বৃহঃস্পতিবার ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১ Thursday 21st November 2024

বৃহঃস্পতিবার ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

Thursday 21st November 2024

জাদুঘর পুনঃপ্রকাশ

বিশ হাজার টাকা জামানত তলব

২০২২-০৪-২৭

ফয়েজ আহমেদ

বিশ হাজার টাকা জামানত তলব

[সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমের সংগ্রাম নিয়ে এই লেখাটি ১৯৬৬ সালের। এর লেখক প্রথিতযশা সাংবাদিক, ছড়াকার ফয়েজ আহমদ (১৯২৮-২০১২)। এই প্রবন্ধটি বিচিত্রায় প্রকাশিত তাঁর নির্বাচিত লেখালিখির সংকলন ‘সত্যবাবু মারা গেছেন’ নামের বই থেকে নেয়া হয়েছে। ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ এবং ‘নন্দনে নন্দিনী’ নামে তাঁর আরও দুটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত লেখালিখির সংকলন গ্রন্থ রয়েছে। ফয়েজ আহমদ পাকিস্তান আমলে প্রায় চার বছর এবং কারাবন্দী ছিলেন তাঁর প্রতিবাদী সাংবাদিকতার জন্য। “বিশ হাজার টাকা জামানত” নামের এই নিবন্ধটি আজকের যুগের পাঠক ও গণমাধ্যম কর্মীদের আগ্রহ জাগাবে, এমন বিবেচনায় এটি আমরা পুনঃপ্রকাশ করছি।]

 

ডঃ আবু মাহমুদকে হত্যার কোন সুনির্দিষ্ট ষড়যন্ত্র ছিল কিনা, সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে শাসকচক্রের পৃষ্ঠপোষকতায় গুলিস্তান রেস্তোরায় সন্ধ্যা যাপনকারী প্রাইভেট বাহিনী সেদিন দিবালোকে তাকে যেভাবে আক্রমণ করেছিল, তাতে তাঁর অকাল মৃত্যুর আশঙ্কাই ছিল স্বাভাবিক। তিন মাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর এখনো তিনি বেঁচে আছেন।  

 

বাঙালী বিদ্বেষ্টা প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান শাসনের জন্যে যাঁকে উপযুক্ত মনে করেছিলেন, সেই গবর্নর মোনায়েম খাঁর আমলের কথা। শাসকদের স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে সুগঠিত প্রাইভেট বাহিনী পরিকল্পিত উপায়ে লালন পালনের অনুশীলনী প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি ক্ষেত্রে শুরু হয়। তার পরবর্তীকালে দুটো রেজিমের প্রাইভেট বাহিনীর দৌরাত্ম্যের কাহিনী এক্ষেত্রে আলোচ্য বিষয় নয়।  

 

সে সময় ষাটের মাঝামাঝি দুঃশাসনের কালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ডঃ মাহমুদকে প্রকাশ্যে শিক্ষাঙ্গনের আবাসিক এলাকায় আক্রমণের খবর শুনে দেশবাসী আতঙ্কিত হয়েছিলেন ; কিন্তু অনেকে এই নিন্দনীয় ঘটনাকে অস্বাভাবিক বলে মনে করেননি। কারণ, এই বেদনাদায়ক ঘটনাটি ছিল তখনকার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির বহিঃপ্রকাশ। সেই উত্তপ্ত ষাটের আমলেই  ছাত্রদের হাতে অর্থ ও অস্ত্র তুলে দিয়ে শাসন কর্তৃপক্ষের ইঙ্গিতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পবিত্রতা হননের প্রচেষ্টা আরম্ভ হয়। তার ট্রাডিশন অব্যাহত থাকারই কথা। আর তার ভয়াবহ পরিণতি কারো কাছে অজ্ঞাত নয়।  

 

অর্থনীতিবিদ ড: মাহমুদ ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ও শাসন এবং একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। রাজনৈতিক অরাজকতা ও অর্থনৈতিক শোষণের সমালোচনা করে তিনি শাসকগোষ্ঠির সমর্থকদের কাছে অবাঞ্চিত ব্যক্তি রূপেই চিহ্নিত হন। চৌষট্টি সালে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে মাথায় রঙিন রুমাল জড়ানো এক বিশেষ দলের কয়েক শত লোক যখন উস্কানিমূলক শ্লোগান দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গেটে উপস্থিত হয়, এই ডঃ মাহমুদই তখন দাঙ্গা-সমর্থক ক্ষিপ্ত ছাত্রদের বাধা দিয়ে চিৎকার করে বলেছিলেন : আমার লাশের  উপর দিয়েই কেবলমাত্র দাঙ্গার উদ্দেশ্যে তোমরা শহরে বের হতে পারবে।  

 

এই ধরনের একজন সরকার সমালোচক ও ‘এগ্রেসিভ' অধ্যাপককে বিশ্ববিদ্যালয়ে আর রাখা যায় না। এমন একজন অধ্যাপককে নিযোগ করতে হবে, যিনি অন্ততঃ ডঃ মাহমুদের মতো সোচ্চার ব্যক্তি নন। আয়োজন চলল। সরকারের চেষ্টায় অতিরিক্ত বেতনে রীডার হিসেবে ডঃ কে টি হোসেনকে তাঁর স্থলে অর্থনীতি বিভাগের প্রধান করা হয় এবং ডঃ মাহমুদকে বিভাগীয় প্রধানের কার্যভার বুঝিয়ে দেয়ার নির্দেশ আসে। গবর্নর মোনায়েম খাঁর একান্ত প্রিয় ডঃ এম, ও, গনি সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।  

 

কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ডঃ মাহমুদ শেষ পর্যন্ত সুবিচারের আশায় হাইকোর্টে মামলা দায়ের করতে বাধ্য হন। মাননীয় হাইকোর্টের মামলায় ডঃ মাহমুদ জয়লাভ করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বা সরকার কোনক্রমেই ডঃ মাহমুদকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রহণ করতে রাজী নন। এই পরিস্থিতিতেই কে বা কারা প্রাইভেট বাহিনীকে নিয়োগ করেন। হাইকোর্টের রায় বের হবার দিন সকাল থেকেই এই মামলাটি বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ আলোচ্য বিষয় ছিল। সেদিন হাইকোর্ট বিচারকের কক্ষ ও করিডর ছাত্র, শিক্ষক ও রাজনৈতিক কর্মীদের দল পরিপূর্ণ করে রেখেছিল। 

 

পিনপতন নীরবতার মধ্যে হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি ডঃ মাহমুদের পক্ষে রায় ঘোষণার সাথে সাথে উপস্থিত শ্রোতাদের এক অংশ উত্তেজিত হয়ে উঠে। ড: মাহমুদ দ্রুতগতিতে হাইকোর্ট কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং উত্তেজনা সৃষ্টিকারী একদল যুবকের সম্মুখ দিয়েই একটি ক্ষুদ্র গাড়িতে করে অধ্যাপকদের আবাসিক এলাকার দিকে যাত্রা করেন। নিজ ফ্লাটের সম্বখেই অদৃশ্য হস্তের ইঙ্গিতে সেই প্রাইভেট বাহিনীর যুবকরা তাড়া করে ডঃ মাহমুদকে আকস্মিক আক্রমণ করে। এই লেলিয়ে দেয়া গুণ্ডাদের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করা যায়নি। প্রকাশ্যে বহু মহিলা পুরুষের সম্মুখেই তাকে প্রহার করা হয়—ডঃ মাহমুদের একমাত্র অপরাধ (!) ছিল, তিনি কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিচার চেয়েছিলেন এবং হাইকোর্ট তাঁর পক্ষে আইনসম্মত রায় দেন। ড: মাহমুদ যখন হাসপাতালে, সে সময় কর্তৃপক্ষ সুপ্রীম কোর্টে উক্ত মামলা উত্থাপন করেন এবং অর্থনীতি বিভাগ প্রধানের কক্ষের তালা ভেঙ্গে নবনিযুক্ত প্রধানকে উক্ত বিভাগের দায়িত্ব তুলে দেন।  

 

সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমান সর্বদাই সরকারের জন্য একজন চোখা ও উজ্জ্বল মাননীয় বিচারপতি। তিনি টেকনিক্যাল কারণে হাইকোর্টের রায় গ্রহণ না করে নিম্ন আদালত থেকে উক্ত মামলা শুরু করার অভিমত ব্যক্ত করেন। এর ফলে প্রকৃত পক্ষে কর্তৃপক্ষের বিজয় হিসাবেই সেই বক্তব্য বা রায় চিহ্নিত হলো। একটা কথা আছে জুডিসিয়াল বার্গলারীবিচার বিভাগীয় তস্করবৃত্তি। ডঃ মাহমুদ পদত্যাগ করে চাকরিহীন ও নিঃস্ব অবস্থায় সাতাত্তর সালের ডিসেম্বরে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। (বর্তমানে ডঃ মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় কার্যরত)।  

 

ঢাকার পত্রিকাগুলো সমস্ত ঘটনাই বিশ্বস্ততার সাথে প্রকাশ করে চলছিল। (অবশ্য সরকারী জেলখানায় আবদ্ধ পত্রিকাসমূহের ভূমিকা ছিল নিয়ন্ত্রিত।) ডঃ আবু মাহমুদ সঠিক নাম উল্লেখ করে থানায় একটি মামলা দায়ের করে ছিলেন। আইনানুগভাবে ডাইরীতে উল্লিখিত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা তখন পুলিশের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। কোন কোন পত্রিকায় কেন আক্রমণকারীদের গ্রেফতার করার ব্যাপারে বিলম্ব করা হচ্ছিল, সে সম্পর্কেও মন্তব্য বের হয়। কিন্তু পুলিশ সমগ্র ঘটনাটি সম্পর্কে কোন ভূমিকা অবলম্বন করতে সাহস পাচ্ছিল না।  দুষ্কৃতকারীদের সন্ধান সম্ভব হয়ে উঠছে না বলেই তারা পত্রিকার রিপোটারদের কাছে নিয়মিত বলে যাচ্ছেন। অপরদিকে ডঃ মাহমুদের আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত ব্যক্তিরা শহরের বুকে 'গুলসিতান' রেস্টুরেন্টে সন্ধ্যায় পানাহার করেন এবং সবার চোখের সম্মুখেই একটি বিশেষ জীপ নিয়ে সর্বত্র ঘুরে বেড়ান।  

 

রাজনৈতিক পার্টিগুলো এই পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসেন। পুলিশে মামলা করার চৌদ্দ দিন পর আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান তোপখানা রোডে (বর্তমান ‘মনিং পোস্ট' পত্রিকার অফিস) একটি জরুরী সাংবাদিক সম্মেলন আহ্বান করেন। পূর্ণকক্ষ এই সাংবাদিক সম্মেলনে জনাব শহীদুল হক (পরবর্তীকালে ‘বাংলাদেশ টাইমস’ পত্রিকার সম্পাদক এবং বর্তমানে দিল্লীতে কুটনৈতিক পদে নিযুক্ত) থেকে শুরু করে অধিকাংশ সিনিয়র রিপোর্টার উপস্থিত ছিলেন। শেখ সায়েব জোরের সাথে বলেন যে, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বর্তমানে এমন এক অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে যে, শাসন কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত দুষ্কৃতকারীদের আশ্রয় দিয়ে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করছেন। ডঃ মাহমুদের উপর আক্রমণ ও পরবর্তী ঘটনা তারই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। 

 

তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করেন যে, দুষ্কৃতকারীদের লাট ভবনে আশ্রয় দেয়া হয়েছে, যাতে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে সাহস না পায়। এই সমস্ত সমাজদ্রোহী ব্যক্তি প্রকাশ্য দিবালোকে রাজধানীর বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সমগ্র পরিস্থিতির জন্যে সরাসরি সরকারকে দায়ী করে তিনি ইঙ্গিত করেন, প্রতাপশালী গবর্নর মোনায়েম খাঁই দুষ্কৃতকারীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা। এই গুরুতর অভিযোগ নিয়ে রিপোর্টাররাই প্রথমে বিপাকে পড়লেন। সবকিছু জানা থাকা সত্ত্বেও তারা এত দিন সরকারী হুমকীর মুখে কিছুই প্রকাশ করতে পারেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক পার্টির প্রধান সাংবাদিক সম্মেলনে গবর্নরের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করে দুষ্কৃতকারীদের গ্রেফতার না করার রহস্য যখন প্রকাশ করলেন, তখন সাংবাদিকরা যেন গভীর সমদ্র ও হাঙ্গরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন। একদিকে সরকারী খড়গ, অপরদিকে সত্যপ্রকাশের চাপ। শেখ মুজিব দৃঢ়তার সাথে বললেন : আপনারা আমার দায়িত্বে ও বরাতে লিখে নিন—লাট ভবনে ডঃ মাহমুদকে আক্রমণকারী ব্যক্তিদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। তিনি দু'তিনবার উল্লেখ করে কথাগুলো লিখে নিতে বললেন। (পরবর্তীকালে শেখ মুজিবের শাসনকাল স্মরণীয়)।  

 

একজন প্রদেশপাল জনগণের সার্বিক কল্যাণ সাধনের জন্য নিয়োজিত বলে ধরে নিতে হবে এবং তিনি শপথবদ্ধ। এমন একজন রাজপুরুষ তিনি, যাঁর ক্ষমতা অপরিসীম এবং যিনি সাধারণভাবে প্রচলিত বহু আইনের ধরা-ছোঁয়ার উর্ধ্বে। অপরদিকে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতার গুরুত্ব গবর্নরের তুলনায় কোন অংশে কম তো নয়ই, বরং সাধারণভাবে দেশের প্রথম শ্রেণীর ব্যক্তি বলেই তাঁকে গণ্য করা হয়ে থাকে। তাঁকে দায়িত্ববান ব্যক্তি হিসেবে আমরা ধরে নেব। সুতরাং এই ধরনের শক্তিশালী ব্যক্তির বক্তব্য যেমন অবহেলা করার উপায় নেই, তেমনি অত্যাচারী শাসকের উদ্যত অস্ত্র উপেক্ষা করা যাবে কোন পন্থায়?  

 

রাতের বেলা ঢাকার সমস্ত দৈনিক পত্রিকার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো অলিখিতভাবে—টেলিফোনে ও মৌখিক। এখনো এই জাতীয় অব্যাহত নিষেধাজ্ঞা বা সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে সাংবাদিক মহল, সাংবাদিক ইউনিয়ন ও সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ প্রতিবাদ করে চলছেন। ‘আজাদ’ পত্রিকা সে সময় সরকার বিরোধী বা বিরোধী দলীয় ভূমিকা অবলম্বন করছিল। গবর্নর মোনায়েম খাঁ পত্রিকাটির সমস্ত বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং পত্রিকার কর্তৃপক্ষ গবর্নরের কোন চিত্র দীর্ঘ প্রায় ছ'বছর প্রকাশ করেননি। আমি আজাদের প্রতিনিধি হিসাবে উক্ত সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলাম।  

 

তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ও পত্রিকার তৎকালীন ভূমিকার দৃষ্টিকোণ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, শেখ মুজিবের অভিযোগপূর্ণ বক্তব্য প্রকাশ করা অযৌক্তিক হবে না। কর্তৃপক্ষ বা ম্যানেজিং ডাইরেক্টর কামরুল আনাম খাঁ এই সিদ্ধান্ত সমর্থনই শুধু করেননি, ফলাও করে প্রকাশের পক্ষে মত দেন। আজাদ-এর প্রথম পৃষ্ঠায় দু’কলামের শিরোনামে সংবাদটি ছাপা হয়—ডঃ মাহমুদকে প্রহারকারী ছাত্ররা লাট ভবনে আশ্রয় নিয়েছে—শেখ মুজিব। আমরা পরিণতির কথা বিবেচনা এবং সরকারী নির্দেশ উপেক্ষা করেই সংবাদটি পত্রস্থ করি।  

 

পরদিন সকাল এগারটার দিকে আমাদের আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হলো—সচিবালয় থেকে ফোন এলো। ফোনটা কবি-বন্ধু ওবায়দুল্লাহ খানের। (বর্তমানে কৃষি মন্ত্রী) তিনি তখন প্রাদেশিক সরকারের বয়ঃকনিষ্ঠ সচিব এবং তথ্য দফতরের দায়িত্বে নিয়োজিত। এই দফতরের দায়িত্ব নেয়ার পর তাঁকে নিজস্ব উদ্যোগে কোনদিনই সংবাদ প্রকাশ বা প্রকাশ না করার জন্যে গায়েবী নির্দেশ জারি করতে দেখিনি। তিনি বললেন : কি ছেপেছেন ! এখন আসছে। ( অর্থাৎ অশুভ খবরটা অগ্রিম দিলেন।)  

 

কিছুক্ষণের মধ্যেই সরকারী হুকুমনামা এসে হাজির। সে সময়ে সরকার বিরোধী পত্রিকা আজাদের যেন ফাঁসীর হুকুম হয়েছে--বিশ হাজার টাকা জামানত তলব। কোন বিকল্প দেয়া হয়নি ; টাকা রাজকোষে জমা দিতে হবে, নইলে কাগজ বন্ধের হুমকি! মোনায়েম খাঁর সরকার ভেবেছিলেন, এবার আজাদকে কাবু করা যাবে। কিন্তু আজাদ কর্তৃপক্ষ দুটো সিদ্ধান্ত নিলেন: হাইকোর্টে সরকারের এই সংবাদপত্রের কন্ঠরোধকারী হুকুম বা হুমকির চ্যালেঞ্জ করা এবং সেদিনই বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা হরণের সরকারী অপচেষ্টার ফলাও প্রচার করা।  

 

সমস্যা দাঁড়ালো, সাংবাদিক সম্মেলনের এই গুরুতর বক্তব্য শেখ মুজিবুর বহমান যদি অস্বীকার করে বসেন? কারণ, একমাত্র আজাদই এই সংবাদ প্রকাশ করেছিল। আর সকল পত্রিকা সরকারের চাপে সেই বিশেষ অভিযোগের গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকু বাদ দিয়ে গেছে।  

 

শেখ সায়েবকে ফোন করে তাঁর বাসায় গেলাম। তিনি সরকারী হুকুমনামার কথা শুনেই রেগে উঠলেন এবং মেয়ের খাতা থেকে নেয়া একখণ্ড কাগজে লিখে দিলেন : আমার সাংবাদিক সম্মেলনের যে বক্তব্য আজাদ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তার প্রত্যেকটি কথা ও শব্দ আমার। কোন ব্যক্তি বা সরকার এই বক্তব্যের চ্যালেঞ্জ করতে চাইলে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে পারেন পত্রিকা বা রিপোর্টারের বিরুদ্ধে নয়। 

 

 বিকেলের মধ্যে আমাদের বিশেষ সংখ্যায় কাঠের সুবৃহৎ টাইপে আট কলাম ব্যাপী ডবল হেডিং-এ খবর বের হলো—ডঃ মাহমুদকে প্রহারকারী ছাত্ররা লাট ভবনে আশ্রয় নিয়েছে—এই হেডিং-এর জন্য : ‘আজাদের বিশ হাজার টাকা জামানত তলব।' রাত দশটা পর্যন্ত ছাপিয়েও সেই বিশেষ সংখ্যার চাহিদা পূরণ করা গেল না। শেষ পর্যন্ত বাইরের গেটে তালা দিয়ে হকার বা উৎসাহী ক্রেতার চাপ বন্ধ করতে হয়। (জামানতের প্রায় সমস্ত অর্থই হয়তো বিশেষ সংখ্যা বিক্রয় করে আয় করা সম্ভব হয়েছিল! ) 

 

 সরকার কখনোই ভাবতে পারেননি যে, আজাদ বিশ হাজার টাকা জামানত তলবের  হুকুমনামার এমন ভয়াবহ সদ্ব্যবহার করবে। পরের দিন সকালে নিয়মিত সংখ্যায়ও উক্ত হুকুমনামার ফলাও প্রচার করা হলো। সরকারী নির্দেশকে প্রচারের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দেখে জবরদস্ত কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিকভাবেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। সাংবাদিক সম্মেলন সংক্রান্ত শেখ মুজিবের সেই লিখিত বক্তব্য সম্বল করে আজাদকে সরকারের বিরুদ্ধে মামলার লড়াই করতে হয়। শেষ পর্যন্ত সরকার পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিবেশে নীরব ভূমিকা পালন করেন।   

 

তবে এই ঘটনা থেকে সরকার একটি নতুন পন্থা বের করেন, যাতে ভবিষ্যতে এই জাতীয় কণ্ঠরোধকারী সরকারী নির্দেশ যেন কোন পত্রিকা প্ৰকাশ করতে না পারে। পরবর্তীকালের এ ধরনের নির্দেশের শেষে লিখে দেয়ার রেওয়াজ হল, “সরকারী নির্দেশ বা হুকুমনামার অত্র আদেশও প্রকাশ করা যাবে না।”  

 

এ যাবত জারিকৃত সরকারী অনুরূপ নির্দেশের এখনো কোন কর্তৃপক্ষ বা সংবাদপত্র চ্যালেঞ্জ করেননি। রাজনৈতিক নেতাগণ এতো সূক্ষ্ম (ক্ষুদ্র) ব্যাপারে হাত দিতে অনিচ্ছুক বলে মনে হয়—ক্ষমতায় তো কোন না কোন দিন তাদেরও আসতে হতে পারে, হয়তো সে কারণে। 

Your Comment