চলচ্চিত্রের মুক্তির প্রশ্নে জহির রায়হানের বাহাস ও আমাদের আজকের বন্দিত্ব
২০২২-০৪-২৫
‘আমাদের ছবিতে আজ অবধি রাজনৈতিক জীবন স্থান পায় নি। অথচ জনতার সঙ্গে এ জীবনের একটা গভীর যোগাযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সঙ্গে দেশের সব কিছু নির্ভরশীল। তাই এদেশের কথা বলতে গেলে রাজনৈতিক জীবন তথা গণআন্দোলনকে বাদ দিয়ে চলচ্চিত্র কি সম্পূর্ণ হতে পারে? আমি তাই গনআন্দোলনের পটভূমিতে ছবি করতে চাই। বাধা চলবে না। পত্রিকা জনতার সঙ্গে কথা বলে। চলচ্চিত্রও জনতার সঙ্গে কথা বলে। জনতার আন্দোলন, জনতার মিছিল, গুলির সামনে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, এদেশের জনতার ঢলে পড়ার ছবি আর খবর পত্রিকার পাতায় ছাপা হতে পারলে সেলুলয়েডে তা স্থান পাবে না কেন?’
চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ নির্মাণের ঘোষণা প্রসঙ্গে ১৯৭০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান কথাগুলো বলেন। দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারে জহির রায়হান আরও স্পষ্ট করে বলেন, ‘যদি পত্রিকার পাতায় গণআন্দোলনের খবর লেখা যেতে পারে, ছবি ছাপা হতে পারে তবে সে আন্দোলনকে বিষয়বস্তু করে চলচ্চিত্র তৈরি করা যাবে না কেন?’
চলচ্চিত্রের মুক্তি, চলচ্চিত্র নির্মাতার স্বাধীনতা ও গণমুখি চলচ্চিত্রের প্রশ্নে অত্যন্ত জরুরি একটি আলাপ সে দিন তুলেছিলেন বাংলাদেশের কীর্তিমান চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। এই প্রশ্ন তিনি তুলেছিলেন আজ হতে ৫২ বছর আগে। পরিতাপের বিষয় হলো, আজও এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক।
জহির রায়হান সে সময় পাকিস্তানের কর্তৃত্ববাদী সামরিক শাসনের ভেতরে বসে তাঁর দেশের জনতার পক্ষে গণমুখি চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। সেই গণমুখি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র বহু বাধার দেয়াল ডিঙ্গিয়ে তিনি নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। আর সেই রাজনৈতিক চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ আজও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে প্রায় নিঃসঙ্গ একটি চলচ্চিত্র। কেননা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আজ আমরা যদি পেছন ফিরে তাকাই তবে অর্ধ-শতাব্দী আগে নির্মিত ‘জীবন থেকে নেয়া’র মাইলফলকটির মত সমান উজ্জ্বল, প্রত্যয়ী আর কোনো গণমুখি রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের অস্তিত্ব আজও আমরা দেখতে পাই না। এই দেখতে না পাওয়া নিয়ে আমাদের কী ভাবা উচিত নয়?
বাংলাদেশের জন্ম ও তার পরবর্তী ইতিহাস লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভূত বিপর্যয় পার হয়ে ৫০ বছরের পথ পাড়ি দিয়েছে। মাত্র ৫০ বছরের এই ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু খুন হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের নায়ক জাতীয় চার নেতা খুন হয়েছেন, দেশের বহু বছর কেটেছে সামরিক শাসনের নিষ্পেষনে, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে হয়েছে গণঅভ্যুত্থান, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রশ্নে তৈরি হয়েছিল গনজাগরণ। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের নিজেদের অধিকার ও দাবির প্রশ্নে নানা আন্দোলন-সংগ্রামে টলতে টলতে আজ তবুও বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে। আর এই দাঁড়িয়ে থাকার কৃতিত্ব তো সেই গণমানুষেরই। বাংলাদেশের মানুষই বাংলাদেশকে দাঁড় করিয়ে রাখছে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট সকল বিপর্যয় সামাল দিয়ে। অথচ গত পঞ্চাশ বছরের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বাংলার সরল অথচ অপরাজেয় এই মানুষের জীবনের প্রতিনিধিত্ব করে এমন চলচ্চিত্র কোথায়?
১৯৬১ থেকে ১৯৭১ মাত্র ১১ বছরের সময়কালে জহির রায়হান প্রায় এককভাবে পূর্ব-বাংলার চলচ্চিত্রের অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সম্মুখ সারির যোদ্ধা জহির রায়হানের দেশ-ভাষা ও দেশের মানুষের জন্য লড়াই তাঁকে সময়ের নায়ক করে তুলেছিল। কথাসাহিত্যিক জহির রায়হানের কলমে যেমন জন্ম নিয়েছিল ‘আরেক ফাল্গুন’ এর মত ভাষা আন্দোলনের স্মারক উপন্যাস, তেমনি জহির রায়হানের কলমেই জন্ম নিয়েছিল ‘হাজার বছর ধরে’র মত আবহমান বাংলার কালজয়ী উপন্যাসের। সেই একই জহির রায়হান দেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধে নিজের ক্যামেরাকে করে তুলেছিলেন রাইফেল। আর সেই রাইফেল থেকেই জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ (১৯৭১)।
প্রশ্ন হলো এই জহির রায়হান যে দেশ জন্মের জন্য লড়াই করে ছিলেন সেই দেশ কি জন্ম নিয়েছে? যে দেশের চলচ্চিত্রকে, সাহিত্যকে প্রতিনিধিত্ব করেন জহির রায়হান সে দেশের চলচ্চিত্র ও সাহিত্যে জহির রায়হানের চিন্তা ও আকাক্সক্ষা কি সার্থকরূপ লাভ করেছে?
একটি নতুন দেশ আর সে দেশের সামগ্রিক চেতনা ও বোধের নয়াকাঠামো গড়ে তোলার অঙ্গিকার ছিল মুক্তিযুদ্ধের। অঙ্গিকার ছিল মুক্তির। অঙ্গিকার ছিল স্বাধীনতার। শিল্প ও শিল্পীর স্বাধীনতার। চিন্তা ও অভিব্যক্তি প্রকাশের স্বাধীনতার অঙ্গিকারকে বুকে নিয়েই জন্ম নিয়েছিল ভাষাভিত্তিক নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। বাংলাদেশ মানুষের মুক্তি ও মুক্তবুদ্ধির অঙ্গিকার রাষ্ট্র হিসেবে কতটুকু ধারণ করতে পেরেছে তা আমরা খুঁজবো। তার আগে একটু দেখি আমাদের চলচ্চিত্র-সংস্কৃতি কতটুকু দেশজ চৈতন্যে লগ্ন হতে পেরেছে। আমাদের চলচ্চিত্র কি মানুষকে ভূমিলগ্ন করে জাগিয়ে তোলে নাকি মোহের মায়াবী কুহেলিকার প্রলোভনে ঘুম পাড়ায়?
আফসোসের সাথে বলতে হয় অতীতে বা বর্তমানে আমাদের চলচ্চিত্র সংস্কৃতিতে ‘গণমুখি চলচ্চিত্র’ চিন্তা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট মানুষদের চৈতন্যে তেমনভাবে কড়া নাড়ে নি। গণমুখি চলচ্চিত্র চিন্তার এই চৈতন্য যতটুকু আমাদের দেশে আজও বেঁচে আছে তা আছে কারণ চলচ্চিত্র আন্দোলনের কিছু মানুষ এই চিন্তা ও আদর্শে আস্থা রেখে তা বয়ে চলেছেন। কিন্তু তা কেন্দ্রের বিষয় নয়। কেন্দ্রে বা ইন্ডাস্ট্রিতে আমাদের চলচ্চিত্রের ‘বিনোদনমুখি’ প্রবণতা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে করে তুলেছে সমাজ ও মানুষের কাছে বাহুল্যের ‘উপকরণ’। আর এই ‘বিনোদনমুখি’ চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি দেশের গণবিরোধী রাজনীতি ও আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনযন্ত্রের কাছে হয়ে থেকেছে বিশেষ আহ্লাদের উপহার স্বরূপ। কেননা, ‘বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি’ গণবিরোধী সকল রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক চাতুর্য আর অপকর্মকে আড়াল করে এক বায়বীয় তারকাপুঞ্জির আসমানদারি বুদবুদের আবেশ তৈরি করে। এই আসমানি বুদবুদের আলোকছটায় মানুষের হুশ হারায় আর তাতে শাসনযন্ত্রের ক্ষমতার ভর ও ব্যাটাগিরি উভয়ে শক্ত হয়ে গেঁড়ে থাকে। এই বেহুশ দশায় মানুষের মুক্তির ইচ্ছে ও স্বপ্ন লোপাট হয়ে যায়।
বিনোদনের বুদবুদের এই দুনিয়ায় একটি ‘জীবন থেকে নেয়া’ খুব দরকারি চলচ্চিত্র। এ চলচ্চিত্র ১৯৭০ সালের পাকিস্তানী কর্তৃত্ববাদী শাসক ও শাসনযন্ত্রের জন্য ছিল হুমকি এবং অস্বস্তিকর সমস্যা। কেননা, এই চলচ্চিত্র মানুষের বেহুশ দশা দূর করে তাদের হুশে ফিরিয়ে আনায় সক্ষম ছিল। আর সেই কারণেই আজও এই চলচ্চিত্র গণমানুষের কাছে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা পেয়ে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে কেন তেমনভাবে গণমুখি চলচ্চিত্র নির্মিত হলো না? এ কি কেবল মেধার সঙ্কট নাকি এই সঙ্কট এখানাকার মানুষের জীবনে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা কোনো প্রবল মায়াবী রজ্জু? কেন এই রজ্জু বা দঁড়ির কঠিন বাঁধন কেটে এখনও তৈরি হয় নি আরও অনেক রাজনৈতিক গণমুখি চলচ্চিত্র?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্য ফিরতে চাই আবারও জহির রায়হানের কাছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে বসে জহির রায়হান পশ্চিম বাংলার একটি পত্রিকায় ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’ শিরোনামে একটি ছোট্ট প্রবন্ধ লিখেছিলেন। আজ ২০২২ সালে তাঁর প্রয়াণ বা অন্তর্ধানের ৫০ বছর পর (৩০ জানুয়ারি ১৯৭২) এই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটির শরণাপন্ন হওয়া যাক। কেননা, জহির রায়হান ৫০ বছর আগে ১৯৭১-এ যে কথাগুলো লিখেছিলেন তা ২০২২ এর আজকের পটভূমিতে বুঝে নেয়া দরকার।
‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’ প্রবন্ধের শুরুতে জহির রায়হান বলছেন, ‘আমাদের মত আধাসামন্ততান্ত্রিক আর আধা ঔপনিবেশিক দেশে একজন সৎ চলচ্চিত্র নির্মাতার দুর্গতির সীমা থাকে না। অনেক বাধার দেয়ালের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছবি তৈরি করতে হয় তাকে। অর্থ। সমাজ। সংস্কার। ধর্মান্ধতা। রাজনৈতিক সংকীর্নতা। শিক্ষাগত অনগ্রসরতা। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনার অভাব। জীবন বোধের অভাব। উঠতি ধনিকশ্রেণীর অতিরিক্ত মুনাফা লাভ করে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার চিন্তা। কাঁচামালের অভাব ও চড়া দর। নতুন লেখাপড়া শেখা কিংবা হঠাৎ বড়লোক হয়ে যাওয়া উন্নাসিকের দল। এমনই আরও অনেক দেয়ালের চাপে রুদ্ধশ্বাস অবস্থায় ছবি তৈরি করতে হয় তাকে।’
বাংলাদেশের জন্মের ৫০ বছর পর জহির রায়হানের প্রবন্ধের এই শুরুর অংশের কোন কথাটির বিরুদ্ধে আমরা আজ বাহাসে যেতে পারবো? মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে বসে একজন যোদ্ধা, একজন চলচ্চিত্রকার তাঁর পরাধীন দেশের সমাজ-সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র বিষয়ে যে চিত্র তুলে ধরেছেন সে চিত্র আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও তো একই।
একজন সৎ চলচ্চিত্রকারের জন্য আজকের বাংলাদেশ বরং ৫০ বছর আগের বাস্তবতার তুলনায় আরও কঠিনই হয়েছে। কারণ আজ দেশ আধা সঙ্কর পুঁজিতান্ত্রিক আর আধা রাজনৈতিক সামন্ততান্ত্রিক। এখন দেশ ও দেশের মানুষ প্রবল কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক শাসন এবং সর্বগ্রাসী অর্থনৈতিক সিন্ডিকেশনের ভেতরে রুদ্ধশ্বাস দিনযাপন করছে। এখানে একজন সৎ চলচ্চিত্রকারের বলার আছে প্রভূত কথা কিন্তু কথা বলবার বা টু-শব্দটি করার ‘স্বাধীনতা’ আইনগতভাবেই আর নেই। যে কারণে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে কার্টুন আঁকার ‘অপরাধে’ কারাগারে যেতে হয়, শরিয়ত বয়াতি গান গাওয়ার ‘অপরাধে’ জেল খাটেন আর সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল সাংবাদিকতার বা খবর প্রকাশের ‘দৃষ্টতা’র কারণে নিখোঁজ হন এবং এরপর সাত মাস জেল খেটে এখন ‘জামিনে’ রয়েছেন। এছাড়া সম্প্রতি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও একজন অভিনয়শিল্পী তাদের চলচ্চিত্রে পুলিশ বাহিনীর সদস্যকে ‘আপত্তিকরভাবে’ উপস্থাপন করার ‘অপরাধে’ গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন। এ তো দুই একটি উদাহরণমাত্র।
এখন পরিস্থিতি এমন যে, কোনো লেখক বা অধ্যাপক অথবা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কেউই স্পষ্ট করে কথা বলতে পারেন না বা বলতে ভয় পান। কারণ মামলা, গ্রেপ্তার এসব ঘটছে হরহামেশা। আর এ সবকিছুই ঘটছে আইনত। অর্থাৎ কোনোটাই ‘বেইআইনি’ নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো তাহলে একজন সাংবাদিক, একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা, একজন অভিনয়শিল্পী বা একজন বয়াতি বা গায়কের বাক, চিন্তা ও অভিব্যক্তি প্রকাশের ‘স্বাধীনতা’ কোথায়?
যখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ এর মাঝে ‘নতুন একটি কবিতা লিখতে যুদ্ধ করি’ কথাটি গাওয়া হয় বা হয়েছিল তখন একজন কবি বা গায়কের বা সুরকারের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা কি মুক্তিযুদ্ধ দেয় নি? আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এই প্রশ্নের মিমাংসা তো আমাদের করতে হবে। এই মিমাংসা না করে আমরা তো সামনে এগুতে পারবো না বা পারছি না। আর পারবো না বা পারছি না বলেই আমাদের গণমুখি চলচ্চিত্র হচ্ছে না বা হয় নি। কারণ দমন ও অন্যায় ‘মেনে’ নিতে থাকা মানুষ কখনওই মহত্তর কোনো উপন্যাস, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, নাটক অথবা কবিতার জন্ম দিতে পারেন না। সবরকম দমনের বিরোধীতা করেই তৈরি হয় গণমুখি সংস্কৃতির। গণমুখি চলচ্চিত্রও এর বাইরে নয়।
‘সৎ চলচ্চিত্র’ তৈরির শর্ত প্রসঙ্গে জহির রায়হান ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘সৎ ছবির প্রাথমিক যে শর্ত সেটা হচ্ছে ছবিটিকে সব রকমের সংকীর্নতা এবং গোঁড়ামি মুক্ত হতে হবে। মুক্ত হতে হবে বিষয়বস্তু এবং তার প্রকাশে। অভিব্যক্তি এবং তার ব্যঞ্জনায়। আবেগ এবং তার স্বতঃস্ফূর্ততায়। বক্তব্য এবং তার নির্ভীকতায়। কোনো রকম বিরোধ থাকলে চলবে না। কিন্তু কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মান্ধ সমাজে মুক্তবুদ্ধির চাষ করতে গেলেই বিরোধ বাধা স্বাভাবিক। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শাসক ও শোষক শ্রেণী সব সময় মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের ঘৃণার ও সন্দেহের চোখে দেখে। তারা চায় সব রকমের সংস্কারগুলো সমাজের সকল স্তরে নিষ্ঠার সঙ্গে লালিত পালিত ও রক্ষিত হোক। তা হলে তাদের খুব সুবিধে হয়। শাসকশ্রেণী তাই এই সমস্ত প্রাগৈতিহাসিক রীতিনীতি এবং সংস্কারগুলোকে রক্ষা করার জন্য কতগুলো আইনের পরিখা খনন করে রাখেন (যেমন সেন্সর বোর্ড)। সৎ চলচ্চিত্র নির্মাতা তাই তার বক্তব্য প্রকাশ করতে গিয়ে যে বাধা ও বিরোধের মুখোমুখি হন সেগুলো হচ্ছে সমাজের সঙ্গে বিরোধ। শাসকশ্রেণীর সঙ্গে বিরোধ। আইনের পরিখাগুলোর সঙ্গে বিরোধ।’
১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদের ১ নম্বর উপধারায় ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা’ দান করা হয়েছে। কিন্তু এই অনুচ্ছেদেরই ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘঠনের প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’
এই যে ‘শর্তসাপেক্ষে’ আমাদের সংবিধান আমাদের ‘বাক ও ভাবপ্রকাশের’ স্বাধীনতা দিল, তা দিয়ে আমাদের বিগত ৫০ বছরের সরকারসমূহ এমন সব আইন প্রণয়ন করলেন এবং অতীত ঔপনিবেশিক শাসনামলের যে সব আইনকে তারা বহাল রাখলেন, তার কারণে আমাদের শিল্পভুবন আজ কার্যত শূন্য ভাগাড়ে পরিনত হয়েছে।
জহির রায়হান ৫০ বছর আগে যেমনটি বলেছিলেন যে একজন সৎ চলচ্চিত্রকারের নির্মিত চলচ্চিত্র সমাজের অচলায়তনের প্রাচীরে ধাক্কা দেয় ফলে সমাজের সঙ্গে সৎ চলচ্চিত্রকারের ‘বিরোধ’ তৈরি হয়। যেহেতু সৎ চলচ্চিত্রকার গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন বলেই ‘গণমুখি’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, তাই তা দেশের শাসক শ্রেণীর স্বার্থ পরিপন্থি হয়। আর তাই চলচ্চিত্রকারের ‘বিরোধ’ তৈরি হয় শাসকশ্রেণীর সঙ্গে। এই শাসকশ্রেণী আসলে কারা? এরা তো কেবল রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতা নন। বর্তমান দুনিয়ায় শাসক শ্রেণী মানে হলো সরকারের মন্ত্রীসভা, সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র এবং এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী আর ক্ষমতাধর দেশ ও দেশের বাইরের ব্যবসায়িক গোষ্ঠী। জনগণকে নিয়ন্ত্রণ ও দমনের জন্য এরা সম্মিলিতভাবে শাসন ‘যন্ত্র’ প্রস্তুত করে এবং তা বলবৎ রাখতে সবরকম বল ও কৌশল প্রয়োগ করে। সে কৌশল কেবল পাল্টা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা অপর ব্যবসায়ীর ব্যবসায়িক উদ্যোগ নস্যাৎ করতেই প্রয়োগ করা হয় তা নয়। এই কৌশল দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সকল তৎপরতাকেও নিয়ন্ত্রণ ও দমনের মধ্যে রাখতে সব রকম প্রচেষ্টা নিয়ে থাকে। কারণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্ত প্রবাহে মানুষ জেগে ওঠে। আর জাগ্রত মানুষকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করা যায় না। তাই শাসকশ্রেণীর পছন্দ ঘুমন্ত, মোহগ্রস্ত, বিভ্রান্ত মানুষের।
প্রশ্ন হলো, শাসক শ্রেণী চলচ্চিত্রকর্মীদের রুখতে কি করেন? তারা প্রথমত তৈরি করেন ‘আইনের পরিখা’। শাসকশ্রেণীর শাসনের দূর্গের চারপাশে গড়ে তোলা এই আইনের ‘পরিখা’গুলো দিয়ে মূলত তারা শুধুমাত্র সৎ চলচ্চিত্রকার বা সৎ-সাংবাদিক বা সৎ-সংস্কৃতিকর্মীকে রুখে দেন-না, তারা রুখে দাঁড়ান গণমানুষের উত্থানকেই। ফলে তাদের শাসন নিরঙ্কুশ আর স্থায়ী হয়ে ওঠে।
আজ বাংলাদেশে চলচ্চিত্রকর্মীদের যে কোনো সৎ চলচ্চিত্রিক প্রচেষ্টাকে রুখে দাঁড়াতে ‘বৈধ’ভাবে ঔপনিবেশিক আইন, পাকিস্তান আমলে প্রণীত আইন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের একাধিক দমনমূলক আইন সটান দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের মত একটি প্রবল অগণতান্ত্রিক দমনমূলক প্রতিষ্ঠান। মাত্র গত কয়েক বছরে এই তালিকায় আরও যুক্ত হয়েছে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’, যুক্ত হওয়ার পথে আছে ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন’। আর মাত্র কয়েকদিন আগে প্রস্তাব করা হয়েছে অত্যন্ত নিয়ন্ত্রণবাদী ও দমনমূলক ওটিটি নীতিমালা। যা ‘বিনোদন ইন্ডাস্ট্রির’ বিশ্ববাজার দখলকারি ওটিটি মাধ্যমের বাংলাদেশী বিকাশকে রুদ্ধ করার শাসনতান্ত্রিক পায়তাড়া। এ সব আইন-নীতিমালা ও বিবিধ বিধির পীড়নের সম্মুখিন হয়ে বাংলাদেশের দূর্বল অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে ততোধিক দুর্বল চলচ্চিত্রকর্মীগণ গত ৫০ বছরে সামষ্টিক অর্থে কার্যত ব্যর্থ হয়েছেন। নিজেদের সার্মথ্য ও সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার তারা করতে পারেনি। আর তাই বিশ্বব্যাপি চলচ্চিত্রের শিল্প ও ইন্ডাস্ট্রির তুমুল প্রতিযোগিতায় না তেমন মর্যাদার স্থায়ী আসন তৈরি করতে পেরেছে আর না নিজের বাজারের দখল ধরে রাখতে অপর দেশের ও ভাষার চলচ্চিত্রের সামনে তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছেন। যে কারণে আমাদের দেশজ চলচ্চিত্র ক্রমাগত নিচের দিকে পতিত হয়েছে। আর তাই চলচ্চিত্রের নির্মাণ-বিতরণ ও প্রদর্শনের সামষ্টিক কাঠামো প্রায় উচ্ছন্নে গেছে।
সামষ্টিক এই ব্যর্থতার মাঝেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ভালো উদাহরণ আছে। আর সে সব উদাহরণ আমাদের আশা ও প্রত্যাশার প্রদীপটিকে হয়ত আজও প্রজ্বলিত রেখেছে। কিন্তু এই দুই একটি টিমটিমে জ্বলা প্রদীপের আলোয় ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল আলোকিত হবার নয়। বরং এই প্রদীপগুলোকে বাঁচাতে হলে এদের মত আরও হাজার হাজার প্রদীপ জ্বালানোর প্রয়োজন। আর দেশময় এই প্রদীপ জ্বালানোর কাজটি করবার স্বপ্নেই মুক্তিযোদ্ধা জহির রায়হান রণাঙ্গনে নির্মাণ করেছিলেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ অথবা লিখেছিলেন ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’ শিরোনামের প্রবন্ধ। কিন্তু প্রদীপ জ্বালানোর কাজটি তো হয় নি আসলে। কেননা, দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র দেড় মাসের মাথায় ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি স্বাধীন দেশের রাজধানীতেই ‘খুন’ হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। অথচ জহির রায়হান কী তুমুল আশা আর বিশ্বাস নিয়ে তাঁর ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’ প্রবন্ধের শেষ বাক্যটিতে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের লোক তাই আজ ওই দেয়ালগুলো ভাঙ্গার জন্য লড়ছে।’
কোন দেয়ালগুলো? যে দেয়ালগুলো পরাধীন পূর্ব-বাংলার মানুষের স্বাভাবিক মুক্ত প্রকাশকে রুদ্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু সে দেয়ালগুলো কি স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার ৫০ বছরেও ভাঙ্গতে পারলো?
আমরা দেখছি স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আজকের বাংলাদেশে যে কোনো একজন সৃজনশীল সৎ স্বাধীন মানুষের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের, সমাজের ও শাসকগোষ্ঠীর তৈরি করা সবরকম দেয়াল আরও মজবুত হয়েছে। গড়ে উঠেছে আরও শত শত নতুন দেয়াল। আর এই সব দেয়ালই আইনত ‘বৈধ’। আর তাই ভূ-খন্ডের স্বাধীনতা বাংলাদেশের মানুষ পেলেও আজও পায় নি নিরঙ্কুশ ‘বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার’।
আজ ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরপূর্তির এই ক্ষণে ভাষাসৈনিক জহির রায়হানের স্মরণে তাই বলছি, আমাদের লড়াইটা হওয়া উচিত সংবিধানের এই ‘শর্তযুক্ত’ বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের বিরুদ্ধে ‘নিরঙ্কুশ’ বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের জন্য, আমাদের লড়াই হওয়া উচিত নিয়ন্ত্রণবাদী ও দমনমূলক সকল আইনের বিরুদ্ধে। এই ভূ-খন্ডে আইনের নামে গড়ে তোলা সকল ‘কালাকানুনের’ বাতিলের জন্য আমাদের লড়তে হবে। কেননা, শর্তযুক্ত এই ‘স্বাধীনতা’ আসলে গণমানুষের জন্য এক শাসনতান্ত্রিক মায়া। এই মায়ার দেয়ালগুলো ভাঙ্গার জন্যই লড়েছিলেন জহির রায়হান। আর সে লড়াই আজও অসমাপ্ত রয়ে গেছে।
গ্রন্থসূত্র:
১। অনুপম হায়াৎ, জহির রায়হানের চলচ্চিত্র: পটভূমি বিষয় ও বৈশিষ্ট্য, পৃ. ১০৩-১০৪, ২০০৭, দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা
২। জহির রায়হান, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্রপাঠ (সংকলন ও সম্পাদনা), পৃ. ২১৫-২১৮, ২০১৮, কথাপ্রকাশ, ঢাকা
বেলায়াত হোসেন মামুন
চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও সংগঠক
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি
সাধারণ সম্পাদক, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ
bhmamun@gmail.com