স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে সরব ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন
২০২৫-০৩-১১

সারাদেশে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, নির্যাতন, মোরাল পুলিশিং, সাইবার বুলিং ও নারীর প্রতি সকল ধরনের অসম্মানজনক আচরণ ও সহিসংতা প্রতিরোধে রাজপথে প্রতিবাদের কলরব শোনা যাচ্ছে। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ ও নানা প্রতিবাদমূলক কর্মসূচির মধ্য দিয়েই দেশে পালিত হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস- ২০২৫’। ৮ মার্চ শনিবার সন্ধ্যায় মশাল মিছিল ও মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের হল পাড়া থেকে নারী শিক্ষার্থীদের মিছিল ও স্লোগানে জেগে ছিল পুরো ক্যাম্পাস। এর আগে ৭ মার্চ, শুক্রবার জাতীয় সংসদ ভবনে প্রতিবাদী সমাবেশ ও মিছিল করেছেন নারীবাদী ও নারী অধিকার কর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেটওয়ার্কের উদ্যোগে ৯ মার্চ, রবিবার সারাদেশে পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর প্রতিবাদ সমাবেশ’ আয়োজিত হয়েছে। একইদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে পালিত হয়েছে ‘লাঠি মিছিল’। এসকল আন্দোলনে নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি সরব হয়ে উঠেছে।
জুলাই গণভ্যুত্থানের ৭ মাস। চোখ বুজলেই এখনো ভেসে উঠে উত্তাল শহীদ মিনার, সারাদেশের শিক্ষার্থী-জনতার সমাবেশ থেকে ভেসে আসা স্লোগান, কারফিউ ভেঙে গানের মিছিল, রাজপথে-অনলাইনে লাশের মিছিল, আকাশে-বাতাসে সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলির শব্দ, দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি। সবশেষ ৩৬ জুলাইয়ের বিজয় মিছিল। ৫ আগস্টের পর দেশে আইন শৃঙ্খলা সক্রিয় না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই দেশে নিরাপত্তাহীনতার পরিস্থিতি তৈরি হয়।
এর ধারাবাহিকতায় ঢাকার শ্যামলীতে যৌন পেশায় থাকা নারীদের ওপর হামলা, কক্সবাজারে হিজড়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, রাস্তাঘাটে বিভিন্ন জায়গায় যৌন হয়রানি, মব অ্যাটাক, রংপুর ও জয়পুরহাটে মেয়েদের ফুটবল খেলায় সংগঠিত বাধা, লালমাটিয়ায় দুই শিক্ষার্থীকে প্রকাশ্যে হামলা ও নির্যাতন, পাহাড়ে-সমতলে আদিবাসী নারীদের ওপর চলমান যৌন নিপীড়ন ও নিত্যদিনের হয়রানি স্পষ্টত দৃশ্যমান হয়ে উঠে। একইসাথে সারাদেশে নারী, শিশু-কিশোরীদের ওপর ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে থাকে এর মাঝে মাগুরার ৮ বছরের শিশুটি এখন জীবন-মৃত্যুর সাথে লড়ছে। এসকল নিপীড়নের শক্তিশালী অভিযোগ, তথ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সরকারের পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতা ও উদাসীনতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, নারী অধিকার ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্দোলনকারীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে জীবন বাজি রেখে এদেশের মানুষ ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অথচ ৫ আগস্টের পরে গণঅভ্যুত্থানে নারীর অবদানকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা করা হয়েছে। একইসাথে সারাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বেড়েছে এবং অপরাধীদের বিচারে রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা দেখা গেছে। যা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও অগ্রহণযোগ্য। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ নির্মাণে পেছনের দিকে হাঁটছে দেশ।
আন্দোলনকারীরা নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন নারীর প্রতি সকল যৌন হয়রানিমূলক, অসম্মানজনক আচরণকে রাষ্ট্র যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে আমলে না নেয়ার কারণেই তা প্রতিনিয়ত বেড়েছে এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। তাদের মতে নারীর প্রতি হয়রানির ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বরং এগুলো নারীদের বিরুদ্ধে একটি সুপরিকল্পিত সহিংসতা ও ভয় দেখানোর সংস্কৃতি তৈরির অংশ হিসেবেই ঘটানো হয়েছে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আরও জানান অথচ নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে পুলিশ বাধা দেয়। গত ২৪ ফেব্রুয়ারির প্রতিবাদের ঘটনা উল্লেখ করে তারা বলেন ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কার্যালয়ের দিকে পদযাত্রায় সক্রিয়ভাবে বাধা দেয় পুলিশ। এদিকে গত ৬ মার্চ ঢাবি শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানি করা মামলার আসামি ঢাবি গ্রন্থাগারের কর্মচারী মোস্তফা আসিফ অর্ণবকে বীরের বেশে বরণ করেছেন ধর্মের নামে নারীবিদ্বেষী একটি দল। মব যখন হ্যারাসারকে ছাড়িয়ে নিতে যায় তখন পুলিশ ঠেকাতে পারে না। এমনকি ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত তথ্য পর্যন্ত থানা থেকে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
উল্লেখিত এই ঘটনা ইতিহাসের একটি নির্লজ্জতম অধ্যায় হয়ে থাকবে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। একইসাথে যৌন নিপীড়ক আসিফকে চাকরীতে পুনর্বহাল করা হলে একযোগে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণাও দিয়েছেন বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী এসকল সমাবেশে প্রতিবাদী ও সৃজনশীল নানা প্ল্যাকার্ড লক্ষ্যণীয়। প্রতিবাদী সমাবেশগুলোর প্ল্যাকার্ডে দেখা যায় ‘অবিলম্বে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে হবে’, ‘নিরাপত্তা দে, নইলে গদি ছাইড়া দে’, ‘বসুন্ধরা গ্রুপের ধর্ষক আনভীর কোথায়’, ‘আমার মাটি আমার মা, ধর্ষকদের হবে না’, ‘নারীর যৌন স্বাধীনতা নিশ্চিত কর’, ‘স্যানিটারি প্যাড কোনো গোপন পণ্য নয়’, ‘আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তা কোথায়’, ‘আটককৃত নিরাপরাধ বম নারী-শিশুদের মুক্তি দিতে হবে’, ‘ধর্ষকদের আল্লাহ মাফ করবেন না’, ‘মুমিনদের বলুন তারা যেন দৃষ্টি নত রাখে’, ‘বৈবাহিক ধর্ষণের বিচার কই’, ‘বিচার কর, করতে হবে’, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি, নিপীড়কের রাজনীতি’ সহ অসংখ্য প্ল্যাকার্ড। নানা রঙের প্ল্যাকার্ডের ভাষাই হয়ে উঠছে সরব কন্ঠ আর স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে উঠেছে নারী নির্যাতনবিরোধী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ।
আন্দোলনকারীদের দাবি
নারীবিদ্বেষী সাম্পতিক ঘটনাগুলোতে শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার নারী অধিকারকর্মীদের আন্দোলনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে অনেক দাবি উঠে এসেছে। তবে প্রায় সকল প্রতিবাদী সমাবেশের লক্ষ্য এক থাকায় যেন সারাদেশের নারীরা সম্মিলিত কন্ঠস্বর হয়ে উঠেছে। প্রায় সকল প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশের উল্লেখযোগ্য দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে-
১। জননিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে দায়স্বীকারপূর্বক পদত্যাগ করতে হবে।
২। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এ ধর্ষণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে, ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির লিঙ্গ, যৌনতা, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, জাতীয়তা, প্রতিবন্ধিতা ও বয়স নির্বিশেষে সকলের ন্যয়বিচারের অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। সম্মতি ছাড়া যেকোনো ধরনের স্পর্শকে যৌন নিপীড়ন ও বিবাহিত-অবিবাহিত নির্বিশেষে সম্মতি ছাড়া পেনিট্রেশনকে ধর্ষণ বলে চিহ্নিত করতে হবে। ভিকটিম ও সাক্ষীকে সকল প্রকার সুরক্ষা প্রদানের জন্য সাক্ষ্য আইনে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে।
৩। অবিলম্বে পাহাড়, সমতলসহ সারাদেশে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও নিপীড়নের সকল ঘটনার বিচার করা এবং প্রয়োজনে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
৪। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থানে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সমন্বয়ে স্বাধীন যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল কার্যকর করা এবং প্রয়োজনে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৫। ধর্ষণের মামলা নেয়া নিয়ে যে থানাগত জটিলতা ও হয়রানি বিদ্যমান তা দূর করতে হবে। বিশেষ আইন অথবা বিশেষ সেলের অধিকারবলে ধর্ষণের অভিযোগ যেকোনো থানা দ্রুত গ্রহণ করবে এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
৬। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের হেনস্তা, স্লাটশেমিং এবং বরখাস্তের ঘটনা পূর্ণ তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
৭। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত লিঙ্গ সংবেদনশীলতার চর্চা, লিঙ্গ সহিংসতা বিরোধী পাঠ পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
৮। বিচারিক ও আইনি প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে লিঙ্গ সংবেদনশীলতার প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
নারী নির্যাতন বিরোধী প্রায় সকল সমাবেশ থেকেই উপরোল্লিখিত দাবিগুলো উঠে এসেছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মতে নিপীড়ন-নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার অত্যতম কারণ হচ্ছে বিগত ঘটনাগুলোতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অদক্ষতা ও স্বদিচ্ছার অভাব।
নারী অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সক্রিয় নারীবাদীরা বলেন, নারীদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক হামলার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে অপরাধীদের আইনের আওতায় না এনে উল্টো সরকারের দায়সারা প্রতিক্রিয়া পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য। ভুল তথ্য, আইন ও বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য অপরাধীদের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লাঠি মিছিল থেকে নারী শিক্ষার্থীরা বলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যখন দায়িত্ব পালন করছেন না তখন আমরা আমাদের অস্তিত্বের জানান দিতেই লাঠি হাতে এখানে এসেছি। নিরাপত্তা বাহিনী যদি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে আমাদের রাজপথে থাকা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।