সেনাবাহিনী না ব্যবসা প্রতিষ্ঠান: পাকিস্তানের বর্তমান পরিণতির কারণ যে প্রতিষ্ঠানটি
২০২২-০৬-০৮
ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের একটি পুরনো রেকর্ড অক্ষুন্ন থেকেছে। সেটি হলো, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই দেশটির কোন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কখনোই তার মেয়াদ পূর্ণ করতে সক্ষম হননি। পাকিস্তানের এই নিয়তি কি স্রেফ কাকতালীয়? একদমই না। বরং পাকিস্তান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের অনুমান হলো, নিজেদের কোটারি স্বার্থ রক্ষা করতে দেশটির জন্মলগ্ন থেকেই সামরিক বাহিনী রাজনীতিকে কঠোরহস্তে নিয়ন্ত্রণের যে পদ্ধতি নির্মাণ করেছে, তারই পরিণাম পাকিস্তানের রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুর ওপরই সেনাবাহিনীর একাধিপত্য। পাকিস্তানের সেনাব্যবসা কীভাবে দেশটির রাজনীতিতে একটি নির্ধারক ভূমিকা পালন করে চলেছে এই লেখাটিতে তা খতিয়ে দেখা হয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়ে অনলাইনে প্রাপ্ত একটি বিদ্রুপ:
সাধারন এই পাকিস্তানী যা কিছু কিনছেন, সকলই ফৌজের তৈরি করা। কিন্তু তার কাছ থেকেই আবার টাকাও আদায় করছে ফৌজ।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন ও রাজনৈতিক দলের হাতে দেশের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়া এড়াতে পাকিস্তানে সংবিধান স্থগিত করে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের হাতে ক্ষমতা নিশ্চিত করেন।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুঁজিপতি গড়ে তোলার সূচনা করেন। সেনা কর্মকর্তারা বিপুল ভূমির ইজারা পান। আ্ইয়ুব খানের পুত্র গহর আইয়ুব খান পিতার সূত্র ধরে সম্পদশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন। শিল্পপতিদের বিকশিত হওয়াটা প্রায় সম্পূর্ণত রাষ্ট্রের বদান্যতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাওয়ায় এমন একটি মক্কেল শিল্পপতি শ্রেণি গড়ে ওঠে যারা নিজেদের স্বার্থ বা দাবি স্বাধীনভাবে তুলতে অক্ষম ছিলেন। পাকিস্তানের দুই অংশের মাঝে বৈষম্যও তার আমলেই বৃদ্ধি পায় এবং পূর্ববাংলার স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়।
তার সংক্ষিপ্ত শাসনামলে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বিপুল গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েও পাকিস্তানকে রক্ষা করায় ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে সামরিক বাহিনীর শাসনের অক্ষমতার চূড়ান্ত প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি বিদায় নিলেও কয়েক বছরের মাথাতেই জেনারেল জিয়াউল হকের নেতৃত্বে আবারও পাকিস্তান সামরিক শাসনের অধীনস্ত হয়।
আফগানিস্তানে সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধ পরিচালনার পর্বটিতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশাসনযন্ত্রে উগ্র ধর্মান্ধতার বিপুল প্রশ্রয় দেন। এই সময়টিতে সেনা পৃষ্ঠপোষকতায় ও মার্কিন অর্থসাহায্যে যে ধর্মযুদ্ধের মনোবৃত্তি গড়ে ওঠে তা রীতিমত লাভজনক পেশায় পরিণত হয়। পরবর্তীতে সন্ত্রাসবাদের আখড়া হিসেবে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি গড়ে তোলায় এই পর্বটি ভুমিকা রেখেছে। রুশ বিরোধী যুদ্ধে বিপুল মার্কিন অর্থের প্রবাহের কারণে সেনাবাহিনীর কিছু নির্দিষ্ট ব্যবসায় রমরমা দেখা যায়। ফলে দেশের মূল শিল্প ও উৎপাদনী খাতের বিকাশ যে রুদ্ধ হয়েছে, সেটা ততটা গুরুত্ব পায়নি।
৯/১১ পরবর্তী পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় দেশীয় রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর স্বার্থ যথাসম্ভব অটুট রেখেছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তানের প্রয়োজন হ্রাস পাওয়াতে দেশটিতে জনগণের বেহাল দশা অব্যাহত থাকে।
২০০৭ সালে পাকিস্তানি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আয়েশা সিদ্দিকা মিলিটারি ইনক. : ইনসাইড পাকিস্তান’স মিলিটারি ইকোনমি নামে একটি বই লিখে পাকিস্তানের রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন। সেসময় দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। আয়েশার বইটি মোশাররফকে এতটাই ক্ষুব্ধ করেছিল যে তিনি আয়েশাকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়ে পুরনো এই কার্টুনে নওয়াজ শরীফের পর যুক্ত হবেন ইমরান খান। সেনাপ্রধানও বদলেছেন। কিন্তু বাস্তবতা একই থেকেছে।
কিন্তু ঠিক কী লিখেছিলেন আয়েশা তাঁর বইতে?
বারোটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত মিলিটারি ইনক. : ইনসাইড পাকিস্তান’স মিলিটারি ইকোনমি বইয়ে আয়েশা একটি নতুন শব্দ নির্মাণ করেছিলেন যা এখন অভিধানে যুক্ত হয়েছে। সেটি হলো মিলবাস বা মিলিটারি বিজনেস, বাংলায় বলা যায় সেনাব্যবসা। আয়েশা সিদ্দিকা ‘মিলবাস’-কে (সেনাব্যবসা) সংজ্ঞায়িতও করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশটির অর্থনীতির একটু বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। একইসাথে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে এই সেনাব্যবসা কীরূপ প্রভাব ফেলে সেটাও তাঁর বইয়ে আলোচিত হয়েছে।
আয়েশার সংজ্ঞায়নে, সেনাব্যবসা বলতে সেই সামরিক পুঁজিকে বোঝায়, যা ‘সামরিক ভ্রাতৃসংঘ’ – বিশেষ করে সেনাকর্মকর্তারা – নিজেদের ব্যক্তিগত লাভের স্বার্থে ব্যবহার করে। সরকারি বা বেসরকারি খাত থেকে সম্পদ বা সুযোগ সামরিক বাহিনীর অন্তর্গত কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তির হাতে তুলে দেয়ার সব প্রক্রিয়াই সেনাব্যবসা বলে বিবেচিত হয়। সেনাব্যবসার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, যেহেতু এই পুরো প্রক্রিয়াটিই লোকচক্ষুর আড়ালে ঘটে এবং এর কোনো হিশাব রাখা হয় না, তাই এটি জবাবদিহিতার আওতার বাইরে থেকে যায়।
আয়েশা সিদ্দিকার মতে, চারটি “কল্যাণমূলক” নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠান পাকিস্তানের সেনাব্যবসার কেন্দ্রে আছে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো হল:
- ফৌজি ফাউন্ডেশন (এফএফ)
- আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট (এডব্লিউটি)
- শাহীন ফাউন্ডেশন (এসএফ)
- বাহরিয়া ফাউন্ডেশন (বিএফ)
এই প্রতিষ্ঠানগুলো পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বন্দোবস্তের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। ছোটবড় বহু বিচিত্র ব্যবসা পরিচালনা করে এরা। এসব ব্যবসার মধ্যে রয়েছে স্কুল, খামার, বেসরকারি নিরাপত্তাসংস্থা, বিমানসংস্থা, বাণিজ্যিক ব্যাংক, বীমা কোম্পানি, বেতার, টেলিভিশন চ্যানেল, সার, সিমেন্ট, পেট্রোল পাম্প, পোষাক সহ আরও বহু ব্যবসা বাণিজ্য।
আয়েশার মতে, পাকিস্তানের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, আর খোদ সামরিক বাহিনীর পেশাদারিত্বের ওপর সেনাব্যবসা সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এটা মুক্ত প্রতিযোগিতার নীতি লঙ্ঘণ করে, এবং ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে সামরিক ভ্রাতৃসংঘ ও তাদের বেসামরিক মক্কেলদেরকে অনৈতিক সুবিধা দেয়। সেনাব্যবসার আওতাধীন কর্মকাণ্ডকে ‘বেসরকারি উদ্যোগ’ হিসেবে দেখিয়ে সরকারি খাতের বরাদ্দ টাকা সরিয়ে ফেলতেও এই প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করা হয়। যে কোন খাতে সেনাবাহিনীর অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে প্রাতিষ্ঠানিক দাপট ও যোগাযোগ কিংবা প্রভাব ব্যবহার করা হয়। এর ফলে বাকিদের জন্য পরিসর ছোট হয়ে আসে, যোগ্যতররাও নিরুৎসাহিত হন এবং ব্যবসা বাণিজ্যে নতুন চিন্তা ও বিচক্ষণতা কিংবা উদ্যম অর্থহীন হয়ে পরে।
পাকিস্তানের নাগরিক সমাজের চরিত্রও নষ্ট করে ফেলেছে সেনাব্যবসা। এর জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী রীতিমত একটি কৌশল আবিষ্কার করেছে, সেটা হলো নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলা বা দুর্নীতিতে জড়িয়ে রাখা। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, তারা কর্পোরেট খাতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক নেতা, বিচার বিভাগের সদস্য, আর বিশেষ করে সাংবাদিকদেরকে সরকারের কাছ থেকে জমি বা প্লট নিতে উৎসাহিত করে। ফলে, নাগরিক সমাজের এসব সদস্যের সামনে আর সেনাব্যবসার স্বার্থে জমি অধিগ্রহণের সমালোচনা করার কোনো নৈতিক সুযোগ থাকে না।
এভাবে পাকিস্তানে যে শাসনব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, আয়েশা তাকে দুর্বৃত্ত পুঁজিবাদের একটা ধরন বলে চিহ্নিত করেছেন। এখানে কর্তৃত্ববাদ ও মক্কেলবাদ উৎসাহিত হয়। এভাবে সবার জবান বন্ধ করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পদগুলোতে কারা থাকবে সেটা নির্ধারণ করার সুযোগ পেয়ে যায় সেনাবাহিনী। রাষ্ট্রের অন্যান্য অংশের সাথে সেনাবাহিনীর কৌশলগত অংশীদারিত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এছাড়া, ক্ষমতার ভারসাম্য বলেও কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
পাকিস্তানের বাজেটের মোট ১৬ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশটির প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ৮৭৫ কোটি ডলার, যেখানে একই অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দকৃত বাজেটের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৫ কোটি ১০ লাখ ডলার। দেখাই যাচ্ছে, এই বিপুল বরাদ্দ ও প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত আকৃতির সামরিক বাজেটের ফলে জনগণের কল্যাণমূলক খাতগুলোতে বরাদ্দ কমে আসে। ফলে একদিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ সবগুলো খাতে দেখা দেয় বিপুল নৈরাজ্য ও তহবিল ঘাটতি, তাদের কোনটাই তাই মানসম্পন্ন হয় না; অন্যদিকে এই বিপুল বরাদ্দের কারণে সেনাবাহিনীই দেশটির সবচেয়ে সুগঠিত, এবং যোগ্য সংগঠন হিসেবে জনগণের সামনে আবির্ভূত হতে পারে। যদিও রাষ্ট্রনৈতিক বিবেচনাতে দেশটিতে বাকি সকল প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা ও ভঙ্গুরতার প্রধান কারণ সেনাবাহিনীর জন্য ভারসাম্যহীন বিপুল বরাদ্দ। কিন্তু একদিকে রাষ্ট্রীয় অর্থের বড় অংশ সামরিক ও বেসমারিক আমলাতন্ত্রের জন্য ব্যয় হয়, আরেকদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যেও তার বড়সড় উপস্থিতির কারণে পাকিস্তানে দেশটি এবং সেনাবাহিনী একাকার হয়ে উঠেছে। তাদের উপস্থিতি বাকি সকলকে প্রায় আড়াল করে দেয়।
এভাবে সেনাবাহিনী দেশবাসীর সামনে নিজেকে একটা মুশকিল আসানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে হাজির করার সুযোগ পায়।
পাকিস্তানে যে মাঝে মাঝেই সামরিক ক্যুদেতা ঘটে, বা বেসামরিক রাজনীতিকদের ক্ষমতায় আসার পেছনেও সেনাবাহিনীর কলকাঠি নাড়ার অভিযোগ ওঠে, তার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করে সেনাব্যবসা। বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়েও সামরিক স্বার্থকে বিবেচনা করেই যে কোন বড় নিয়োগ, আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারণ বা অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নির্ধারণ করে। অর্থাৎ, ক্ষমতায় থাকুক বা না থাকুক, পাকিস্তানের যে কোন কিছুতে সেনাবাহিনীই প্রায় শেষ কথা।
পাকিস্তানে প্রথম সামরিক শাসন জারি হয়েছিল ১৯৫৮ সালে। সেই থেকে দেশটির ক্ষমতার রাজনীতির একটি প্রভাবশালী খেলোয়াড় হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজের অবস্থান পোক্ত করেছে। দেশটির ৭৫ বছরের ইতিহাসে পাঁচবার (ইস্কান্দার, আইয়ুব, ইয়াহিয়া, জিয়া, পারভেজ) সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতায় এসেছে; অন্যদিকে বেসরকারি কর্তৃপক্ষ যখন ক্ষমতায় ছিল তখনও নানানভাবে রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে চেয়েছে।
পাকিস্তানের রাজনীতির ধারাবাহিকতা পর্যালোচনা করে আয়শা সিদ্দিকা মনে করেন, পাকিস্তান যে ন্যুনতম অর্থেও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারল না, এর পেছনে সেনাব্যবসা বিশাল ভূমিকা রেখেছে।
কিন্তু ব্যবসার এই ধরণটা কী কারণে বিপজ্জনক? কারণ সামরিক বাহিনীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লোকসান দিলেও সেটা সহজে বন্ধ হবে না। বরং সরকার ভর্তুকি দিতে থাকবে। ফলে দুর্নীতি, অপচয় বা অযোগ্যতার কারণে কেউ শাস্তি পাবে না। এই মাপের অযোগ্যতা বা অপচয়ের কারণ ঘটিয়ে অন্য কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে হয়তো বাজারে টিকে থাকা সম্ভবই হতো না। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বচ্ছতা বলেও কিছু নাই। অন্যদিকে এই সেনাব্যবসাগুলোর সাথে জড়িত সেনাকর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজন ও পরিচিরা সরকারী কাজের ঠিকাদারি, সরবরাহ ইত্যাদির লাভজনক ভাগ পায়, যারা বহুক্ষেত্রে পেশাদারও না। ফলে প্রতিযোগিতার সুযোগ একদম ধ্বংস হয় কিংবা দারুণ রকম সঙ্কুচিত হয়।
এছাড়াও দেশটির সেনা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাতে আছে রাস্ট্রীয় তহবিলের বিপুল পরিমান টাকা। এই টাকার ওপর জবাবদিহিতা খুব কম। এগুলো ব্যয় করা হয় রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, গোত্র সর্দার ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কেনাবেচার জন্য, গোপন অপরাধী চক্র পোষার জন্য এবং এমন আরও বহু কাজে। ফলে দেশটিতে যে “উন্নয়ন নীতি” চলছে, তার বিরুদ্ধে কথা বলাটা বিপদজনক হয়ে ওঠে। এককালে পাকিস্তানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও অর্থনৈতিক গাঁটছড়া নিয়ে কথা বলাটা অসম্ভব ছিল। পরবর্তীতে চীনা বিনিয়োগে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, গভীর সমুদ্রবন্দর গদর নির্মাণ বা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের জন্য সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ নিয়ে কথা বলার বাস্তবতা পাকিস্তানে প্রায় থাকেনি।
ফলে সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি করা এই সব বিরাটাকার অবকাঠামো শেষ পর্যন্ত জনগণের কোন কাজে লাগবে কিনা, এগুলোর অর্থ কীভাবে শোধ হবে, এগুলোর সমীক্ষা অনুযায়ী সত্যিই লাভজনক হবে কিনা, লোকসান হলে তার দায় কে নেবে-- এগুলো নিয়ে আলাপ হয়েছে খুব কম। এই উদ্যোগগুলোর প্রতিটাতেই সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে সেই ঝুঁকি খুব কমই নিয়েছেন ভিন্নমতাবলম্বীরা। বরং উল্টোদিকে বিপুল তহবিল খরচ করে এই সব প্রকল্প পাকিস্তানকে কিভাবে বদলে দেবে, সেই স্বপ্ন দেখানো হয়েছে সাধারণ মানুষকে। একেবারেই অস্বচ্ছ কায়দায় এইসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এখন ঋণ শোধ করার পালা আসলে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবেই প্রায় দেউলিয়া হবার উপক্রম।
এই সবকিছুই পাকিস্তানকে খাদের মুখে পড়া একটা রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। ২০২২ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহ নাগাদ পাকিস্তানের মোট ঋণ ও দায়ের পরিমাণ ৫৩.৫ ট্রিলিয়ন পাকিস্তানি রুপি, যা প্রায় ২৬ হাজার ৮৭১ কোটি ডলারের সমপরিমাণ। বিশাল এক ঋণের ভারে ডুবে গেছে দেশটি, যার সাথে সরাসরি সম্পর্ক আছে ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার মূল্যের চীন পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের (সিপিইসি)।
দেশটিতে খাদ্যমূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিপুল হারে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির কারণে বর্তমান অর্থবছরে পাকিস্তানি রুপির দর ২১.৭২ শতাংশ কমে গেছে। এটা আরও কমবে। ২০১৯ সালে পাকিস্তান আইএমএফের সাথে একটা তিন বছর মেয়াদী ৬০০ কোটি ডলারের বেইলআউট চুক্তি সই করেছিল। ২০২২ সাল নাগাদও তা চূড়ান্ত হয় নি। বর্তমান অর্থবছরের জুন নাগাদ ৪ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি আর মাত্র ১০১০ কোটি ডলারের বৈদেশিক বিনিময়ের রিজার্ভ নিয়ে দেশটি দেউলিয়া হওয়ার পথে আছে।
কিন্তু যে নীতিগুলোর কারণে পাকিস্তান এভাবে দেউলিয়া হতে চলেছে, তা নিয়ে কথা বলাটাও পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ। অল্প কয়েকজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তি বা গণমাধ্যমকর্মী তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে সাহস রাখেন। কারণ তা বিপজ্জনক।
সেনাব্যবসা কখনো কখনো কৌতূককর পরিস্থিতিও তৈরি করে। ২০২১ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি গুলজার আহমেদ দেশটির প্রতিরক্ষা সচিব লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মিয়া মোহাম্মদ হিলাল হোসেনকে প্রশ্ন করেন, “(সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দকৃত জমির ওপর) কমিউনিটি সেন্টার, প্রেক্ষাগৃহ, আর আবাসন প্রকল্প কি বানানো হয় প্রতিরক্ষার স্বার্থে?” তিনি আরো বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্নেল আর মেজররা রাজার মত আচরণ করে।
সেনাব্যবসা কখনো কখনো মর্মান্তিক পরিস্থিতিরও জন্ম দেয়। ২০১৮ সালে করাচিতে সেনামালিকানাধীন আশকারি বিনোদন্ পার্কে এমনটা ঘটেছিল। নিম্নমানের নাগরদোলা বা চরকি তৈরি করার ফল হিসেবে কাশফ সামাদ নামের এক কিশোরী মেয়ের মৃত্যু হয়, আরো ১৫ জন আহত হন। ব্যবসা করা সেনাবাহিনীর কাজ নয়, এবং এই অকাজটাও যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পেশাদারিত্বের সাথে করতে পারে না, এই ঘটনায় তা দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে যায়।
ইমরান খান যখন ক্ষমতায় গেছেন, বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছে তিনি সেনাসমর্থনে তা পেরেছেন। উৎখাত হবার পর ইমরান হুবহু একই অভিযোগ করেছেন বিরোধীদের প্রতি। উভয়ের অভিযোগই সত্য হবার সম্ভাবনা আছে। এমনকি সর্বশেষ ইমরান তার লংমার্চ আকস্মিকভাবে থামিয়ে দিয়েছেন সেনাবাহিনীর পরামর্শে, তেমন সংবাদও গণমাধ্যমে এসেছে। কিন্তু এইভাবে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর দৃশ্যমান ভূমিকার কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা কখনো কখনো অভিযোগ করলেও যে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক একাধিপত্য দেশটির সেনাবাহিনী ভোগ করে আসছে, তা নিয়ে ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতায় যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা কখনো কথা বলার কথা ভাবেন না।
এই একাধিপত্য নিয়ে প্রশ্ন তুললে কী হতে পারে, তা সবচে বেশি করে টের পান দেশটির সাংবাদিক সমাজের বিকিয়ে না যাওয়া অংশটি। ২০২০ সালের জুলাইয়ে, সাংবাদিক মতিউল্লাহ জানকে ইসলামাবাদের একটা স্কুলের সামনে থেকে অপহরণ করে ১২ ঘন্টা আটক করে রাখে অজ্ঞায়পরিচয় ব্যক্তিরা। সেবছরের সেপ্টেম্বরে সাংবাদিক বিলাল ফারুকিকে সামাজিক মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য ‘অবমাননাকর’ পোস্ট করার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০২১ সালের এপ্রিল মাসে প্রখ্যাত পাকিস্তানি সাংবাদিক আবসার আলম তার নিজগৃহে গুলিবিদ্ধ হয়ে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। তাৎক্ষণিকভাবে কেউ হামলার দায় স্বীকার করে নি। কিন্তু এই হামলার মাত্র দুইদিন আগে তিনি টুইটারে দেশটির ক্ষমতাশালী গোয়েন্দাসংস্থা প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদের সমালোচনা করেছিলেন।
সেবছরের মে মাসে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সমালোচক সাংবাদিক আসাদ আলী তুর ইসলামাবাদে তার নিজগৃহে অজ্ঞাতপরিচয় হামলাকারীদের দ্বারা আক্রান্ত হন। এই হামলার প্রতিবাদে আয়োজিত এক সমাবেশে প্রখ্যাত সাংবাদিক হামিদ মীর আসাদ আলী তুর সহ পাকিস্তানি সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের পরিচয় প্রকাশ করে দেবেন বলেন। তিনি এসব হামলার সাথে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার সম্পর্ক আছে বলে ইঙ্গিত দেন। এর পরপরই জিও নিউজে তাঁর জনপ্রিয় টকশো “ক্যাপিটাল টক”-এর উপস্থাপনার দায়িত্ব থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এর আগেও ২০১৪ সালে বালুচিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘণ নিয়ে সোচ্চার হওয়ার প্রেক্ষিতে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন হামিদ মীর।
সর্বশেষ একটি ঘটনায় ২০২২ সালের মে মাসে সামরিক বাহিনীর হাতে হয়রানির শিকার হয়েছেন অন্তত ৬ জন সাংবাদিক। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর দায়ে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা ঠুকে দেয়া হয়েছে।
এভাবে হামলামামলার মাধ্যমে বিচিত্র এক ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য তৈরি করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীই দেশটির অলিখিত শাসক গোষ্ঠী হয়ে আছে। সরকার বদলালেও এদের ক্ষমতা এতটুকু কমে না। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের বিকাশে এই সেনাব্যবসাই প্রধান বাধা।
উপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের কায়েমী স্বার্থকে টিকিয়ে রাখতে গত ৭০ বছরে এই প্রতিষ্ঠানটি যে ভয়াবহ দানবাকৃতি নিয়েছে, তা শুধু উপনিবেশ পরবর্তীকালে বৃটিশ, মার্কিন, চীন ও আরও নানান বহুজাতিক স্বার্থের কাছে জনগণের স্বার্থকে বিকিয়েই দেয়নি, নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ উদ্ধারে দেশটিকে একটি চিরস্থায়ী যুদ্ধাবস্থায় নিপতিত করেছে। একদা সেনামদদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া ইমরান খান সম্প্রতি সেনাবাহিনীকে ইঙ্গিত করে পাকিস্তান তিন টুকরো হয়ে যাবে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে জিওটিভিতে এক টকশোতে বলেছেন, “যদি এস্টাবলিশমেন্ট (পাকিস্তান সেনাবাহিনী) সঠিক সিদ্ধান্ত না নেয়, তাহলে আমি আপনাকে লিখে দিতে পারি, তারা ধ্বংস হবে (পাকিস্তান ও এস্টাবলিশমেন্ট)। সশস্ত্র বাহিনীই প্রথমে ধ্বংস হবে।”
এভাবে রাষ্ট্রের একটা অঙ্গ যখন সম্পূর্ণ জনগণ থেকে, এমনকি রাষ্ট্রীয় আর সকল প্রতিষ্ঠানের চাইতে বড় হয়ে ওঠে, তাদের কোন জবাবদিহিতার সুযোগ থাকে, তখন তার কাছে রাজনৈতিক ক্ষমতা, প্রশাসনিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক ক্ষমতা, বিচারিক ক্ষমতা-- সকল কিছুই পুঞ্জীভূত হয়, পরিণামে যা ঘটতে পারে তাই ঘটছে পাকিস্তানে। এভাবে, সামরিক বাহিনী আর রাষ্ট্র যখন একাকার হয়ে যায়, তখন শেষ পর্যন্ত উভয়েরই পতন ঘটার প্রেক্ষাপট ও সম্ভাবনা তৈরি হয়।