“পিশাচের আবার বিচার কী?”
“পিশাচেরও বিচার আছে। পিশাচের কথাও আমরা শুনব। সে কেন পিশাচ হয়েছে এটাও দেখব।”
হলুদ হিমু কালো র্যাব, হুমায়ূন আহমেদ, অন্যপ্রকাশ, ২০০৬
১.
সময়টা তখন ২০১০ সাল। তারিখ ২২ মার্চ। স্থান ধানমণ্ডির দৃক গ্যালারি। সেদিন সোমবার দুপুরে আকস্মিক পুরো ভবন ঘিরে ফেলে রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী। আন্তর্জাতিক আঙিনায় সুপরিচিত ও দেশের বরেণ্য আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের শুরু হতে যাওয়া একটি প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল “ক্রসফায়ার”। এ ঘটনায় সে সময় তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়। যদিও আমাদের জনপদে শিল্পচর্চায় রাষ্ট্রীয় বাধা নতুন নয়। তেমনি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের পথচলার শুরু থেকে “বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড”ও কোনো অভাবিত বিষয় ছিল না।
অভাবিত, অকল্পিত ও অঘটিত বিষয় হচ্ছে তীব্র গুরুত্ববাহী অনেক বিষয়ে শিল্প সাহিত্যস্রষ্টাদের নিরবতা। “স্পর্শকাতর” আখ্যায় তা অনেকে এড়িয়ে যান। ভান করেন না দেখার। এই নিশ্চুপ থাকা আলোর উপস্থিতিহীন কালোকেই মদদ জোগায়। এ রঙহীন দশায় গুমরে হাহাকার থাকে বর্ণিলতার জন্য। একটি শিশুর “আব্বু, তুমি কানতেছো কেন?” প্রশ্ন হয়ে অনেক সময় তা সংবাদ শিরায় আসে।
সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত হিসেবে আমজনতা যাকে ভয় পেত, লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকরা যে বাস্তবতা নিয়ে কথা বলতে সাহস করতেন না, সেই কালো পোশাকধারী র্যাবকে নিয়ে প্রথম উপন্যাসটি লিখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এর বহু বছর পর ২০১৫ সালে মঈনুল আহসান সাবের র্যাবকে নিয়ে আরেকটি উপন্যাস লেখেন। যার নাম “আবদুল জলিল যে কারণে মারা গেল”।
হুমায়ূন আহমেদের ছবির অলংকরণ : হাসান মাহমুদ দোলন
২.
একজন হুমায়ূন আহমেদহীন এক দশক অতিক্রান্ত হলো আজ ১৯ জুলাই। ২০১২ সালের এ দিন তিনি নিউ ইয়র্কের বেলভিউ হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অনন্তলোকে পাড়ি জমান। ৭০ দশকের প্রথমভাগে হুমায়ূন আহমেদকে প্রথম আবিষ্কার করেন এ শতকের বাংলার অন্যতম মণীষী ও লেখক আহমদ ছফা। ড. আহমদ শরীফ উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন হুমায়ূনের প্রথম দিকের সাহিত্যকর্মের। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য জীবনের প্রথম স্বীকৃতি আসে ‘‘বাঙলাদেশ লেখক শিবির” পুরষ্কার অর্জনে। যে লেখক শিবিরে তখন সক্রিয় মায়েস্ত্রো আখতারুজ্জামান ইলিয়াস থেকে শুরু করে হাসান আজিজুল হক। অনেকের এমন মত যে, পরের সময়ে তিনি ‘‘বাজারি” ও ‘‘সস্তা” সাহিত্যের পথে হেঁটেছেন। এমন সমালোচকদের লেখা, কাজে-কর্মে-কথায় প্রায়ই মনে হয় ‘‘জনপ্রিয় সাহিত্য” ও ‘‘কালজয়ী সাহিত্য” দুটি ভিন্ন বিষয়। এ প্রেক্ষিতে হিমু সিরিজের ১৫তম বই ‘‘হলুদ হিমু কালো র্যাব” উপন্যাস নিয়ে আজ তার প্রয়াণ বার্ষিকীতে কিছু কথার অবতারণা।
দূরদৃষ্টির সক্ষমতায় একজন লেখক অন্য দশজনের চেয়ে আলাদা। ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ গঠিত হয় বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। রাষ্ট্রের এই বিশেষ বাহিনীর ভয়াবহতা লেখক হুমায়ূন টের পেয়েছিলেন বহু আগে। জীবন বিবাগী হলুদ রঙের পাঞ্জাবির হিমুকে তিনি তার কল্প সাহিত্যে দাঁড় করান কালো পোশাকের র্যাবের মুখোমুখি।
র্যাব তখন একদিকে আতঙ্কের অপর নাম। অপরদিকে সন্ত্রাস নামক ব্যাধির এক স্থায়ী সমাধান হিসেবে রীতিমত পূজিত। বিদ্যালয়ের যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতায় শিশুরা অস্ত্রধারী র্যাব সাজছে, র্যাবের পোশাক অনুকরণ চলছে। এমন একটা বিরুদ্ধ সময়ে হুমায়ূন আহমেদ বাউন্ডুলে হিমুর হলুদ রঙের প্রতীককে মুখোমুখি করলেন সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত র্যাবের কালো রঙের মোকাবিলায়। রঙের এই ব্যবহার নিয়েও কিছু কথা বলা যায়।
র্যাবের জন্য বিশেষ এই রঙের পোশাক বাছাইয়ের মাঝেও একটা মনস্তাত্ত্বিক ভীতিপ্রদর্শন আছে। আমাদের মনের মাঝে এক এক রঙের যে সাংস্কৃতিক তাৎপর্য আছে, বহুক্ষেত্রে যার মাঝে বর্ণবাদ আছে, আছে আরোপিত অর্থ, সেই প্রতীককে ব্যবহার করেই মৃত্যু, প্রশ্নহীন ক্ষমতা, ভীতি এসবের বার্তা হিসেবেই র্যাবের জন্য এই পোশাকটি নির্ধারিত হয়। হুমায়ূন তাই বাংলা সাহিত্যে সন্ন্যাসীবেশের প্রতীক হলুদকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন মৃত্যুর প্রতীকের সামনে। উপন্যাসটির বিরুদ্ধে র্যাব তখন একটি সংবাদ সম্মেলনও করেছিল। যেখানে বলা হয়েছিল, বাহিনীটির জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে এই উপন্যাস লেখা হয়েছে। কথাটি ভুল নয়, র্যাব বিশেষ এক ধরনের পূজা পেয়েছিল। জনপ্রিয় ধারার সাহিত্য করা হুমায়ূনের দিক থেকে এই রকম একটি বিষয় বাছাই করাটা সেদিক দিয়ে অত্যন্ত সাহসী এক কাজ ছিল।
৩.
উপন্যাসটিতে বরাবরের মতো হিমুর অতীন্দ্রিয় নানা কাণ্ড আছে। আছে তার মাজেদা খালা ও খালুকে নিয়ে তুমুল হাস্যরসাত্মক বর্ণনা। আলোচ্য সৃষ্টিতে ঢাকার পার্ক, যৌনকর্মী, মাদক বিক্রি, পুলিশি নজরদারি, শহরের বিবরণ বিভিন্ন বিষয়ে আলো ফেলেছেন হুমায়ূন আহমেদ। স্যাটায়ার, ফান তুমুলভাবে বিরাজিত তার অন্য সৃষ্টির মতো এ বইয়েও। কিন্তু সময় বিবেচনায় এ উপন্যাসের রাজনৈতিক গুরুত্ব এই ২০২২ সালে দাঁড়িয়েও কম নয়। হুমায়ূন আহমেদ যেন প্রমাণ করছেন শিল্প, সাহিত্যের জন্য অনুকূল পরিবেশ বলে কিছু নেই। প্রতিকূলতাতেই আসল সৃষ্টিমানের পরীক্ষা। তার এ উপন্যাস যারাই পড়বেন, তারই মনে হবে এ পরীক্ষায় অনবদ্য সাফল্য দেখিয়েছেন তিনি। প্রতিবাদে বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে শ্লোগান দেওয়া, মিছিল, মিটিং, বিবৃতি, কলাম লেখা, টক শো'র মাধ্যমে মানুষের কাছে বক্তব্য পৌঁছে দেওয়া মোটেই গুরুত্বহীন নয়। কিন্তু সর্বজনের কাছে সহজে পৌঁছার মতো এ বিষয় নিয়ে সার্থক একটি উপন্যাস বাংলা ভাষায় সক্রিয় কোনো লেখকের পক্ষেই তখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
ভীতির প্রতি হুমায়ূন খানিকটা তাচ্ছিল্যই ছুড়ে দিয়েছেন রসিকতা দিয়ে। উপন্যাসে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পড়া হিমু ছাড়া হয়তো কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না এমন পরিহাস করার। হিমু তাই এই উপন্যাসে একটা বিরাট বড় সামাজিক বিপ্লব, দেখা যাক হিমুর সেই দুরন্ত সাহসের প্রকাশকে:
বালতিতে কী?
পানি।
দেখাও। পানিও দেখালাম।
তোমার ব্যাগে কী?
একটা বই স্যার।
কী বই?
জঙ্গি বই স্যার। বিরাট বড় এক জঙ্গির জীবনকথা। জঙ্গির নাম চেঙ্গিস খান। নাম শুনেছেন কি-না জানি না।
দেখি বইটা। র্যাবের এই লোক (কথাবার্তায় মনে হচ্ছে অফিসার) বই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। বইটা কার?
আমার মামাতো বোনের মেয়ের। মেয়ের নাম মিতু। ভিকারুননিসা স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে। ছাত্রী খারাপ না। স্যার, আমি এখন যেতে পারি?
না। তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে।
আমি আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, 'স্যার ক্রসফায়ার হবে?'
অফিসার জবাব দিলেন না।
পুলিশের সঙ্গে র্যাবের এইটাই মনে হয় তফাত। পুলিশ কথা বেশি বলে। র্যাব চুপচাপ। তারা কর্মবীর। কর্মে বিশ্বাসী।
৪.
যে সহজ গভীর জীবন দর্শন হুমায়ূন আহমেদ এই উপন্যাসে দেখিয়েছেন, তার আরও কিছু পরিচয় পাঠকের সামনে তুলে ধরি, এই কথাগুলোই হয়তো বিচার বিষয়ে, হত্যা বিষয়ে, জীবন বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদের ভাবনা পাঠকের সামনে পরিষ্কার করতে যথেষ্ট হবে :
“তোমার মধ্যে আমাদেরকে রিডিকিউল করার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করছি। why?”
আমি বললাম, আপনারা মানুষের জীবন নিয়ে রিডিকিউল করেন, সেই জন্যেই হয়তো?”
শুভ্রের বাবা বললেন (তিনি আপনি আপনি করে বলছেন) আপনি কেন আমাদের কর্মকাণ্ড সমর্থন করেন না বলুন তো? আপনার যুক্তিটা শুনি। আপনি কি চান না ভয়ঙ্কর অপরাধীরা শেষ হয়ে যাক? ক্যান্সার সেলকে ধ্বংস করতেই হয়। ধ্বংস না করলে এই সেল সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
আমি বললাম, স্যার, মানুষ ক্যান্সার সেল না। প্রকৃতি মানুষকে অনেক যত্নে তৈরি করে। একটা ভ্রূণ মায়ের পেটে বড় হয়। তার জন্য প্রকৃতি কী বিপুল আয়োজনই না করে! তাকে রক্ত পাঠায়, অক্সিজেন পাঠায়। অতি যত্নে তার শরীরের একেকটা জিনিস তৈরি হয়। দুই মাস বয়সে হাড়, তিন মাস বয়সে চামড়া, পাঁচ মাস বয়সে ফুসফুস। এত যত্নে তৈরি একটা জিনিস বিনা বিচারে ক্রসফায়ারে মরে যাবে- এটা কি ঠিক?
জনপ্রিয় লেখক হিসেবে নিপুণ কৌশলে সত্য বলে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। আর তা প্রচারিত হয়েছে বিপুল মানুষের ভেতর। সমাজ, রাষ্ট্রের রূপান্তরে যারা কাজ করেন তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই জাদুকরের এমন সৃষ্টি। বৃষ্টি দেখা, জোছনা ভালোবাসার মতো অনেক অমোঘ সত্য বোঝার জন্য হলেও আমাদের হুমায়ূন আহমেদের কাছে ফিরতে হয়। তার প্রয়াণের এক দশক পর এ সত্য উপেক্ষা অসম্ভব। কল্প সাহিত্যে হলুদের কাছে এই সশস্ত্র কালো রূপী ঘাতকের নত হওয়া আমাদের বাস্তবের চলমান লড়াইয়ে জেতার ইঙ্গিত। তাই প্রয়াণ সত্ত্বেও আমাদের আসছে বিজয় উৎসবের সারথী হয়ে থাকছেন লোকান্তরিত হুমায়ূন।
হাসান শাওন | লেখক, সাংবাদিক