মহানবীকে লক্ষ্য করে বিজেপির নেতা নূপুর শর্মার মন্তব্য ঘিরে বিশ্ব উত্তপ্ত। বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে নূপুর শর্মাকে বিজেপি শাস্তি দিলেও পর্যবেক্ষকদের অনুমান, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিজেপির মুসলিম-বিদ্বেষী তৎপরতা অব্যাহতই থাকবে। ইতিহাস বদলের চেষ্টা, পাঠ্যবইতে সাম্প্রদায়িক উপকরণ বৃদ্ধি, রাজনীতিতে হিংসা ছড়ানো বুলি— এসবই তার লক্ষণ। দৃকনিউজের পাঠকদের জন্য আমরা এই বিষয়ে বাছাই করা কিছু মৌলিক প্রবন্ধ এবং অনুবাদ প্রকাশ করছি। তার ধারাবাহিকতায় রয়টার্সের একটি বিশ্লেষণ আজ প্রকাশ করা হলো। লেখাটি বিজেপির পাঠ্যসূচিতে ভারতের ইতিহাস পুনর্লিখন প্রকল্পের তাৎপর্য বুঝতে সাহায্য করবে।
কেবল হিন্দু জনগোষ্ঠী যে ভারতের আদিম অধিবাসীদের বংশধর, তা প্রমাণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার পণ্ডিতদের একটি কমিটি নিয়োগ দিয়েছে ২০১৮ সালে। দেশটির সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের সদস্যরা এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে, এই তৎপরতার মধ্য দিয়ে সরকার তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করতে চায়।
“আমরা গণেশ দেবের উপাসনা করি। হয়তো সেকালে কোনো প্লাস্টিক সার্জন ছিলেন, যিনি একজন মানুষের শরীরের ওপর একটা হাতির মাথা বসিয়ে দিয়েছিলেন। এমন অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা রেখেছেন বিরাট ভূমিকা।”– নরেন্দ্র মোদি, ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। আলোকচিত্র: সৌরভ দাস/এপি
২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে একদল ভারতীয় পণ্ডিত নয়া দিল্লীর এক মনোরম সড়কের পাশে একটি ঝকঝকে বাংলোয় সমবেত হন। তাদের আলোচনার কেন্দ্র ছিল: কীভাবে জাতির ইতিহাস পুনর্লিখন করা যায়।
এর মাস ছয়েক আগে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার বিশেষজ্ঞদের এই কমিটিকে চুপচাপ নিয়োগ দিয়েছিল। সেই কমিটির অস্তিত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রথমবারের মত এই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
রয়টার্সের পর্যালোচনা করা সভার কার্যবিবরণী এবং কমিটি সদস্যদের সাক্ষাৎকার থেকে এই কমিটির উদ্দেশ্যটুকু পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সেটা হল প্রত্নতাত্ত্বিক সন্ধান আর ডিএনএর মত নজির কাজে লাগিয়ে এটা প্রমাণ করা যে, কয়েক হাজার বছর আগে ভারতবর্ষে প্রথম যে মানুষেরা বাস করতেন, আজকের হিন্দুরা তাদের সরাসরি বংশধর। আরেকটা উদ্দেশ্য: প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলো যে অতিকথা নয়, বরং বৈজ্ঞানিক সত্য, তা প্রতিষ্ঠা করা।
১৪ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটির সদস্য আর মোদি সরকারের মন্ত্রীদের সাক্ষাৎকার থেকে এর উদ্দেশ্য নিয়ে একটা ইঙ্গিত মেলে। সেই ইঙ্গিতটা হলো হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের উদ্দেশ্য বহু ধর্মের বহুবর্নিল নকশা ১৩০ কোটি মানুষের জাতিরাষ্ট্রটাতে কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখার মধ্যেই সীমিত নয়। তাদের চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষা হল জাতীয় পরিচয়কে তাদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা, যে দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ভারত কেবল হিন্দুদের রাষ্ট্র, এবং কেবল হিন্দুদের এখানে স্থান মিলবে।
এটা করতে গিয়ে ভারত যে বহুসাংস্কৃতিক একটি রাষ্ট্র, সেই বয়ানের দিকে তারা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছেন। পুরনো বয়ানটি অনুযায়ী, আজকের দিনের ভারত একটা শিল্পকর্ম, যা অভিবাসন, আগ্রাসন আর ধর্মান্তরের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির শিকড় জনমিতিক তথ্য-উপাত্তের মাঝে নিহিত। ভারতীয়দের মধ্যে হিন্দুরা সংখ্যাগুরু হলেও মুসলমানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা প্রায় ২৪ কোটির কাছাকাছি, দেশটির মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ।
কমিটির সভাপতি কে এন দীক্ষিত রয়টার্সকে বলেন, “আমাকে এমন একটা প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে, যা সরকারকে প্রাচীন ইতিহাসের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য পুনর্লিখন করতে সহায়তা করবে।”
এই কমিটি গঠন করেছেন সংস্কৃতিমন্ত্রী মহেশ শর্মা। তিনি এক সাক্ষাৎকারে এটা নিশ্চিত করেছেন যে তাদের কাজ ভারতের ইতিহাস সংশোধন করার এক বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ।
যা ঘটে চলেছে তা ভারতের মুসলমানদের জন্য অশুভ ইঙ্গিতবাহী। তারা ২০১৪ সালে মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে দেশটিতে ঘটা ধর্মীয় সহিংসতা আর বৈষম্যের প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে আর কোনোদিনই এতটা কোনঠাসা অনুভব করেননি। তাদের একজন নেতা বলেন, “এই সরকার চায় মুসলমানরা ভারতে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বাস করুক।”
রয়টার্স এই নিবন্ধের বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির মন্তব্য জানতে অনুরোধ করলে তিনি তাতে সাড়া দেন নি।
পাঠ্যক্রমে নতুন ইতিহাস আরোপের তৎপরতা
ভারতীয় ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক উস্কে দেয়ার পেছনে একটি আদর্শিক, জাতীয়তাবাদী হিন্দু সংগঠনের হাত আছে। দলটি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) নামে পরিচিত। ২০১৪ সালে আরএসএস মোদির ভারতীয় জনতা পার্টিকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছিল। এই কমিটি তৈরির সময়ে দেশটির কৃষি মন্ত্রণালয়, মহাসড়ক আর অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যারা ছিলেন, তারা এই সংগঠনের সদস্য।
আরএসএসের দাবি ভারতীয় উৎসের সব মানুষের পূর্বপুরুষ হিন্দু, দেশটির ১৭ কোটি ২০ লাখ মুসলমান যাদের অন্তর্ভূক্ত। ভারতমাতার অংশ হিসেবে তাদের সবাইকেই একটা একক সাধারণ উৎস মেনে নিতে হবে। মোদি সেই শৈশব থেকেই আরএসএসের একজন সদস্য। সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী মহেশ শর্মার একটি আনুষ্ঠানিক জীবনীগ্রন্থ থেকে জানা যাচ্ছে, তিনিও বহুবছর ধরে আরএসএসের একজন একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতীকী বর্ণের প্রতি দিকনির্দেশ করে আরএসএসের মুখপাত্র মনমোহন বৈদ্য রয়টার্সকে জানিয়েছেন, “ভারতীয় ইতিহাসের আসল রঙ গেরুয়া এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনার জন্য আমাদেরকে ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে।”
আরএসএসের ঐতিহাসিক গবেষণা শাখার প্রধান বালমুকুন্দ পাণ্ডে বলেন, শর্মার সাথে প্রায়ই তার দেখা হয়। পাণ্ডের মতে, ভারতের অতীত গৌরব পুনর্বহাল করার ‘সমূহ সময় উপস্থিত’, প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রগুলো যে অতিকথা নয়, সত্য তা প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়েই তা সম্ভবপর হবে।
মহেশ শর্মা রয়টার্সকে বললেন তিনি আশা করেন কমিটি যে সিদ্ধান্ত টানবে তা বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই আর বিদ্যায়তনিক গবেষণায় পথ করে নেবে। সরকারি নথিপথে এই প্যানেলটিকে “আজ থেকে ১২ হাজার বছর আগে ভারতীয় সংস্কৃতির উদ্ভব, এর বিবর্তন ও দুনিয়ার অন্যান্য সংস্কৃতির সাথে আদানপ্রদান বিষয়ে একটি সামগ্রিক সমীক্ষা” চালানোর কমিটি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
শর্মা বলেছেন, ভারতীয় ইতিহাসের এই ‘হিন্দু প্রথম’ সংস্করণটি বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে যুক্ত করা হবে। পুরনো পাঠ্যক্রমটি দীর্ঘদিন ধরে শিখিয়ে আসছে যে, মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে মানুষজনের আগমন ও জনসমাজের রূপান্তর অনেক বেশি সাম্প্রতিক ঘটনা। ৩ থেকে ৪ হাজার বছর আগে তা ঘটেছে।
“ভারতীয় ইতিহাসের আসল রঙ গেরুয়া এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনার জন্য আমাদেরকে ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে।”– মনমোহন বৈদ্য, মুখপাত্র, আরএসএস। আলোকচিত্র: ডিএনএ ইন্ডিয়া
ভারত যে গণ অভিবাসনের দরুণ গঠিত হয়েছিল, মোদির দলের শীর্ষপর্যায়ের সদস্যগণ আর হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা সেই ধারণাটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা বিশ্বাস করেন আজকের হিন্দুরা দেশটির প্রথম বাসিন্দাদের থেকেই উদ্ভূত হয়েছেন। ঐতিহাসিক রোমিলা থাপারের মতে, ভারতের মাটিতে কে প্রথম পা রেখেছে সেটা জাতীয়তাবাদীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণ হল, “হিন্দুদেরকে যদি একটি হিন্দু রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে অগ্রগণ্য করতে হয়, তাদের ভিত্তিস্বরূপ ধর্মটা আমদানিকৃত হলে চলে না।” নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুবছর শিক্ষকতা করা এবং প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস বিষয়ে একাধিক গ্রন্থ প্রণেতা ৮৬-বছর-বয়সী থাপারের মতে, নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে হিন্দুদের অগ্রগণ্যতায় জোরারোপ করার জন্যই জাতীয়তাবাদীদের প্রয়োজন হয় নিজেদেরকে প্রাচীন অধিবাসীদের বংশধর দাবি করার, প্রয়োজন হয় এই ভূমিতে জন্ম এমন একটা ধর্মের উত্তরাধিকার দাবি করার। আজ থেকে ৩-৪ হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে বিপুল হারে জন আগমন ঘটেছিল, ব্রিটিশ আমল থেকেই এই তত্ত্বটি সমাদৃত হয়ে আসছে।
“নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে হিন্দুদের অগ্রগণ্যতায় জোরারোপ করার জন্যই জাতীয়তাবাদীদের প্রয়োজন হয় নিজেদেরকে প্রাচীন অধিবাসীদের বংশধর দাবি করার, প্রয়োজন হয় এই ভূমিতে জন্ম এমন একটা ধর্মের উত্তরাধিকার দাবি করার।“ রোমিলা থাপার। আলোকচিত্র: টাইমস অফ ইন্ডিয়া
হিন্দু শাস্ত্রের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি ইতিহাস নির্মাণ
পূর্বোল্লিখিত ইতিহাস কমিটি আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মহাপরিচালকের কার্যালয়ে সভা করেন। আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া একটি ফেডারেল প্রতিষ্ঠান যা প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা দেখভাল করে থাকে। কয়েকজন আমলা আর শিক্ষকসহ এই কমিটির সদস্য ১৪ জন। কমিটির সভাপতি দীক্ষিত আর্কিওলজিকাল সার্ভের একজন উচ্চপদস্থ সাবেক কর্মকর্তা।
তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী মহেশ শর্মা রয়টার্সকে জানিয়েছিলেন, তিনি কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন করবেন। কমিটির প্রতিবেদনের তথ্য যেন স্কুলের পাঠ্যবইগুলোতে লেখা হয় সেজন্য সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ে দেনদরবার করবেন। শিক্ষা ও সাক্ষরতা কর্মসূচির দায়িত্বে থাকা এই মন্ত্রণালয়টির প্রধানও আরএসএসের একজন অনুসারী, প্রকাশ জাভাদেকার।
জাভাদেকার বলেন, “আমরা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতিটা সুপারিশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করব। আমাদের সরকারই প্রথম এমন একটা সরকার যারা স্কুল কলেজে ইতিহাসের যে সংস্করণ শেখানো হচ্ছে তাকে অন্তত প্রশ্নের মুখে ফেলার সাহস রাখে।”
ইতিহাস কমিটির প্রথম সভার কার্যবিবরণীর তথ্য অনুযায়ী সভাপতি দীক্ষিত বলেন, “ভারতীয় সভ্যতা যে কয়েক হাজার বছর পুরনো, তার প্রমাণাদির সাথে প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থসমূহের একটা যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। এটা করতে পারলে কমিটি যেই দুটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চায়, সেগুলোকে জোরদার করতে সুবিধা হবে। এক, হিন্দু রচনাগুলোতে যেসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে সেগুলো সত্য; আর দুই, আজকের হিন্দুরা সেই সময়ের হিন্দুদের থেকে উদ্ভূত হয়েছেন।
কমিটি সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎকার আর কার্যবিবরণী থেকে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি ব্যাপকভিত্তিক প্রচারাভিযানের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানা যায়। মানব অবশেষের ডিএনএ পরীক্ষা আর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর দিনতারিখ নির্ণয় যার অন্তর্গত।
“ভারতের এমন একটি ইতিহাসের জন্য সময় এসে গেছে যা ভারতীয়দের মহান অতীত বিষয়ক তথ্যাবলির ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করবে।” - অমিত শাহ, ভারতের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আলোকচিত্র: স্ক্রল/টুইটার
মহেশ শর্মা রয়টার্সকে বলেছিলেন, তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চান হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলো সত্যনিষ্ঠ বিবরণ। মানুষের রূপ ধরে এক হিন্দু দেবতার পথচলার বর্ণনা দেয়া মহাকাব্য রামায়ণের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে শর্মা বলেন, “আমি রামায়ণের বন্দনা করি। আমি মনে করি এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। যারা এটাকে কল্পকাহিনী ভাবেন তারা পুরোপুরি ভুল। দেবতা রাম কীভাবে তাঁর স্ত্রীকে এক দানব রাজার হাত থেকে উদ্ধার করলেন মহাকাব্যটি সেই গল্প বলে। এখনো বহু ভারতীয় নারী-পুরুষের ভূমিকা ও দায়িত্ব বিষয়ক বোধ গড়ে দেয় রামায়ণ।”
শর্মার মতে, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে পৌরাণিক নদী স্বরস্বতীর অস্তিত্ব প্রমাণ করাটাকে প্রাধান্য দেয়া হবে, আরেকটি প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ বেদে যার উল্লেখ আছে। শর্মা ও কমিটির কার্যবিবরণী অনুসারে, অন্যান্য প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত স্থানগুলোতে পাওয়া শিল্পকর্মগুলো পরীক্ষা করে দেখা, এসব শাস্ত্রে বর্ণিত জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক ঘটনাগুলোর দিনতারিখ নির্ণয় করা, এবং আরেক মহাকাব্য মহাভারতে সংঘটিত সমরগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানসমূহ খনন করা।
যেভাবে কিছু খ্রিস্টান প্রাচীনকালের কোনো বন্যার নিদর্শনের মাঝে বাইবেলে বর্ণিত নূহ নবির কিশতির গল্পের প্রামাণিকতা খোঁজেন, ঠিক সেই একই চিন্তাধারায় ভারতের প্রাচীন ধর্মগুলোর স্থানকাল আর কিছু নিদর্শন যদি প্রমাণ করা যায় তাহলে গল্পগুলো সত্য এমনটা ভাবা হচ্ছে।
মহেশ শর্মার জিজ্ঞাসা, “কুরআন আর বাইবেলকে যদি ইতিহাসের অংশ বিবেচনা করা যায়, তাহলে আমাদের হিন্দু ধর্মশাস্ত্রগুলোকে ভারতের ইতিহাস বলে মেনে নিতে সমস্যা কী?”
এই কমিটি গঠনের নির্দেশ মোদি দেননি। সরকারি নথিপত্র দেখাচ্ছে এটি গঠনের ইন্ধনদাতা ছিলেন শর্মা। কিন্তু এর মিশন মোদির দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ২০১৪ সালে মুম্বাইয়ে একটি হাসপাতাল উদ্বোধন করার সময় মোদি প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রগুলোতে নথিভুক্ত হওয়া বৈজ্ঞানিক অর্জনগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করেন। হাতির মাথাওয়ালা হিন্দু দেবতা গণেশের ব্যাপারে মোদি বলেন: “আমরা গণেশ দেবের উপাসনা করি। হয়তো সেকালে কোনো প্লাস্টিক সার্জন ছিলেন, যিনি একজন মানুষের শরীরের ওপর একটা হাতির মাথা বসিয়ে দিয়েছিলেন। এমন অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা রেখেছেন বিরাট ভূমিকা।” রয়টার্সের তরফ থেকে মোদিকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল এই বিষয়ে বিশদ বলতে। তিনি কোনো সাড়া দেননি।
রয়টার্স যে ১২ জন কমিটি সদস্যের সাক্ষাৎকার নিয়েছে তাদের মধ্যে ৯ জন বলেছেন, তাদেরকে প্রাচীন ভারতীয় ধর্মগ্রন্থগুলোর সাথে মিলে যাবে এমন প্রত্নতাত্ত্বিক আর অন্যান্য প্রমাণ খুঁজে বের করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তাদেরকে এই মত প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল যে, ভারতীয় সভ্যতা যতটা পুরনো বলে আমরা জানি, তা তারচেয়েও অনেক বেশি পুরনো। বাকিরা তাদের কমিটি সদস্য হওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছেন, কিন্তু দলের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলাপ করতে রাজি হননি। কমিটির সদস্যদের মধ্যে আছেন একজন ভূগোলবিদ, কয়েকজন প্রত্নতত্ত্ববিদ, কয়েকজন প্রাচীন সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিত, আর দুইজন আমলা।
সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিতদের একজন সন্তোষ কুমার শুক্লা। তিনি নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। শুক্লা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, তিনি বিশ্বাস করেন, ভারতের হিন্দু সংস্কৃতি কয়েক লাখ বছর পুরনো। কমিটির আরেক সদস্য রমেশ চন্দ শর্মা। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক প্রধান শর্মা বলেছেন তিনি কঠোরভাবে একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করবেন। তিনি জানিয়েছেন, “আমি কোনো মতাদর্শ অনুসরণ করি না।”
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের জন্য বাৎসরিক বরাদ্দ ৪০০ মিলিয়ন ডলার। ঐতিহাসিক গবেষণা, প্রত্নতত্ত্ব, আর শিল্পকলার জন্য কেন্দ্রীয় তহবিলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস এই অর্থ বরাদ্দ। ফলে মন্ত্রণালয়টি ঐতিহাসিক সংশোধনের প্রচারাভিযান শুরু করার জন্য একটি প্রভাবশালী জায়গা।
২০১৪ সালে মোদির নির্বাচনী জয়লাভের পর সংস্কৃতিমন্ত্রী হিসেবে পেশাগত জীবনে চিকিৎসক ও একগুচ্ছ হাসপাতালের সভাপতি মহেশ শর্মার নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। সেসময় তিনি বলেছিলেন, তিনি আরএসএসের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা লাভ করেছেন। দিলখোলা হাসির এই ভদ্রলোকটির কাছে ভারতমাতার একটা প্রতিকৃতি আছে, মধ্য দিল্লিতে তার বাংলোর সভাকক্ষের প্রবেশপথে সেটা ঝুলে থাকে। এর নিচে রয়েছে অতীতের আরএসএস নেতাদের প্রতিকৃতি।
শর্মা বলেন, “গত তিন বছরে ভারতীয়দের সোনালি অতীতের শ্রেষ্ঠতা প্রমাণ করতে তার মন্ত্রণালয় দেশজুড়ে অসংখ্য কর্মশালা আর সেমিনার আয়োজন করেছে।” তার মতে, উদ্দেশ্যটা ছিল একটা তরতাজা বয়ান তৈরি করা, যা ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরু সমর্থিত উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনের মোকাবিলা করবে।
নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরি ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন। আজকাল সেখানে ডানপন্থী হিন্দু নেতৃবৃন্দ আর দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনা আর সভার আয়োজন হয়ে থাকে। ২০১৬ সালে এমন এক আয়োজনে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির সভাপতি অমিত শাহ নেহরুকে পশ্চিমা বিশ্ব দ্বারা প্রভাবিত এক ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে এক হাত নিয়েছেন। সেসময় শাহ বলেন, আমরা সবসময়ই বিশ্বাস করে এসেছি যে আমাদের নীতিগুলোতে ভারতীয় মাটির ঘ্রাণ থাকতে হবে। ভারতের এমন একটি ইতিহাসের জন্য সময় এসে গেছে, যা ‘ভারতীয়দের মহান অতীত বিষয়ক তথ্যাবলির’ ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করবে।
প্রথম প্রকাশ রয়টার্স, প্রকাশের তারিখ মার্চ ৬, ২০১৮
মূল লেখার লিংক: https://www.reuters.com/investigates/special-report/india-modi-culture/
তর্জমা: ইরফানুর রহমান রাফিন