বৃহঃস্পতিবার ২২শে কার্তিক ১৪৩১ Thursday 7th November 2024

বৃহঃস্পতিবার ২২শে কার্তিক ১৪৩১

Thursday 7th November 2024

আন্তর্জাতিক বিশ্ব

ক্ষমা না চেয়েই বিদায় নিলেন রাণী

২০২২-০৯-১৯

দীপান্বিতা কিংশুক ঋতি

ভূতপূর্ব উপনিবেশগুলোর বিষয়ে রাণীর অবস্থান অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ। ছবি: পেনপেন্সিলড্র, ইনস্টাগ্রাম

 

 

১৯৫২ সালে ব্রিটিশ সিংহাসনে বসার মধ্য দিয়ে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ উত্তরাধিকারসূত্রে বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রজা হিসেবে পান। এঁদের মধ্যে অনেক প্রজাই বিষয়টাতে খুশি ছিলেন না, কিন্তু প্রজার মত আবার কবে কোন রাজা বা রাণী জানতে চেয়েছেন? এ বছরের সেপ্টেম্বরের আট তারিখে রাণীর মৃত্যুর পরে পূর্বতন ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে তাই বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মাঝেই নানান ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কোনো কোনো দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা রাণীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করলেও, বহুক্ষেত্রেই সাধারণ জনতা, বুদ্ধিজীবী শ্রেণি এবং ইতিহাস সচেতন অনেকেই রাণী সম্বন্ধে তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এমন একটি দেশ হলো কেনিয়া, যে দেশটি রাণী এলিজাবেথের শাসনামলে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে ১৯৬৩ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে।

 

কেনিয়ার বর্তমান রাষ্ট্রপতি উহুরু কেনিয়াত্তা চার দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছেন এবং কেনিয়ার শীর্ষ সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায় রাণীর মৃত্যুর খবর জায়গা করে নিয়েছে। দেশটির ক্ষমতাসীন নেতারা “মানবতার স্বার্থহীন সেবার প্রতিমূর্তি”র প্রশংসা করেন, কমনওয়েলথে রাণীর “প্রশংসনীয়” নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানান এবং “গভীর শোক ও সমবেদনা” প্রকাশ করেন। তবে একটি দেশের শীর্ষ নেতাদের মনোভাবই জনসাধারণের সামগ্রিক মনোভাব নয়। জনতার ভাষ্য প্রায়শই কূটনীতির তোয়াক্কা করে না। রাণীর মৃত্যুতে কেনিয়াসহ বিভিন্ন দেশের মানুষের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় সেটিই দেখা যায়।

 

 

১৯৫২ সালে কেনিয়ার নাইরোবিতে পৌঁছানোর পর প্রিন্সেস এলিজাবেথ। ছবি: দ্য টাইমস

 

ফিরে দেখা যাক রাণীর অভিষেকের বছরের দিকে। ১৯৫২ সালে তৎকালীন প্রিন্সেস এলিজাবেথ প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে কেনিয়ার ট্রিটপস লজে এক রাজকীয় সফরে ছিলেন। সফরের সময়েই তাঁরা এলিজাবেথের পিতা রাজা  ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যু সংবাদ পান। এভাবে কেনিয়ার ট্রিটপস লজ ব্রিটেনের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী শাসকের প্রিন্সেস হিসেবে ঘুমিয়ে রাণী হিসেবে জেগে ওঠার ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকে। ঐ একই বছরে কেনিয়ায় শুরু হয় বিখ্যাত মাউ মাউ বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের মূলে ছিল ব্রিটিশশাসিত কেনিয়ায় অসমতা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। এই বিদ্রোহে উপনিবেশবাদী প্রশাসন সাড়া দেয় নারকীয় অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে। ১৯৫৬ সালে এই বিদ্রোহ পুরোপুরি দমন করতে সমর্থ হয় ব্রিটিশ সরকার, তবে এ বিদ্রোহই কেনিয়ার স্বাধীনতার দিকে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ ছিলো। অবশেষে ১৯৬৩ সালে কেনিয়া স্বাধীন দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নেয়।

 

 

ঐ একই বছরে কেনিয়ায় শুরু হয় বিখ্যাত মাউ মাউ বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের মূলে ছিল ব্রিটিশশাসিত কেনিয়ায় অসমতা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। এই বিদ্রোহে উপনিবেশবাদী প্রশাসন সাড়া দেয় নারকীয় অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে। ১৯৫৬ সালে এই বিদ্রোহ পুরোপুরি দমন করতে সমর্থ হয় ব্রিটিশ সরকার, তবে এ বিদ্রোহই কেনিয়ার স্বাধীনতার দিকে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ ছিলো। অবশেষে ১৯৬৩ সালে কেনিয়া স্বাধীন দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নেয় 

 

 

কেনিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশের অস্তিত্বের শুরু উনিশ শতকের শেষ দিকে। আজ কেনিয়া বলে যে ভূখণ্ডটি পরিচিত, তখন তা ছিলো জাঞ্জিবারের সুলতানের আওতাধীন। ব্রিটিশ মিলিটারির চাপে সুলতান একে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। ১৮৯০ এর দশক থেকে ব্রিটিশরা কেনিয়ায় আসতে শুরু করে। এর লক্ষ্য ছিলো দুটি- কেনিয়ার উর্বর ভূমি দখল করা এবং পার্শ্ববর্তী ব্রিটিশ উপনিবেশ উগান্ডার নিরাপত্তা বাড়ানো। এজন্য কেনিয়ার মোম্বাসা শহর থেকে কিসুমু শহর পর্যন্ত রেলপথ তৈরি করা হয়। স্থানীয় মাসাই, কিকুইয়ু এবং কাম্বা জনগোষ্ঠী থেকে জমি দখল ও উচ্ছেদের বিরুদ্ধে যেকোনো প্রতিরোধ দমন করতে আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত ব্রিটিশ বাহিনী পাঠানো হয়।শাসনের প্রয়োজনে ব্রিটিশরা তাদের একটা সহযোগী শ্রেণিও তৈরি করে।

 

স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে পুরোপুরি বশীভূত করতে ব্রিটিশরা ক্ষমতার যথেচ্ছ চর্চা করে। এই ক্ষমতার চর্চা ছিলো খেয়ালখুশিমত স্থানীয়দের গুলি করা। মাসাইরা ব্রিটিশ আর্মিকে এড়িয়ে চললেও কিকুইয়ুরা তাদের ভূমি দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ এই প্রতিরোধ দমন করতে নৃশংসতার পথ বেছে নেয়। আফ্রিকান দোসরদের সঙ্গে নিয়ে ব্রিটিশরা কিকুইয়ু ও কাম্বা জনগোষ্ঠীর প্রচুর মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। এ সময়ে এই নির্বিচার হত্যা এবং দুর্ভিক্ষের ফলে বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়। সেইসঙ্গে রিন্ডারপেস্ট অসুখের মহামারীতে প্রচুর পশুসম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়।

 

১৯০৩ সালে ইউরোপীয় বসতিস্থাপনকারীরা কেনিয়ায় বাস করতে শুরু করলে আদিবাসীদের দুর্ভোগ আরো বাড়ে। এই শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের সংখ্যা কম হলেও বিপুল পরিমাণ ভূমি তাদের দখলে চলে যায়। এই ভূমির বড় অংশই আফ্রিকানদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়। ভূমি পুনর্বিন্যাসের ব্যবস্থা করা হয়, যেখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে উর্বর জমি কেড়ে নিয়ে শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের দিয়ে দেওয়া হয়। শ্বেতাঙ্গ এসব ভূমি মালিকের বেশিরভাগই ব্রিটেন কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ইউরোপীয় ও স্থানীয় কেনিয়ানদের মধ্যকার সেই সম্পর্ক নির্ধারিত হয়, যা বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বহাল থাকবে। ১৯১৫ সালের দ্য ক্রাউন ল্যান্ডস অর্ডিন্যান্স অ্যাক্ট এর মধ্য দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের যে সামান্য ভূমি অধিকার ছিলো, তাও কেড়ে নেওয়া হয়। এর ফলে রাতারাতি কেনিয়ানরা নিজেদের ভূমিতে পরবাসীতে পরিণত হয়।

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকার বহু সাবেক সেনা সদস্যকে উপনিবেশগুলোতে বাস করতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে কেনিয়ায় বহিরাগতদের আগমন ক্রমশ বাড়তে থাকে। অনবরত চলতে থাকা এই ভূমি দখল কেনিয়ানদের অধিকারের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন তৈরির দিকে ঠেলে দেয়। এর মধ্যে ইস্ট আফ্রিকান অ্যাসোসিয়েশন (ইএএ) ১৯২১ সালে গঠিত হয়ে পরের বছরই নিষিদ্ধ হয়। ১৯৪২ সালে গঠিত হয় কেনিয়ান আফ্রিকান ইউনিয়ন (কেএইউ)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কেনিয়ানদের এই অসন্তোষ আরো বেড়ে যায়। সে সময়ে নাইরোবির বস্তিগুলোয় হাজার হাজার কেনীয় শোচনীয় দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছিলেন, এবং তাঁদের চাকরি বা মৌলিক সামাজিক অধিকার পাওয়ার কোনো আশাই ছিলো না। একই সময়ে ইউরোপীয় সেটলাররা কেনিয়ায় বাস করছে প্রাচুর্যের সঙ্গে, এবং কেনিয়দের তারা দেখছে ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের চোখে।

 

একই চিত্র ছিলো গ্রামাঞ্চলেও। উর্বর জমিগুলো কেড়ে নিয়ে কেনীয়দের বাধ্য করা হয় তুলনামূলকভাবে পানি উর্বর জমি থেকে বঞ্চিত সংরক্ষিত এলাকায় বাস করতে। এভাবে নিজেদের জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া দশ লাখ কিকুইয়ু জনগোষ্ঠীর মানুষের চাইতে তিন হাজার ইউরোপীয়র অধিকারে বেশি জমি ছিলো। এই পরিস্থিতি থেকে জন্মানো পুঞ্জীভূত ক্ষোভই এক সময়ে মাউ মাউ বিদ্রোহের জন্ম দেয়। এই বিদ্রোহের অগ্রভাগে থাকেন কিকুইয়ু আফ্রিকানরা, যাঁরা ইউরোপীয় বসতিস্থাপনকারীদের ভূমিতে ছোট ছোট হামলা চালিয়ে প্রতিরোধ জারি রাখেন। প্রতিরোধের বিষয়টি লক্ষ্য করলেও সরকার এবং বসতিস্থাপনকারীরা ক্ষোভের প্রশমনে তেমন ভ্রূক্ষেপ করেনি, বরং তাদের দমনমূলক নীতির প্রয়োগ জারি রাখে। এই কঠোর ও অনমনীয় চর্চার ফলে মাউ মাউ বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত বড় আকারে সশস্ত্র প্রতিরোধের রূপ নেয়।

 

মাউ মাউ বিদ্রোহীদের আক্রমণের একটা লক্ষ্য ছিলেন সেই কিকুইয়ুরা, যারা ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। এ ধরনের দোসরদের মধ্যে প্রধান যারা, তাদেরকে বিদ্রোহীরা হত্যা করেন। কিছু শ্বেতাঙ্গ সেটলারদের ওপরেও হামলা চালানো হয়। জবাবে পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় চালায়। আন্দোলনকে নড়বড়ে করে দিতে প্রচুর কিকুইয়ুকে গ্রেফতার করে তাদের ওপর অত্যাচার চালানো হয়। এর ফল হয় উল্টো। আরো বেশি মানুষ আন্দোলনে সমর্থন দিতে শুরু করে। ১৯৫২ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসে দেখা যায়, প্রায় ৯০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক কিকুইয়ুই মাউ মাউ বিদ্রোহের শপথ নিয়েছেন। বিপরীতে, সরকার কিকুইয়ু নেতাদের প্ররোচনা দিতো পাল্টা শপথ নিতে, যার ফলে মাউ মাউ শপথ এবং অন্য যে-কোনো উপনিবেশবিরোধী শপথ অকার্যকর হয়ে যাবে। ১৯৫২ সালের অক্টোবরে ইউরোপীয়দের দোসর কিকুইয়ুদের জ্যেষ্ঠ নেতা ওয়ারুহিউকে নাইরোবিতে হত্যা করে বিদ্রোহীরা। এই ঘটনার ফলে প্রশাসন অবশেষে বুঝতে পারে, মাউ মাউ বিদ্রোহ কেনিয়ায় ঔপনিবেশিক শাসনের জন্য হুমকিস্বরূপ। ওয়ারুহিউর মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পরে সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে।

 

 

নাইরোবি, কেনিয়া। ১৯৫২ সাল। রাণী হিসেবে এলিজাবেথ ইংল্যান্ডে ফেরত যাবার পরই কেনিয়ায় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। মাউ মাউ সন্দেহে আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া  হচ্ছে। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

 

জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরে অপারেশন জক স্কট শুরু হয়, যার মধ্য দিয়ে পুলিশ ১৮৭ জন কিকুইয়ুকে মাউ মাউ বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করে। এরপরেও অনেক নেতাই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। পুলিশ ধারণা করেছিলো, এর ফলে বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু বিদ্রোহীরা জবাবে আরেকজন কিকুইয়ু নেতা ও কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ বসতিস্থাপনকারীকে হত্যা করেন। হাজার হাজার মাউ মাউ বিদ্রোহী ঘর ছেড়ে আবেরদেয়ার বনে ও মাউন্ট কেনিয়ার পাদদেশে শিবির স্থাপন করে থাকতে শুরু করেন। দ্রুতই তাঁরা সংগঠিত হন এবং ওয়ারুহিউ ইতোতে এবং দেদান কিমাথির মতো বেশ কয়েকজন গেরিলা নেতার উত্থান হয়। ১৯৫২ সালে তেমন উল্লেখযোগ্য আর কিছু না ঘটলেও পরের বছর শুরুই হয় বেশকিছু শ্বেতাঙ্গ ভূমিপতি এবং তাদের আফ্রিকান দোসরদের হত্যার মধ্য দিয়ে।

 

 

দূরবীন দিয়ে মাউ মাউ বিদ্রোহ পর্যবেক্ষণ করছেন সেনা কর্মকর্তারা। ছবি: উইকিপিডিয়া

 

 

এর ফলে ব্রিটিশ সরকার ও সেনাবাহিনীর তৎপরতা বাড়ে। বনের অস্থায়ী শিবিরেও সেনাবাহিনী হানা দেয়। তাছাড়া, কোনো গ্রামে একজন মাউ মাউ বিদ্রোহীকে পাওয়া গেলে পুরো গ্রামকেই অপরাধী গণ্য করা হতো। তখনও উচ্ছেদ না হওয়া অবশিষ্ট বহু কিকুইয়ুকেই এ সময়ে নিজেদের ঘর ছেড়ে সংরক্ষিত এলাকায় যেতে বাধ্য করা হয়। এই দমনমূলক তৎপরতার নৃশংসতম অংশ ছিলো নির্যাতন শিবিরগুলো। নিপীড়ন ও অত্যাচারের কেন্দ্র এই শিবিরগুলোতে বন্দির কাছ থেকে জবানবন্দি নেওয়ার এবং ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যাওয়াকে বন্ধ করার মূল হাতিয়ার ছিলো প্রহার, যৌন নির্যাতন এবং হত্যা। এসবের ফলে ক্রুদ্ধ বহু কিকুইয়ু নতুন করে মাউ মাউ বিদ্রোহে যোগ দেন।

 

 

সংরক্ষিত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়ার ভেতর মাউ মাউ সন্দেহে আটককৃতরা। ছবি: এএফপি 

 

 

কেনিয়ায় পাঠানো ব্রিটিশ সেনাদের বনে লড়াই করার অভিজ্ঞতা ছিল সামান্যই। কাজেই, নিষ্ফল প্রতিরোধের কিছু সময় পরে তাদের জায়গা নেয় স্থানীয় কেনিয় সেনা সদস্যরা, আর ব্রিটিশ সৈন্যরা বনের সীমানা পাহারা দেওয়ার কাজে নিযুক্ত হয়। একইসাথে ব্রিটিশ বিমানবাহিনী মাউ মাউ ক্যাম্পের ওপর বোমাবর্ষণ করতে থাকে। সেই সঙ্গে চলে মেশিনগানের হামলা। ১৯৫৩ সালে বড় বড় কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধ হয় দুই পক্ষের মধ্যে। মাউ মাউ বাহিনীর আস্ত্রবল ও লোকবল কম থাকায় ক্ষতিটা তাদেরই বেশি হয়। বছর শেষে দেখা যায়, তিন হাজারের বেশি মাউ মাউ নিহত হয়েছেন, এবং নেতা ওয়ারুহিউ ইতোতে সহ এক হাজার মাউ মাউ বন্দি হয়েছেন। এছাড়া, প্রায় এক লক্ষ  সন্দেহভাজন মাউ মাউ সমর্থককে আটক করা হয়েছে।

 

এরপরেও মাউ মাউ বিদ্রোহ চলমান থাকলে ব্রিটিশ সরকার নাইরোবি শহরে বিদ্রোহ পুরোপুরি দমন করার জন্য অপারেশন অ্যানভিল চালায়। এ সময়ে সন্দেহভাজন প্রত্যেককেই পুলিশ গ্রেফতার করে। কোনোরকম ব্যাখ্যা ছাড়াই হাজার হাজার কিকুইয়ু পুরুষকে নির্যাতন শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। এছাড়া বহু গ্রামীণ কিকুইয়ুকে তাঁদের নিজেদের ঘর ছেড়ে ব্রিটিশদের তৈরি গ্রামে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকতে বাধ্য করা হয়। ১৯৫৪ সালের শেষ দিকে দেখা যায়, দশ লাখ কিকুইয়ু ঘরবাড়ি ছেড়ে এসব গ্রামে বাস করছেন। গ্রাম বলতে, বেড়া দেওয়া ক্যাম্পের থেকে একটু বেশি। তাছাড়া, জায়গাগুলো ছিলো দুর্ভিক্ষ আর অসুখের আকর। গ্রামবাসী কড়া পাহারায় থাকায় বনে যুদ্ধরত মাউ মাউদের কাছে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছানোও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

 

 

১৯৫৪ সাল। মাউ মাউ সন্দেহে আটককৃতদের ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

 

 

১৯৫৫ সালে ব্রিটিশ বাহিনী বনের ভেতরে চিরুনি অভিযান চালাতে শুরু করে। মাউ মাউ বিদ্রোহীরা তখন খাবার এবং যুদ্ধের রসদের অভাবে পর্যুদস্ত। এর ফলে অল্প মাউ মাউ বিদ্রোহী মারা পড়লেও তাঁদের মনোবল নড়বড়ে হয়ে যেতে শুরু করে। সরকার বন কেটে মাউ মাউ বিদ্রোহীদের হত্যা করার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলের আফ্রিকানদের জড়ো করতে থাকে। বছর শেষে দেখা যায়, বনে আর মাত্র ১৫০০ জনের মতো মাউ মাউ বিদ্রোহী আছেন, এবং তাঁদের অবস্থা এতোই শোচনীয় যে তাঁদের পক্ষে আর সংগঠিত সশস্ত্র বিদ্রোহ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। পরের বছর সবচেয়ে প্রভাবশালী মাউ মাউ নেতা কিমাথি গ্রেফতার হন। যাঁরা বাকি থাকেন, তাঁদের পক্ষে ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে অর্থবহ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। মাউ মাউ বিদ্রোহ এভাবেই স্তিমিত হয়ে পড়ে।

 

কেনিয়াতে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত জরুরি অবস্থা বহাল থাকলেও তার আর দরকার ছিলো না। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, নিহত মাউ মাউয়ের সংখ্যা ১১,৫০৩, যদিও ধারণা করা হয় প্রকৃত সংখ্যাটা অনেক বেশি। পরবর্তী সময়ে হার্ভার্ডের ঐতিহাসিক ক্যারোলিন এলকিনস তাঁর গবেষণা করতে গিয়ে জানতে পারেন যে, ব্রিটিশ সরকার সে সময়ের প্রচুর নথিপত্র কেনিয়া ছাড়ার সময়ে সঙ্গে নিয়ে গেছে, যদিও এই অভিযোগ তারা অস্বীকার করে থাকে।

 

 

১৯৫৪ সাল। কেনিয়ার কারোইবঙ্গিতে মাউ মাউ সন্দেহভাজনদের তল্লাশি করতে পুলিশকে সহায়তা করছে ব্রিটিশ সৈন্যরা। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

 

 

এলকিন্সের গবেষণা এবং মাউ মাউ বিদ্রোহ নিয়ে লেখা তাঁর বই ব্রিটিশ গুলাগ বলে যে, মাউ মাউ বিদ্রোহে নিহত ও আটককৃতদের সংখ্যা ব্রিটিশ সরকার যা দাবি করে তারচেয়ে বেশি। বিষয়টি শিউরে ওঠার মতো অবশ্যই। তবে আরো ভীতিকর এসব সংখ্যার পেছনে থাকা মানুষদের অভিজ্ঞতা। কাবুগি নজুমার বিষয়টিই ধরা যাক। তাঁর শাস্তি ছিলো, যতোক্ষণ না তিনি মাউ মাউ বিদ্রোহে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করছেন, ততক্ষণ তাঁকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৩৬ কেজি মাটিতে ভরা বালতি মাথায় নিয়ে দৌড়াতে হবে। ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বরে আগুথির স্পেশাল ডিটেনশন ক্যাম্পে মারা যান তিনি। তাঁর শরীরে লাঠির আঘাতের চিহ্ন ছিলো। কেনিয়ার ব্রিটিশ প্রশাসন দাবি করে যে, তিনি প্রাকৃতিক কারণে মারা গেছেন। পাওলো নজিলিকে চিমটার সাহায্যে খোজা করা হয়। জেইন মুথোনি মারাকে গরম কাঁচের বোতল দিয়ে ধর্ষণ করা হয়। গিথিরিরি ক্যাম্পে কিবেবে মুচারিয়াকে রাবারের স্ট্রিপ দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মরিচ গোলানো পানি বোতলে ভরে সেই বোতল দিয়ে ধর্ষণ করা হয় সালোমে মাইনাকে। হত্যা, ধর্ষণ, অনাহারে রাখা, অঙ্গচ্ছেদন বন্দি শিবিরগুলোর দৈনন্দিন বিষয় ছিলো।

 

 

কাবুগি নজুমার বিষয়টিই ধরা যাক। তাঁর শাস্তি ছিলো, যতোক্ষণ না তিনি মাউ মাউ বিদ্রোহে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করছেন, ততক্ষণ তাঁকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৩৬ কেজি মাটিতে ভরা বালতি মাথায় নিয়ে দৌড়াতে হবে। ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বরে আগুথির স্পেশাল ডিটেনশন ক্যাম্পে মারা যান তিনি। তাঁর শরীরে লাঠির আঘাতের চিহ্ন ছিলো। কেনিয়ার ব্রিটিশ প্রশাসন দাবি করে যে, তিনি প্রাকৃতিক কারণে মারা গেছেন।

 

 

অথচ মাউ মাউ বিদ্রোহ দমনের করাল চেহারা চাপা দিয়ে রাখতে কম চেষ্টা করা হয়নি। প্রথমত, কেনিয়া ছেড়ে যাওয়ার সময়ে বেশিরভাগ নথিপত্র ব্রিটিশ সরকার সরিয়ে ফেলে। এছাড়া কেনিয়া সরকারও এমন এক পথ ধরে, যাকে দ্য ক্রনিকলের সাংবাদিক মার্ক পেরি বলেছেন অফিশিয়াল অ্যামনেসিয়া। বিদ্রোহের ভয়াবহ নৃশংসতাকে জাতিগতভাবে ভুলে যেতে চেষ্টা করা হয়। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাঝেও ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব চড়া হতে থাকলে ব্রিটিশরা উপলব্ধি করে যে, উপনিবেশটি ধরে রাখা সম্ভব হবে না। ফলে স্বাধীনতা পরবর্তী দেশটিতে প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখতে তারা একপ্রকার শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্তই নেয়। ১৯৬৩ সালে স্বাধীনতার পরে কেনিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী জোমো কেনিয়াত্তা বারবার ঘোষণা করেন যে, “কেনিয়ানদেরকে অবশ্যই অতীত ভুলে যেতে হবে এবং ক্ষমা করতে হবে।” কেনিয়াত্তা নিজেও একজন কিকুইয়ু। ব্রিটিশদের পক্ষাবলম্বনকারী কেনিয়াত্তা সেনাবাহিনী পাঠিয়ে অবশিষ্ট মাউ মাউ বিদ্রোহীদের প্রধান নেতাদের হত্যা করেন এবং আত্মসমর্পণ না করা জীবিতদের ফেরারি ঘোষণা করেন।

 

 গবেষণার সময়ে ক্যারোলিন এলকিনস দেখেছেন, বহু তরুণ কিকুইয়ুই জানেন না তাঁর দাদা-দাদী বা নানা-নানীকে বন্দী করা হয়েছিলো। বা, পাশের বাসার বাচ্চাটির সাথে তার খেলা বারণ ছিলো কারণ প্রতিবেশী শিশুটির বাবা হয়তো তার মাকে ধর্ষণ করেছিলো। মাউ মাউ নিয়ে কথা বলার ওপরে এক ধরনের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিলো। ২০০২ সালে এলকিনসের গবেষণার সময়ে অনেকেই এই নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। অনেকেই মনে করেন, ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টার ফলাফল বর্তমানকেও প্রভাবিত করছে। আফ্রিকার ইউনাইটেড স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সহকারী অধ্যাপক ডক্টর নজোকি ওয়ামাই বলেন, “ঔপনিবেশিক সময়ের খারাপ দিক সম্বন্ধে আমাদের বলা হয়েছিলো, এমন কিছু আমার মনে পড়ে না। আমাদের অনেককেই অন্যভাবে বিষয়গুলো জানতে হয়েছে। তাছাড়া, কেনিয়ার ঔপনিবেশিক শিক্ষার ধারাবাহিকতার কারণে রাণীকে এখানে দেখানো হয় আরাধ্য ব্যক্তি হিসেবে।”

 

ফিরে আসা যাক রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছে। তাঁর মৃত্যুর পর ভূতপূর্ব বহু উপনিবেশের বাসিন্দার মধ্যেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেনিয়া এর ব্যতিক্রম নয়। ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংসভাবে যে কয়েকটি বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে, মাউ মাউ তার মধ্যে অন্যতম। এ সময়ে দ্বিতীয় এলিজাবেথই ব্রিটেনের রাণী ছিলেন। আলঙ্কারিক পদে থাকলেও তাঁর জাতির করা অন্যায়ের জন্য তিনি কখনো দুঃখপ্রকাশ বা ক্ষমাপ্রার্থনা করেননি।

 

কোন কোন দেশ ১৫০ বছর পর হলেও তাদের ভয়াবহ অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে, যেমন বেলজিয়ামের রাজপরিবার ও সরকার ক্ষমা প্রার্থনা করেছে আনুষ্ঠানিকভাবে। কঙ্গোসহ আফ্রিকায় তাদের উপনিবেশিক ইতিহাস বীভৎস। আবার কাউকে কাউকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্যও করা হয়েছে। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতার জন্য জার্মানী ও জাপান। কিন্তু ফ্রান্স, ইংল্যান্ডসহ বহু দেশ এটা করেনি। বহু রাষ্ট্র গড়িমসি করছে। তুরস্ককে ন্যায্যভাবেই আর্মেনীয় গণহত্যার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার চাপ দেয়া হলেও পশ্চিমা বহু দেশই নিজেরা তাদের অতীত নিয়ে আত্মসমালোচনা ও অনুতাপ প্রকাশ করেনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ গণহত্যা চালাবার কারণে পাকিস্তানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা চাইবার শক্তি দাবি আছে বাংলাদেশে।

 

অন্যদিকে আফ্রিকার নতুন প্রজন্মের মাঝে ইউরোপীদের চাপিয়ে দেয়া দাসযুগ ও উপনিবেশিক আমলের স্মৃতিই শুধু জেগে উঠছে তাই না, উপনিবেশের ধারাবাহিকতায় আজও যে বহু আফ্রিকার দেশে আজ্ঞাবাহী শাসক গোষ্ঠীই ক্ষমতাসীন আছে, সেই অনুভূতিও সোচ্চার হচ্ছে। উঠছে ক্ষতিপূরণের দাবিও।

 

বলা হয়ে থাকে, ব্রিটিশ রাণী ছিলেন একজন আনুষ্ঠানিক বা আলঙ্কারিক রাণী মাত্র। তাঁর কোন শাসনতান্ত্রিক এখতিয়ার ছিল না। সেক্ষেত্রে তাকে নিয়ে আসলে আলাপ করার কিছু নেই। ব্রিটিশ গণমাধ্যম তাঁকে নিয়ে অতীতের পোষাকি ধারাবাহিকতা হিসেবেই মাতামাতি করতে পারে। অন্যদিকে, তাঁকে বা তাঁর রাণীর পদটিকে যদি গুরুত্ব দিতেই হয়, তাহলে নিজেদের সরকারের, পরিবারের কাজের দায়ভার সমেতই তাকে সেই গুরুত্বটা দিতে হবে। আফ্রিকার বহু নাগরিকের মনে ন্যায্য ভাবেই এই প্রশ্নটি এসেছে।

 

যেমনটা আগেই বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতিসহ কেনিয়ার শীর্ষ নেতারা রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করলেও নাইরোবিতে অনেকেই খবরটা সম্বন্ধে উদাসীন ছিলেন। কেউ কেউ জানতেনই না, অনেকে জেনেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। অনেকের কাছেই তিনি দূরের কোনো চরিত্র। কেউ কেউ তাঁকে চেনেন দ্য ক্রাউন নামের টিভি সিরিজের মাধ্যমে।

 

বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে অবশ্য সমালোচনা হয়েছে রাণীর মৃত্যুতে। কারণ, তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মাউ মাউ বিদ্রোহের স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। ইতিহাসকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করা হলেও নতুন প্রজন্মের মানুষেরা মাউ মাউ আন্দোলন দমনের বীভৎসতা সম্বন্ধে অনবহিত নন। নিয়াম্বুরা মাইনা বলেন, “আমার দাদা-দাদী বা নানা-নানী যখন আমাকে তাঁদের গল্প বলেন, তখন যন্ত্রণাটা পুরোপুরি অনুভব করা যায়। যে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে আমাদের মানুষদের যেতে বাধ্য করা হয়েছে, তাঁকে বাদ দিয়ে অন্যের যন্ত্রণার দিকে মনোযোগী হতে আমি অস্বীকার করি।” কিকোন্দে মোয়াম্বুরি (৩৩) বলেন, “তাঁর নৃশংস ইতিহাসকে বৈধতা দিতে মৃত্যুকে ব্যবহার করা উচিত নয়। এই স্থূল প্রথাকে যে তরুণ প্রজন্ম প্রশ্নবিদ্ধ করছে, এতে আমি খুশি।”

 

রাণীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পরিবর্তে অনেক কেনিয়ানই মাউ মাউ আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোকে বেছে নিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় “মাউ মাউ” বা “দেদান কিমাথি”র মতো শব্দগুলো ট্রেন্ডিং হয়ে উঠেছে রাণীর মৃত্যুর পরদিন।

 

কেনিয়ার বিশ্বখ্যাত লেখক নগুগি ওয়া থিঙ্গোর পুত্র কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির সহকারী অধ্যাপক ও লেখক মুকোমা ওয়া নগুগি আফ্রিকায় রাণীর প্রভাব সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলেন। তিনি টুইটারে লেখেন, “রাণী যদি দাসপ্রথা, উপনিবেশবাদ এবং নব্য-উপনিবেশবাদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করতেন, এবং তাঁর/ তাঁদের নামে নেওয়া অজস্র জীবনের ক্ষতিপূরণের জন্য রাজদরবারে সুপারিশ করতেন, তাহলে হয়তো আমি দুঃখ বোধ করতাম। একজন কেনিয়ান হিসেবে আমি কিছুই বোধ করছি না। অদ্ভুত এই নাটক।” নগুগি ওয়া থিঙ্গো বলেন, “কেনিয়ানরা জানে কী ঘটেছিলো। আমরা এটা বহু বছর ধরেই বলে আসছি।… এটা একটা গণহত্যামূলক যুদ্ধ ছিলো, এবং কেউ এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। ব্রিটেনে অল্প কয়েকজন তাঁদের সরকারের বক্তব্য বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন।” নগুগি আরো জানান, কেনিয়াকে সাংস্কৃতিকভাবেও আক্রমণ করা হয়েছিলো মাউ মাউ বিদ্রোহের সময়ে। উপনিবেশ এবং এর স্বাধীনতা-পরবর্তী ধারা সম্বন্ধে তিনি বলেন, “কেনিয়া-কেন্দ্রিক আফ্রিকা-পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়ার পরেই খুব পদ্ধতিগতভাবে একদল ইংরেজিভাষী অভিজাতের জন্ম হলো, যারা আফ্রিকার ভাষাগুলো হতে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। এবং এর ফলেই ১৯৫২ সালে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে আপনি গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, ইতিহাস, এসবকিছুর উত্তর ইংরেজিতে লিখেও যতই ভালো করুন না কেন, ইংরেজি বিষয়ে আলাদাভাবে পাশ না করলে আপনাকে পরের শ্রেণিতে উঠতে দেয়া হবে না। ইংরেজিকেই তখন সুশিক্ষা, সার্বিক জ্ঞান ও মেধার পরিচায়ক হিসেবে গণ্য করা শুরু হলো। ১৯৬৪ সালে কেনিয়ার সদ্য স্বাধীন হওয়া আফ্রিকান সরকারও প্রাক-প্রাথমিক হতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সকল আফ্রিকান ভাষার বদলে ইংরেজিকে স্থান দিয়ে এই মানসিকতাকে জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে তোলে।”

 

 

রাণী যদি দাসপ্রথা, উপনিবেশবাদ এবং নব্য-উপনিবেশবাদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করতেন, এবং তাঁর/ তাঁদের নামে নেওয়া অজস্র জীবনের ক্ষতিপূরণের জন্য রাজদরবারে সুপারিশ করতেন, তাহলে হয়তো আমি দুঃখ বোধ করতাম। একজন কেনিয়ান হিসেবে আমি কিছুই বোধ করছি না।

 

সাবেক উপনিবেশগুলোতে করা অন্যায় ও জবরদস্তি বিষয়ে ব্রিটিশ শাসকরা নীরবতা বজায় রাখাকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করেন। অন্য বহু রাষ্ট্র ইতিহাসের নানান পর্বে তাদের করা অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং বিরল কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রতীকি ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করলেও ব্রিটিশরা বিষয়টাকে এড়িয়ে যেতে পেরেছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝেই নিজেদের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি শক্তিশালী অংশ তৈরি করার মাধ্যমে। ক্ষমা চাইবার বদলে বরং এরা নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের কাছে কৃতজ্ঞ। কমনওয়েলথ নামের ব্রিটিশ উপনিবেশিকতার ধারা রক্ষা করা সংগঠনটি এভাবেই টিকে গিয়েছে।

 

যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কেনিয়ার শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। দেশটি কমনওয়েলথের সদস্যও। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংগঠনটির ভূ-রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, রাজা তৃতীয় চার্লস কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করে ব্রিটেনের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নেবেন। এ বছরের শুরুতে রাজপরিবারের এ ধরনের চেষ্টা দেখা গেছে জ্যামাইকার ক্ষেত্রে। তবে সেই চেষ্টা ধোপে টেকেনি, কারণ জ্যামাইকার জনগণ এবং নেতৃবৃন্দ দাসপ্রথার জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন, এবং মানবতা পরিপন্থী অপরাধের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা দাবি করেছেন।

 

রাণী তাঁর সত্তর বছরের শাসনামলে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। এই নেতাদের মধ্যে কেনিয়ার বহু রাষ্ট্রপতিও ছিলেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজা তৃতীয় চার্লসকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ভূতপূর্ব উপনিবেশে করা ব্রিটিশদের অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।

 

 

তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, এপি, ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি, সিএনএন, সাউথ আফ্রিকান হিস্ট্রি অনলাইন, ডয়চে ভেলে, নিউজ উইক, এনডিটিভি, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, দ্য ক্রনিকল।