ভবনের দ্বিতীয় তলায় দৃক গ্যালারিতে উদ্বোধন হয়। অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা উঠে আসে আলোকচিত্রী সুমন পাল, ইশতিয়াক করিম, পারভেজ আহমেদ ও শহিদুল আলমের তোলা ছবিতে।
৪ সেপ্টেম্বর বিকাল সাড়ে ৫টায় প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়। গ্যালারির একাংশ তালাবদ্ধ কারখানার আদলে সাজানো হয়। সেখানে ছবির সঙ্গে ছিল আগুনে পুড়ে যাওয়া প্রতীকি ধ্বংসাবশেষ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন দৃকের প্রতিষ্ঠাতা ও আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। সেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘিরে হৃদয় বিদারক অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন আলোকচিত্রী সুমন পাল। বক্তব্যের মাঝেই ঠিক ৫টা ৪৮ মিনিটে বিকট শব্দে বেজে ওঠে সাইরেন। এরপর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মৃত্যুবরণ করা ৫৪ শ্রমিকের নাম সমস্বরে উচ্চারিত হয় গ্যালারিতে। সেদিন হাসেম ফুডসে আগুন লাগার পর ঠিক এই সময়েই একজন শ্রমিক তার স্বজনদের উদ্দেশে সাহায্য চেয়ে একটি খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলেন।
হাসেম ফুডসে অগ্নিকাণ্ডে সরকারি হিসাবে ৫২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও নাগরিক তদন্তে স্বজনরা জানায় আরও দুই শ্রমিকের লাশ নিখোঁজ রয়েছে। নিহত ৫৪ জনের একজন ১৮ বছর বয়সী রিপন মিয়া ইয়াসিন। বড় হয়ে কবি হতে চেয়েছিলেন ইয়াসিন। অনুষ্ঠানে তার কবিতা ‘১৬ ডিসেম্বর’ আবৃত্তি করে শোনান দৃকের প্রতিষ্ঠাতা ও আলোকচিত্রী শহিদুল আলম।
এই পর্যায়ে আলোকচিত্রীদের পক্ষ থেকে নিজ অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন আলোকচিত্রী সুমন পাল। হৃদয়বিদারক সেসব মুহূর্ত, নিজের অভিজ্ঞতা, ভুক্তভোগী শ্রমিক পরিবারের সঙ্গে কথোপকথনের বর্ণনা দিতে দিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি জানান, কারখানায় মৃত্যু হওয়া এক শ্রমিকের শিশু সন্তানের সঙ্গে হাসপাতালে কথা হয় তার। শিশুটি ডিএনএ নমুনা দিতে ঢাকা মেডিকেলে আসে। শিশুটিকে যখন প্রশ্ন করা হয়, তার মা কোথায়? তখন সে জানায় মা গ্রামের বাড়িতে আছে। ওই শিশুটি আসলে জানেই না, তার মা আর নেই। মায়ের লাশ শনাক্তের জন্যই সে আজ এখানে। তিনি আরও জানান, এই অগ্নিকাণ্ডের ছবি তুলতে গিয়ে মর্মান্তিক চিত্র দেখার পর তিনি বেশ কিছুদিন বিষণ্নতায় ভুগেছেন।
ইয়াসিনের কবিতার খাতাসহ শ্রমিকদের পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া তাদের ব্যবহৃত বেশকিছু সামগ্রীও স্থান পেয়েছে এই প্রদর্শনীতে। ১৯৯০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বেশকিছু বড় অগ্নিকাণ্ড ও শ্রমিক হতাহতের সংখ্যা তুলে ধরা হয় প্রদর্শনীর দেয়ালে। এতে ডিজিটাল স্ক্রিনে নির্মম হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হিসেবে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় ৫৪ শ্রমিকের জীবনের গল্প। https://scorchedlivesathashemfoods.com/ শীর্ষক ওয়েব লিংকে গিয়ে নিহত শ্রমিকদের ছবি ও নামে ক্লিক করলেই ভেসে ওঠে মৃত্যুর শেষ মুহূর্তে পরিবারের সঙ্গে শেষ কথা, অলিখিত স্বপ্ন ও থমকে যাওয়া জীবনের গল্প।
গবেষকদলের কাছ থেকে জানা যায়, করোনা পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাতেই কারখানায় কাজে যোগ দেন সন্তানেরা। বয়স কম থাকায় এর মাঝে অনেকেরই বাড়ি থেকে কাজের সম্মতি ছিল না। কারখানার দালাল, এলাকার পরিচিত লোকজন ও স্বজনদের মাধ্যমেই হাসেম ফুডসে যোগ দেন বেশিরভাগ শিশু-কিশোর। এমনকি পরিবারকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েও এসেছেন কেউ কেউ। স্কুল বন্ধ থাকায় অভাবের সংসারে খানিকটা আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরানোই ছিল তাদের লক্ষ্য। কান্নাজড়িত কণ্ঠে ও বুকে কষ্ট চেপে দৃকের কাছে হারানো সন্তানদের গল্প বলেছেন পরিবারের সদস্যরা।
আলোকচিত্র গ্রহণের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের পর অনুষ্ঠানে নিহত শ্রমিকদের স্মরণে খালি গলায় গান করেন সংগঠক ও শিল্পী বীথি ঘোষ। হাসেম ফুডসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নাগরিক তদন্ত কমিটিতে কাজ করা এই শিল্পী জানান, মৃতের সংখ্যা ৫২ নাকি ৫৪ সেটির সুরাহা সরকার প্রশাসনকেই করতে হবে। তদন্তে বাড়তি যে দুই জনের নাম উঠে এসেছে, তারা কোথায় সেটির দায় সরকারকেই নিতে হবে।
মানুষকে দাসে পরিণত করে উন্নয়ন ও মুনাফার সৌধ নির্মাণ করা হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন নাগরিক তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘হাসেম ফুডসের আগুনের ঘটনায় নাগরিক তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করে। অগ্নিকাণ্ডের ৯ দিন পরেও কারখানায় গিয়ে চারতলায় আগুন দেখি। তদন্ত কমিটির সদস্যরা শ্রমিকের হাড়ও খুঁজে পান। অবশ্য সরকারি তদন্ত কমিটি এবং কারখানার সংশ্লিষ্টরা সেই হাড় সরিয়ে ফেলে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে অনেক উন্নয়নের গল্প শুনি, তবে একের পর এক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে মানুষের প্রাণ গেলেও কারখানায় শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না।’
হাসেম ফুডসে আগুন নেভানোর নূন্যতম কোনো ব্যবস্থা ছিল না জানিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, ‘যেখানে দাহ্য পদার্থ থাকার কথা নয়, সেখানে দাহ্য পদার্থ ছিল। যেখানে তালা লাগানোর কথা নয়, সেখানে তালা লাগানো ছিল। একশ্রেণির দালালের মাধ্যমে কারখানায় শ্রমিক সরবরাহ করা হয়। বয়স কম হলে কম টাকায় নিয়োগ দেওয়া যায়। বড় বড় এসব উন্নয়ন প্রকল্পে মানুষের সুরক্ষা নেই, প্রাণ-প্রকৃতি কারও নিরাপত্তা নেই।’
আনু মুহাম্মদ আরো বলেন, এই অগ্নিকান্ডের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এই ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তবে সেই ধারাবাহিকতায় কোনো গণমাধ্যম আর হত্যাকাণ্ড বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে পারছে না। প্রশ্ন আসে না তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ঘিরেও। পরিস্থিতি এমন যে ক্ষমতাকে প্রশ্ন তোলাই অপরাধ, বলেন এই অধ্যাপক।
আলোকচিত্রী শহিদুল আলম তার বক্তব্যে বলেন, ‘এমন মৃত্যু আগেও আমরা দেখেছি। সারাকা থেকে তাজরীন, স্পেকট্রাম থেকে রানাপ্লাজায় এই দেশের শ্রমিক ভাই-বোনেরা নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। যতদিন না পর্যন্ত আমরা শোষণমুক্ত হব ততদিন এমন ভয়াবহতা চলতেই থাকবে। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে আগুনে পোড়া মৃত্যুর যন্ত্রণা তুলে ধরতে চাই। এটাই আমাদের প্রতিবাদ।’
কারখানায় কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকার ও বিচার ব্যবস্থার চলমান উদাসীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই এমন আয়োজন বলেও জানান শহিদুল আলম। পাশাপাশি নিপীড়িত এই মানুষদের পাশে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান তার।
প্রদর্শনীতে আসা ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিক্সন বলেন, ‘এটি একটি শক্তিশালী আয়োজন। অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুরা যেখানে কাজ করত সে কারখানায় শ্রমিকদের সুরক্ষায় উপযুক্ত ব্যবস্থা ছিল না। এমন ট্রাজেডির সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্ত জরুরি।’ এমন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জবাবদিহির পাশাপাশি দ্রুত বিচার নিশ্চিত করাও জরুরি বলে মত দেন তিনি।
টানা ১৭ দিনব্যাপী প্রদর্শনী শেষ হবে ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১। প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে ৮টা পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে প্রত্যেকের জন্য উন্মুক্ত এই প্রদর্শনী।