বৃহঃস্পতিবার ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১ Thursday 21st November 2024

বৃহঃস্পতিবার ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

Thursday 21st November 2024

আন্তর্জাতিক জলবায়ু

কেরালায় ময়ূরের সংখ্যা বৃদ্ধি : জলবায়ু পরিবর্তনের অশুভ সঙ্কেত

২০২২-০৪-২৬

আথিরা পেরিনচেরি
তর্জমা : সায়রাত সালেকিন সাত্বিক

কেরালায় ময়ূরের সংখ্যা বৃদ্ধি : জলবায়ু পরিবর্তনের অশুভ সঙ্কেত

প্রতীকী ছবি
আলোকচিত্র সৈয়দ সাইফুল আলম 

 

  • ময়ূর একটি শুষ্ক জায়গার প্রাণী বলে পরিচিত হলেও বিশেষজ্ঞদেরকে বিস্মিত করে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আর্দ্র প্রদেশ কেরালায় ক্রমাগত ময়ূরের উপস্থিতি বাড়ছে।
  • কৌতূহলজাগানিয়া এই প্রবণতার কারণ উদঘাটন করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্যউপাত্ত খতিয়ে দেখছেন । সে লক্ষ্যে করা এক জলবায়ু মডেলিং বলছে যে ২০৫০-এর দশকে পুরো প্রদেশ জুড়ে এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে।
  • কোন নির্দিষ্ট প্রজাতির উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতি তাদের বাসস্থান পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এর মধ্য দিয়ে যে সংকেতটি আমরা পাই, তা হল এই যে, প্রাণীকুলের বাসস্থানের অবশিষ্ট এলাকাগুলো সংরক্ষণ করা এবং একইসাথে ক্ষয়প্রাপ্ত জমি পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানো একটা গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য আকারে হাজির হয়েছে।

 

কুঞ্জন কুরুম্বানের পুরো জীবন কেটেছে মধ্য-কেরালার পালাক্কাড অঞ্চলের পাল্লাভুর গ্রামে। তবে ষাটোর্ধ এই কৃষকের ভাষ্যমতে, কয়েক বছর আগেও গ্রামের ত্রিসীমানায় একটি ময়ূর খুঁজে পাওয়া ছিল অকল্পনীয়।

 

তিনি বলেন, “এখন তারা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে,” তিনি বলেন। “ওরা নারিকেল গাছে বাসা বাঁধে, প্রচুর বাচ্চা জন্ম দেয়, এবং কয়েকটা এখন এমনকি ফসলও খেয়ে ফেলছে।”

 

এই পর্যবেক্ষণ কেবল কুঞ্জনের একার নয়। উঠে আসছে পাখি পর্যবেক্ষকদের প্রতিবেদন – কেরালার এমন সব প্রান্তে ময়ূরের দেখা মিলছে যেখানে আগে এদের টিকিটারও হদিস মেলেনি। এবং একটি নতুন গবেষণা বলছে, এই ধারা থামবার নয়। বরং আগামী দশকগুলোয় কেরালার আবহাওয়া ক্রমশ শুষ্ক হওয়ার সাথে সাথে বাড়বে ময়ূরের বিস্তার।

 

সুতরাং, জলবায়ু পরিবর্তনের নিকট কেরালা প্রদেশের পরাজয়ের এক অশুভ পূর্বাভাস হিসেবেই এই বৃদ্ধিকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, যেমনটা জানাচ্ছে ইকোলজিকাল ইন্ডিকেটরস-এ প্রকাশিত এক নতুন গবেষণা।

 

সময়রেখা

কেরালায় ময়ূরের বিচরণ নিয়ে সুনির্দিষ্ট বয়ান একেবারেই বিরল। ১৯৩৩ সালে “ভারতের পাখি মানব” হিসেবে খ্যাত সালিম আলী কোচিনত্রাভানকোর দুটি অঞ্চলে একটি পাখি বিষয়ক অনুসন্ধান পরিচালনা করেন। বর্তমান মধ্য ও দক্ষিণ কেরালার অন্তর্ভুক্ত এই অঞ্চল দুটোর নির্বাচিত ১৯টি স্থানের একটিতেও খোঁজ মেলেনি ময়ূরের।

 

যুগান্তকারী এই জরিপের ঠিক পঁচাত্তর বছর পর তার পদচিহ্ন অনুসরণ করেন একদল পাখি পর্যবেক্ষক। পাখির সংখ্যা ও উপস্থিতি পুনরায় মূল্যায়ন করতে সালিম আলীর নির্বাচিত সেই ১৯টি স্থানেই ফিরে যান দলটি। আশ্চর্যজনকভাবে, এবার ১৯টির মধ্যে ১০টিতেই ময়ূরের দেখা মেলে।

 

২০১৪ সালে ইন্ডিয়ান বার্ডস-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে তাঁরা জানান, “ভারতীয় ময়ূরের এই ছড়িয়ে পড়াটি যে সংকেত পাঠাচ্ছে তা হল পশ্চিম ঘাট এলাকার দক্ষিণে প্রচুর শুষ্ক ও খোলা পরিবেশের আবির্ভাব ঘটছে – যা পূর্বে ছিল না।”

 

সাম্প্রতিক তথ্যে এই প্রবণতার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক নাগরিক বিজ্ঞান তথ্যসম্ভার ‘ই-বার্ড’-এ পাখির তালিকা ও উপস্থিতি সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করে থাকা পর্যবেক্ষকদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেরালার অনেক জায়গাতেই এখন ময়ূরের দেখা মিলছে।

 

কতটুকু জায়গা জুড়ে বর্তমানে ময়ূরদের বাস, এ-তথ্যের দ্বারা উৎপন্ন প্রাথমিক মানচিত্রগুলোয় সেটা ফুটে উঠছে। মানচিত্রের একেকটি ছক সমান ১ বর্গ কিলোমিটার, যা প্রণীত হয়েছে গবেষণার থেকে বের হয়ে আসা তথ্যসমূহের একটি তুলনামূলক বিবেচনার মধ্য দিয়ে। মানচিত্রের বেগুনি ছকগুলো লক্ষ্য করুন।

 

১৯০০-১৯৮৯ সময়কার মানচিত্রে যখন এই বেগুনি ছক প্রায় অনুপস্থিতই বলা চলে, ১৯৯০-২০০০ সময়কার মানচিত্রে এসব ছকের কয়েকটির আবির্ভাব লক্ষ্য করা যায়। এবং ২০১০ ও ২০১৫-এর মানচিত্রে এসে দেখা যায় মধ্য-কেরালায় ময়ূরের উপস্থিতি নির্দেশক বেগুনি ছকের এক বিপুল সম্ভার।

 

জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ

 

কেরালার ত্রিসুরে অবস্থিত কেরালা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কেএইউ) বন অনুষদে বন্যপ্রাণী বিষয়ক অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত পিও নামীরকে এই সবকিছুর একটা সমন্বয় – ই-বার্ডের পরিসংখ্যান, প্রকাশিত নিবন্ধসমূহ ও নিজস্ব পাখি-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার নথি – পিও নামীরকে বিষয়টি আরও গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে উদ্বুদ্ধ করে। 

 

তিনি বলেন, “আমি প্রায় পাঁচ দশক ধরে কেএইউ ক্যাম্পাসে বাস করছি এবং পাখি পর্যবেক্ষণ করে আসছি। কিন্তু কেবল অতি সম্প্রতিকালে আমরা এখানে হঠাৎ ময়ূরের দেখা পেতে শুরু করি। বর্তমানে এরাই এখন সংখ্যায় সবচে বেশী; তাদের অনেকেই এমনকি এখানেই বংশবিস্তার করছে।”

 

এটি নিঃসন্দেহে একটি অবাক করার মত বিষয়, কারণ ময়ূরেরা সাধারণত শুষ্ক ও অনুর্বর পরিবেশে বাসা বাঁধে। যদিও রাত্রিকালীন বিশ্রামের জন্য গাছের প্রয়োজন হয় তাদের, গ্রামাঞ্চলের অবারিত পর্ণমোচী ঝোপঝাড়েও বেশ স্বচ্ছন্দে বাস করে তারা। জঙ্গলের ধারও ময়ূরদের পছন্দের আবাসস্থলের তালিকায় রয়েছে। বার্ডস অফ দি ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট’য়ের মত পাখি পর্যবেক্ষকদের মাঠ নির্দেশিকাগুলো এও উল্লেখ করে যে, জনবসতি বা ফসলের ক্ষেতের কাছাকাছি বাস করার সময় ময়ূরদের মধ্যে বন্য ও আক্রমণাত্মক প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়।

 

এদিকে বিগত বছরগুলোতে কেরালার বৃষ্টিপাতের হার ক্রমশই কমছে। ২০১৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে কেরালার বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের বাৎসরিক ও মৌসুমী হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে। ২০১৬ সালের আরেকটি গবেষণায় ১৮৭১ ও ২০১২ সালের মাঝখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণের পরিবর্তন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, দক্ষিণ-পশ্চিমা বর্ষায় ঘটে যাওয়া “স্বল্পমেয়াদী খরার” জন্য দায়ী এই হ্রাসটিই দায়ী। এটা সম্ভব যে অন্যান্য মৌসুমে বাড়তে থাকা বৃষ্টির হার এই খরাগুলোর প্রখরতাকে সামাল দিয়েছে।

 

সুতরাং প্রশ্ন ওঠে – ক্রমবর্ধমান শুষ্কতা ও তার সাথে বাড়তে থাকা অনুর্বরতার মতন জলবায়ু সংক্রান্ত বিষয়ই কি কেরালার ময়ূর রহস্যের প্রধান কারণ? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নামীর এবং সানজো হোসে (বর্তমানে দেহরাদুনের বন গবেষণা ইন্সটিটিউটে কর্মরত) জলবায়ু মডেলিং নামক একটি পদ্ধতির দ্বারস্থ হলেন, যা নির্দিষ্ট জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্যগুলোর প্রবণতা বিশ্লেষণ করে এর একটি ভবিষ্যৎ রুপ অনুমান করে।

 

এ কাজের জন্য তারা প্রথমেই ই-বার্ড থেকে কেরালায় ১৯৭৯ ও ২০১৭ সালের মাঝে ময়ূরের উপস্থিতি বিষয়ে ১,৫৭৩টি নথি যোগাড় করেন। এরপর বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার মতন জৈব-জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্যগুলোর সাথে এসব নথি থেকে পাওয়া তথ্য মডেল ও এলগোরিদমে রূপান্তরিত করা হয়।  এর মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে, ২০৫০ ও ২০৭০-এর দশকে (ভিন্ন ভিন্ন জলবায়ু পরিস্থিতিতে), ময়ূর উপস্থিতির বিন্যাসের একটি অনুমান তৈরি হয়।

 

জলবায়ু পরিবর্তন ও ময়ূর পরিধি

 

ফলাফলগুলো এই বাস্তবতা উন্মোচন করে যে, বর্তমান জলবায়ু পরিস্থিতির অধীনে কেরালার কেবল ১৯ শতাংশ এলাকা – মধ্য-কেরালার ত্রিসুর, পালাক্কাড ও মালাপ্পুরাম, এবং উত্তর কেরালার কাসারগড় – ময়ূর বসবাসের উপযুক্ত। তবে আগামী দিনের জলবায়ু পরিবর্তনে বদলে যেতে পারে এই চিত্র। ২০৫০-এর দশকে প্রায় ৪১ থেকে ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি হতে পারে কেরালায় ময়ূরের সংখ্যা। আলাপ্পুজহা, এরনাকুলাম, কোট্টায়াম, আর কোঝিকোরে জেলাগুলাকে হিশাবের বাইরে রাখলে, মধ্যভূমি আর নিম্নভূমিগুলোতেই সম্ভবত এই পরিধি সম্প্রসারণটি ঘটবে। যা-হোক, জলবায়ু মডেলগুলো এমন বার্তাও দেয় যে, ২০৭০-এর দশকের মধ্যে ময়ূরের বিস্তারের এই হার অনেকটাই হ্রাস পাবে (২২ থেকে ৩২ শতাংশ)।

 

নামীর বলেন, “এর কারণ হচ্ছে মডেলগুলো অনুযায়ী, ২০৫০-এর দশকের সাথে তুলনায় ২০৭০-এর দশকে বৃষ্টিপাতের হার অনেকটাই বৃদ্ধি পাবে।” তিনি আরও যোগ করেন, এর ফলে যে আর্দ্র পরিবেশটির জন্ম হবে, সেটি তখন উল্টো ময়ূরদের জন্য অসুবিধাই সৃষ্টি করবে।

 

নামীর আর হোসের দলটি আরও দেখেছে যে, এই বন্টনবিষয়ক পরিবর্তনগুলোর অর্ধেকটা ব্যাখ্যা করে তাপমাত্রার মৌসুমিয়ানা (যে অঞ্চলগুলো শুষ্কতম মরসুমে গড় তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে দেখায়)। পরিবর্তনের বাকি অর্ধেক কারণ বৃষ্টিপাতের মাত্রা ( বছরে ১৫ সেন্টিমিটারের কম বৃষ্টি হওয়ার জায়গাগুলোতে ময়ূরের উপস্থিতি বেশি ছিল)।

 

নেচার কনজারভেশন ফাউন্ডেশনে কর্মরত বিজ্ঞানী সুহেল কাদের মন্তব্য করেন, “আমার ধারণা মডেলটির অনুমানগুলো খুবই সম্ভাব্য, যদি আমরা পূর্বের প্রবণতাগুলোর দিকে তাকাই। এমনকি দেশের অন্য অঞ্চলেও আমরা ময়ূরের সংখ্যাবৃদ্ধি ও সম্ভাব্য পরিসর সম্প্রসারণ খেয়াল করছি। এই প্রবণতাগুলো আসলে কিসের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, সেটি বুঝতে গবেষণা প্রয়োজন।”

 

বেশ কিছু গবেষণা অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নিম্নভূমির প্রাণীকুল প্রকৃতই উপকৃত হতে পারে। দেখা গেছে আবহাওয়ার এই বদলের সুবাদে তৈরি অনুকূল পরিবেশে প্রায়শই তাদের পরিধির প্রসার ঘটে থাকে।

 

কিন্তু কেরালার ময়ূরদের ক্ষেত্রে এই প্রভাবসমূহকে মোকাবিলা করার মত কি কিছু আছে?

 

নামীরের মতে, “কোনভাবেই আর কোন অবশিষ্ট প্রাকৃতিক আবাসস্থল হারানোর সুযোগ আমাদের নেই। সেটা বন হোক, জলাভূমি হোক অথবা তৃণভূমিই হোক। এখন আমাদের উচিত পুনরুদ্ধারকামী প্রতিবেশের মূলনীতিগুলোকে নির্ভুলভাবে অনুসরণ করে সময়ের সাথে গুণমান হারানো ভূমি পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া। একইসাথে প্রয়োজন প্যারিস চুক্তির নীতিমালা অনুযায়ী কার্বন নির্গমন নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে অনতিবিলম্বে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা।”

 

পরিশেষে নামীর বলেন, এই পূর্বাভাসগুলো যে কেবল ময়ূরের জনসংখ্যার আলাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় সেটা আমাদেরকে বুঝতে হবে। “কোন প্রজাতির উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতির রুপে হাজির হওয়া এই ঘটনাগুলো এক কথায় গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবাণী। যেহেতু আমরা ইতিমধ্যেই কেরালায় এর প্রাদুর্ভাব দেখতে পাচ্ছি, আমাদের উচিত অবশিষ্ট আবাসস্থলগুলোর সংরক্ষণের লক্ষ্যে এখনই সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করা।”

 

https://india.mongabay.com/2019/12/peafowl-kerala-symbol-of-climate-change/?fbclid=IwAR19vdiXSBLpuzYxefnHKT_iXCQWwyrwvao9-mCjaRnmrvb-eqPnpvQeybw

 

Your Comment